ভাত কাপড়
ভাত কাপড়
"দিলি তো ভেঙে? কি হবে এখন? ইস্, একেবারে চুরমার হয়ে ভাঙলো। এটাকি আর জোড়া দেওয়া যাবে? এই একটাই মাত্র জিনিস ছিলো আমার একদম নিজের বলতে!" কথাগুলো বলতেবলতেই গাল বেয়ে কয়েকফোঁটা জল গড়িয়ে এলো চোখের কোল থেকে। আঁচলটা টেনে নিয়ে তাড়াতাড়ি চোখের জলটা মুছে নিলেও দিপালীর ছেলেরবৌ তিতলির চোখ কিন্তু এড়ায়নি সেই অশ্রুধারা।
তিতলি ভারী অবাক হলো। সামান্য একটা কাঁচের স্বচ্ছ কাপ ভেঙে গেলো বলে তার প্রবল পরাক্রমী, রাশভারী, মুখরা শাশুড়ি কাঁদছেন। কী সাংঘাতিক কাণ্ড, ভাবা যায়? কোনো কথা না বলে তিতলি চুপচাপ নিজের ঘরে চলে গেলো। আর সর্বক্ষণের কাজের মেয়ে বীণা ভয়ে একেবারে জড়সড় হয়ে গেছে। তার হাত থেকেইতো সকালের চায়ের-বাসন ধোবার সময় সাবান মাখানো কাপটা ছিটকে পড়ে গেছে। পড়ে গিয়ে ভেঙেও গেছে চুরমার হয়ে। আজ বীণার কপালে ঠিক কতদূর কতখানি দুঃখ আছে তা একমাত্র গিন্নীমাই জানেন। হয়তো দিনভর বাক্যবাণে এফোঁড়-ওফোঁড় করবেন, কে জানে?
বেলা গড়িয়ে যায় প্রায়। দিপালী নিজের ঘরের সাবেকি পালঙ্কের ওপরে পাশ ফিরে দেওয়ালের দিকে মুখ করে শুয়ে আছেন। তিতলি দু-একবার উঁকি দিয়ে দেখে গেছে বটে, তবে শাশুড়ির মুহুর্মুহু ফোঁসফোঁস দীর্ঘশ্বাস শুনে আর সাহসে কুলোয়নি সাংসারিক কথাবার্তা কিছু জিজ্ঞেস করতে। যদিও আজ প্রায় দশবছরের ওপর তিতলি এবাড়িতে বৌ হয়ে এসেছে, তথাপি এখনো শাশুড়ির হিসেবে তার নাক টিপলে দুধ বেরোবে এখনো... সংসারের প্যাঁচ-পয়জার সেকি বোঝে? তিতলি আর ঝুঁকি বাড়াতে চায়নি। এতোদিনে তার অভীষ্টলাভের দিন এসে হাজির হয়েছে নিজে হেঁটেহেঁটে... এই সুবর্ণসুযোগ গিন্নিপনা করার, তিতলি মোটেই হারাতে চায়না। নিজের মনের মতো বাজার করালো বীণাকে দিয়ে। তিতলির সাংবাদিক বর অবশ্য এই সংসারধর্মের অনেক ঊর্দ্ধ দিয়ে যায়। সে মানুষকে খাবার সময় ডেকে খেতে দিলে খায়, নইলে হোটেলে যায় খেতে। সুতরাং তাকে সংসারের এমন তুচ্ছাতিতুচ্ছ বিষয় নিয়ে তিতলি মোটেই বিরক্ত করলোনা। সে নীচেরঘরে তার বইপত্রের ডাঁই কম্পিউটার ল্যাপটপের গুহায় দিব্য আছে। রান্নাবান্না হলে খাবারসময় হলে ডাক পড়বে তার। আর সেও নাড়ুগোপালের মতোই এসে স্নানটি করে এসে খেতে বসবে। মায়ের গোপাল অতি সুবোধ বালকই বটে। নিজের কাজের বাইরে আর কোনো বিষয়ে তার কোনো কৌতূহল নেই। এটা অবশ্য একদিকে তিতলির পক্ষে খুবই ভালো, কোনো চাপ নেই, আবার একদিকে বড্ডই খারাপ! এমন লোকের সঙ্গে একটু যে ঝগড়া করবে বা জমিয়ে পিএনপিসি করবে, কি খানিকটা কান-ভাঙচানি দেবে তারও উপায় নেই।
তা দিপালীর এহেন গোপাল পুত্রও আজ খেতে বসে এদিকওদিক চেয়ে বলে ফেলে, "সকাল থেকে মাকে দেখছি নাতো! মা খাবেনা?" "ওবাবা, যতটা ভোলেভালা ভাব দেখায়, ততটা নয়তো! মায়ের খোঁজ দিব্যি আছে!" তিতলি মনেমনে ভাবলেও মুখে বলে মায়ের শরীরটা একটু খারাপ, সকাল থেকে শুয়েই আছেন, চা খাওয়ার পর থেকে।" "হুম", বলে গোপাল ভাতের মাঝখানটায় গোল গর্ত করে বাটি থেকে ডাল ঢালতেঢালতে বলে, "ওষুধ-বিষুধ খেয়েছে? তা, রাঁধলো কে? বীণা?" "মরণদশা", বিড়বিড় করে তিতলি... "দশবছর হয়ে গেছে বিয়ে, অথচ বৌয়ের রান্নার স্বাদ চেনেনা মায়ের গোপাল!"
