aftab hossain

Classics Others

3  

aftab hossain

Classics Others

ভাইরাল

ভাইরাল

7 mins
63



বলছি আপনার প্রোফাইল টা একটু বলুন দিকি ।

রায়বাবুর কথা শুনে অবাক চোখে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো লোকটা । 

রায়বাবু তাড়া দিলেন , আচ্ছা লোক তো মশায় আপনি , প্রোফাইল বোঝেন না । মানে কি করেন ? পলিটিক্যাল লিংক আছে কি না ? মানে ধরুন মাঝামাঝি মানের নেতা হলেও চলবে , ভিআইপি দের সাথে লিংক আছে ? নিদেনপক্ষে ওনাদের সাথে কয়েকটা সেলফি , কিংবা কোন MLA বা মিনিস্টার রেকমেন্ডেশন ।

 লোকটা আবার চুপ ।

রায়বাবু আর একটু ব্যাখ্যা করে বললেন বলছি বিদেশ গেছেন কখনো ? NRI ছাপ আছে ? বাড়ির কেউ বড় ডাক্তার না নামকরা ইঞ্জিনিয়ার আছেন ? বা ধরুন কবি . মানে রিলেটিভে কি কোন সেলিব্রিটি আছে ?

লোকটা আবার চুপ।

এবার রায়বাবু বিরক্ত । আরে দূর মশাই আপনি কালা নাকি ? আচ্ছা, ফেসবুক আইডি টা বলুন, দেখি ভেরিফায়েড আইডি কিনা , লেখা শেয়ার করেন তো নাকি ? তা ফ্যান ফলোয়ার কেমন আপনার । বলছি লাইক টাইক পড়ে ? শেয়ার হয় আপনার লেখা ? কত গুলো পেজে লেখা বেরোয় আপনার ? নিজের গ্রূপে ফলোয়ার আছে ? কমেন্ট টমেন্ট পড়ে ?? ওয়েব ম্যাগ গুলোতে রেগুলার লেখেন তো নাকি ।

লোকটা আবার ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে চুপ । 

রায়বাবু বিরক্ত হয়ে হাঁক পাড়েন কি রে কেষ্ট,, যাকে তাকে অফিসে ঢোকাস কেন ,, যত সব সময় নষ্ট । দাদা আপনি আসুন,,অনেক কাজ বাকি,,আসুন তো মশাই ।

লোকটা এবার আমতা আমতা করে বললো মানে কোন ভাবেই কি লেখা বের করা যাবে না ? রায়বাবু তাচ্ছিল্য করে বললেন :- "দূর মশাই আপনার তো কোন প্রোফাইলই নেই । অচেনা লোকের লেখা লোক পড়বে কেন " ? চোখ ছোট করে বললেন " 30 হাজার দিতে পারবেন ,ভাইরাল করে দেব আপনাকে "।

লোকটা আবার চুপ ।


লোকটা মানে আকাশ মুখার্জি । 10 বাই 9 এর খুপরিতে ছেলে বউ নিয়ে অশান্তির সংসার । অশান্তিরই বললাম , এত অশান্তি আগে ছিল না,,ভালোবাসার বিয়ে,, উদ্দাম আঠারোর আবেগের দিনে আকাশের প্রায় সব কিছু ভালোলাগা নিয়ে ওর হাত ধরেছিল কুর্চি । কুর্চি নামটাও আকাশের ই দেওয়া । ছেলে বিতান আসার সময় পর্যন্ত্য সম্পর্কটা বেশ ছিল । তারপর অভাবের কালো হাঁ সব সম্পর্ক গুলোকে কেমন যেন গিলে খেল । আকাশ গুণী ছিল কিনা সেটা কোনদিনও ভেবে দেখেনি কুর্চি,কিন্তু আকাশের সততা আর সারল্য কাছে টেনেছিল ওকে । আজ বিয়ের এত বছর পর কুর্চির মনে হয় কোথাও হয়ত একটা ভুল হয়ে গেছে । লোকটার সততা বা সারল্য টা ভন্ড ,আসলে লোকটা অলস আর ভীতু টাইপের । পরিবর্তনের নামে লোকটার গায়ে জ্বর আসে । সারাক্ষন বই মুখে গুঁজে বসে থাকলে সংসার চলে না এটা লোকটা বোঝে না । বিতানের মুখ চেয়ে চুপ থাকে । অন্য কেউ হলে কবে সংসার ছেড়ে চলে যেত । এখন কুর্চির একটাই স্বপ্ন বিতান টার কিছু একটা হোক ।


