STORYMIRROR

SHUBHAMOY MONDAL

Drama Tragedy Thriller

3  

SHUBHAMOY MONDAL

Drama Tragedy Thriller

ভাঙা চেয়ারটা

ভাঙা চেয়ারটা

10 mins
172


- স্যার, বাড়িটার জন্য প্রোমোটার ২৩ তারিখ এগ্রিমেন্টের দিন ঠিক করেছে। আপনাদের চেকগুলোও সেদিনই পেয়ে যাবেন। আমাকে জিজ্ঞাসা করতে বলল যে, কবে ফিরছেন আপনারা আর টিকেট বুকিং করে দিতে হবে কিনা?...


- ম্যাডাম, বাড়িটার জন্য প্রোমোটার এ'মাসের ২৩ তারিখ এগ্রিমেন্টের দিন ঠিক করেছে। আপনাদের চেকগুলোও সেদিনই পেয়ে যাবেন। আমাকে জিজ্ঞাসা করতে বলেছে যে, কবে আসছেন আপনারা আর টিকেট বুকিং...


মোবাইলটা পকেটে ঢোকাতে ঢোকাতে বিশু মুচকি হেসে প্রোমোটার মনিরুলকে বললো - দু'দিন আগেই এখানে সবাই এসে হাজির হয়ে যাবে, কাকা! কে বলে সম্পত্তির টান মানুষের থেকে কম, হে হে হে...


প্রোমোটারের অফিস থেকে সব কথাবার্তা সেরে বেরিয়ে এসে, বড় রাস্তার দিকে পা বাড়ালো বিশু। পকেট থেকে মোবাইলটা বের করে দেখলো প্রায় একটা বাজে এখন। তাকে আজ দক্ষিণেশ্বরে যেতে হবে, পুজো দিতে। অনেক দিন আগে থেকেই ভেবে রেখেছে যে, এই ডিল-টা পাকা হলেই মা ভবতারিণীর কাছে গিয়ে পুজো দেবে সে। আজ তার মনে হচ্ছে এই ডিলটা প্রায় পাকা হয়েই গেল, তাই...


এইসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতেই, ফোনটাকে আবার প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে রেখে সে হাতটা বের করতে না করতেই তারস্বরে বেজে উঠল সেটা। 

ক্রিং ক্রিং ক্রিং...


- হ্যালো... হ্যাঁ, বলছি... কি হয়েছে?... পড়ে গেছে?... এ্যাঁ, কী?... ফেলে দিয়েছে?... কি সব আজগুবি কথা... ফাঁকা চেয়ারে বসতে গেল, আর চেয়ারটা তাকে ফেলে দিল?... কী বললেন?... আপনাকেও ফেলে দিয়েছে?... আচ্ছা, আমি আসছি!... হ্যাঁ, হ্যাঁ, এক্ষুণি আসছি...


ফোনটা কেটে আপন মনেই গজগজ করতে থাকে বিশু - এ আবার কি আপদ রে ভাই! খালি চেয়ারে কেউ বসতে গেলেই নাকি তাকে ফেলে দিচ্ছে চেয়ারটা! বাপের জন্মে এমন আজব কিস্যা শুনিনি, কি ব্যাপার কে জানে? এও এখন আবার গিয়ে দেখতে হবে। মন্দিরে যাওয়াটা আজ গেল বোধ হয়। দ্রুত পায়ে আফজল মিঞার দোকানের দিকে হাঁটা দিল বিশু।


- নিয়ে যাও ভাই তোমার আরাম কেদারা। এমনিতেই এ'সব সাবেক আমলের ভারি কাঠের চেয়ার বাড়িতে এখন রাখতে চায় না লোকে, তার ওপর এ আবার ল্যাং মারে! আমার সব খদ্দের পালাবে এই চেয়ার এখানে থাকলে। তুমি এখনই এ'কে নিয়ে বিদেয় হও দোকান থেকে...


