বেলা শেষের ভালোবাসা
বেলা শেষের ভালোবাসা


"হ্যালো, হ্যাঁ লোপা ,তোর সঙ্গে আমার কিছু কথা আছে।এখন সময় আছে তো তোর।"
"আপাতত ফ্রি আছি। বলো কি বলবার আছে।আর একটু ছোট্ট করে বলবে মা প্লিজ"।
"হ্যাঁ জানি তো, তুই খুব ব্যস্ত। সেজন্যই তো এই সন্ধ্যে বেলায় ফোন করলাম তোকে"।
"উফ্ মা, বড্ড বাজে বকবক করো তুমি। সোজা কথাটা সোজাভাবে বললেই তো হয়।এত দেরি কেন করছো বুঝতে পারছি না।"
"বলছিলাম একবার আসতে পারবি বৃদ্ধাশ্রমে। একটু কথা ছিল তোর সঙ্গে"।
"না মা পারবো না এখন যেতে। অনেক কাজ।অফিস,ঘর সব সামলে এখন তোমার কাছে যাওয়া, জাস্ট ইম্পসিবল।আর তাছাড়া বোঝার চেষ্টা করো মা ,আমি তোমার মতো ফ্রি বসে নেই সারাদিন"।
"আচ্ছা ঠিক আছে"।
ফোনটা নামিয়ে রাখলেন নমিতা দেবী। চোখের কোণে কি একটু জল চিকচিক করছে?বোধহয়।
নমিতা দেবীর বয়স ৬৫। স্বামী একবছর আগে মারা গেছেন। একমাত্র মেয়ে লোপা তাই বাবার সমস্ত ঘরবাড়ি বিক্রি করে দিতে বলে তার মাকে। কারণ সে নিজের সংসার, চাকরি এইসব ছেড়ে মাকে সময় দিতে পারবে না এতো দূরে এসে।আর তাই এই ব্যবস্থা। স্বামীর ভিটেমাটি ছেড়ে চলে যেতে হবে মেয়ের ওখানে। শান্ত স্বভাবের নমিতা দেবী প্রথমটায় রাজী হননি। কিন্তু মেয়ের জেদের কাছে শেষমেশ হার স্বীকার করেছেন। কিন্তু কি হলো এতে? মেয়ের বাড়িতে নিজেকে নাকি মানিয়ে নিতে পারছেন না তিনি। এমনটাই মেয়ের বক্তব্য ছিল।আর কিই বা করতেন তিনি।সবসময় তো ভয়ে কাঠ হয়ে থাকতেন । কখন কি ভুল হয়ে যায়।মেয়ে এখানে আসার পর স্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছিলো..জামাই, নাতি, নাতনি অপছন্দ করে এমন কোনো কাজ যেন তার মা না করে। মনে মনে সব মেনে ও নিয়েছিলেন।এমন কোনো কাজ তিনি করতেন ও না। সন্ধ্যের পর সবাই যখন ঘরে চলে আসতো, আড়ষ্ট হয়ে থাকতেন তিনি। নিজের জন্য বরাদ্দ ছোট্ট ঘরটিতেই বসে থাকতেন চুপ করে। এখানে আসবার সময় মেয়েকে কত করে বলেছিলেন টিভিটা নিয়ে আসবার জন্য । কিন্তু মেয়ে কিছুতেই রাজি হলো না। বললো ওদের ওয়েল ডেকরেটেড ঘরের সঙ্গে নাকি এই টিভি একেবারেই বেমানান।অথচ নমিতা দেবীর স্পষ্ট মনে আছে, এই মেয়ের আবদারেই ঘরে এই কালার টিভি টা কেনা হয়েছিল বলে, ওর বাবা বা তিনি নিজেও কোনদিন এই টিভি পাল্টে অন্য টিভি কেনার কথা স্বপ্নেও ভাবেননি। আসলে মা বাবার মধ্যে যে ইমোশন টা কাজ করে, সন্তানদের কাছে তার কোনো মূল্য ই নেই। এখানে আসার পর নমিতা দেবী দেখেছেন, ড্রইং রুমে টিভি দেখতে দেখতে কতো নিজেদের মধ্যে গল্প করতো ওরা সবাই। নমিতা দেবী র খুব ইচ্ছা করতো এক একদিন ওদের কাছে গিয়ে বসে, ওদের সঙ্গে নিজেও গল্প করে। কিন্তু মেয়ের কড়া নির্দেশ, যেন ওদের কথাবার্তায় তিনি কোনো ভাবেই কোনো মন্তব্য না করেন। অতঃপর কি আর করবেন। চুপ করে ঘরেই বসে থাকতেন।