 " অভাব যখন চাওয়া পাওয়ার থেকে কম হয় তখন ভিখারী ও রাজা হয় " । এই প্রবাদ টা আকাশের জীবনের এক অমোঘ সত্যি । ছোট থেকে অভাবের সংসার আকাশ কে অতটা আঘাত দেয়নি যতটা না আঘাত করতো ওর না পারা নিয়ে সমাজের খিল্লিকে । নাঃ আকাশ কিচ্ছু পারতো না , মানে যেগুলো পারলে সমাজ ওকে মনে রাখবে সেগুলোর প্রায় কিছুই আকাশ কোনদিনও পারেনি । আকাশ কোন হোমড়া চোমরা ক্লাবের মেম্বার ছিল না, না ক্রিকেট বা ফুটবল টিমের ক্যাপ্টেন না স্টেজ পারফর্মার , আর পড়াশোনা ,,টিউশন ছাড়া পাশ করে যেত কোনরকমে । তবে আকাশ কবিতা লিখতো , গল্প বুনতো । যে কবিতা কেউ পড়েনি , আকাশ ও কাউকে পড়ায় নি । সারাদিন ফ্যাক্টরির কালো ঘামে নিজেকে নিগড়ে যখন রাতের কালো হাতগুলো ওকে ভবিষ্যতের ভয় দেখাতো তখন আকাশ আর ওর লেখাগুলো দিস্তা খাতায় জীবন্ত হয়ে জীবনের প্রতিটা বাস্তবকে কল্পনার চাদরে জড়িয়ে ওম নিত সুখের । কুর্চিকে নিয়েও লিখেছিল জীবনের প্রথম অনু কবিতা " ইচ্ছে " । ওর ব্যাগে চুপ করে ফেলেছিল চিরকুট টা ,,


" ইচ্ছে টা ছিল সুযোগ হয়নি ।

এক থেকে মুহূর্তে একশ দেখার ইচ্ছে ছিল ।

এক থেকে দোকা হয়ে হারানোর ইচ্ছে ছিল ।

কাঁধে নির্ভরতা খোঁজার হাতকে উড়িয়ে নিয়ে যাবার ইচ্ছে ছিল ।

মেঠো ধুলোয় নিজেকে ঝাপসা দেখার ইচ্ছে ছিল ।

পাহাড়ী রাস্তায় চুপিসারে বৃষ্টি ভেজার ইচ্ছে ছিল ।

পেট্রল পোড়া গন্ধে নিকোটিনের গন্ধ মেলানোর ইচ্ছে ছিল ।

 ইচ্ছে কি জানে ? "

 

 উত্তরটা কুর্চি দিয়েছিল জীবনসঙ্গী হয়ে , কি মধুর ই না ছিল দিনগুলো,,এখন সাধ্যগুলো সব একই আছে ইচ্ছেটাই শুধু নেই । কুর্চিকেও দোষ দেয়না আকাশ , ব্যর্থ স্বামী নিয়ে সংসার করা সহজ নয় । আকাশের ও চাওয়া পাওয়া কোন দিনও ছিল না ,,আজও নেই । শুধু দিস্তা খাতায় স্বপ্নগুলো বেড়েই চলতো, পাতার পর পাতা,দিস্তার পর দিস্তা ।



প্রিন্টিং প্রেসের মালিক যেদিন প্রুফ রিডার রায়বাবুকে কোরাল ড্র বা এডোব ফটোশপের কাজ শিখতে বলেছিল সেদিনই মাথায় আকাশ ভেঙেছিল , সারা জীবন হাতে কালি লাগিয়ে কাজ করা আর বানান ভুল ধরা প্রিন্টিং এর মানুষ রায়বাবু । দুম করে কম্পিউটার শেখা তাও আবার যেগুলো কখনো নাম শোনেনি সেগুলো কে শেখা অসম্ভব রায়বাবু তা জানতো । মারওয়ারি মালিক বলতো " বেওসা চেঞ্জ হচ্ছে রায়বাবু ,সোব কম্পুটারিজ হবে , না শিখলে আগে বাড়বে কি করে " । চাকরিটা হারাবে এটা জেনে আর পোয়াতি বউ টার ভবিষ্যৎ এর চিন্তায় যখন বাজারে ফলিডলের খোঁজে রায়বাবু ব্যস্ত তখন কেস্টর সাথে আলাপ । কেস্টর আসল নাম কি কেউ জানে না , সবাই কেষ্ট দাস নামেই চেনে । "লেখালিখি" বলে একটা অনলাইন ফেক publication চালায় বেনামে , সোস্যাল মিডিয়ায় মাতাল,প্রেমে ধোঁকা খাওয়া,সাপ ব্যাঙ আগডুম বাগডুম লেখা গুলোকে ফলস পাবলিসিটি দিয়ে লেখার রিচ বাড়ায় । তারপর শখের কবিদের লেখা বই করে ছাপাব বলে হাজার হাজার টাকা ডোনেশন নেয় । ভালো ব্যবসা , রায়বাবুকে পার্টনার শিপের কথা বলতেই রায়বাবু রাজি , এখন দুজনের যৌথ ব্যবসা ,, ইনভেস্টমেন্ট বলতে একটা এন্ড্রয়েড স্মার্ট ফোন,একটা কম্পিউটার ,কয়েকশ ফেক সোশ্যাল একাউন্ট,,। ফাস্ট্রু খাওয়া হযবরল লেখা গুলোকে নিপুণ হাতে রায়বাবু বেছে নেয় , কেষ্ট হাজারখানেক লাইক আর শেয়ার করে সোশ্যাল মিডিয়ায়,,তারপর দম দেখে একদিন ফোন করে লেখক বা লেখিকাকে , সেটাও পোর্টফোলিও দেখে ডিমান্ড,,ওনাদের টার্গেট ক্ষেত্র একটু অন্যরকম বেশিরভাগই গৃহবধূ যেমন বড় সরকারি নেতার বউ ,ডাক্তারদের বউ ,ইঞ্জিনিয়ারদের বেকার বউ , সরকারি অফিসারদের বউ কিংবা NRI দের বউ । শুধু গৃহবধুই নয় আছে ফাস্ট্রেডেট যুবসমাজ আর বাউন্ডুলে বড়লোক আর তাদের সুপুত্ররা । প্ৰথমে ওনাদের প্রতিভার মেকি প্রশংসা তারপর ডিমান্ড আর ডিমান্ড পেলেই একটা ভুলভাল প্রিন্টিং সেন্টার থেকে একটা বই আর বই বেরোলেই হাজারটা ফেক একাউন্ট থেকে কয়েকশ শেয়ার,,মালিক আর ক্ল্যায়েন্ট দুজনেরই প্রফিট আর দুজনেই খুশ । মানে পুরো সোশ্যাল মিডিয়া নির্ভর লেখার মাফিয়া নেটওয়ার্ক , 

