অর্ধেক দরজার ওপাশে
অর্ধেক দরজার ওপাশে
🕯️ গল্প: “অর্ধেক দরজার ওপাশে”
লেখক: ফারিহা ইসলাম
---রাত তখন ১টা ১৭। গ্রামের শেষ মাথায় দাঁড়িয়ে থাকা পুরনো স্কুলবাড়িটার দিকে তাকিয়ে অদ্ভুত একটা শব্দ শুনতে পেল অরণী—
যেন কাঠের দরজা ধীরে ধীরে খুলছে।
কিন্তু সমস্যা হলো—
এই স্কুলটা ১২ বছর ধরে বন্ধ, আর এর দরজাগুলো সব সময়ই তালাবদ্ধ থাকে।
অরণী নতুন এসেছে এই গ্রামে, তার দাদুর পুরনো বাড়িতে।
সেদিন রাতেই সে প্রথম শব্দটা শুনেছিল।
খড়্— কড়্— কড়্...
যেন আধখোলা দরজা বাতাসে নড়ছে।
কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার—
স্কুলের সামনে কোনো বাতাসই ছিল না।
পরদিন সকালে গ্রামের সবাইকে জিজ্ঞেস করেও কোনো উত্তর পেল না।
সবাই একটা কথাই বলল—
“ওই স্কুলের দক্ষিণ দিকের দরজাটা আধখোলা থাকলে কেউ কাছে যায় না।”
অরণী হাসল।
“আধখোলা? তালা দেওয়া দরজা আধখোলা থাকবে কিভাবে?”
বলতেই, পাশের বাড়ির বুড়ো লোকটা নিচু গলায় বলল,
“মা… দরজাটা বাইরে থেকে নয়,
ভেতর থেকেই খোলে।”
দ্বিতীয় রাত
অরণী ঠিক করল সত্যি কী হয় সেটা দেখবে।
নিজের ফোনে টাইমার সেট করে জানালার পাশেই বসল।
১টা ১৫
১টা ১৬
১টা ১৭—
খড়্— কড়্— কড়্...
ঠিক সেই একই শব্দ।
স্কুলবাড়ির দক্ষিণ দিকের দরজাটা অর্ধেক খোলা দেখা গেল।
কিন্তু এবার অন্য কিছু ঘটল—
দরজার ফাঁক দিয়ে চুল ঝুলে থাকা মানুষের মতো একটা ছায়া বেরিয়ে এলো।
ধীরে ধীরে…
তার পর—
ছায়াটা একদম থেমে অরণীর জানালার দিকে তাকাল।
অরণীর গলা শুকিয়ে গেল।
চোখ দুটো নিস্তব্ধ, কিন্তু সেখানে কোনো eyeball নেই—
শুধু ফাঁকা সাদা।
এরপর ছায়াটা হঠাৎ—
পিছন ফিরে আবার সেই অর্ধেক খোলা দরজার ভেতরে ঢুকে গেল।
---পরদিন
অরণী গ্রামের স্কুলের হিস্ট্রি খুঁজতে গিয়ে একটা পুরনো খবর পেল—
বারো বছর আগে—
একজন নারী শিক্ষক স্কুলের দক্ষিণ ঘরে গলায় দড়ি দিয়ে মারা যায়।
আর তার মৃত্যুর সময় রাত ছিল— ১টা ১৭।
লোকেরা বলে তার আত্মা “দরজা পুরো খুলতে পারে না”…
কারণ যেদিন তাকে পাওয়া গিয়েছিল, দরজাটা সেদিনও অর্ধেক খোলা ছিল।
তারপর থেকে ঠিক সেই সময়েই দরজাটা নড়ে ওঠে।
অরণী ঠিক করল—
আজ সে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ভেতরে যাবে।
রাত ১টা ১৬।
সে স্কুলে পৌঁছে দেখল—
দরজাটা নিজে নিজে খড়্— কড়্— কড়্ শব্দ করে খুলছে।
১টা ১৭
দরজা অর্ধেক খোলা।
হঠাৎ দরজার ভেতর থেকে সেই নারীর ভয়ঙ্কর ছায়া বের হলো।
এইবার অরণী ভয় পেল না—
বরং বলল,
“তুমি কি কারো সাহায্য চাইছো?”
ছায়াটা থেমে গেল।
তার চোখে এবার যেন কিছু অনুভূতি।
তার দু’হাত অরণীর কাঁধ ধরল—
তবে ঠাণ্ডার মতো লাগল না…
বরং গরম, মানুষের মতো।
তারপর ধীরে ধীরে তার ফাঁকা গলায় একটা শব্দ তৈরি হলো…
“আমি…
দরজা…
পুরো…
খুলতে… পারি… না…”
অরণী বুঝতে পারল—
তার মৃত্যুর কারণ আত্মহত্যা ছিল না।
কেউ তাকে ভেতর থেকে আটকেছিল।
যেইমাত্র অরণী দরজাটা পুরোটা খুলে দিল—
এক মুহূর্তে অন্ধকার ঘরটা পরিষ্কার হলো,
আর ছায়াটা ধোঁয়ার মতো মিলিয়ে গেল।
মিলিয়ে যাওয়ার আগে সে শুধু একটা কথা বলল—
“ধন্যবাদ…
এবার দরজা আর অর্ধেক থাকবে না…”
সেদিনের পর আর কখনো—
কখনোই
রাত ১টা ১৭-তে সেই দরজাটা নড়ে ওঠেনি।