মাঝে মাঝে নমিতা দেবীর মনে হত ,এর থেকে তো তিনি একা নিজের স্বামীর ভিটেতে থাকলেই ভালো করতেন। কতোবার লোপাকে বলেছিলেন সে কথা। কিন্তু জেদী লোপা মায়ের কোনো কথাই শোনে নি। নমিতা দেবীর স্পষ্ট মনে আছে যে ছ সাত মাস তিনি ছিলেন মেয়ের বাড়িতে, এক দিনের জন্য ও তিনি মন খুলে কথা বলতে পারেন নি কারুর সঙ্গে। সবসময় ভয় হতো, এই না কিছু ভুল ত্রুটি হয়ে গেল। আসলে এখনকার জেনারেশন এ সবকিছু ই মেপে মেপে করতে হয়। চেষ্টা করেছিলেন ও তো সেটা করবার। কিন্তু শেষরক্ষা হলো কই। সেই তো শেষ আশ্রয় এই বৃদ্ধাশ্রম ই হলো।
আর সেদিন বিকালে কি হয়েছিল সেটা কি মরবার আগে পর্যন্ত ভুলতে পারবেন নমিতা দেবী। মেয়ের এখানে আসার পর তিনি নিজেই রান্নার দায়িত্ব নিতে চেয়েছিলেন। মনে মনে ভেবেছিলেন, আহা মেয়েটা সারদিন বাইরে কাজ করে। ঘরের এই কাজ টা করে দিলে মেয়েটার একটু উপকার হবে।আর শুধু তো এই কজনের রান্না করা। ঘরের কাজের জন্য সর্বক্ষণের একটি মেয়ে আছে। তাই কোনো অসুবিধা হয় না।আর তিনি তো বরাবরই সবাইকে রান্না করে খাওয়াতে ভালোবাসেন।আর এতো নিজের নাতি, নাতনি, মেয়ে,জামাই।এরা তো আপনজন। সেদিন সকাল থেকেই শরীর টা ঠিক ভালো লাগছিলো না তার।তাও সকলের জন্য খাবার বানিয়ে রেখেছিলেন। কাজের মেয়েটিকে বলে রেখেছিলেন, কেউ এলে যেন দরজা খুলে দেয়। আর নিজে ড্রইং রুমের সোফাটায় একটু শুয়ে পড়েছিলেন।কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছেন , নিজেও জানেন না।
হঠাৎই চিৎকার চেঁচামেচিতে ঘুম টা ভেঙ্গে গেল। চোখ খুলে দেখলেন নাতনি দাঁড়িয়ে আছে সামনে। সঙ্গে কিছু বন্ধু বান্ধব।আর নাতনি তার দিকে তাকিয়ে বলছে,"তোমার একটা ম্যাক্সিমাম কমন সেন্স নেই দিদুন। এভাবে ড্রইং রুমের সোফাতে শুয়ে আছো। অতই যদি ঘুম পেয়েছে, নিজের রুমে গিয়ে শুতে। সত্যি তুমি পারো দিদুন"। নমিতা দেবী খুব অপ্রস্তুত হয়ে গিয়েছিলেন , নাতনির এই ব্যবহারে। তাড়াতাড়ি উঠে নিজের ঘরে চলে গিয়েছিলেন। এতেই শেষ হয়নি। মেয়ে ,জামাই অফিস থেকে ফিরে , নিজেদের মেয়ের কাছে সব শুনে ,যা নয় তাই শুনিয়েছে নমিতা দেবীকে। সবাই শুধু এটাই দেখলো যে, সোফায় কেন শুয়েছে, নিজের ঘরে কেন শোয়নি।কেউ একবার ও এটা জানতে চাইলো না , কোনোদিন যে মানুষটা ওখানে শোয় না।আজ তার কি এমন হয়েছিল যে , ওখানে শুয়ে ছিলো।কেউ একবার ও জানতে চাইলো না তার শরীর ঠিক আছে তো। খুব কষ্ট হচ্ছিল সেদিন । নিজেকে খুব অসহায় মনে হচ্ছিল।জামাই, নাতি, নাতনি সকলের কথা না হয় ছেড়েই দেওয়া হলো। কিন্তু তার মেয়ে, নিজের গর্ভজাত সন্তান, সে ও তো একবার জিজ্ঞেস করতে পারতো তার মাকে।
না আজ আর এসব পুরানো কথা মনে করে মনখারাপ করবেন না নমিতা দেবী।এখন তো আর তিনি একা নন।এখন তো তার সঙ্গে আছে কেউ। এবার সেই ঘটনায় আসা যাক, যা এই বৃদ্ধ বয়সেও নমিতা দেবীর জীবনকে আমুল পরিবর্তন করে দিতে পেরেছিল।....
লোপা যেদিন তার মা অ্যাডজাস্ট করতে পারছে না বলে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে গিয়েছিল, সেদিন নমিতা দেবীর মনে হয়েছিল,এই দিনটার জন্যই কি বাবা, মা তাদের সন্তানদের বড়ো করে। খুব কষ্ট হয়েছিল সেদিন। রেখে যাবার সময় লোপা বলে গিয়েছিল, যখন তখন ফোন যেন না করে।ও নিজেই খবর নিয়ে নেবে। কতো বার লোপাকে বলেছিলেন, একটা ছোট ফোন দিতে। যদি কখনো কোনো দরকার হয়। কিন্তু মেয়ে স্পষ্ট বলে দিলো, দরকার নেই। প্রয়োজন হলে ও নিজেই খবর নিয়ে নেবে। আর সেরকম দরকার হলে তো বৃদ্ধাশ্রমে ও একটা ফোন আছে। আর ঠিক সেই বিশেষ দরকারে ই তো ফোনটা করেছিলেন লোপাকে। ডেকেছিলেন একবার দেখা করবার জন্য, কিছু বলবার জন্য। কিন্তু মায়ের জন্য সময় নেই মেয়ের হাতে।
সেদিন বিকেলে মনমরা হয়ে বসেছিলেন বাগানে। আনমনা হয়ে তাকিয়ে ভাবছিলেন পুরানো দিনের কথা। হঠাৎই পিছন থেকে কেউ ডাকলো,"মিতা তুমি এখানে কি করছো?"এতদিন পর এই নামে তাকে কে ডাকলো। চমকে পিছন ফিরে তাকালেন নমিতা দেবী। তারপর যাকে দেখলেন, তাঁর সঙ্গে দেখা হয়েছিল আজ থেকে বহু বছর আগে। চেহারায় একটু ভারিক্কি ভাব এসেছে, মাথার চুলগুলো প্রায় সব ই সাদা, চোখে হাই পাওয়ারের চশমা। কিন্তু সব ছাপিয়ে তাঁর অসাধারণ ব্যক্তিত্ব। যা চল্লিশ বছর আগেও একই রকম ছিলো। অবাক হয়ে তাকিয়ে ছিলেন নমিতা দেবী।মুখ থেকে শুধু একটাই কথা বের হলো, "অমর দা তুমি?" তাঁর বান্ধবী চিত্রার দাদা ছিলো অমর। পড়াশোনা র জন্য চিত্রা ও আসতো নমিতা র বাড়িতে, আর নমিতা ও যেতো চিত্রা র বাড়িতে। সেখানেই প্রথম দেখা হয় অমরের সঙ্গে। চিত্রা ই প্রথম আলাপ করিয়ে দিয়েছিলো দুজনের। দুজনেরই একে অপরকে ভালো লেগেছিল প্রথম দেখাতেই। তারপর থেকে তো মাঝে মাঝে ই দেখা হতো। ধীরে ধীরে দুজনের কথাবার্তা ও শুরু হয়েছিল। কিন্তু ওই পর্যন্তই। তারপর তো উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার পর ই নমিতা র বিয়ে হয়ে গিয়েছিল।আর কোনো যোগাযোগ ও হয়নি। দুজনের সেই ভালোলাগা টা আর ভালোবাসা পর্যন্ত পৌঁছাতে পারেনি।তার আগেই দুজনে আলাদা হয়ে গিয়েছিল। একটা ভালোবাসা শুরু হতে না হতেই শেষ ও হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সত্যিই কি তাই?
