অর্থম অনর্থম
অর্থম অনর্থম
---টাকা, টাকা, বুঝলে? টাকাই আসল। সব কিছুই কেনা যায় টাকার জোরে। এই যে শিক্ষা, জ্ঞান তাও আজকাল কিনতে হয়। পড়াশোনার পেছনে কত খরচ বোঝো কি ? টাকা না থাকলে পড়তেও পারবে না।
গগন বাবু নিজের স্ত্রীকে বোঝাচ্ছিলেন। আসলে স্ত্রী পিয়ালী দেবী ছেলের কেরিয়ার নিয়ে চিন্তিত। ছেলে ছোট থেকেই বাপের সোহাগে বাঁদর তৈরি হয়েছে। এখন কলেজে উঠেই তার বাইক চাই।
---সে তো বুঝলাম, কিন্তু ওর তো একটা ভবিষ্যত আছে ... মিনমিন করে বলেন পিয়ালী দেবী।
---ওর ভবিষ্যত গড়ে দেবো আমি। যা কামিয়েছি ও কেন,তোমার নাতিও বসে খাবে সারা জীবন। সব ব্যবস্থা আছে। ''
---কিন্তু তাই বলে এভাবে ওড়াবে ? আর পড়াশোনা না করে....'গলায় জোর আনতে চেষ্টা করেন এক মা।
---ধুসসস! এখন আনন্দ করবে না তো কবে করবে? আর বললাম তো তোমায়, ওকে দিয়ে তো আর চাকরী করাবো না, ও বসেই খাবে। আর নামের পাশে একটা ডিগ্রীও জুটিয়ে দেবো। টাকাই কথা বলবে। গগন বাবুর মুখে তৃপ্তির হাসি।
---ভুলে যেও না গড়িয়ে খেলে কলসির জলও শেষ হয়।
শেষ চেষ্টা করেন ওঁর সহধর্মিণী।
---আমার একটা কলসি নয় গিন্নি। প্রচুর কলসি! আমি ওর মত বয়সে পড়তে চেয়েছিলাম, জানো? খুব ভালো রেজাল্ট করেছিলাম। শখ ছিল ডাক্তার হব। বাবা ছিলেন ব্যবসাদার। হিসাব করে বুঝিয়েছিলেন ডাক্তারি পড়ে সময় আর টাকার অপচয় না করে এই ব্যবসায় নামলে কয়েক বছরে ফুলে ফেঁপে উঠবে আমাদের ব্যবসা। বাবা অশিক্ষিত হলেও ব্যবসাটা বুঝতেন। সেদিন বাবার কথাই শুনেছিলাম। আর আজ দেখো আমি কোথায় পৌঁছে গেছি। আমার হাতেই দুটো নার্সিং হোম। তিনটে ল্যাব। ডাক্তারদের পয়সা দিয়ে কিনে রেখেছি বুঝলে! ডাক্তারি না পড়েও লোকের জীবন মরণ আমার হাতে।
পিয়ালী দেবী দীর্ঘশ্বাস ফেলেন। এই মানুষকে বোঝাতে পারবেন না উনি এসব। ছেলে অন্তপ্রাণ বাপ।
ঘর ছেড়ে বেরিয়ে যেতেই ছেলে রজতাভ এসে ঢোকে বাবার কাছে।
----দারোয়ান মহিদুলের মেয়েটা উচ্চমাধ্যমিকে জেলায় সেরা হয়েছে। শুনেছো?
পিয়ালী দেবীর কথার উত্তরে গম্ভীর গলায় গগন বাবু বললেন,
----হুম। মহিদুলকে আজ আগাম দু মাসের মায়না দিয়ে বিদায় করবো ভেবেছি।
----মানে ?
----ওর মেয়ের যা রেজাল্ট কয়েক বছর পর জাজ ব্যারিস্টার বা ডাক্তার হবে। তার বাবার এই দারোয়ানগিরি কি ভালো দেখায়?'
---কি বলছ এসব? ও যাবে কোথায়, পঁচিশ বছর আমাদের বাড়িতে রয়েছে মহিদুল। আঁতকে ওঠেন পিয়ালী দেবী।
----ঠিকই বলছি গিন্নি। ছেলে বড় হয়েছে। ঐ নুসরতের নজর ভালো না। এসব শিক্ষিত মেয়ের এখানে না থাকাই ভালো!
----তোমার ছেলেকে আগে দেখো ...
----আমার ছেলেকে দেখতে হবে না। ঐ দেখো আসছে বাইক নিয়ে!
বাইকের আওয়াজে পিয়ালী দেবী জানালার দিকে তাকান।
*******
----ছেলেকে ভাবছি ব্যাঙ্গালোরে পাঠাবো, একটা ম্যানেজম্যান্টের কোর্স করাবো। একটু টাকা লাগবে, কিন্তু.....
গগন বাবু রাতে খেতে বসে বললেন।
----সে কি ? তোমার ছেলে পড়ে কি করবে ?পয়সা নষ্ট হবে যে!
----নামের পাশে বেশ এমবিএ লেখা থাকবে! বিয়ের বাজারে দাম বাড়বে। তাছাড়া ... আমাদের একাউন্টসের নটবরদার ছেলেটা সিএ, আর উকিল মলিদির ছেলে এমবিএ করেছে আই আই এম থেকে। স্টেটসে যাচ্ছে। পরাণের ছেলেটা তো পড়তেই শিকাগো চলে গেলো।
এই প্রথম গগন বাবুর গলায় এক অন্য সুর শুনে পিয়ালী দেবী একটু অবাক হলেন। বললেন'
---- তার চেয়ে ওকে বাইরে না পাঠিয়ে সার্টিফিকেটটা কিনেই আনো।
----বলছো? কিন্তু ... আচ্ছা দেখছি। তবে ...।
----মিতালীর ফোন এসেছিল, ওর ছেলে খড়গপুর আইআইটি তে ইঞ্জিনিয়ারিং এ চান্স পেয়েছে, কিন্তু খরচ আছে। সেজন্যই ফোন করেছিল।
----বাব্বা! তোমার বোনের গুমর ভেঙেছে তবে? প্রেম করে সেই প্রাইমারি টিচারকে বিয়ে করে কত বড় বড় কথা বলেছিল। টাকা নয়, জ্ঞান আসল। ছেলেকে সাধারণ স্কুলে পড়িয়ে বলেছিল মেধার জোরেই ছেলে একদিন বড় হবে।তবে এখন কেন ?
----টাকা চায়নি! তবে বলল ছেলেটা সুযোগ পেয়েছে, জানি না কতটা ওকে পড়াতে পারবো। আসলে ওর বরের অসুখে ওরা তো সর্বশান্ত প্রায়। হোষ্টেলে দিতে হবে ছেলেকে।
----এক কাজ করো, ওদের কিছু টাকা দিয়ে দাও। আর শুনিয়ে দিও যে আমাদের ছেলে এমবিএ করছে।
পিয়ালী দেবী জানেন মিতালীর ছেলে খুব ভালো স্টুডেন্ট। ও মেধার জোরেই একদিন এগিয়ে যাবে। প্রাথমিক ভাবে হয়তো মিতালীরা অসুবিধায় পড়েছে। কিন্তু এভাবে ওদের অপমান করা ঠিক হবে না। রাতুল খুব ভালো ছেলে, মাসিকে ভালোও বাসে। তার রাহুলের মত উশৃঙ্খল নয়। বড়দের সম্মান করে যথেষ্ট!
*******
পরপর চারটে ব্যবসায় ভরাডুবির পর রাহুল নেশায় ডুবে গেছিল। নার্সিংহোম ল্যাব সব বিক্রি হয়েছে আগেই। দেনার দায়ে গগনবাবুর সব সম্মত্তি প্রায় নীলামে। সেদিন বাপ ছেলের তুমুল ঝগড়ার পর স্ট্রোকটা হয়েছিল গগন বাবুর। কিন্তু রাহুল বাবাকে ভালো নার্সিং হোমে দিতেও রাজি নয়, সব টাকা নাকি জলের মত বেরিয়ে যাবে এভাবে।
রাতুল আর মিতালী খবর পেয়ে ছুটে এসেছিল। ওরাই সব ব্যবস্থা করেছিল চিকিৎসার। রাহুলের তাতেও রাগ! টাকা ছাড়া ছেলেটা কিছুই চেনে না। একটা দিক পড়ে গেছিল গগন বাবুর। জড়ানো গলায় ছেলেকে কিছু বললেই ক্ষেপে যাচ্ছিল ছেলে!
অপারেশনের টাকাটাও রাহুল খরচ করতে রাজি নয়। পিয়ালী দেবী অবাক হয়ে ভাবে যে বাবার উপার্জন বাবার পিছনেই খরচ করতে চায় না---এ কেমন ছেলে ? ছোট থেকে যা চেয়েছে রাহুল তাই পেয়েছে বাবার কাছে। আজ সেই বাবাকে ঝেড়ে ফেলতে চাইছে।
এক কোমল হাতের ছোঁয়ায় পেছন ফেরেন উনি। নুসরতকে দেখে অবাক হয়ে চেয়ে থাকেন। মহিদুলের মেয়েও আইএএস হয়েছে, শুনেছিলেন দু বছর আগেই।
নুসরত ওঁর হাত দুটো ধরে বলে,
----সব ব্যবস্থা হয়ে গেছে মাসীমনি। মেসোর অপারেশনের টাকাও জমা দিয়েছি। মেসো ঠিক ভালো হয়ে উঠবে।
অপসৃয়মান নুসরতের দিকে তাকিয়ে পিয়ালীদেবীর মনে পড়ে ওর ভর্তির টাকাটাও একদিন টালবাহানা করে দেননি ওঁরা। চাকরিও গেছিল মহিদুলের। তবুও মেয়েটা পড়েছিল নিজের জেদ নিয়ে। আজ মানুষের মত মানুষ হয়ে মেয়েটা ওঁদের দেখিয়ে দিল অদম্য জেদ থাকলে অর্থ কোনো সমস্যা নয়।
(সমাপ্ত)