তবে মুখে তিতলি বলে, "প্রথম-উত্তর - জানিনা, আর দ্বিতীয়-উত্তর - আমি।" বলেই আর দাঁড়ায়না তিতলি। আজ বলে কত খেটেখুটে ইউটিউব থেকে দেখে এই প্রথমবারের মতো শাশুড়ির খবরদারি ছাড়াই নিজের মনে নিজে পুরোটা রান্না করেছে... বরের কোনো হেলদোল নেই! রান্না খেয়ে মনেহলো বীণার রান্না! অবশ্য তাকেইবা দোষ দেয় কিকরে? চা, কফি, বড়জোর ঘোল, রায়তা কি রুটি, এর উপরে শাশুড়ি দশবছরে তাকে উঠতেই দেননি। দুবেলা রান্নাবাড়া পুরোটা নিজের হাতে। শক্তপোক্ত মানুষ, নিজের ইচ্ছায় করছেন... তাতে তিতলির কি? বরং গায়ে হাওয়া লাগিয়ে বেড়ানোর রোজকার সুযোগ কেউ ছাড়ে? তিতলিও ছ
াড়েনি। তবে কিনা ফেসবুক কিম্বা রান্নার রিয়েলিটি শোগুলো দেখলেই বুকটা তিতলির হুহু করে উঠতো। তাও আমল দিয়ে তেমন গায়ে মাখেনি তিতলি। "কিন্তু তাইবলে শাহী-ডাল খেয়ে বর বুঝবেনা যে ওরান্না বীণার হাতের হতেই পারেনা। যাকগে, তুমি আবার কাল থেকে তোমার মায়ের হাতের রান্নাই খেও বাপু। আশাকরি কালকের মধ্যেই উনি ওনার ঐএকমাত্র সম্পত্তি কাঁচের-কাপের শোকটা কাটিয়ে উঠতে পারবেন", ভাবতেভাবতে তিতলি শাশুড়ির ঘরে উঁকি মারলো।
এখনো দিপালী শুয়েই আছেন। তিতলি আস্তেআস্তে ডাকলো, "মা, ওমা, খাবেন আসুন। অনেকটা বেলা হয়েছে।" দিপালী তিতলির ডাকে উঠে বসলেন। সাদা ইঞ্চিপাড় শাড়ির আঁচলটা কাঁধে ফেলে ধীরেধীরে মেঝেতে পা রাখলেন, "গোপাল খেয়েছে? তোমরা খেয়ে নাও... আমার আজ আর তেমন ক্ষিদে নেই মা। মাথাটাও বড় টিপটিপ করছে।" একবেলায় দিপালীর বয়স যেন বিশবছর বেড়ে গেছে। ঝড়েভাঙা বিধ্বস্ত গাছের মতো দেখাচ্ছে ওনাকে। তিতলির এতোক্ষণের বিতৃষ্ণাটা একটু থমকালো। এগিয়ে এলো শাশুড়ির কাছে, "মা, এতো দুঃখ করছেন কেন? আমি ঠিক হাতিবাগান বা ধর্মতলা ঘুরে খুঁজেখুঁজে ঠিক ঐরকম স্বচ্ছ কাঁচের-কাপ এনে দেবো আপনাকে।" দিপালী আবার ফুঁপিয়ে উঠে তিতলিকে জড়িয়ে ধরলেন যেন পরম ভরসায়। তিতলি হতভম্ব... কিছুতেই বুঝতে পারছেনা যে একটা সামান্য কাঁচের-কাপের শোক কি এতটাও হতে পারে?
দিপালী নিজেকে একটু সামলে গুছিয়ে বললেন, "ঐরকম দেখতে কাপ হয়তো আনতে পারো, কিন্তু তাতেকি ওনার হাতের স্পর্শ লেগে থাকবে বৌমা? যখন বিয়ে হয় তখনতো ওনার তেমন রোজগার ছিলোনা, তায় আমার বাপেরবাড়ির অমতে বিয়ে। জাতে মেলেনি। উনি জেদ করে বিয়ে করে নিলেন। ওনার বাড়ির কারুরও তেমন মত ছিলোনা এই বিয়েতে। নমোনমো করে শাশুড়ি ট্রাঙ্ক থেকে নিজের একখানা শাড়ি আর থালায় পাঁচরকমের ভাজা আর ডালভাত দিয়ে সাজিয়ে ওনাকে দিয়ে ভাতকাপড় দেওয়ালেন। নিয়ম ওটা। শাশুড়ির হাত খালি, নিজের বাঁহাত থেকে একগাছি সরুচুড়ি খুলে পরিয়ে দিলেন। উনি চুপচাপ দেখলেন। তারপর বললেন অর্ধবেকার ছেলেকে বিয়ে করেছো। কিছু হ্যাপাতো থাকবেই। তারপর নিজের খাদির পাঞ্জাবির পকেটে হাত ঢুকিয়ে খবরের কাগজের মোড়কে মোড়া কাপটা বার করলেন। বললেন অনেক খুঁজে দরদস্তুর করে কিনেছি তোমাকে উপহার দেবো বলে। তোমার পছন্দ নাহলেও আমি নাচার... তবে হ্যাঁ, আমি আজ
থেকে আমৃত্যু তোমার ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নিলাম।" বলতেবলতে কোথায় যেন হারিয়ে গিয়েছিলেন দিপালী। তিতলি মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিলো। সাদা শাড়ির আঁচলে চশমার কাঁচ মুছে নিয়ে আবার শুরু করলেন দিপালী, মুখে যেন তার নববধূর দীপ্তি উজ্জ্বল, "ওনার মুখেরতো কোনো রাখঢাক ছিলোনা। শাশুড়ির সামনেই হাসতেহাসতে বললেন, এই কাপে আমি চুমু ভর্তি করে দিয়েছি। যতবার তুমি যত চুমুক চা খাবে এতে সেটা আমার চুমুর বিনিময় হয়ে এসে সোজা আমার এই ঠোঁটে পড়বে, বুঝলে? ওনার কথা শুনে শাশুড়ি লজ্জা পেয়ে অন্যদিকে মুখ ফেরালেন। তারপর সংসার শুরু হলো, প্রথমমাসটা কাটতেনা কাটতেই দ্বিতীয়মাসে আমার কপাল পুড়লো। উনি চলে গেলেন চিরকালের মতো আমাকে একলা করে দিয়ে। সেইদিনই জানতে পারলাম আমার শরীরে গোপাল... গোপাল আসছে। শোক করার সময় রইলোনা। পাশে কাউকে পেলামনা। একলা-একলাই পথচলা শুরু হলো... চল্লিশটা বছর ধরে। তবে উনি কথা রেখেছিলেন জানো বৌমা। দুবেলা ওনার ঠোঁটের ছোঁয়া যে পেতাম ঐকাপের চায়ের প্রতি চুমুকেচুমুকে। আজ থেকে ওনার স্পর্শটাও যে ছেড়ে গেলো...!" সদ্যকিশোরীর মতো দিপালী ফুঁপিয়েফুঁপিয়ে কাঁদছেন তিতলির বুকে মাথা রেখে।
তিতলির চোখও শুকনো নেই। তিতলির চোখের জলে আজ ধুয়ে যাচ্ছে শাশুড়ির ওপরে জমেথাকা দশবছরের দ্বেষ, বিদ্বেষ, ক্ষোভ, দুঃখ, অভিমান সব। এখন আর শাশুড়ি বৌমা সম্পর্কে নয়... এক নারী অনুভব করছে অন্য এক নারীর অসহায়, অবরুদ্ধ, অবদমিত প্রেম।