আজ দীর্ঘ চল্লিশ বছর পর তাহলে কি এভাবে দেখা হতো দুজনের?
আজ এতদিন পর দুজনের যে এরকম একটা জায়গায় দেখা হবে, তা তাদের কল্পনারও অতীত ছিল। প্রত্যেক দিন দুজনে কতো সুখ দুঃখের কথা গল্প করে।অমর নমিতাকে নিজের জীবনের গল্প বলে। কিভাবে তার ছেলে বউ এর সংসারে সে একজন বাড়তি মানুষে পরিণত হয়েছে দিনের পর দিন। কিভাবে তাঁর স্ত্রী মারা যাবার পর একা ছেলেকে মানুষ করেছেন। তিনি নিজের সব দায়িত্ব পালন করেছেন। ছেলেকে তিনি ছেলের বিয়ের আগে বলেও ছিলেন যে, যেন কোনো বৃদ্ধাশ্রমে ওনাকে রাখার ব্যবস্থা করে। কারণ উনি জানতেন এই কথাটা যে, আজকালকার মেয়েরা একটু আলাদা, তাদের মানসিকতা ও আলাদা। সবাই ছোট সংসারে থেকে অভ্যস্ত। তাই সবাইকে নিয়ে মানিয়ে গুছিয়ে থাকতে তাদের অসুবিধা হতেই পারে। এটাই স্বাভাবিক।আর তাতে ওনার কোনো অভিযোগ ও ছিলো না ছেলের বউ এর প্রতি। কিন্তু তখন ছেলে কিছুতেই রাজি হলো না।অথচ বিয়ের পর সেই ঘটনাটাই ঘটলো। যদিও তাতে কোনো আক্ষেপ নেই ওনার।
এইভাবেই প্রতিটা দিন ওরা দুজন একে অপরের সাথী হয়ে উঠেছিল সুখ, দুঃখ, হাসি, কান্নার।একে অপরের বেঁচে থাকার অবলম্বন হয়ে উঠেছিল।আর হয়তো তাই যে কটা দিন বেঁচে থাকে, যাতে আরও ভালো করে বাঁচতে পারে, সেইজন্যই হয়তো দুজনে মিলে এই সিদ্ধান্তটা নিয়েছিল । আসলে ওরা দুজনে ই তো দুজনের পরিবারের কাছে বাড়তি সদস্য। ওদের ছেলে মেয়েরা কেউই চায়না ওদের নিজেদের সংসারে। আর সেজন্যই ওরা দুজন পরিণত বয়স্ক মানুষ একে অপরের সঙ্গে থাকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। অমর বাবু তো এটাও ঠিক করে ফেলেছেন যে ডায়মন্ড হারবার এ ওনার যে বাড়ি আছে, সেখানেই ওরা দুজন একসঙ্গে থাকতে পারবেন। একটা ছোট বাগান ও আছে সেখানে। নিজেদের মতো এই বয়সে একটু গাছপালা লাগাবে।আর অমর বাবুর পেনশনের টাকায় মোটামুটি ভালো ভাবেই চলে যাবে দুজনের।
আর ঠিক এই কারণেই নমিতা দেবী মেয়েকে ফোন করেছিলেন আজ। নিজের সিদ্ধান্তটা মেয়েকে জানাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু মেয়ে তো আসতেই চাইছে না এখানে। মাকে শুধু রেখে গিয়েই তার সব দায়িত্ব শেষ। কিন্তু মেয়েকে তো কোনো ভাবে জানাতেই হবে তাঁর এই সিদ্ধান্ত। আর তাই পরের দিন আবার ফোন করলেন তিনি মেয়েকে। মেয়ে তো ফোন ধরেই শুরু করলো আবার মাকে হাজার কথা শোনানো। নমিতা দেবী তখন বললেন,"আর যাতে তোকে কখনো বিরক্ত না করতে হয়, সেজন্যই ডাকছি তোকে"। ফোনের ওপাশ থেকে মেয়ের
জিজ্ঞেস করল,"এর মানে কি? তুমি বলতে কি চাইছো মা?"নমিতা দেবীর নিস্পৃহ উত্তর,"সেইজন্যই তোকে ডাকছি তো।"মেয়ে বললো,"ঠিক আছে, কাল যাচ্ছি ।এখন রাখো। অনেক কাজ আছে।"
পরের দিন অফিস যাবার পথে লোপা এলো। তারপর মায়ের কাছে গিয়ে বললো,"কাল সারারাত টেনশনে ঘুমাতে পারিনি।কি বলতে চাইছিলে কাল তুমি?"নমিতা দেবী বললেন, "দাঁড়া তোর সঙ্গে একজনের আলাপ করিয়ে দি। খুব ভালো মানুষ।" লোপা এবার বিরক্তি প্রকাশ করে বললো,"মা আমি অফিস যাবার পথে তোমার সঙ্গে দেখা করতে এসেছি।অত ভণিতা না করে সরাসরি বলো কি বলতে চাইছো।" নমিতা দেবী আর লোপার কথার মধ্যেই অমর বাবু এসে পড়লেন।গত কাল ই নমিতা দেবী বলে রেখেছিলেন যে তার মেয়ে আসছে।অমর বাবু এসে নিজেই লোপাকে বললেন,"তুমি লোপা তাই তো? তোমার মায়ের কাছে তোমার কথা অনেক শুনেছি।"লোপা প্রত্যুত্তরে নমস্কার করলো হাত জোড় করে। নমিতা দেবী মেয়েকে বললেন,"এনার কথাই তোকে বলছিলাম"। লোপা আবার ও বিরক্তি প্রকাশ করে বললো,"প্লিজ মা, বেশি ভণিতা না করে বলো তাড়াতাড়ি। আমার কাজ আছে।"মেয়ের এই ব্যবহারে নমিতা দেবী অপ্রস্তুত হয়ে গেলেন, অমর বাবুর সামনে। ব্যাপারটা বুঝতে পেরে অমর বাবু নিজেই বললেন, "আমি বলছি লোপা। আসলে তোমার মা বলতে সংকোচ বোধ করছেন তোমাকে।সেরকম মা মেয়ের বন্ধুত্ব পূর্ণ সম্পর্ক তো তোমাদের না। থাকলে হয়তো এতটা সংকোচ বোধ করতেন না উনি।"লোপা এবার আরো বিরক্তি দেখিয়ে বলল," উনি যখন বলতেই পারছেন না, আপনিই বলুন তাহলে। এই কদিনে তো মায়ের বেশ শুভাকাঙ্ক্ষী হয়ে উঠেছেন আপনি।"অমর বাবু বললেন, "শুভাকাঙ্ক্ষী। হ্যাঁ তা বলতে পারো। তবে এই কদিনে আমরা একে অপরের আশ্রয় হয়ে উঠেছি ।তার থেকেও বেশী একে অপরের ভালো বন্ধু হয়ে উঠেছি।আসলে তোমার মা আর আমি একে অপরকে অনেক দিন আগে থেকেই চিনি। এখানে আসার পর দুজনেই দুজনকে দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। আমরা দুজনে ই নিজেদের ছেলে মেয়ের সংসারে বাড়তি একজন মানুষ। সেকারণে ই তো তারা আমাদের এখানে রেখে গেছে।আর তাই আমরা দুজন সিদ্ধান্ত নিয়েছি, যে কটা দিন বেঁচে থাকবো, একে অপরকে অবলম্বন করে বেঁচে থাকবো। তোমার মা ও এই বয়সে সঙ্গীহীন, আর আমি ও তাই। এবার বুঝতে পারলে তো লোপা , তোমার মা তোমাকে কেন ডেকেছিলেন এখানে।"
লোপা সব কথা শোনার পর রাগে দিশাহারা হয়ে বললো,"মা তোমার লজ্জা করছে না।এই বয়সে এরকম একটা সিদ্ধান্ত নিতে। একবারের জন্যও ভাবছো না যে আমার সম্মান টা কোথায় থাকবে আমার শ্বশুর বাড়িতে। ছিঃ মা! তুমি যে এই বয়সে এরকম একটা কাজ করবে, সেটা কোনো দিন ভাবতে পারিনি আমি।"হঠাৎ পিছন থেকে একটা পুরুষালি কন্ঠের আওয়াজ শুনে লোপা চমকে পিছন ফিরে তাকালো,"কেন ভাবতে পারছেন না লোপা দেবী। আমরা তো নিজেদের বাবা মাকে আমাদের লাইফ থেকে একপ্রকার বিতাড়িত করে দিয়েছি। খোঁজ ও নিতে পারিনা সবসময়। দেখা করা তো অনেক দূরের কথা। ওঁরা নিজেদের বাড়ি থেকে, ছেলে মেয়ে দের লাইফ থেকে বিতাড়িত হয়েই আছে। আর তাই ওঁরা যদি এই বয়সে নিজেদের মতো করে বাঁচতে চায় একে অপরকে অবলম্বন করে, আমাদের তাতে বাধা দেবার কোনো অধিকার নেই লোপা দেবী।"কথাটা অমর বাবুর ছেলে জয়দীপ এর। আসলে অমরবাবু ও আজ নিজের ছেলেকে ডেকেছিলেন সব কথা বলবার জন্য। লোপার পিছনেই জয়দীপ ও ছিলো।আর তাই ওদের সমস্ত কথোপকথন জয়দীপ শুনেছে। আর জয়দীপের এ ব্যাপারে কোনো আপত্তি নেই।সে তার বাবার এই সিদ্ধান্তে এতটুকুও ও লজ্জিত না, বরং সে খুশি হয়েছে । আর তাই সে লোপাকে বোঝানোর চেষ্টা করে।
লোপা একটু ইতস্তত করে বললো,"কিন্তু।"
জয়দীপ বললো," কোনো কিন্তু না লোপা দেবী। সবসময় সমাজ কি বলবে, আশেপাশের লোকজন কি বলবে ,এইসব ভেবে আমরা অনেক সময়ই অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিতে পারিনা। কিন্তু আপনি বলুন তো লোপা দেবী, আজ যদি আপনার মা, বা আমার বাবা, বৃদ্ধাশ্রমে থাকেন, তখন আমার বা আপনার মনে কি কখনও একটা অনুশোচনা বোধ কাজ করবে না, যে আমরা ব্যক্তিগত কারণেই নিজেদের বাবা মাকে বৃদ্ধাশ্রমে রেখে এসেছি।তার থেকে তো এটাই ভালো যে ওনারা দুজনেও একে অপরের সাথে ভালো থাকুক। একে অপরকে অবলম্বন করে বাঁচুক।জীবনের এই শেষ বেলায় এসে নিজেদের মতো করে বাঁচুক। আর আমাদের ও ওনাদের এই সিদ্ধান্ত কে সম্মান করা উচিৎ। লোপাও আর কিছু না বলে মায়ের হাতের উপর হাত রেখে বললো, "আমি আছি তোমার পাশে"।
নমিতা দেবী আর অমর বাবু অশ্রুসজল চোখে দুজনের ছেলে মেয়ে কে জড়িয়ে ধরলেন।তবে এটা আনন্দের অশ্রু। তাদের দুজনের বেলা শেষের এই ভালোবাসায় তাদের ছেলে মেয়ে ও সঙ্গে আছে যে।