"ফেল কড়ি ছাপ লেখা ,প্রতিভা কি আর যায় দেখা " ।


ডুবন্ত শিল্প রাজ্য পশ্চিমবঙ্গে ইউনিয়ন বাজিতে অনেকে ছাঁটাই হবার পরেও পুরোনো লোক হিসেবে আকাশ কে রেখে দিয়েছিল কোম্পানি । শুধু ভালো কর্মীর জন্য নয় ,এই ফ্যাক্টরির সব সাংস্কৃতিক অনুষ্টানের লেখা লেখির সব কাজ এতদিন আকাশই করে এসেছে । সে ফ্যাক্টরির উদযাপন দিবস হোক বা শ্রমিক দের মে দিবস ,লেবার ইউনিয়নের নেতা হোক বা কোম্পানির অবাঙালি ইঞ্জিনিয়ার,সবাই শুধু একবার বলে দিত আকাশ দা কাল ভাষণ দিতে হবে ,একটু লিখে দিও তো । ব্যাস আকাশ নিজের ভঙ্গিতে সাবলীল ভাবে লিখে দিত । স্টেজে ওর লেখা অন্য কেউ পড়ে যখন হাততালি তে পুরো মঞ্চ টা ভেসে যেত তখন একবারও কেউ ওর নাম উচ্চারণ না করলেও আকাশ নিজের থেকেই খুশি হত, এতদিন এটাই চলছিল । এবারের রবীন্দ্র জয়ন্তীতে আকাশকে কেউ কিছু না বলায় খানিকটা অবাক হয়েছিল,,অনুষ্টানের দিন শুনলো ফ্যাক্টরির নতুন জয়েন করা এক ফিটার ওয়ার্কার নাকি সব লেখালেখি করছে । প্রোডাকশনের জমাদারবাবুকে জিজ্ঞেস করাতে জানলো নতুন ছেলেটা নাকি সোশ্যাল মিডিয়ায় সেনসেশন । ইদানিং নাকি কি সব ব্যাপারে ভাইরাল হয়েছে । ফ্যান ফলোয়ার ও নাকি অনেক । তাই এবার ম্যানেজার বাবু ওকে দায়িত্ব দিয়েছেন । এই সব অত্যাধুনিক ভাষাজ্ঞান বা উন্নত প্রযুক্তির কোনটাই আকাশের কোনদিনও ছিল না । আর ইন্টারনেট টা এখনো গরিবের কাছে আলাদিনের প্রদীপ । আঘাতটা লেগেছিল ,, কুর্চিকে এগুলো বলেও লাভ নেই । বাড়ি ফিরে রাতের কালো অন্ধকারে চোখের জল লুকিয়ে বাঁধাই করা লেখাবোঝাই দিস্তা খাতাটা বুকে চেপেই শুয়ে পড়েছিল । 



"লেখালিখি" পাবলিকেশন এর খবর টা ফ্যাক্টরির নতুন ছেলেটাই আকাশকে দিয়েছিল । নিজে থেকেই এসে বলেছিল কাকা তোমাদের ওই পুরোনো খাতা কলমে লেখা আর চলে না,, আজকাল জো দিখতা হে ওহি বিকতা হে । নতুন নতুন পেজে মিউজিক দিয়ে লেখা ইন্টারনেটে বেরোয় কাকা,, পাবলিক ওটাই খায় । ঠিকানা নিয়ে বুকে সাহস করে কেষ্ট দাসের অফিসে এসে হাজির হয়েছিল আকাশ।যদি তার সারাজীবনের লেখা গুলো ইন্টারনেটে দেওয়া যায় । তারপর ওপরের ওই আলাপচারিতা । রায়বাবুর কাছ থেকে প্রশ্নগুলো শুনে বাড়ি ফেরার পথে কুর্চির জন্য প্রেসার এর ওষুধটা একপাতা বেশি কিনলো । সাথে একটা পঞ্চাশ টাকার স্ট্যাম্প পেপার । ওদের যাতে উইল নিয়ে কোন অসুবিধা না হয় ।


আজ বিতান জয়েন করলো । বাবা সুইসাইড করার পর মাকে নিয়ে দাঁত চেপে লড়ে আজ বিতান বড় সরকারি আধিকারিক । পুরোনো ঘর ভেঙে নতুন ঘর হয়েছে । বাবার দিস্তা মার্কা খাতাটা এপর্যন্ত কয়েক হাজার বার ওর পড়া । প্রায় সব লেখাগুলো ই ওর মুখস্ত । বিশেষ করে শেষ কয়েকটা লাইন

 " প্রীয় কলম ,

 সবাই জানবে আমি আত্মঘাতী ভীরু ,

কিন্তু আমি জানি তুমি খুনি ।" 


এই দিনটার জন্য বিতান অনেক দিন অপেক্ষা করছে । এখন গভীর রাত । ফেসবুক প্রোফাইলে বিতান JOB প্রোফাইল টা UPDATE দিল । সাথে দপ্তরের মন্ত্রী আমলাদের সঙ্গে কয়েকটা সেলফি নেওয়া পোস্ট । তারপর

 দশ বছর ধরে অপেক্ষা করা দুটো ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠালো 

একটা কেষ্ট দাস কে আর একটা রায়বাবুকে । সাথে

 " লেখালিখি " পেজে একটা মেসেজ 

" অনেকগুলো লেখা ভাইরাল করতে চাই , যা লাগে দেব " ।













Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics