বেলাশেষে
বেলাশেষে
কয়েকদিন ধরেই ঠান্ডাটা বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে। তবে প্রতিবছরের মতো এই বছরও আজকের দিনটা শ্রী বেলাশেষে বৃদ্ধাশ্রমেই কাটাবে ঠিক করেছে। জীবনের শেষবেলায় পৌঁছে যাওয়া মানুষগুলোকে অনাবিল আনন্দ উপহার দেওয়ার জন্যেই ও শহর থেকে দূরে একটু নিরিবিলিতে এই বেলাশেষে বৃদ্ধাশ্রমটা বানিয়েছিল। সব জিনিস নিয়ে ও বেরিয়ে পড়লেও পৌঁছাতে ওর একটু দেরী হয়ে যাবে আজ। তাড়াতাড়ি না পৌঁছলে মানুষগুলো না খেয়ে ওনাদের সবার আদরের নাতনি শ্রীতমা ওরফে শ্রীর জন্য অপেক্ষা করবে এটা ভেবেই ওর খারাপ লাগছে। এইসব ভাবতে ভাবতে ওর চোখটা সবে একটু লেগেছিল। হঠাৎ ওর ড্রাইভার জোরে ব্রেক কষায় ও জিজ্ঞেস করল- কী হল?
-দিদিমণি, একজন বয়স্ক মানুষ হঠাৎ গাড়ির সামনে চলে এসেছিল।
-সেকি! চলো, নেমে দেখি ওনার কোথাও লেগেছে কিনা।
ওরা গাড়ি থেকে নেমে দেখল মানুষটি রাস্তায় বসে আছে। ওরা ওনাকে সামনের একটা চায়ের দোকানে বসিয়ে চোখেমুখে জল দিল।
-আপনি ঠিক আছেন?
-হ্যাঁ রে মা, আমি ঠিক আছি।
-আপনার বাড়ি কোথায় বলুন আমি আপনাকে দিয়ে আসছি।
-এখন তো আমার যাওয়ার বলতে একটায় জায়গা আছে, ওই পরপারে।
ওনার কথা শুনে শ্রী বুঝতে না পেরে আবার জিজ্ঞেস করে- আপনার বাড়ি...
-(ওকে মাঝপথে থামিয়ে দিয়ে) সবাই যেমন আগাছা ছেঁটে ফেলে তেমনি আমাকেও ছেঁটে ফেলেছে।
শ্রী বুঝতে পারে এই মানুষটার প্রকৃত আপনজন বলতে কেউ নেই। তাই ও ঠিক করে ওনাকেও বেলাশেষেতে নিয়ে যাবে। তাই ও বলে- আপনি আসুন, আমার গাড়িতে ওঠুন।
-কোথায় নিয়ে যাবি রে মা?
-মা বলে যখন ডেকেছেন তখন একটু ভরসা রাখুন।
-আচ্ছা চল।
ওরা গাড়িতে উঠে আবার রওনা দেয় ওদের গন্তব্যের দিকে। যথাসময়ে ওরা পৌঁছেও যায়। নতুন বছরে নতুন একটা পরিবেশে এসে নির্মলবাবুও খুব খুশি। ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে খুব পরিচিত একজনকে সামনে থেকে আসতে দেখে নির্মলবাবু হঠাৎ দাঁড়িয়ে পড়েন। এতবছর পর জীবনের প্রথম ভালোবাসার মানুষটাকে এখানে দেখতে পাবেন সেটা উনি আশা করেননি। ওনাদের দুজনের কাছ থেকে শ্রীতমা জানতে পারে এইরকম একটা শীতের সকালই ওনাদের প্রেমের সাক্ষী ছিল। আজও সেই শীতের সকালই এতদিন পর এই দুজন ভালোবাসার মানুষকে আবার মিলিয়ে দিলো। শ্রী মনে মনে ভাবে-সব ভালোবাসাই বিয়ের পূর্ণতা পায় না, কিছু ভালবাসা থাকে যা শুধু বেলাশেষে শান্তি এনে দেয়। নতুন বছরে নতুন ছন্দেই না হয় শুরু হোক ওনাদের জীবন। এই শীতের আমেজেই না হয় ওনাদের প্রথম প্রেম আবার ফিরে পাক পুরোনো সজীবতা। নির্মলবাবুর অনুরোধে সুষমাদেবী আজ বহুদিন পর আবার গান ধরেন,
" আমার পরান যাহা চায়
তুমি তাই, তুমি তাই গো
আমার পরান যাহা চায়।..."
গান আর খাওয়া-দাওয়ায় জমে ওঠে ওদের নতুন বছরের সকালটা। চারপাশে শীতল বাতাস বইলেও ওদের মধ্যে ভালোবাসার সম্পর্কের উষ্ণতার ছবিগুলো ধরা থাকে শ্রীতমার মুঠোফোনের ক্যামেরায়।