প্রায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হতে চলা আধভাঙা রায়বাড়িকে পুরোপুরি ভেঙে ফেলার আগে, বাড়ির ভেতর থেকে যাবতীয় সব ভাঙাচোরা আসবাবপত্র বের করে আনা হয়েছিল। তারই মধ্যে একমাত্র ব্যবহারযোগ্য, অক্ষত এবং পূর্ণাঙ্গ অবস্থায় পাওয়া গিয়েছিল এই সাবেকি আরাম কেদারাটাকে। বিশু দিন দু'য়েক আগে ওটাকে বিক্রির জন্য এখানে, আফজল মিঞার কাছে নিয়ে এসেছিল। পুরোনো আসবাবপত্রের কারবারি সে।


তারপর তো এইসব কাণ্ড! দোকানে আসা খদ্দেরদের কারো হয়তো মনে ধরেছে চেয়ারটা। কিন্তু যেই সে বসতে গেছে ঐ চেয়ারে, অমনি তাকে অদৃশ্য কেউ যেন ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিয়েছে মাটিতে! সেই দলে খোদ আফজল মিঞা নিজেও নাকি আছে। সব কথা শুনে, তা' যাচাই করে দেখার সাহস আর পেলো না বিশু। অগত্যা একটা ঠেলা গাড়িতে চাপিয়ে সেটাকে ফিরিয়ে এনে রায়বাড়ির পিছনের দিকে তার অস্থায়ী তাঁবুর এক কোণে রেখে দিল।


**************************************************


- ও বিশুর মা, গরম চা টা একটু দিয়ে যা বাবা। সেই পাঁচটা থেকে উঠে বসে আছি - এখন বাজে সাড়ে সাতটা, সকালে এক কাপ চা দেওয়ারও কি কেউ নেই বাড়িতে! 


নিচের সদর দরজা খোলার আওয়াজ শুনে, অশীতিপর বৃদ্ধ রায়সাহেব মনে করেছিলেন, তাঁদের রান্নার লোক বিশুর মা বাজার থেকে ফিরলো বুঝি। আসলে ডাক্তার এসেছিলেন তাঁর ছেলে প্রতাপের জ্বর পরীক্ষা করতে। 


দেবদত্ত রায় আশি পেরিয়েছেন অনেক দিন হলো। এখন আর বয়সের হিসাব রাখতে পারেন না - তবে নব্বই এর কাছাকাছি পৌঁছে গেছেন বইকি। তাঁর বড় খোকা প্রতাপ-ই তো অবসর নিয়েছে প্রায় বছর দুই তিন হ'ল। 


আগে তাঁর এ্যাটেনডেন্ট হিসাবে কেউ না কেউ থাকতোই সব সময়। এখন ছেলে অবসর নেওয়ার পর তাঁর লব্ধ সেই পরিষেবা বন্ধ হয়েছে। একমাত্র মেয়েকে বিয়ের পরে বিদেশে পাঠিয়ে ছিলেন, তারা সেখানেই স্থায়ীভাবে থেকে গেল। একমাত্র বৌমাও দু'দিনের জ্বরে হঠাৎ মারা গেল, তাদের একটা মাত্র ছেলে, সেও বোধ হয় আমেরিকাতেই সেটেল হবে। 


বাড়িতে এখন লোক বলতে তেতলায় একা তিনি, আর দোতলায় প্রতাপ। নিচে রান্নাবান্না ও ঘরের কাজ করার জন্য এক মহিলা থাকে, বিশুর মা। বাজার হাট দোকান পাট এই সব আগে বিশুর বাবা করতো। সে মারা গেছে বছর দুয়েক আগে, টিবি হয়ে। তারপর আর নতুন করে কাউকে রাখা হয়নি, বিশুর মা নিজেই ঐ কাজটুকু করে নেয়। তার জন্য প্রতাপ ওর মাইনেও বেশ কিছুটা বাড়িয়ে দিয়েছে।


বিশু ছেলেটা পড়াশোনায় ভালো, বেশ বুদ্ধিমানও। সে-ই একমাত্র মানুষ যে রায়সাহেবের কাছে এসে তাঁর সঙ্গে কিছুক্ষণ সময় কাটায় রোজ। কিন্তু সেও তো তার স্কুল থেকে ফিরে সেই বিকেলবেলা আসে। সকালবেলাটা তাঁর বলতে গেলে একপ্রকার নির্বাক নিঃসঙ্গই কাটে এই ঘরে। ঐ চা নিয়ে বিশু বা বিশুর মা এলে, তবু যা হোক দু'চারটে কথা বলতে পারেন তাদের সঙ্গে একবার, ব্যস। 


রোজ বেশ ভোর থাকতেই ঘুম থেকে উঠে পড়েন তিনি, অভ্যেস। তারপর নিজেই টানা হ্যাঁচড়া করে নিজের অথর্ব শরীরটাকে বিছানার ধারে এনে চড়িয়ে দেন এই আরাম কেদারায়। সারাদিন এখানে বসেই কাটে তাঁর। তারপর সেই সন্ধ্যাবেলা বিশু এসে তাঁকে ধরে ধরে নিয়ে গিয়ে শুইয়ে দেয় তাঁর বিছানায়। সারাদিন একা নিজের ঘরে ঐ আরাম কেদারায় আধশোয়া হয়ে বসে থাকতে থাকতে প্রায় হাঁপিয়েই ওঠেন আজকাল রায়সাহেব। 


রাজ্যের তথা এই শহরের অবস্থাও নাকি এখন খুব একটা ভালো নয়। রোজই তো রেডিওতে শোনেন খুন, পাল্টা খুন, আর কি সব আন্দোলনের খবর। যুক্তফ্রন্ট সরকারও তো বোধ হয় আর টিকলো না! স্বাধীন হয়ে ইস্তক ঝামেলা যেন লেগেই রয়েছে রোজ। বড় খোকার অফিসে তালা পড়লো নাকি সত্যিই ওর রিট্যায়ারমেন্টের বয়স হলো, তাই বা কে জানে? 


তারও তো আবার হাঁপানির রোগ, ওর মায়ের থেকেই এটা পেয়েছে। সত্যি বলতে কি, প্রতাপবাবুর শরীর ওঁর বাবার তুলনায় বেশ দুর্বলই। ঠাণ্ডা পড়তে না পড়তেই হাঁপানির টান যেন বেড়ে গেছে এ'বছর তাঁর। তার ওপর গরম জলে ঠিকঠাক দু'দিন স্নান করা হয়নি, ব্যস জ্বর বাঁধিয়েছেন। ডাক্তারের ধারণা এটা নিউমোনিয়া, কিন্তু প্রতাপবাবু নিজেই অন্য কিছু বলে সন্দেহ করছেন। 


এরই মধ্যে আবার কারা যেন বাড়িতে এসে হুজ্জতি করে গেছে - এত বড় বাড়িতে দু'জন মাত্র মানুষ থাকে! আর এদিকে লোকে মাথা গোঁজার একটু জায়গার জন্য মাথা কুটে মরছে! এসব চলতে দেবে না তারা, এ এক ধরণের শোষণ বই কিছু না...


ওদিকে প্রতাপবাবুর জ্বর আর সারলো না। অল্প কয়েক দিনের রোগভোগের পরেই, ইহলোকের মায়া কাটিয়ে চলে গেলেন তিনি। তাঁর একমাত্র প্রবাসী ছেলে জানালো, সে ওদেশেই সব পারলৌকিক ক্রিয়াকর্ম সেরে নেবে। এই রাজ্য তথা শহরের যা হাল এখন, তার নাকি বাড়ি ফিরতে সাহস হচ্ছে না! বলিহারি পিতৃভক্তি, ধন্য দেশভক্তি। 


এর কিছুদিন পরের ঘটনা। কয়েকদিন ধরে বিশুর মাও ঠিকঠাক রাঁধা-বাড়া, কাজ-কর্ম করতে পারছিল না। তার শরীরটাও নাকি খুব একটা ভালো যাচ্ছিল না ইদানিং। বিশুও ছিল না, বার্ষিক পরীক্ষার শেষে সে মামার বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিল। সেখান থেকে ফিরে এসে দেখে, তার মা বোধ হয় দু'দিন আগেই...


অগত্যা মামাকে খবর পাঠিয়ে ডেকে এনে, তাঁর সাহায্যে কোনোমতে মায়ের শবদাহ করলো সে। তারপর মামার সঙ্গে তাঁর বাড়িই চলে গেল। এই বাড়িতে স্বভাবতই তখন আর ফেরা হলো না তার। মামার বাড়িতে মায়ের সব পারলৌকিক ক্রিয়া সম্পন্ন করে তবেই ফিরলো সে। 


ওদিকে জীবনের শেষ কয়টা দিন অথর্ব রায়সাহেব অভুক্তাবস্থায় অনাদরে, তাঁর ঐ চেয়ারে বসেই কাটিয়ে ইহলোক ত্যাগ করলেন। তাঁর অন্তিম ক্রিয়া কর্মাদিও সব করতে হলো বিশুকেই। তাঁর প্রবাসী আত্মজা বা একমাত্র পৌত্র কেউই নাকি আসতে পারলো না তাদের নানাবিধ সমস্যার কারণে!...


**************************************************


রায়সাহেবের নাতি অরিন্দম এবং মেয়ে-জামাই হৈমবতী ও অখিলেশ যথারীতি এগ্রিমেন্টের দু'দিন আগেই এসে পৌঁছে গেলেন কলকাতা। তাঁরা জানেন, তাঁদের পৈতৃক বাড়িটা আর বসবাসযোগ্য নেই, ভেঙে পড়েছে। কেয়ার টেকার হিসেবে বিশুই যে শুধু ওখানে একটা তাঁবু খাটিয়ে থাকে, সেও জানা। তাই তাঁরা শহরে এসে সোজা হোটেলে গিয়েই উঠলেন। পরদিন পুরোটাই তাঁরা শুয়ে বসে জেট ল্যাগ কাটালেন সবাই।


ছুটি পাবার জন্য তার কোম্পানির বিস্তর কাজ নিয়েই কলকাতা আসতে হয়েছে অরিন্দমকে। তাই তার পরদিন সারাক্ষণই সল্টলেকে ব্যস্ত রইলো সে। অখিলেশের এক কোন দূরসম্পর্কের আত্মীয় কর্মরত আছেন কলকাতার আবহাওয়া দপ্তরে, তিনি গেলেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। শুধু একা হৈমবতী রয়ে গেলেন হোটেলে। আত্মীয় স্বজন দু'একজন শহরে তাঁরও যে নেই এমন না। কিন্তু বাবার শেষকৃত্যে না এসে এখন পৈতৃক বাড়ি প্রোমোটিং করাতে এসেছেন - এটা ভেবেই তাঁদের সঙ্গে দেখা করতে একটু যেন বাধছিল তাঁর।


অগত্যা, একবার নিজেদের বাড়িটায়, ভাঙা হোক তবুও জন্মভিটা তো তাই ওখানেই যাওয়া স্থির করলেন তিনি। পরদিনই বাড়ির এগ্রিমেন্ট সই হবে, তার জন্য তাঁদেরই সব দরকারি কাগজপত্র উকিলকে দিতে গিয়েছিল তখন বিশু। হৈমবতী দেখলেন - তাঁদের বাড়ির সদর দরজাটা এখনও দাঁড়িয়ে আছে তেমনই, যদিও তার ভিতরে সেই তিনতলা বাড়িটা যে আর দাঁড়িয়ে নেই, সেটা দেখাই যাচ্ছিল।


হৈমবতী ভেজানো সদর দরজাটা ঠেলে ভেতরে ঢুকলেন। বাড়িটা পুরোই ধ্বসে পড়েছে, শুধু পূর্ব দিকের দেওয়ালটা ফুট দশেক অবধি সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে এখনও। অবশ্য ঠিক দাঁড়িয়ে আছে না বলে, বাঁশের ঠেকা দিয়ে তাকে দাঁড় করিয়ে রেখেছে বিশু - এটা বললেই ভাল হয়। ঐ দেওয়ালটা ঘেঁষেই সে তার একার থাকার মত একটা অস্থায়ী ঝুপড়ি ঘর বানিয়ে নিয়েছে।


বাড়িটা এখন শুধুই ভাঙা ইঁট, সুড়কির স্তূপে পরিণত হয়েছে। পিছনে তাঁর বাবার বানানো সাধের বাগান এখন ঝোপ ঝাড়, ঘন জঙ্গল, সাপ খোপের আখড়া। সেদিকে আর বিশেষ এগোতে না পেরে পূর্ব দিকে বিশুর সেই ঝুপড়িটার কাছে আসেন হৈমবতী। সেখানে আসতেই, তার ভিতরে একপাশে সরিয়ে রাখা তাঁর বাবার অতিপ্রিয় সেই আরাম কেদারাটাকে দেখতে পেলেন তিনি!


জীবনে এই প্রথমবার, আজ এই চেয়ারটাকে বাড়িতে খালি অবস্থায় দেখতে পেলেন তিনি, এখানে। বাড়িতে ঐ চেয়ারটায় বরাবরই তিনি তাঁর বাবাকে বসে থাকতে দেখেছেন। তিনতলায় বাবার ঘরে এমনিতে খুব একটা যাওয়া হতো না তাঁর। বাবার নানা রকম দরকারি কাজের জিনিসপত্র ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকতো তাঁর ঘরময়, তাই তাঁর অনুপস্থিতিতে ওই ঘরে ঢোকায় একরকম নিষেধাজ্ঞাই ছিল।


বাড়িতে বাবা থাকা অবস্থায় যতবার তিনি তিনতলায় বাবার ঘরে গেছেন, বরাবরই দেখেছেন বাবা ঐ আরাম কেদারায় বসেই তাঁর কাজ করছেন বা বিশ্রাম নিচ্ছেন। তাই এই আরাম কেদারাটাকে, তাঁর বাবা বসে নেই এমন অবস্থায়, তিনি এই প্রথমবারই দেখতে পেলেন। বুকটা কেমন যেন হু হু করে উঠলো তাঁর। 


বাবার জীবনের শেষ দিনগুলোয়, শত ইচ্ছা সত্ত্বেও তাঁর কাছে আসতে না পারার কষ্ট এবং তাঁর শেষকৃত্যেও যোগ দিতে না পারায় তাঁর মনে জমে থাকা সমস্ত যন্ত্রণা আর দুঃখগুলো বুকের ভেতরটায় যেন মোচড় দিয়ে আজ বেরিয়ে এলো তাঁর গলা বেয়ে। হাউ হাউ করে কেঁদে উঠলেন তিনি শিশুর মতন - বাবা... 


এই নির্জন পরিত্যক্ত বাড়িতে বাবার ব্যবহৃত সেই আরাম কেদারাটাই তাঁর কাছে যেন হয়ে উঠলো বাবার প্রতিভূ। কেদারার পায়াটাকে দু'হাতে জড়িয়ে ধরে পিতৃবিয়োগের ব্যথায় আজ মন খুলে গলা ছেড়ে কাঁদলেন তিনি। এখানে তাঁর এই আচরণ কারো চোখে 'সিলি প্রাইমিটিভ ইমোশন' লাগবে না, আর লাগলেও তিনি থোড়াই কেয়ার করেন!


পরদিন অরিন্দমের হাতদুটো ধরে তাকেও নিয়ে এলেন সেখানে হৈমবতী। বললেন - বাবু, দেখ তোর সেই দোল খাওয়া চেয়ারটাই শুধু একই রকম রয়েছে এখনও। তুই ছোটবেলায় কি বায়না করতিস ওটায় উঠে খেলবি বলে, মনে আছে? আজ তোকে কেউ বাধা দেবে না, একবার বসে দেখ দাদুর আরাম কেদারায়, কেমন লাগে!


অরিন্দম হায়ার সেকেন্ডারি দিয়ে ইস্তক দেশের বাইরে থাকে, সেও নয় নয় করেও কম সে কম বছর বিশেক তো বটেই। মাকে হারিয়েছিল তার আগেই, আর এখন তো বাবা, দাদু কেউই নেই। পিসিকেও শৈশবে বছর আষ্টেক বয়সেই শেষবার দেখেছিল - তাঁর বিয়ের সময়, তার পর আজ আবার দেখছে তাঁকে। আত্মীয়, পরিবার, পরিজন ও পারিবারিক সম্পত্তি আদি বিষয়ে তাই সে স্বভাবতই খুব উদাসীন।


আজ পিসির আবদারে দাদুর ঐ আরাম কেদারাটায় বসতেই কেমন যেন একটা শিড়শিড়ানি অনুভব করল অরিন্দম। অদ্ভুত এক আকর্ষণে যেন আটকে গেল সে চেয়াটায়, মাথার ভেতরটা কেমন ঝাঁকিয়ে উঠে দু'চোখ জুড়ে অন্ধকার নেমে এল তার। সকলের মনে হলো যেন ঘুমিয়ে পড়লো সে সেই আরাম কেদারায়! 


শুধু বিশু লক্ষ্য করলো - কেদারাটা অরিন্দমকে নিয়ে আপনার থেকেই ধীর লয়ে দুলতে লাগলো, ঠিক যেমনটা রায়সাহেব বসে থাকা অবস্থায় তাঁকে দুলতে দেখতো সে। কেদারাটার সামনেই তখন দাঁড়িয়ে ছিল বিশু আর তার সঙ্গে ছিল আফজল মিঞাও। এই প্রথম তারা দু'জনেই দেখলো যে এই চেয়ারটাতে বসে অমন আরামে ঘুমিয়ে পড়লো কেউ। এই প্রথমবার তাদের সামনেই ঐ চেয়ারে কেউ বসলো কিন্তু তাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল না চেয়ারটা! তাই দু'জনেই একটু অবাক চোখে মুখ চাওয়া চাওয়ি করলো!


আফজল মিঞা প্রোমোটার মনিরুলের খুব কাছের বন্ধু। তাকে আজ সকালেই একটা ভীষণ জরুরী পারিবারিক কাজে হঠাৎ বেরোতে হলো। তাই তার হয়ে এগ্রিমেন্টের সব কথাবার্তা ফাইনাল করবার জন্য সে আফজলকেই পাঠিয়েছে এখানে। এখন এই চেয়ারটাকে এমন অদ্ভুত উল্টো আচরণ দেখে, সব কেমন যেন তালগোল পাকিয়ে গিয়েছিল তার।


এই বিষয়টা অবশ্য জানতেন না হৈমবতী বা অখিলেশ। তাই এভাবে অবাক চোখে সেই চেয়ারটার পানে তাকিয়ে তাদের মুখ চাওয়া চাওয়ি করতে দেখে, স্বাভাবিক ভাবেই তাঁরা একটু বিস্মিত‌ হলেন। অখিলেশ তো একরাশ বিরক্তি নিয়েই এগ্রিমেন্টের সব কাগজপত্রগুলো তাঁকে দেবার জন্য তাড়া দিলেন বিশুকে।


বিশু তাঁর নির্দেশ মত ব্যাগ থেকে এগ্রিমেন্টের ফাইলটা বের করে দেয়। চেয়ারটা থেকে একমুহুর্তের জন্যও নজর কিন্তু সরে না তার একটুও। অখিলেশকে বিশু ফাইলটা দিতে না দিতেই, চোখ খোলে অরিন্দম! অদ্ভুত এক স্থির দৃষ্টিতে তাকায় সে ফাইলটার দিকে। তার থমথমে মুখ আর স্থির রক্তাভ চোখ - কেমন যেন অপরিচিত লাগে উপস্থিত সকলেরই। কয়েক মিনিট আগের সেই পার্থিব সব বৈষয়িক বিষয়ে উদাসীন, চঞ্চল যুবক অরিন্দমের সঙ্গে এই মুহূর্তে চেয়ারে বসে থাকা এই অরিন্দমের যেন আসমান জমিন ফারাক! হাত বাড়িয়ে ফাইলটা দিতে ইশারা করে অরিন্দম। 


শুধু বিশুর চোখেই প্রতীয়মান হন সেই আরাম কেদারায় তখন বসে থাকা প্রকৃত ব্যক্তিটি। তিনি অরিন্দম নন, স্বয়ং দেবদত্ত রায় সাহেব! তাই তাঁর ইশারা মোতাবেক, বিশু দ্রুত এগিয়ে এসে অখিলেশের হাত থেকে একরকম যেন ছিনিয়ে নিয়েই ফাইলটা তুলে দেয় তাঁর হাতে। 


হাতের মুঠোয় ধরে গোটা ফাইলটাকে চেপে দলা পাকাতে পাকাতে অরিন্দম বলে ওঠে - কোনো প্রোমোটিং করা যাবে না এখানে। যেমন ছিল এই রায়বাড়ি, তেমনটাই ফের বানাতে হবে তাকে। বাড়ির তিনতলাটা হৈমবতী পাবে, দোতলাটা অরিন্দমের, আর একতলাটা পাবে বিশু। 


অরিন্দমের গলার আওয়াজটা শুনে এবার চমকে ওঠে সবাই। সব থেকে বেশি বিস্মিত হন হৈমবতী আর বিশু - এ যে তাঁদের দু'জনেরই বহুদিনের পরিচিত আওয়াজ! এ যে আর কারোর না, স্বয়ং দেবদত্ত রায় সাহেবের গলা! কথাগুলো বলা শেষ হতেই আবার চোখ বন্ধ হয়ে যায় অরিন্দমের, আরাম কেদারায় আবার এলিয়ে পড়ে সে।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama