STORYMIRROR

Sonali Basu

Drama

3  

Sonali Basu

Drama

ভালোবাসার ঘর

ভালোবাসার ঘর

7 mins
2.0K


দিন দুই আগে চন্দ্রিমা এসেছে গোপালপুর বেড়াতে। দাদা শরৎ এখানে বদলি হয়ে এসেছে বছরখানেক হল। সরকারি চাকরিতে যা হয় আর কি। এখানে আসার পর থেকেই বৌদিদি দীপা ওকে বলছে “একবার অন্তত এখানে ঘুরে যাও। তোমার দাদা বলছে এখানে বেশীদিন থাকবে না আবার অন্য কোথাও বদলি হবে। বদলি হয়ে গেলে আফসোস হবে ঘুরতে পারলে না বলে। তাই বলছি এবারের ছুটিতে এসো”


ভাইঝি শ্রেয়া আর ভাইপো শ্রেয়ান দুজনেই ধরে পড়েছে “হ্যাঁ পিপি তুমি একবার অন্তত এসো। আমরা তোমার সাথে বালির প্রাসাদ বানাবো”

কোন ইচ্ছেই ছিল না গোপালপুর যাওয়ার কিন্তু বৌদির আর ভাইপো ভাইঝির অত অনুরোধ শেষ অব্দি ফেলতে পারেনি। শেষ মুহূর্তে বিনা পরিকল্পনা করে চন্দ্রিমা সপ্তাহখানেকের জন্য বেড়াতে এসেছে তাও এই বর্ষার ঋতুতে। স্টেশনে দাদা বৌদি দুজনেই এসেছে ওকে নিয়ে যেতে। গাড়িতে বাড়ি যেতে যেতে বৌদি হাল্কা স্বরে অনুযোগ করেছিল “সব ঋতু ফেলে শেষে বর্ষায় এলে?” ও হেসে বলেছে “বর্ষায় তোমাদের শহর কি সুন্দরী থেকে বাঁদরী হয়ে যায়? কিছু দেখা যাবে না!”

দাদা বলেছে “কেন দেখা যাবে না, বর্ষায় যে কোন জায়গার এক আলাদা রূপ খোলে” বৌদি আর কথা বাড়ায়নি, হেসে পরিস্থিতি সামলে দিয়েছে। বাড়িতে আসার পর ছোট দুজন একেবারে ঝুলে পড়েছে পিসির দুদিকে, এক মুহূর্তের জন্যও ছাড়ছে না ওকে। অবশ্য চন্দ্রিমার বেশ লাগছে ওদের সাহচর্য।


প্রথমদিন বিশ্রাম নিয়ে কিছুটা জোর ফিরে এলে পরেরদিন দাদা বৌদির সাথে ও চলল গোপালপুর বিচ ঘুরতে। লাইটহাউসের ওদিকে ঘুরতে গিয়ে ওর চোখে প্রায় জলই এসে পড়লো। এই বাতিস্তম্ভটার পেছনে দাঁড়িয়েই তো কৌস্তভ ওকে প্রথমবার জড়িয়ে ধরে চুমু খেয়েছিল। শ্রেয়া আর শ্রেয়ান বলল “চলো চলো পিসি, লাইটহাউসের ওপরে। দেখবে কি সুন্দর দেখায় আমাদের গোপালপুর” ওদের উৎসাহে ওরা সবাই উঠে এলো বাতিস্তম্ভের ওপর। এদিকওদিক দেখতে দেখতে চোখে পড়েই গেলো সেই আড়ালটা যেখানে কৌস্তভ ওকে টেনে নিয়ে গিয়েছিল।

