arijit bhattacharya

Inspirational

3  

arijit bhattacharya

Inspirational

বহ্নিশিখা

বহ্নিশিখা

5 mins
958


প্লিজ বিলিভ মি মম,রক্তিমের সাথে সম্পর্ক রাখা আমার পক্ষে জাস্ট অসম্ভব। হি ইজ জাস্ট ইনটলারেবল।ওর ইগো আর গোঁয়ার্তুমি আমি আর নিতে পারছি না। "চেঁচিয়ে উঠল সুস্মিতা। কিন্তু মেয়ের কথায় কোনো কানই দিলেন না স্বপ্নাদেবী। তিনি ভালো করেই জানেন রক্তিম পরের মাসে ইউ কে যাবে ,সেখানে গিয়ে তার কেরিয়ার সেটল করার প্ল্যান আছে। সাউথ কোলকাতার গড়িয়ার হাই সোসাইটির বাসিন্দা ইংলিশে এম.এ পাশ করা তার মেয়ের জন্য একমাত্র রক্তিমই উপযুক্ত। রক্তিমের মতো নিজের কেরিয়ার নিয়ে সিরিয়াস আর ক্রিয়েটিভ খুব কম ছেলেই আছে। স্বপ্নাদেবী ও তাঁর স্বামী প্রশান্তবাবুর চোখে রক্তিম সত্যিই হীরের টুকরো। আর সবচেয়ে বড়ো কথা,রক্তিম তাদের প্রতিবেশী। ছোটবেলা থেকেই সুস্মিতা আর রক্তিম একই সাথে বড়ো হয়েছে,একে অপরকে চিনেছে,একে অপরকে বুঝেছে। মেয়ে তো একটা সময় বলতে গেলে কিশোরী বয়সে রক্তিমের প্রেমে পাগল ছিল। বলতে গেলে রক্তিম বলতে অজ্ঞান। মেয়ে যখন ক্লাস টেনে পড়ে,তখনই স্বপ্নাদেবী জানতে পারেন যে তাঁর মেয়ে ও রক্তিমের মধ্যে প্রেমের সম্পর্ক বিদ্যমান রয়েছে। কিন্তু,যেহেতু রক্তিম ছেলেটা পড়াশুনাতে খুবই ভালো ,বরাবরই ক্লাসের মধ্যে ফার্স্ট-সেকেণ্ড হয় এবং সেই সাথে সঙ্গীতেও অনুরাগী,তাই স্বপ্নাদেবী এবং প্রশান্তবাবুর মনে হয়েছিল রক্তিমের সাথে মিশলে তাঁদের মেয়ের ভালোই হবে।তাই তাঁরা সম্পর্কটার ক্ষেত্রে আপত্তি করেন নি।কিন্তু ,এখন স্বপ্নাদেবী বুঝতে পারছেন না হঠাৎই রক্তিমকে কেন তাদের মেয়ের এত খারাপ লাগতে শুরু করেছে।


নিজের বেডরুমে ঢুকে কান্নায় ভেঙে পড়ল সুস্মিতা। আজ তার সামনে রক্তিমের মুখোশ খুলে গেছে। বলতে গেলে,ছেলেটা নিজের কেরিয়ার নিয়ে প্রচণ্ড সিরিয়াস ঠিক আছে, কিন্তু অত্যন্ত সেলফিশ আর ইগোইস্টিক। শুধু নিজের ভালো চাই। নিজের ভালো ছাড়া কিছুই বোঝে না। আর শুধু ভালো এডুকেশনাল কেরিয়ার থাকলেই সব হয়ে যায় নাকি! চার্টার্ড অ্যাকাউন্ট্যান্ট ইন্দ্রনারায়ণ রায়ের জ্যেষ্ঠ পুত্র রক্তিম রায়ের মধ্যে না আছে অন্যের প্রতি সহমর্মিতা,না আছে দায়িত্ববোধ ,না আছে কথা দিয়ে কথা রাখা। না আছে কারোর ফিলিং আর ইমোশনের কেয়ার নেওয়া। শুধু নিজের স্ট্যাটাস আর কেরিয়ার!এরকম লোককে কি ভালো লোক বলা  

যায়! অথচ সবার মুখে একটাই কথা রক্তিমের মতো ভালো ছেলে আর হয় না।কান্নায় ভেঙে পড়তে পড়তে সুস্মিতার মনে হয় রক্তিমের কাছে কি সত্যিই তার আবেগ-অনুভূতির কোনো মূল্য নেই। আজ রক্তিম বলছিল বিকালে আইনক্সে সিনেমা দেখতে যাবার কথা,কিন্তু সুস্মিতা বলছিল তার গান শিখতে যাবার কথা। বরাবরই সে ক্ল্যাসিক্যাল মিউজিকের ব্যাপারে খুব খুব খুব প্যাশনেট।    তাই আজকে না হয়ে অন্য কোনো দিন সে রক্তিমের সাথে সিনেমা দেখতে যেতে পারে। এটা শুনে তাকে যাচ্ছেতাই শোনাল রক্তিম। রক্তিমের কথায় সে আই আই এস সি ব্যাঙ্গালোর থেকে পাশ করা ছেলে, এখন কয়েকদিন পরেই সে কেমব্রিজে পড়তে যাবে। সুস্মিতার মতো একজন রাস্তার মেয়ের পক্ষে রক্তিমের মতো একজন সফল ছেলের এক মুহূর্তও সময় হবে না। ভাবে কি রক্তিম নিজেকে! সুস্মিতাও লেডি ব্র্যাবোর্ন কলেজ থেকে ইংলিশে এম.এ করা ছাত্রী। সম্প্রতি নেট এ বসার প্রস্তুতি নিচ্ছে। তার নিজের আত্মসম্মান নেই!রক্তিম 'হীরের টুকরো' বলেই তাকে যাচ্ছেতাই অপমান করবে সবার সামনে এমনকি নিজেদের বন্ধু ও আত্মীয়দের সামনে এটা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া যায় না।


সুস্মিতা আগে জানত রক্তিমের মতো ভালো ছেলে হয় না। আজ মনে পড়ে এক বৃহস্পতিবারের কথা! বহুদিন পরে কোলকাতায় ফিরেছিল রক্তিম। সেইদিনে ছিল রক্তিমের সাথে সুস্মিতার ডেট। সেদিনই জানতে পারে বেঙ্গালুরু নিবাসিনী রক্তিমের এক বিশেষ বান্ধবীর কথা,যার সাথে রক্তিমের অন্তরঙ্গতা আছে।এমনকি এর আগে শারীরিক সম্পর্কও হয়েছে কয়েকবার।তার রক্তিম আর ভার্জিন নয়! এই তথ্য সুস্মিতার জীবনে ছিল বিনা মেঘে বজ্রপাত।রক্তিমের কাছে এসব তো কিছুই নয়। যাই হোক,তারপরও সে রক্তিমের সাথে সম্পর্কে 'না' করে নি। তার কারণ তার পরিবার ,তার আত্মীয়স্বজন সবাই রক্তিম রায়কে খুবই পছন্দ করে। সবাই রক্তিম রায়কেই তার বয়ফ্রেন্ড হিসাবে দেখতে চায়!


সবচেয়ে বড়ো ব্যাপার হল রক্তিমের মধ্যে কোনো দায়িত্বজ্ঞান নেই। কিছুমাস আগেই কাকিমা অর্থাৎ রক্তিমের মা হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। রক্তিম তখন বাড়িতেই । অবাক হবার মতো ব্যাপার হল রক্তিমকে একদিনও হাসপাতালে যেতে দেখেনি সে, বা মায়ের জন্য চিন্তিতও হতে দেখেনি। বরং একদিন জিজ্ঞাসা করায় রক্তিম সাফ মুখের ওপর জানিয়ে দিয়েছিল,"মাই মম ইজ ইল। সো হোয়াট ক্যান আই ডু! আই অ্যাম নট এ ডক্টর ,সো আই ক্যাননট কিউর হার।" সুস্মিতাও বলেছিল,"বাট ইউ ক্যান প্রে!প্রেয়ার রিয়েলি ওয়ার্কস।।"

একটু হেসে বলেছিল রক্তিম,"ওনলি প্রে অ্যাণ্ড ডুয়িং নাথিং ইজ এ ননসেন্স। ওনলি এ ফুল উইল ডু দিস।" চমকে উঠেছিল সুস্মিতা। এর মধ্যে কি আবেগ-অনুভূতি কিছুই নেই। পুরোই একটা যন্ত্র!


তার মেসো অরুণ গাঙ্গুলীর চোখে তো রক্তিমের থেকে ভালো কোনো ছেলে হতেই পারে না। রক্তিমই তার যোগ্যতম। এমতাবস্থায় কি করবে বুঝতে পারে না সুস্মিতা। তার বন্ধুরা তো অনেকেই বলে নিজের মনের কথা শুনবে না তার আত্মীয় পরিজনরা যা চায় সেইটাকেই নিজের ভবিতব্য বলে মেনে নেবে! এই চক্রব্যূহে পড়ে হাঁসফাস করে সে।


রক্তিমের সাথে তার সম্পর্ক বহুবার জুড়েছে,বহুবার ভেঙেছে। যে সম্পর্কের সাথে হৃদয়ের কোনো যোগ থাকে না, যে সম্পর্কে মিলনের মধ্যে হৃদয়ের জলতরঙ্গ বেজে ওঠে না,যে সম্পর্কে আঁখিতে আঁখিতে মিলনে শরীরে শিহরণ জাগে না,সেই সম্পর্ক টেনে নেওয়া যেতে পারে কোনোওভাবে মাত্র,কিন্তু তা দীর্ঘস্থায়ী হয় না। যে সম্পর্কে থাকে প্রাণের যোগ,হৃদয়ের টান একমাত্র সেই সম্পর্কই দীর্ঘস্থায়ী হয়। সম্পর্ককে অটুট হতে গেলে যে আবেগের মেলবন্ধন থাকা দরকার, যে অনুভূতির স্বতঃস্ফূর্ততা প্রয়োজন,সেই জিনিস রক্তিম আর সুস্মিতার সম্পর্কের মধ্যে পুরোটাই অনুপস্থিত।আর যে সম্পর্কে প্রকৃত মনের মিলন হয় না,সেই সম্পর্কের পরিণতিও আশাজনক নয়,বরং আশঙ্কাজনক।


দুবছর আগে সুস্মিতা এক মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির চাকরি পেয়ে চেন্নাই গিয়েছিল।তখন রক্তিমের সাথে তার সম্পর্ক সবেমাত্র ভেঙেছে,আর তার কারণ সুস্মিতার চোখে ধরা পড়েছে রক্তিমের আবেগশূন্যতা,তার জীবনের যান্ত্রিকতা। হয়তো কেরিয়ার ঠিকঠাক চলছে,কিন্তু মানসিকভাবে প্রচণ্ড ভেঙে পড়েছে সে। এই অবস্থায় তার জীবনে প্রবেশ করে ঋতুরাজ,আঠাশ বছরের একজন প্রাণবন্ত ওড়িয়া তরুণ। সম্পূর্ণ ভাবে রক্তিমের বিপরীত। সুস্মিতার জীবনের মরুভূমির মধ্যে ঋতুরাজের আগমন ছিল মরূদ্যানের ন্যায়। এভাবে নিজের অজান্তেই যে কখন ঋতুরাজকে ভালোবেসে ফেলেছে তা বুঝতেই পারে নি সুস্মিতা।

ঋতুরাজের আঁখির সাথে তার আঁখির যখন মিলন হতো তখন হৃদয়ে বেজে উঠত কোনো এক অজানা সঙ্গীত,ঋতুরাজের পরশে তার জীবনে নেমে এসেছিল এক অকাল বসন্ত।

ঋতুরাজের যে জিনিসটা তাকে মুগ্ধ করতো বরাবর তা হল ঋতুরাজের কাজের প্রতি ডেডিকেশন,তার ডিটারমিনেশন,অন্যের অনুভূতিকে গুরুত্ব দেওয়া,সবার সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যবহার করে মিলেমিশে কাজ করার প্রবণতা।ধীরে ধীরে ঋতুরাজ মোহান্তির সাথে বন্ধুত্ব পরিণত হয় ভালোবাসায়,এক গভীর আবেগমথিত ভালোবাসা। তার জীবনে ঋতুরাজের সাথে বন্ধুত্ব   ছিল এক ঝলক মুক্ত হাওয়া।


কিন্তু প্রেমের স্বর্গে বেশিদিন ভাসা হল না সুস্মিতার।একদিন তার সামনে অফিসের পার্টিতে ধরা পড়ে ঋতুরাজের মদ্যপ রূপ। এ যেন ডক্টর জেকিল আর মিস্টার হাইড! একই মানুষের দুই ভিন্ন সত্ত্বা। সম্পূর্ণ পৃথক। মুখে গালাগালির ফুলঝুরি,সম্পূর্ণ অপ্রকৃতিস্থ এক মাতাল। সুস্মিতার দিকে এগিয়ে এসে অশ্লীল অঙ্গভঙ্গি করে বুকে হাত দিতেই আর নিজেকে সামলাতে পারে না সুস্মিতার। সবার সামনেই চড় মারে  

ঋতুরাজকে।সেই রাত কান্নায় সে ভিজিয়েছিল বালিশ। পুরুষরা কি সবাই এইরকম!সবাই একইরকম কি স্বার্থপর,সবাই কি একইরকম অসৎ,সবাই কি একইরকম মুখোশধারী!


মন ভেঙে যায় সুস্মিতার। ক্ষমা চায় রক্তিমের কাছে যদিও সম্পর্ক ভাঙার জন্য মূল দায়ী ছিল রক্তিমই । আবার শুরু হয় 'ফলস শো অব লাভ।'রক্তিম আর সুস্মিতাকে বাড়ি বা পাড়ার কোনো অনুষ্ঠানে একসঙ্গে দেখে বাহবা দিয়ে ওঠে আত্মীয় পরিজনেরা ,কিন্তু সুস্মিতার বুকের ভিতরটা হাহাকার করে ওঠে,হাঁসফাঁস করতে থাকে সে এই সম্পর্কের জাঁতাকলে।


না,এবার ঠিক করেছে সুস্মিতা। আত্মীয় -পরিজনের সামনে তাদের খুশি করার জন্য ভালোবাসার এই মিথ্যা প্রদর্শন আর নয়, সমাজকে খুশি করা অনেক হয়েছে। রক্তিম,পরিবার আর সমাজকে বুঝিয়ে দেবার সময় চলে এসেছে যে,তার মতো মেয়েরও মূল্য রয়েছে। সেও ক্ষমতা রাখে  স্বপ্রতিষ্ঠিত ও সুপ্রতিষ্ঠিতরূপে সমাজে নিজেকে প্রমাণ করার। পারবে কি সে এই অন্ধকার কৃত্রিমতা আর দেখনদারিতে পরিপূর্ণ সমাজের বুকে বহ্নিশিখার মতো জ্বলে উঠতে। মাঝে মাঝে দ্বিধাবোধ হয় তার। কিন্তু,তাকে যে আলোকোজ্জ্বল বহ্নিশিখা হয়ে উঠতেই হবে। এটা খুবই জরুরি-তার নিজের জন্য আর সমাজের জন্যও!


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational