STORYMIRROR

শিপ্রা চক্রবর্তী

Romance Classics Inspirational

4  

শিপ্রা চক্রবর্তী

Romance Classics Inspirational

অন্তরালে

অন্তরালে

6 mins
146


গরম ধোঁয়া ওঠা কফির কাপ হাতে ঝুলবারান্দায় বেতের দোলনার ওপর বসে আছে নিকিতা। আকাশের বুকে তখন গোল থালার মত একটা চাঁদ উঠেছে। চাঁদের রূপোলি আলো গায়ে মেখে মন প্রান দিয়ে রাতের নিস্তব্ধতাকে উপলব্ধি করছে নিকিতা। দূরে কৃষ্ণচূড়া গাছটা লাল ফুলে ভরে এসেছে। চাঁদের আলোয় অন‍্য রূপে ধরা দিয়েছে তার সৌন্দর্য।

কৃষ্ণচূড়ার ডালে এক জোড়া পেঁচা বসে আছে, থেকে থেকে তারা ডাকছে। নিজেদের মনের কথা আদান প্রদান করছে হয়তো! নিকিতার মন আজ বড্ড চঞ্চল হয়ে আছে, কি করবে কিছুই বুঝতে পারছেনা! একদিকে অতীতের স্মৃতি...., আর অন‍্যদিকে নতুন ভবিষ্যতের হাতছানি । রাতের এই গভীর নিস্তব্ধতার মাঝে নিজের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করছে নিকিতা!

---------হঠাৎ কাঁধে একটা স্পর্শ পেয়ে নিকিতা পিছন ঘোরে, এবং একটা দীর্ঘনিঃশ্বাস ছেড়ে বলে ওঠে তুমি.... এখনও ঘুমাওনি মা......!

---------অনুরাধা দেবী বলে ওঠেন, অত চিন্তা করিসনা নিকি... সব ঠিক হবে। আর সব থেকে বড় কথা হল রুহি....একটা নতুন জীবন পাবে, যেখানে শুধু ওর মা... না... বাবাও থাকবে।

-------নিকিতা মায়ের কাঁধে মাথাটা এলিয়ে দিয়ে বলে উঠল, সেটাইতো ভাবছি মা....পরবর্তী কালে কোন সমস‍্যা হবে...নাতো!!!! রুহিকে মেনে নিতে রুদ্রর। তখন কি... হবে তাহলে!


-------অনুরাধা দেবী বলে উঠলেন, রুদ্র খুব ভালো ছেলে নিকি, আমরা প্রথমে বুঝতে পারিনি! আজ আমাদের ভুলের জন‍্য তোর এই পরিনতি। সেদিন যদি রুদ্রর প্রস্তাবে তোর বাবা রাজি হয়ে যেত, তাহলে এই দিনটা কখনও আসতোনা! তোকেও এত অত‍্যাচার সহ‍্য করতে হতনা! সবসময় যে... ছোটরা ভুল করে তা... কিন্তু নয়! বড়রাও মাঝে মাঝে ভুল করে।

--------নিকিতা মায়ের চোখে চোখ রেখে অবাক বিস্ময়ে বলে উঠল, কি... প্রস্তাব মা...?

------অনুরাধা দেবী বলে উঠলেন, বিয়ের প্রস্তাব!

------নিকিতা উত্তেজিত হয়ে বলে উঠল, বিয়ের প্রস্তাব.....রুদ্র নিয়ে এসেছিল, তোমাদের কাছে....!

-------অনুরাধা দেবী বলে উঠলেন, হ‍্যাঁ.... তোর বিয়ে হওয়ার একমাস আগে। সেইদিন বিকেলে তুই গেছিলিস অভিকের সাথে দেখা করতে। রুদ্র এসেছিল তখন আমাদের বাড়ি। আমি দরজা খুলে রুদ্রকে দেখে বলেছিলাম, নিকি.... তো নেই বেড়িয়েছে ও.... আসলে আমি বলব তুই এসেছিলিস, কিছু দরকার থাকলে বল আমি বলে দেবো নিকিকে।

------রুদ্র তখন বলেছিল, আজ আমি নিকির সাথে নয়! তোমাদের সাথে কথা বলতে এসেছি!!

------আমি অবাক হয়ে বলেছিলাম কি.. কথা?

-----রুদ্র বলে উঠেছিল, কাকুর কাছে চলুন বলছি।

-----আমি রুদ্রকে নিয়ে তোর বাবার কাছে গেলাম রুদ্র বলে উঠেছিল, কাকু আমি নিকিতাকে খুব ভালোবাসি ওকে বিয়ে করতে চাই, আর অভিকের ব‍্যাপারেও কিছু বলতে চাই, কাকু ছেলেটা একদম ভালো নয়! আমি খোঁজ নিয়ে দেখেছি।

--------তোর বাবা রাগে জ্ঞানশূন‍্য হয়ে রূদ্রকে মেরে বাড়ি থেকে বার করে দিয়েছিল এবং বলে উঠেছিল, নিজের রাস্তা পরিষ্কার করার জন‍্য এখন অভিককে খারাপ বলা হচ্ছে, অভিক আমার অফিস কলিগের ছেলে, আমি ওকে ভালো করে চিনি। আর কান খুলে শুনে রাখ রুদ্র এরপর কোনদিনও যেন তোকে আমার বাড়িতে আসতে না... দেখি, নিকির আশেপাশে না.. দেখি। তোর মত ছেলের সাথে আমি আমার মেয়ের বিয়ে কোনদিনও দেবনা...!


-----রুদ্র সেদিন চুপচাপ চলে গেছিল, শুধু যাওয়ার আগে বলে গেছিল,কাকিমা আমি নিকিতার পাশে সবসময় থাকব, আমার জীবনে নিকির জায়গা কাওকে কোনদিনও দেবনা, ভবিষ্যৎ যদি কোনদিনও নিকির জীবনে আমাকে প্রয়োজন বলে আপনাদের মনে হয়, তাহলে অবশ‍্যই বলবেন আমাকে। আমি আসি আর নিকিকে এই ব‍্যাপারে কিছু বলার দরকার নেই। তাইতো যেদিন তুই অভিকের অত‍্যাচার সহ‍্য করতে না পেরে প্রায় অর্ধমৃত অবস্থায় রুহিকে নিয়ে আমাদের কাছে এসেছিলিস, সেইদিন তোর বাবা সহ‍্য করতে পারেনি। আর নিজের ভুল সিদ্ধান্তের জন‍্য তোর জীবনের এই করুন পরিনতিটা মেনে নিতে পারেনি, তাই অসুস্থ হয়ে পড়েছিল। তখন আমিই তোর বাবাকে রুদ্রর শেষ কথাগুলো বলি। তোর বাবা রুদ্রকে ফোন করে ডাকে, আর তারপরের সব ঘটনাতো তোর জানা।


------নিকিতা অবাক বিস্ময়ে মায়ের দিকে চেয়ে থাকে। মায়ের মুখের কথাগুলো শুনে নিকিতার কেমন গল্পকথা লাগে। সত‍্যি এই ভাবে কাওকে ভালোবাসা যায়। রুদ্র সবসময় সব কিছুতে ওর পাসে ছিল কিন্তু ভালোবেসেছিল সেটাতো কোনদিন বলেনি। নিকিতা ভালোবাসার ওপর বিশ্বাস হারিয়ে ফেলেছে অভিককে দেখে। অভির মত মানুষের কাছে ভালোবাসার কোনো মূল‍্য নেই। নিকিতা দৃঢ় স্বরে বলে ওঠে, ওর জন‍্য রুদ্র আমার বিয়েতে আসেনি আর আমার সাথে কোনরকম যোগাযোগ রাখেনি তাইতো!


-পিছন থেকে পরিতোষ বাবু বলে ওঠেন, হ‍্যাঁরে... মা সব আমার জন‍্য হয়েছে, না... হলে হীরের টুকরোকে দূরে ছুড়ে ফেলে কাঁচের টুকরোকে গ্রহন করি। আজ আমার জন‍্য সব হয়েছে তোর জীবনে। এই এতগুলো বছর তোকে কষ্ট সহ‍্য করতে হয়েছে, সব আমার জন‍্য। তোর অতীতকে তো আমি কিছুতেই মুছে ফেলতে পারবনা, তাই বর্তমান আর ভবিষ‍‍্যৎকে সুন্দর করতে চাইছি।


-নিকিতা দোলনা ছেড়ে উঠে বাবাকে জড়িয়ে ধরে বলে ওঠে, যা... হয়েছে সেটা আমার ভাগ‍্যে ছিল তাই হয়েছে। এর জন‍্য নিজেকে অপরাধি করে রেখোনা বুঝলে। চলো অনেক রাত হয়েছে শুয়ে পড়ো।


নিকিতা ঘরে ঢুকলো, রুহি তখন টেডি জড়িয়ে পরম শান্তিতে ঘুমাচ্ছে। ঘরের জানলা দিয়ে চাঁদের রূপোলি আলো ঢুকে ঘরটাকে আলোকিত করে তুলেছে। নিকিতা রুহির কপালে স্নেহের পরশ দিয়ে চোখটা বন্ধ করে শরীরটাকে বিছানায় এলিয়ে দিল।


নতুন দিনের নতুন আলোর সাথে নিকিতার জীবনটা নতুন ভাবে শুরু হবে আবার। অতীতের স্মৃতি রয়ে যাবে মনের এক কোনে তাকে মুছে ফেলা যাবে না ঠিকই! তবে সময় স্রোতের অতল গভীরে চাপা পরে কিছুটা ফিঁকে হবে।কোর্টরুম থেকে বেড়িয়ে এসে রুদ্র টেনশনে পায়চারি করছে। বাকি সবাই ভিতরে আছে, রেজিস্ট্রারের সামনে নিকিতা বলেছে, ও... সই করার আগে রুদ্রর সাথে আলাদা ভাবে কথা বলতে চায়। তাই দশমিনিট সময় দেওয়া হয়েছে ওদের দুজনকে। রুদ্র বেড়িয়ে আসলেও নিকিতা এখনও আসেনি।


-------হঠাৎ একটা পরিচিত কন্ঠস্বর ভেসে আসল রুদ্রর কানে, কিরে এখনও তোর স্বভাব বদলায়নি দেখছি! টেনশেন হলেই নখ খেতে শুরু করে দিস।

-------রুদ্র পিছন ঘুরে বলে উঠল, তোর আমাকে বিয়ে করতে কিসের আপত্তি বলবি???

--------নিকিতা গম্ভীর মুখে বলে উঠল, আপত্তি থাকাই তো উচিৎ, তোর কি মনে হয় রুদ্র অাপত্তি থাকা উচিৎ নয়

--------রুদ্র বলে উঠল, সেটাইতো জানতে চাইছি কিসের আপত্তি?


--------নিকিতা বলে উঠল, তুই কি আমাকে বলেছিস ভালোবাসিস তাই বিয়ে করছিস বলিসনিতো! আমার বাবা বিয়ে করতে বলেছে আর রাজি হয়ে গেলি বিয়ে করতে, কেন তোর নিজের কোন পিছুটান নেই, তাই বলে আপত্তিরও কোন কারন নেই! তবে আমার ঘোর আপত্তি আছে এই বিয়েতে! আমি কারোর দয়া চাইনা! বিশেষ করে তোর। কারন তুই আমার সাথে কোন যোগাযোগ রাখিসনি রুদ্র এত বছর। একবারও আমার খোঁজ নিসনি আমি ভালো আছি কিনা? আমাকে তোর জীবন থেকে একেবারেই উপড়ে ফেলেছিলিস। আর হঠাৎ করে এতদিন পর এসে বলছিস আমাকে বিয়ে করবি!! আমি কি করে মেনে নেব তাহলে!


---------রুদ্র উত্তেজিত হয়ে বলে উঠল কাকু বলেছে বলে আমি তোকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছি এটা কিন্তু ঠিক নয়! আর আমি তোকে দয়া করবো এত স্পর্ধা আমার নেই!! আমি তোকে ভালোবাসি, আর আমি চাইনা রুহি বাবার ভালোবাসা থেকে বঞ্চিত হোক!! তাই আমি তোকে আর রুহিকে নিয়ে আমার নতুন জীবন শুরু করতে চাই। আমার হারানো প্রেমকে আবার ফিরে পেতে চাই। আমাদের ভালোবাসা দিয়ে ঘেরা সুন্দর জগৎ তৈরী করতে চাই রুহির জন‍্য।


-------নিকিতা বলে উঠল, তাই তুই আমাকে ভালোবাসিস! কবে থেকে শুনি? কোনদিনও তো... এই কথাটা আমাকে বলিসনি!!

--------রুদ্র নিকিতার চোখে চোখ রেখে বলে উঠল, সেই স্কুল লাইফ থেকে। কিন্তু কোনদিন তোকে সাহস করে বলতে পারিনি, তবে একবার সাহস করে বিয়ের প্রস্তাব নিয়ে গেছিলাম তোদের বাড়ি, কিন্তু আমার মত পিতৃপরিচয় হীন ছেলেকে হয়তো মেনে নিতে পারেনি তখন কাকু, তাই চলে এসেছিলাম নীরবে, আর আমার ভালোবাসাকে সাজিয়ে রেখেছিলাম আমার মন মন্দিরে।

-------নিকিতা জলভরা চোখে রুদ্রর চোখে চোখ রেখে বলে উঠল, কেন বলিসনি আমাকে আগে!তাহলে আমাকে এত কষ্ট পেতে হতনা!!! কেন বলিসনি রুদ্র যে... তুই আমাকে ভালোবাসিস?

--------রুদ্র নিজের হাতে নিকিতার চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে বলে উঠল, ভয়ে...., যদি আমাদের বন্ধুত্বটা নষ্ট হয়ে যায়!!! আর তাছাড়া তুইও যদি কাকুর মত আমাকে অস্বীকার করিস, তাহলে যে আমি সেটা সহ‍্য করতে পারতাম না!!!! তবে এইবার আমার প্রতীক্ষার শেষ হবে তো!!! কিরে বিয়ে করবি না... আমাকে?

-------নিকিতা বলে উঠল, না... করবো না।

-----রুদ্র বলে উঠল, কেন....???

--------নিকিতা বলে উঠল, তুই... খুব বাজে তাই।

-------রুদ্র হাসি মুখে বলে উঠল, অতটাও বাজে নয়.... ভেবে দেখতে পারিস আর একবার।

------নিকিতা বলে উঠল, ঠিক আছে বিয়ে করতে পারি, তবে আমার শর্ত আছে...

-------রুদ্র বলে উঠল, কি শর্ত আছে আপনার বলুন ম‍্যাডাম!!!

-------নিকিতা বলে উঠল, আমার সব ইচ্ছে পূরন করতে হবে, আর আমাকে আর রুহিকে সবসময় ভালোবাসার চাদরে মুড়িয়ে রাখতে হবে, আর কোনদিন ছেড়ে যাওয়া চলবে না.. আমাদের।

------রুদ্র নিকিতার হাতটা শক্ত করে ধরে বলল, রাজি তোর সব শর্তে আমি রাজি। একবার যখন তোকে হারিয়ে আবার ফিরে পেয়েছি তখন আর ছেড়ে যাওয়ার কোন প্রশ্নই ওঠেনা। এখন তাহলে ভিতরে যাওয়া যাক। বিয়েটাতো সারতে হবে। সবাই ভিতরে অপেক্ষা করছে আমাদের জন‍্য।

নিকিতা আর রুদ্র হাসতে হাসতে একে অপরের হাত ধরে ভিতরে ঢুকল। রুদ্রর নামের সিঁদুরে নিজেকে রাঙিয়ে রুহিকে কোলে নিয়ে রুদ্রর হাত ধরে অতীতের কালো স্মৃতিকে পিছনে ফেলে, হাজার হাজার নতুন স্বপ্ন দুচোখে এঁকে নতুন করে জীবন পথে এগিয়ে চলল নিকিতা।





Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance