বাড়ির কাজের মেয়ে
বাড়ির কাজের মেয়ে
মনিকা তাড়াতাড়ি করে টিফিন বক্সটা তিন্নির ব্যাগে দিয়ে বললো, "নে ব্যাগটা কাঁধে নিয়ে নে । মিতু ....যা ওকে স্কুল বাসে তুলে দি আয়।"
তিন্নি বলে উঠলো, "আমি জ্যাম নিয়ে যাবো না তুমি মেয়োনিজ কেন দাও নি মাম্।" কথাটা বলেই পা মাটিতে ঠুকে বায়না শুরু করলো।
মনিকা বললো, "এত বায়না করোনা তুমি, এবার কিন্তু বাস মিস করবি তুই।"
মিতু বলে উঠলো, "কি হতো ও যেটা চাইছে সে..টা দিলে , শুধু মুধু ওকে সক্কাল বেলা তুমি কাঁদলে বউদি।"
মনিকা তখন বললো, "তুই আর ওকে আশকারা দিস না তো, আচ্ছা ঠিক আছে সন্ধ্যেবেলা মেয়োনিজ দিয়ে স্যান্ডুইজ করে দেবো ,এবার হ্যাপি।"
তিন্নি ছোট ফুলিয়ে বললো , "প্রমিস।"
মনিকা বললো, "হ্যাঁ হ্যাঁ এবার যাও, স্কুলে দুষ্টুমি করবে না।"
মিতু নিয়ে গেল। মনিকা টেবিল এ বসে আনাজগুলো তাড়াতাড়ি করে কাটতে শুরু করলো। মিতু ফিরে এসে বললো, "বউদি ঘরটা কি আগে ঝাঁট দেবো না রান্নার কিছু লাগবে।"
মনিকা বললো, "তুই পোস্তটা মিক্সিতে দিয়ে দে। তারপর ঝাঁট দে।"
কিছুক্ষন পর মিতু ঝাঁট দিতে দিতে কথা বলতে শুরু করলো, "জানো বউদি, ঘোষ বাড়ির মেয়ের বিয়ে ঠিক হলো , এই এত জিনিস সব সোনার ,কি মোটা মোটা ভারি ভারি গয়না, আমি বললাম মেয়ের বিয়ে ঠিক হয়েছে তো আমাকে একটা নতুন শাড়ি দাও । দিল না জানো !! ওরা না হাড় কিপটে ,কত্ত কাজ আমাকে দিয়ে পাকা দেখার দিন করালো, লুচি বেলালো, কি সব নতুন নতুন রান্নার পদ হয়েছিল , একগাদা বাসনপত্র সব করেছি ,তাও একটা শাড়ি চাইলাম দিল না ।"
মনিকা পেঁয়াজ কাটছিল চোখে জল ভরে গেছে, মিতুর কথা শুনে বলে উঠলো, "উহঃ বাবা কি বকবক করতে পারিস তুই, নে নে তাড়াতাড়ি ঝাঁটটা শেষ কর ।"
মনিকা আবার বললো, "ওরা একটু ওরকমই , দুর্গা পূজোর সে বার দেখা হয়েছিল কি বাড়িয়ে বাড়িয়ে কথা বলে । তা ওদের মেয়ের কোথায় বিয়ে ঠিক হলো রে?"