 সেবার কলেজ থেকে ওরা এসেছিল গোপালপুর ঘুরতে, সাথে এম সি স্যার। জু’লজির ছাত্র ছাত্রীদের সামুদ্রিক কচ্ছপের ব্যাপারে শুধু পড়ানো নয় সামনাসামনি দেখাতে চেয়েছিলেন উনি। তবে ঘুরতে এসে ছাত্র ছাত্রীরা শুধুই পড়ায় আটকে থাকেনি ঘুরেছে খেয়েছে প্রেমও করেছে চুটিয়ে। কলেজে ওদের আলাপ হওয়ার পর ভালো লাগা পর্ব অনেকদিন চলেছিল। ভালো লাগা পর্ব ভালোবাসায় এগিয়ে গেলেও কেউ কাউকে তখনো মুখ ফুটে কিছু বলেনি। সেইদিন বিকেলে কৌস্তভ ওকে শুধু মুখে বলেনি ভালোবাসি এও বলেছিল পড়া শেষ করে চাকরি পেয়েই আমরা চারহাত এক করবো। চন্দ্রিমা সানন্দে সায় দিয়েছিলো। কিন্তু কে জানতো এই আনন্দ ক্ষণস্থায়ী। পরেরদিন ওরা গিয়েছিল ধবলেশ্বর বিচে। ওখানে ধবলেশ্বর শিব মন্দিরে পুজো দেবে এই আশাও ছিল মনে। কিন্তু নিয়তি অন্যরকম কিছু লিখে রেখেছিল ওদের জন্য, নাহলে স্নান করতে নেমে কৌস্তভ ডুবে যাবে কি করে। এমন ডুবলো যে সারাদিন ধরে খুঁজেও ওকে পাওয়া যায়নি। শেষে যখন পাওয়া গেলো ওর দেহ ছেড়ে প্রাণপাখি উড়ে গেছে। দীপা হতবাক হয়ে গিয়েছিল, কোন কথা বলার মতো অবস্থা ছিল না ওর। কেউ তো সে ভাবে জানতো না ওদের মন দেওয়া নেওয়ার ব্যাপারটা তাই ভেবেছিল বন্ধুর মৃত্যুতে ওর এই দশা। বাড়ি ফিরে আসার পরও ওর মনের অবস্থা ভালো ছিল না। কারো কাঁধে মাথা রেখে চোখের জল ফেলে যে হাল্কা হবে সে উপায়ও ছিল না। অনেক কষ্টে আবার স্বাভাবিক হয়েছে ও। কিন্তু তারপর থেকে ওর বেড়ানোর বিশেষ করে সমুদ্রে আসার ইচ্ছেটাই মরে গেছে।

বিচে ঘোরাফেরা করতে করতে খিদে পেয়ে যাওয়াতে ওর দাদা ওদের বালিতে বসতে বলে মাছ ভাজা আনতে গেলো। ছোট দুজন বালির ওপর কিছু লিখতে ব্যস্ত। দীপা বলল “কেমন লাগছে তোমার চন্দ্রিমা?” ও মাথা নেড়ে মুখে মেকি হাসি ফুটিয়ে বলল “ভালো”

“আমি জানতাম তোমার ভালো লাগবে। প্রথম যখন তোমার দাদার বদলির কথা শুনলাম আমি তো ঘাবড়ে গিয়েছিলাম এই ভেবে যে কোথায় গিয়ে পড়ছি, কোন আঘাটায়। এসে দেখলাম জায়গাটা অপূর্ব” দীপার কথার মাঝে ওর দাদা এসে উপস্থিত সাথে আরেক ভদ্রলোক। শরৎ হাসি মুখে আসতে আসতে বলল “এই দেখো কাকে ধরে নিয়ে এলাম” দীপা ঘুরে ভদ্রলোককে দেখে বলল “ও কৌস্তভদা যে, দারুণ” তারপর চন্দ্রিমার দিকে তাকিয়ে বলল “উনি তোর দাদার সহকর্মী” চন্দ্রিমার তখন কথা বলার অবস্থাই নেই, নামটা শুনে বোবা হয়ে গিয়ে শুধু স্থির দৃষ্টি ভদ্রলোকের দিকে তাকিয়ে আছে। দীপা অবশ্য ননদকে খেয়াল করেনি ও তখন ওই ভদ্রলোককে বলছে “বসুন... বসুন। কোথায় এসেছিলেন? বিচে ঘুরতে নাকি?”

ভদ্রলোক হাসি মুখে বসতে বসতে বলল “আরে না না আমার দিদিরা এসেছিল বেড়াতে। ওদের ছাড়তে গিয়েছিলাম স্টেশনে। তারপর ভাবলাম ফাঁকা বাড়িতে এখনি গিয়ে কি করবো, তাই একটু ঘুরতে এলাম”


শরৎ বলল “আরে মাছ ভাজাগুলোর ব্যবস্থা করো ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে যে”

দীপা সবাইকেই খাবার ভাগ করে দিলো হাসি মুখে। খাওয়া আর গল্পের মাঝে চন্দ্রিমার মনটা আরও খারাপ হতে থাকলো, ও যে ভুলতে পারছে না কৌস্তভকে।

ঘোরা শেষ করে ওরা আবার ফিরে এলো বাড়িতে। 

  সকাল থেকে নেমেছে বৃষ্টি, অঝোর ধারায়, তা আর থামার নামগন্ধ করছে না। বাড়িতে বসে টিভি দেখে আর বৌদির

সাথে গল্প করে সময় কাটছিল না চন্দ্রিমার। বিকেলে তাই বৃষ্টি খানিকক্ষণের জন্য বন্ধ হতেই ও দীপাকে বলল “একটু বাইরে থেকে ঘুরে আসছি বৌদি” বর্ষাস্নাত বিকালে দীপা তখন মুখরোচক জলখাবার বানাতে ব্যস্ত। তাই মুখে বলল “যাও তবে ছাতা নিয়ে, বৃষ্টির কোন ঠিক নেই” শ্রেয়া শ্রেয়ান সাথে যেতে চেয়েছিল কিন্তু বৃষ্টির সম্ভাবনা আছে বলে দীপা বারণ করলো। আর ঘুরতে যাওয়ার রাস্তা বন্ধ হতে দুজনের মুখই ভার হল। চন্দ্রিমা বলল “রাগ করিস না তোদের জন্য স্পেশ্যাল সারপ্রাইজ আনবো”

“সত্যি পিপি?” দুজনের গলাতেই আগ্রহ ঝরে পড়ছে। মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে নিষ্কৃতি। বৌদির কথামতোই ছাতা হাতে চন্দ্রিমা বেরোলো রাস্তায়। হেঁটে হেঁটে বিচের দিকে গেলো ও। আজ অন্যদিনের তুলনায় বিচে ভিড় কম। একটা জায়গা বেছে বালির ওপর বসলো ও। কতদিন হয়ে গেলো কৌস্তভ চলে গেছে ওর জীবন থেকে অথচ ও স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে পারছে না। প্রতিটা মুহূর্তে ওর মনে পড়ে যায় ওর সাথে কাটানো সময়গুলোর কথা। মুখে শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত ভালোবাসি না বললে কি হবে মনে মনে তো জানতো ওরা একজন আরেকজনের জন্য। কত আনন্দ করেছিল সেবার বেড়াতে এসে এখানে। প্রতিটা ছবি চোখের সামনে ফুটে উঠে ওকে আরও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত করে তুলছে। 

হঠাৎ বড়বড় ফোঁটায় বৃষ্টি পড়তে শুরু করলো। এতটাই নিজের ভাবনায় মগ্ন ছিল ও যে কখন আকাশ ঘিরে মেঘ এসে উপস্থিত হয়েছে তা টেরও পায়নি। বৃষ্টি শুরু হতে ও তড়িঘড়ি উঠে যেদিকে দোকান সেদিকে দৌড়ালো মাথা বাঁচানোর জন্য। একটা বন্ধ দোকানের সামনের ছোট চালার তলায় গিয়ে দাঁড়ালো ও। ওখানে দাঁড়িয়ে রুমালে মুখ মাথা মুছে ফেলতে ফেলতে এদিকওদিক দেখছিল চন্দ্রিমা হঠাৎ দেখলো এতো জোরের বৃষ্টিকে অবজ্ঞা করে একজন কিরকম বিচের ওপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। ও বেশ অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকলো মানুষটার দিকে। খানিক কাছাকাছি আসতে ও চিনতে পারলো মানুষটাকে, দাদার সহকর্মী কৌস্তভ দাশগুপ্ত। ওর মনে প্রশ্ন উঠলো উনি এরকম বৃষ্টিতে ভিজে চললেন কোথায়। দেখতে দেখতে ভদ্রলোক অনেক দূর চলে গেলেন আর ততক্ষণে অঝোর বর্ষার বেগ খানিক কমেছে। চন্দ্রিমা আর দেরী না করে তাড়াতাড়ি ফিরে এলো বাড়িতে।

চায়ের আসরে দীপা গরম গরম কচুরি আর তেঁতুলের চাটনি পরিবেশন করতে করতে বলল “আমি তো ভাবনায় পড়ে গিয়েছিলাম তুমি বেরোনোর পর বৃষ্টি শুরু হওয়াতে। ভাবলাম দেরী হলে তোমার দাদাকে বলবো তোমার খোঁজ করতে”


চন্দ্রিমা বলল “আমি বেশি দূরে যাইনি। ওই বিচেই বসেছিলাম। তবে একটা ব্যাপার দেখলাম। অত বৃষ্টির মধ্যেও দাদার সহকর্মী কৌস্তভবাবু কোথায় যেন যাচ্ছিলেন”

দাদা বৌদি দুজনেই একসাথে বলল “তাই নাকি? অদ্ভুত তো” কিন্তু দুজনেই কিছু জানে না এটা মানতে অসুবিধা হল চন্দ্রিমার। তবে ওই ব্যাপারে আর কথা তুললো না।

পরেরদিন আবহাওয়া ভালো থাকাতে ওরা চলল ধবলেশ্বর বিচের দিকে বেড়াতে। আজ দাদা ওর সহকর্মীটিকে ধরেই নিয়ে এসেছে সবাই মিলে আনন্দ করবে বলে। বিচে পৌঁছে ওরা চড়ুইভাতির ব্যবস্থা শুরু করলো। রান্না করেই নিয়ে এসেছে দীপা, এখানে শুধু ঘুরবে ফিরবে খাবে। গল্প গানের মাঝে খাওয়ার বিরতি। খাওয়ার পর ওরা একটু এদিক ওদিক ঘুরে দেখা শুরু করলো। মেয়েরা একদিকে আর ছেলেরা একদিকে। শ্রেয়া শ্রেয়ান আর চন্দ্রিমা তিনজনে মিলে বালির প্রাসাদ বানাচ্ছে। হঠাৎ চন্দ্রিমাই প্রস্তাব দিলো “চল আমরা আলাদা আলাদা প্রাসাদ বানাই তারপর দেখবো কারটা বেশি সুন্দর হয়েছে” ওরা দুজনেই রাজি। তিনজন মহা উৎসাহে নিজের নিজের প্রাসাদ গড়তে ব্যস্ত। কেউ যে ওদের খেয়াল করছে তা চন্দ্রিমা বুঝতেও পারেনি হঠাৎ একজনের মন্তব্যে চমকে মুখ তুলে তুলে তাকালো। শুনলো কৌস্তবদা বলছে “বালির প্রাসাদ বানালে দুঃখ পাবেন। ওটা ভীষণ ভঙ্গুর কখন যে ভেঙে যাবে আগে বোঝাই যায় না”

চন্দ্রিমা বলল “জানি তবু বানাতে সবারই সাধ যায়, ঠকতে হতে পারে জেনেও”


“বাহ আপনি মনে হচ্ছে জীবন সম্পর্কে ভীষণ অভিজ্ঞ”

“তা বলতে পারেন। ভবিতব্য আমাকে অভিজ্ঞতা দিয়েছে”

“আপনি ভবিতব্য মানেন?”

“কেন আপনি মানেন না বুঝি?”

“আমি এখন বুঝতেই পারিনা আমার কোন ভাবনাটা ভুল আর কোনটা ঠিক। উত্তর খুঁজতে চেষ্টা করেছি, পাইনি তাই ছেড়ে দিয়েছি”

ওদিকে দূরে তখন দীপা শরতকে বলছিল “কি গো তোমার কেমন মনে হচ্ছে জুটিটাকে?”

ওদিকে খেয়াল করে শরৎ বলল “মন্দ নয়”

“তাহলে দেখো না কথা এগিয়ে”

“কৌস্তভ কি রাজি হবে? যা ঘটে গেছে ওর জীবনে”

“আরে বাবা একবার বিয়ের পর স্ত্রী ছেড়ে চলে গেছে বলে বারবার একই ব্যাপার ঘটবে নাকি? তাছাড়া তুমি কি তোমার বোনকে চেন না। ও কত ভালো তা আমরা সবাই জানি”

“ঠিক আছে বলবো কথা, দেখি কি হয়”

   আজ চন্দ্রিমা কলকাতা ফেরত যাচ্ছে। ওর ছুটি শেষ। ট্রেনে চাপাতে ওরা সবাই এসেছে। কৌস্তভও। দুজনেই জেনেছে ওদের চার হাত এক করার কথা ব্যবস্থা করছে দাদা বৌদি। কেউই অরাজি নয়। ট্রেনে ওঠার পর টুং করে মেসেজ ঢুকলো চন্দ্রিমার মোবাইলে। দেখলো কৌস্তভ লিখেছে – আমরা দুজনেই জানি নিজেদের সম্পর্কে। তবু আমি তোমার সাথে নতুন সংসার করবো বলে আগ্রহে অপেক্ষা করছি। কবে আসবে তুমি?”   

 


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama