ভালোবাসার রং ধুয়ে যায়
ভালোবাসার রং ধুয়ে যায়


স্টেশনে ট্রেন এসে এখনো পৌঁছায়নি। তিতলি উসখুস করছিল আর দেখছিল একবার ডানদিক আর একবার বাঁ দিক, যদিও জানে কোন দিক থেকে ট্রেন আসবে। স্টেশনে লোকজন যদিও বেশি নেই কারণটা হল বর্ষা। কদিন থেকে নাকি নিম্নচাপের সৃষ্টি হয়েছে যার কারণে আকাশের মুখ ভার আর যখন তখন কেঁদে ভাসিয়ে নিজের মন হাল্কা করছে। আকাশের দিকে একবার করে দৃষ্টি হেনে পরেরবারে তাকিয়ে দেখছে ট্রেনের মাথা দেখা যাচ্ছে কি না। আজ তাথৈ, ওর বোন আসছে কদিনের ছুটিতে। ও শহরে থেকে ইউনিভার্সিটিতে মাস্টার্স করছে ভূগোলে।
তিতলির অবশ্য চিন্তা ছিল বোনের একা শহরে থেকে পড়াশোনা করা নিয়ে। ওর বোন ওর থেকে বেশি সুন্দর দেখতে। এখানে যখন ছিল পুরুষদের চোখ ওর ওপর ঘোরাফেরা করতো। এখানে নাহয় বোনকে চোখেচোখে রাখা গেছে কিন্তু বড় শহরে ওর পক্ষে গিয়ে তো সেটা করা সম্ভব না কারণ বাড়িতে মা রয়েছে। তাই ওর চিন্তা অমূলক নয়।
কতো রকমের চিন্তাভাবনা ওকে সারাদিন ব্যস্ত করে রাখে কিন্তু কারো কাছে বলে যে একটু হাল্কা হবে সে উপায় নেই। মা নামেই বাড়িতে থাকে তার শরীর বাড়ির সীমানায় উপস্থিত থাকলেও মনটা অনেকদিন আগেই হারিয়ে গেছে। ছোট থেকে মায়ের কঠিন সংগ্রাম দেখেছে ওদের দুজনকে বড় করতে গিয়ে, কারণ ওদের বাবা ওদের দায়িত্ব নিতে অস্বীকার করেছিল। এতো কষ্ট করতে হয়েছে তবু ওদের মা কোনদিন ওদের বাবার সম্পর্কে একটাও খারাপ কথা বলেনি। তবে মানসিক চাপ আর সাংসারিক চাপের মাঝে পিষে গিয়ে ওর মা অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ছিল। শেষে এমন অবস্থা হল যে মাকে বাধ্য হয়ে অ্যাসাইলামে ভর্তি করতে হল। অনেকদিন চিকিৎসার পর যদিও ওদের মায়ের অবস্থা কিছুটা স্থিতিশীল তবু ডাক্তার বলে দিয়েছে কোনভাবেই কোন চাপ দেওয়া যাবে না তাকে। বাধ্যতামূলক ভাবে তিতলির ছোট্ট ঘাড়ে এসে পড়েছে পুরো সংসারের ভার।
এতো কিছু যখন ঘটে চলেছে তখন ওর ছোট আদরের বোন ক্লাস নাইনের ছাত্রী। এর পরের কয়েকটা বছর খুব গুরুত্বপূর্ণ। তিতলির পড়াশোনা তো বন্ধ হয়ে গিয়েছিল বোনের চালাতেই হবে। ওর এতো আত্মত্যাগের কারণেই বোধহয় মায়ের সাধের সংসার ভেসে যায়নি।
ভাবনাগুলোর মাঝে এমনই হারিয়ে গিয়েছিল ও যে হঠাৎ ট্রেনের গম্ভীর হুইসেলের আওয়াজে চমকে সামনে তাকালো। দেখলো ট্রেন ঢুকছে। ট্রেন থামতে নেমে এলো তাথৈ, কিন্তু পেছনে ও কে? সন্দীপ!?! কিন্তু ও যে তাথৈ’এর সাথে আসবে কালকে ফোনে কথা বলার সময় একবারও বলেনি তো। ও সব প্রশ্ন মনের মধ্যে আটকে রেখে হাসি মুখে এগিয়ে গেলো বোনের দিকে। তাথৈ বলল “ভালোই হল দিদি তুই এসেছিস” বোনের হাত থেকে ব্যাগটা নিয়ে ও বলল “আয় তোরা” বলে ষ্টেশন পেরিয়ে ভাড়ার গাড়িতে উঠে বসলো। তাথৈ পেছন পেছন এসে গাড়িতে উঠতে গিয়ে বলল “দিদি, তুই সামনে বস সন্দীপ আমার পাশে বসবে”
সন্দীপ! খট করে কানে লাগলো নাম ধরে ডাকাটা আর অবাক হয়ে দেখলো সন্দীপও হাসি মুখে ব্যাপারটা মেনে নিলো। তিতলি আর কিছু না বলে সামনের সীটে গিয়ে বসলো। সারা রাস্তায় ওদের দুজনের কথা শুনে গেলো ও আর মনের মধ্যে সন্দেহের কাঁটা খচখচ করে গেলো। ব্যাপারটা একটু পড়েই খোলসা হল যখন সন্দীপ নেমে গেলো ওর বাড়ির সামনে। বিদায় নেওয়ার সময় তাথৈ ওকে বলল “কাল দিদি যাবে তোমাদের বাড়ি। কাকিমাকে জানিয়ে রেখো”
বাড়ি ফিরতে তিতলি সংসারের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। মনে মনে ও তাথৈকে অনেক কিছু জিজ্ঞেস করতে চাইলেও করলো না কারণ ও জানে বোন একটু পরে নিজেই সব বলবে। ঠিক তাই দুপুরের খাওয়ার টেবিলে তাথৈ বলল “দিদি তোকে কিছু বলার আছে। আমি সন্দীপকে ভালোবাসি আর ও আমাকে। আমরা বিয়ে করতে চাই। ও বাড়ির সবাই জানে এ সম্পর্কের কথা কিন্তু আমাদের এখান থেকে তুই সম্বন্ধের কথাটা বলতে যাবি সন্দীপের বাড়িতে”
তিতলি এক মুহূর্তের জন্য চোখে অন্ধকার দেখেছিল। শেষ অব্দি সন্দীপ, করতে পারলো এরকম?
সন্দীপ তিতলির কলেজে পার্ট টাইম লেকচারার হয়ে এসেছিল। এত ভালো পড়াতো যে ও খুব মন দিয়ে সন্দীপের সব ক্লাস করতো একটাও ফাঁকি দিতো না। এই সময় ওদের জীবনে বিপর্যয় নেমে এলো মায়ের অসুস্থ হওয়াতে। ওর কলেজ যাওয়া বন্ধ হল। এরকম একদিন সন্দীপ হঠাৎ এসে হাজির ওদের বাড়িতে। সেই বিকেলের কথা তিতলি কোনদিন ভুলবে না। বোন বিকেলে বেরিয়েছিল তাই দরজায় খটখট শুনে বোন ফিরেছে ভেবে দরজা খুলেছিল কিন্তু বোনের বদলে যাকে দেখলো খুব অবাক হয়ে গিয়েছিল তাকে দেখে। সামনে সন্দীপ দাঁড়িয়ে। ও ব্যস্ত হয়ে “আসুন স্যার... আসুন” বলে ভেতরে আসতে আহ্বান জানালো। সন্দীপ বলল “না আমি ব্যস্ত। আজ আর ভেতরে আসবো না। আমি এটাই জানতে এসেছিলাম তুমি ক্লাস করছো না কেন?”
তিতলি ভাবতেই পারেনি স্যার ওকে এতোটা লক্ষ্য করেন। ও বলল “স্যার আমার না যাওয়ার কারণ অনেক। সব তো দরজায় দাঁড়িয়ে বলা যায় না। আপনি ভেতরে এসে বসুন, সব বলছি”
তারপর সব খুলে বলেছিল স্যারকে। সন্দীপ খুব সহানুভূতি দেখিয়েছিল, বলেছিল “এরপর কিছু হলে জানিয়ো আমি যথা সম্ভব চেষ্টা করবো সাহায্য করতে” ভরসার একটা লোক পেয়ে তিতলি খুব বল পেয়েছিলো মনে। সময়ের সাথে সাথে দুটো মন কাছে চলে এসেছিলো। এর মাঝে বোন স্কুল ফাইনাল দিয়ে কলেজে ঢুকলো। ও পড়াশোনায় দারুণ ভালো। তিতলি সন্দীপের সাথে আলোচনা করতো বোনের ব্যাপারে। ভালো জায়গায় পড়লে ওর ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল হবে সেটা জানলেও ও একা অচেনা শহরে কি ভাবে থাকবে এটা তিতলিকে খুব ভাবাচ্ছিলো। এর মধ্যে সন্দীপ শহরের এক কলেজে ভালো অফার পেয়ে চলে যাচ্ছিলো তাই যাওয়ার আগে দেখা করতে এসে বলল “তোমার চিন্তার কারণ নেই। আমি ওখানেই তো যাচ্ছি, তাথৈ’এর খবরাখবর আমি ভালোভাবে নেবো”
তিতলি নিশ্চিন্ত হয়েছিলো। সন্দীপের সাথে ওর ফোনে কথাবার্তা হত তাই ওর মনে কোন দুশ্চিন্তা আসেনি। কিন্তু আজ ও বুঝতে পারলো চোখের বাইরে চলে গেলে এভাবে মনের থেকেও দূরে চলে যাওয়া যায়।
পরেরদিন খবর দিয়ে ও সন্দীপের বাবা মায়ের সাথে দেখা করতে গেলো। সন্দীপ দরজা খুলে ওকে দেখে কিছু বলতে চাইছিল কিন্তু তার আগে ও বলল “আপনার বাবা মা আছেন বাড়িতে। আমি ওনাদের সাথে কথা বলতে চাই”
সন্দীপ হ্যাঁ না বলার আগেই ওর বাবা মা আপ্যায়ন করলো “এসো এসো। আমরা তোমার অপেক্ষাই করছি”
সব কথাবার্তাই হল তারপর পাকা কথা বলার জন্য ও নেমতন্ন করে এলো ওদের। রাস্তায় বেরোনোর সময় সন্দীপকে আসেপাশে না দেখে তিতলি বেশ স্বস্তি বোধ করলো। কিন্তু রাস্তার বাঁক ঘুরতেই সেই স্বস্তি উবে গেলো, সামনে সন্দীপ দাঁড়িয়ে। “তোমার সাথে আমার কিছু কথা আছে তিতলি”
তিতলি হাসলো “আমার আর কোন কথা শোনার নেই সন্দীপবাবু। আপনি হারিয়ে গেছেন আমার জীবন থেকে আর ফিরে আসার চেষ্টা করে আরেকটা মেয়ের জীবনে অশান্তি ডেকে আনবেন না। আপনারা যাতে সুখী থাকেন সেই ব্যবস্থাই করে এলাম”
কথা শেষ হতে হতেই বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি নামলো। আকাশের দিকে একবার চেয়ে তিতলি বাড়ির পথে হাঁটা দিলো। বৃষ্টির জলে চোখের জল মিশে একাকার হয়ে যাচ্ছিলো।