মিতু বললো, "ওতো জানি না। সব বলবে নাকি আমায়, তবে শুনেছি বিয়ে পর দেরাদুনে চলে যাবে।"
মনিকা কড়াইতে তেলটা দিল আর রান্না শুরু করলো । মিতু হাতে হাতে এগিয়ে দিচ্ছে তারপর বললো ,"জানো বউদি ওই যে মাড়োয়ারি বাড়িটায় কাজ করি না, ওরা না হেব্বি সুন্দর মিষ্টি বানাতে পারে । আমি জেনে আস্ বো, তুমি তিন্নিকে বানিয়ে দেবে ।"
মনিকা সবজিগুলো নাড়তে নাড়তে বলে উঠলো, "তিন্নিটা ভীষণ জেদি হয়ে উঠেছে দিন দিন । কোনো কথাই শোনে না ,খালি বায়না ।"
মিতু তখন বলে, "ও সব বাচ্চাই ওরকম বউদি, আমি যে পাল বাবুদের বাড়ি কাজ করতাম না আগে, ওদের ছেলেটা ও ,কি দুষ্টুমি করতো ,কেউ সামলাতেই পারতো না ।"
মনিকা বললো ,"ওরা গতবছরই তো চলে গেল ।"
মিতু বললো, "হ্যাঁ । জানত যাবার সময় কত্তো জিনিস দিয়ে গেছেছিল পাল বউদি, খুব ভালো ছিল জানো...। ওদের যাবার পরই তো এই ঘোষদের কাজটা ধরলাম, একদম ফালতু এরা।"
বিকেলবেলা তিন্নি বিছানায় শুয়ে শুয়ে ড্রয়িং করছে । মোবাইলটা বেজে উঠলো, তিন্নি ফোনটা ধরলো, ফোনের ওদিক থেকে শব্দ ভেসে এলো, "কেমন আছো বেটা? কি করছিস? স্কুলে গেছিলি?" তিন্নি সব উওর দিলো তারপর বলে উঠলো, "জানো পাপা , মাম্ আমায় ডল্ হাউস কিনে দিচ্ছে না ,তুমি বলো না মামকে ।"
মনিকা শুনতে পেয়ে ঘরে ঢুকে বললো আবার বাবার কাছে নালিশ হচ্ছে, বলে ফোনটা তিন্নির কাছ থেকে নিয়ে মনিকা কথা বলতে শুরু করলো , "এই অতল জানতো.......।"
কয়েক দিন পর....
সকালবেলা ঘুম থেকে উঠলো মনিকা। ঘড়িতে অনেক বেজে গেছে । মিতু এলো না । মিতুর কলিংবেল বাজানোর শব্দে রোজ মনিকার ঘুম ভাঙে। বিছানায় বসে চুলটা হাত দিয়ে ঘুরিয়ে মিতুর কথা চিন্তা করতে করতে তড়িঘড়ি উঠলো মনিকা । তিন্নিকে রেডি করিয়ে তারপর ওর ব্যাগটা গোছাতে যাবে, তিন্নির বায়না শুরু "আমি চাউমিন খাব আজ।"
মনিকা বলে উঠলো, "ওহ্ তিন্নি আজ মিতু আসেনি, দেখছো তো দেরি হয়ে গেছে ।"
তিন্নি বললো, "মাম্ মিতু কেন আসেনি? ওর কি শরীর খারাপ ?"
মনিকা বললো , "কি জানি? হবে হয়তো। নাও চলো এবার ।"
সেদিন তখন বিকেল ,তিন্নিকে নাচের ক্লাসে নিয়ে গেল মনিকা , তিন্নির নাচ শেখা শেষ হলে ওকে একেবারে বাড়ি নিয়ে ফেরে আর এই মাঝের সময়টা তিন্নির আরেকটা বন্ধুর মা আর মনিকা নাচের স্কুলের পাশে একটা পার্কে বসে, আর সময়টা কেটে যায় গল্পে গল্পে।
সেদিনও তাই হলো তিন্নির বন্ধুর মা বললো ,"জানো মনিকা আমার বাড়িতে যে মেয়েটা কাজ করে, কি মুখে মুখে তর্ক করে জানো , সেদিন প্রায় ঝগড়াই করে বসলো , আচ্ছা বলো বাড়িতে লোকজন এলে তো একটু বেশি বাসন পড়বেই, বলো ? তো ওনার মুখ হাড়ি হয়ে গেল।"
মনিকা বলে উঠলো, "আর বলো না আমারটার কি যে হয়েছে কিছুই বুঝতে পারছি না, তিন চার দিন হয়ে গেল আসছে না ।"
তিন্নির বন্ধুর মা বললো, "সে কি গো ! তাহলে তো খুব অসুবিধে হচ্ছে তোমার, দাদাও তো এখানে থাকেন না তাই না ?"
মনিকা বললো, "হ্যাঁ ভ
ীষণ সমস্যায় পড়েছি আর ওর কথা বলো না, বছরে দুতিন বারের বেশি আসতেই পারে না এখন, ছোট মেয়ে, একা পারা যায় সব, বলো ?......."
অতলের সঙ্গে রাতে মনিকার কথা হচ্ছে মোবাইল এ। মনিকা বললো, "মিতু তো আজ ও এবসেন্ট, কি করবো কিচ্ছু বুঝতে পারছি না।"
অতল বলে উঠলো, "আচ্ছা ওর ফোন আছে না?"
মনিকা জানায়, "সুইচড অফ।"
অতল বলে উঠলো, "এসে যাবে দেখো না আর দু দিন।"
মনিকা বলে উঠে, "তুমি তো মুখেই বলে দিলে আর এদিকে আমার কি অবস্থা , তিন্নির স্কুল, টিউটোরিয়াল, তারপর এই পুরো বাড়ির কাজ। একটা মেয়ের জীবনে কাজের মেয়ের গুরুত্ব না অনেক, তুমি আর বুঝবে কি।"
অতল মৃদু হেসে বললো, "তুমি এমন করে বলছো যেন একটা মেয়ের জীবনে তার হাজবেন্ডের থেকেও বেশি দামি বাড়ির কাজের মেয়ে।"
মনিকা একটু রেগে বলে উঠলো , "হ্যাঁ তাই।"
অতল তখন বললো, "আচ্ছা তুমি রাগ করছো কেন! একটা কাজ করলেই তো হয়, তুমি মাকে ডেকে নাও ক'দিন, তাহলে তো অনেকটাই প্রবলেম সলভ হবে।"
মনিকা বললো ,"কার মাকে ডাকবো ? তোমার মা তো তোমার ছোট বোনের বাড়িতে, ওর অ্যাডভান্স স্টেজ। আর আমার মা পারবে না জানোই তো বাবার হাঁটুর সমস্যায় ভুগছে আর দাদার মেয়েটাও ছোট ,বউদি একা পারবেনা ।তাই মা আসতে পারবেনা, বলে কোনো লাভ নেই।"
অতল বললো, "আচ্ছা তাহলে ঘোষ বাড়িতে একবার খোঁজ নাও না, ওদের বাড়িতে ও তো কাজ করত ।ওরা কিছু জানে কি না......."
মনিকা পরেরদিন ঘোষবাড়ি গিয়ে জানতে পারলো মিতু পাড়ার অটো চালায় বিলুর সাথে পালিয়েছে । ঘোষ গিন্নি আরো বললেন মিতু নাকি তাদের বাড়ির শাড়ি গয়না চুরি করে পালিয়েছে। মনিকা তার অসুবিধের কথা তার মাকে জানায়, আরো কিছুদিন পর তার বাপের বাড়ির দিক থেকে এক বয়স্ক মহিলাকে নিয়ে আসে মনিকার দাদা। মনিকার দাদা জানায় এই মহিলার নাম ভানু, স্বামী নেই, ছেলে ও ছেলের বউ আছে। মহিলা খুবই ভাল । পার্মানেন্ট থাকবে , শনি রবি শুধু বাড়িতে যেতে দিতে হবে, আর মনিকার কোনো অসুবিধা হবেনা।
কিছুদিনের মধ্যে ভানুর সাথে তিন্নির খুব ভাব হল। ভানুর কাছ থেকে গল্প শুনে খাওয়া, ঘুমনো সব কিছু । মনিকা খানিকটা নিশ্চিন্ত হল । এমনি ভাবে কেটে গেলে অনেকগুলো দিন.......।
সেদিন তিন্নির স্কুল ছুটি । লুচি খাওয়ার বায়না করলো। মনিকা বেলে দিচ্ছিল আর ভানু ভাজছে। তিন্নি পা দুলিয়ে খেলতে খেলতে বলে উঠলো ,"মাম্ জানতো ম্যাম বলেছে যার প্রজেক্ট বেস্ট হবে সে প্রাইজ পাবে। মাম্ বলো না কি নিয়ে প্রজেক্টটা করবো?"
মনিকা কথা বলতে যাবে ওমনি কলিং বেলটা বাজল। তিন্নি ছুটে গিয়েই ডোরটা টানলো আর বলে উঠলো "মিতু.... তুমি কোথায় ছিলে ?জানো মাম্ তোমায় কত খুঁজেছে।"
মিতু তিন্নির গালটা টিপে আদর করলো। মনিকা মিতুকে দেখেছে, মিতু একটা গোলাপ ছাপ সিন্থেটিক শাড়ি পরেছে, চোখে গাঢ় কাজল, সঙ্গে হাতে একগাদা কাঁচের চুড়ি। মনিকার দিকে মিতু তাকিয়ে বললো, "তুমি রাক্ করেছো বউদি, আমি বলেই যেতাম ,কিন্তু তাড়াহুড়োতে বলা হয়নি।"
মনিকা বললো, "তোকে তো চেনাই যাচ্ছে না, তা এভাবে পালিয়ে যাবার দরকার কি ছিল, বাড়িতে জানিয়েই তো বিয়ে করতে পারতিস।"
মিতু বলে উঠে "বিলু অন্য জাতের বলে মা রাজি ছিল না আর ওর ঘরে ও কেউ মানছিল না। তাই....."
রান্না ঘর থেকে ভানু লুচি ভেজে নিয়ে এলো তিন্নির জন্য। মিতু ভানুকে দেখে বলে উঠলো, "বউদি ক'দিন আমি ছিলাম না তুমি নতুন লোক নিয়ে নিলে ।"
মনিকা বললো, "ক'দিন মানে? তুই জানিস কতদিন তুই আসিস নি ?আর না বলে যাবার সময় মনে ছিল না। ঘোষ বাড়ি থেকে জানলাম তুই নাকি শাড়ি গয়না নিয়ে পলিয়েছিস ।আমার কতটা প্রবলেম হয়েছিল তুই যাবার সময় ভেবেছিলিস? কি হলো বল?"
মিতু বললো, "বিশ্বাস করো আমি ওদের ঘর থেকে কিছু চুরি করিনি বিশ্বাস করো।" তারপর কাঁদো কাঁদো হয়ে বললো "বউদি আমাকে আবার কাজে নাও না গো। আমার মা'র শরীরটা ভালো যাচ্ছে না আর বোনটাও পড়ছে , ওদের টাকার দরকার, আমার ওপর রাগ করলেও আমি তো মুখ ঘুরিয়ে থাকতে পারি না। আমার রোজগারে এ তো আগে সংসারটা ভালোভাবে চলতো তুমি তো জানো বউদি ।"
মনিকা বললো "কিন্তু উনি তো করছেন এখন..... ....... ।" মিতু মনিকার পা ধরে বলতে গেল, তিন্নিও বলে উঠলো "মাম্ ,তুমি মিতুকে নিয়ে নাও না মাম ,মিতুর সাথে আবার স্কুলে যাবো আগের মতো ।"
মনিকাও শেষ পর্যন্ত রাজি হয়ে গেল ।
সন্ধ্যেবেলা মনিকা ফোনে সবকিছু অতলকে জানালো। অতল হাসতে হাসতে বলে উঠলো "তাহলে আর কি আমাকে তো আর লাগবেই না তোমার, মিতু যখন চলে এসেছে। মনিকাও হালকা রাগের ছলে বললো ,"ভাল হয়েছে যাও, দেখো মিতু খুব ভালো আর সবটা বোঝে ঠিকমত , ভানুর তো বয়স বেশি ওনাকে দিয়ে সব কাজ করানোও যায় না, আর শনি, রবি তো থাকে ও না। তাই ......"
অতল এর সাথে কথোপকথন চলতে থাকলো.....।
পরেরদিন সকালে কলিং বেলটা বাজল আর মনিকা ঘড়ির দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে দরজা খুলতে গেল।