Unmask a web of secrets & mystery with our new release, "The Heel" which stands at 7th place on Amazon's Hot new Releases! Grab your copy NOW!
Unmask a web of secrets & mystery with our new release, "The Heel" which stands at 7th place on Amazon's Hot new Releases! Grab your copy NOW!

SUBHAYAN BASU

Romance Tragedy Classics

3  

SUBHAYAN BASU

Romance Tragedy Classics

অনিকেত বিজয়

অনিকেত বিজয়

7 mins
607


ছেলেটার নাম ছিল বিজয়। একটা নাম ভেবে ভেবে দিতে হয় বলেই যে ওর নাম বিজয়, তা নয়, বিজয়া দশমীর দিন জন্মেছিল বলেই ওর এই নাম। জন্ম দিয়েই ওর মা অন্ধকারে ঢলে পড়েছিলেন, তারপর বিজয়কে হাতড়ে হাতড়ে, খুঁজতে খুঁজতে গভীরতর অন্ধকারে কোথায় যে হারিয়ে গেলেন! সে বছর বিজয়া দশমীর দিন খুব বৃষ্টি হয়েছিল, তাই ওর জন্মটা বৃষ্টিতেই ঢাকা পড়ে গিয়েছিল।

ছোটবেলা থেকেই বিজয় মামারবাড়িতে মানুষ।ওর বাবা স্কুলমাষ্টারি থেকে ফেরিওয়ালা, জুতোর ব্যবসা থেকে উকিলের মুহুরিগিরি সবই করেছেন, কিন্তু কোনটাই টেঁকেনি বেশিদিন ।বয়সের ভারে শেষে বেশী খাটতে পারতেন না। সুইচ অফ করে দেওয়ার পরেও পাখাটা যেমন খানিকক্ষণ ঘুরতে থাকে সেভাবেই ক্লান্ত ,রুগ্ন শরীরে বাবাও কাজে যেতে বাধ্য হতেন ।প্রতিদিন পড়ন্ত বিকেলে বা সন্ধ্যাতারাকে মাথার পিছনে নিয়ে বাবা ধীরে ধীরে ঘরে ফিরতেন।এসেই খোঁজ করতেন দুরন্ত বিজয়ের। তল্লাশি চালাতেন পাড়ায়-পাড়ায়।শেষমেষ বাবার একটা হাত ধরে ,বিজয় তিড়িং বিড়িং করে লাফাতে লাফাতে,হাত ছাড়াবার নানা চেষ্টা করতে করতে ,বাড়ি ফিরত।সবাই বলত বাবার আদরে ছেলেটা গোল্লায় গেল।কোনদিন একটু বকুনি পর্যন্ত দেননি ওকে। রোজ রাতে ঘুম চোখে, বাবা অনেক গল্প শোনাতেন ।মার গল্প,নানা লেখকের নানা গল্প, আকাশের , পৃথিবীর সৃষ্টির ,তারার জন্ম-মৃত্যুর গল্প, বাবার নিজের জীবনের গল্প ।সব গল্পের মানে বোঝা যেত না ।কারখানায় কি করে লেদ মেশিন চলে, কিভাবে সাবান তৈরি হয়, ঘুড়ির কাগজ কিভাবে কাটে ,এসব ছোটখাটো নানা ঘটনার বর্ণনা আর কথাবার্তার মধ্যেই ওরা ঘুমিয়ে পড়তো। ঘুম আসার আগে পর্যন্ত অন্ধকারে শুয়ে শুয়ে বিজয় কত কিইনা ভাবতো ,বাবা ঘুমিয়ে পড়লে অন্ধকারেই বিজয় যেন স্পষ্ট দেখতে পেত ,হাল্কা কাচের পদ্মফুলের মত আলোর শেডের বিচ্ছুরিত মৃদু নীল ছায়ালোক থেকে মা এসে দাঁড়িয়েছেন তার সামনে। তারপর জেগে ঘুমিয়ে কত কথা হতো দুজনের। শুধু মাঝে মাঝে রাস্তা দিয়ে লরী যাবার শব্দে ওর স্বপ্ন ভেঙে যেত। একদিন ওর ঘরে বিদ্যাসাগরও এসেছিলেন, বাবার মুখে বিদ্যাসাগরের অনেক গল্প শুনেছিল বিজয়।

 অবশেষে একদিন মামার বাড়ি থেকে বাবার হাত ধরে বেরিয়ে পড়তে হলো দুজনকে।বাবা বলেছিলেন আর জীবনে ওখানে যাবেন না ।একটা ঘর ভাড়া করে অনেক কষ্টে ওরা থাকত। এদিকে বিজয় একটু বড় হয়েছে ,আর বাবার চলাফেরার ক্ষমতা আরো আস্তে হয়ে গেছে ।যেটুকু রাস্তা ও একছুটে চলে যায়, বাবার যেন সে রাস্তা আর শেষ হতেই চায় না ।পথের সঙ্গে লড়াই করে বাবা এগোতে থাকেন। বাবা আর আগের মত ওকে গল্প বলে ঘুম পাড়ান না, রাতের অন্ধকারে আগের মত বিবেকানন্দ ,রবার্ট ব্রুস, সিস্টার নিবেদিতার গল্প বলেন না ,মা ও আর আসেন না ।বাবা বলতেন "সিস্টার নয়,সব সময় বলবে জননী নিবেদিতা ।তোমার জননী,আমার জননী।"বিজয় তাই মাঝে মাঝে, নিবেদিতার ছবি খুঁটিয়ে দেখে, মা কেমন হয়, খুঁজত।মনকে বোঝাতে চাইত ,মাকে সে পেয়েছে।বাবার কাছে বায়না ধরত "আমাকে কাঁটাপুকুরে নিয়ে চলো, নিবেদিতা যে রাস্তা ঝাঁট দিয়েছিলেন, সেই রাস্তা আমি দেখব ।"বাবার আর নিয়ে যাওয়া হয়নি ।বাবা ঘুমিয়ে পড়লে ছোট্ট ঘরের আধো-অন্ধকারে ,ক্যালেন্ডারের ছবিটা ,দেয়ালের রং চটা জায়গাটা ,খালি বইয়ের তাকগুলোয়, স্ট্রিটলাইটের অল্প আলোয় ,সব মরা বলে মনে হতো । ওদের ঘরে কোন মায়াবী নাইটল্যাম্প নেই,শুধু রাস্তার আলোই এসে পড়ে ,সেই আলো আঁধারের মধ্যে অনেকক্ষণ চোখ সওয়ালে বাবার ঘুমন্ত মুখটাই দেখা যায় শুধু।

 বিজয়কে ছোটবেলায় একটা স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছিলেন বাবা, কিন্তু পরে মাইনে দিতে না পারায় আর সে স্কুলে পড়তে পারেনি। কিন্তু সেদিন বাবাই ওর হাত ধরে নিয়ে গিয়ে, ওকে একটা ফ্রি নাইট স্কুলে ভর্তি করে দিলেন।ওখানে সব গরীব দুঃখীরা পড়ে।বিজয় বেশ বুঝতে পারত, বাবা তাকে লেখাপড়া শেখানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাচ্ছেন ।এমনকি একদিন পড়া না করার জন্য জীবনে প্রথমবার বাবা ওকে বকেছিলেন।সেই নাইটস্কুলেই পড়তে লাগল ও,কিন্তু গরীবদুঃখীর ছেলে কারা, বিজয় খুঁজে পেত না ।কেউ কখনো তাকে বলে দেয়নি গরীব কাদের বলে।

এদিকে বাবা রাতের খাওয়া বন্ধ করলেন,খেলেই বমি হয়ে যেত।বাবা বিজয়কে খেয়েদেয়ে শুয়ে পড়তে বলতেন, তারপর আবার সকালের জন্য অপেক্ষা।আগে মামারবাড়ির রাতটাই ছিল সবচেয়ে ভালো, এখন সবকিছুই যেন কেমন হয়ে গেছে। রাত আর কাটতেই চায় না।দীর্ঘায়িত হতে হতে,রাস্তার কলে বালতি পাতার শব্দে শেষ হয় ।

কারো কারো জীবনে বৃত্তাকারে দুঃখই ফিরে আসে বারেবারে। বাবা ই এতো দিন বিজয়কে স্নেহের বাঁধনে আগলে রেখেছিলেন।সেই বাবাও একদিন হুট করে মার কাছে চলে গেলেন। বিজয়ের বয়স তখন মাত্র দশ। মামার বাড়িতেই আবার থাকতে শুরু করলো ও। কিন্তু একদম ভালো লাগতো না ।মামার বাড়ির যে ঘরটায় শুয়ে শুয়ে বাবার কাছে গল্প শুনত বিজয়,সেই ঘরটায় এখন ছোটমামার সংসার ।ঐ ঘরে ওকে ঢুকতেই দেয় না। ঘরটা অনেক বদলে গেছে, কিন্তু মাথার ওপর পদ্মকাটা হালকা নীলচে আলোর শেডটা সেই একই রকম আছ। ঐ ঘরে শুয়ে শুয়ে ছোট মামা এখন হয়তো ওর ছেলেকে গল্প শোনায়। কখনো মামার বাড়ির তিনতলার জানালা দিয়ে রাস্তার দিকে চেয়ে থাকে বিজয়। বাড়ির সামনে দিয়ে পূব থেকে পশ্চিমে ট্রামলাইন চলে গেছে। ওই রাস্তার ডানদিকের ফুটপাথ দিয়েই বাবা হেঁটে আসতেন, কোন কোন দিন তিনতলার ঝুলবারান্দায় দাঁড়িয়ে বাবার জন্য অপেক্ষা করত ও। বিকেলবেলা বাবাকে আসতে দেখলেই, ছুটে চলে যেত নীচে। তারপর দুজনে ওপরে আসত।ওই রাস্তার দিকেই আজ চেয়ে চেয়ে বিজয় ভাবে ,বাবা কি আসতে পারে না, ওই রাস্তা দিয়ে হেঁটে ?সাদা ধুতি পাঞ্জাবি,হাতে ছাতা নিয়ে হেঁটে আসার সেই চেনা ভঙ্গিটা আর কি দেখা যাবে না ?অবাস্তব আশায় অপলকে বিজয় চেয়েই থাকে।হঠাৎ কি খেয়ালে নীচে নেমে যায় দরজার কাছে ,দাঁড়িয়ে থাকে মৃত পিতার শুধু একবারের জন্য ফিরে আশার আকাঙ্ক্ষায়।সামনে ঘুঁড়ির দোকানে রঙবেরঙের ঘুঁড়ি-লাটাই-সুতো।উল্টোদিকে ফটোর দোকানে কত রকমের ছবি টাঙানো রয়েছে। এসব দেখতে দেখতে সে বাবার কথা ভুলে যেত ।যখন হঠাৎ সম্বিৎ ফেরে ,তখন মাথা নিচু করে উপরে উঠে আসে ।তখন হয়ত বিনুদি ময়দা মাখছে, সেখানে পুরনো থামে হেলান দিয়ে আপন মনে থামের গায়ে আঁকিবুকি কাটে সে।

বড়মামা বিজয়কে খুব ভালবাসেন ।তার জন্যই সে এ বাড়িতে থাকতে পেরেছে।বড়মামা বিজয়কে স্কুলে ভর্তি করে দিয়েছেন। সে মন দিয়ে পড়াশোনা করে আর ভাবে, বাবার খুব ইচ্ছে ছিল তার লেখাপড়া হোক।সে পড়বেই।ছোটবেলা থেকে না খেয়ে না পড়ে, নানা অপমান আর দুঃখ-কষ্টের মধ্যে মানুষ হলেও, বিজয়কে কেউ কখনো কাঁদতে দেখেনি ।বাবার মৃত্যুতেও সে কাঁদেনি।

 স্কুল ফাইনালে দারোন ভাল রেজাল্ট করে বিজয় এখন কলেজে পড়ে। স্বভাবেও খারাপ নয়। কিন্তু মামার বাড়ির কেউ ওকে দেখতে পারে না। বড়মামার ভালোবাসা পায় বলে ,ও যেন সকলের চোখের কাঁটা হয়ে উঠেছিল ।বড়মামার ভালো রোজগার, তার মুখের উপর কেউ কোন কথা বলতে পারতো না ।বাবা মারা যাওয়ার পর, বাবার অভাব বুঝতে না দেবার জন্য ,বড় মামা অনেক চেষ্টা করেছেন।বিজয়ও তাকে ভক্তি করত ভগবানের মতো। ওকে পড়াশুনা করতেই হবে ।বাবার শেষ ইচ্ছে, বড়মামার এত চেষ্টা ,এতো ভালোবাসার দাম ওকে দিতেই হবে। নিজের পায়ে একদিন দাঁড়িয়ে তারপরেই ওর ঘরে বাবার যে ছবিটা আছে, সেটার সামনে দাঁড়িয়ে বাবাকে প্রনাম করে বলবে, "দেখো, এই সেই আমি।" ভাবতে ভাবতে বিজয় তন্ময় হয়ে যায়। ছোটবেলা থেকে আঘাত পেয়ে পেয়ে ওর চোখে আর জল আসে না, বুকে তাই ওর আঠেরো বছরের কান্না জমানো।

 বড়মামার শরীরটা কিছুদিন ধরেই খারাপ যাচ্ছিল। সেদিন সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে, মাথা ঘুরে পড়ে গেলেন। হার্ট অ্যাটাক। ডাক্তার আসার আগেই ,সব শেষ ।বিজয়ের সামনে থেকে পৃথিবীর সমস্ত আলো যেন এক নিমেষে হারিয়ে গেল।

 বড়মামার শ্রাদ্ধ চলছে। বাড়িটাতে একটা সম্পূর্ণ শূন্যতা ,বুঝতে পারে বিজয় ।ওর গলা শুকিয়ে যায়, বড়মামার ছবির দিকে তাকিয়ে ।মনে মনে ভাবে হার্টফেল ?নাও তো হতে পারে।পুড়িয়ে দিল কেন মামাকে?পাশ দিয়ে গোপাল মামা এসে ফুলদানিতে ফুল সাজাতে লাগলো ।বিজয় বলল "মামাকে তোমরা কবর দিলে না কেন গো ?"গোপালমামা অবাক হয়ে তাকিয়ে থেকে, শেষে চোখদুটো কুঁচকে বলে উঠল "তা তো বলবিই, দাদা তোকে মানুষ করেছে কিনা?জানোয়ার কোথাকার।" গোপাল মামা চলে যায় ।বিজয় হাঁটু গেড়ে মামার ফটোর সামনে বসে পড়ে ,মাটিতে মাথাটা ঠেকিয়ে বিড়বিড় করে বলতে থাকে" মামা স্বর্গ ,মামা ধর্ম, মামাহি পরমং তপঃ; পিতা স্বর্গ, পিতা ধর্ম, পিতাহি পরমং তপঃ।"

 বিজয় দেখল বড়মামার দুঃসম্পর্কের এক বোনঝি,যে বড়মামার কাছেই আসতো না, সে চিৎকার করে কেঁদে ভাসিয়ে দিল।অথচ বড়মামার সবচেয়ে প্রিয় ছিল যে বিজয় ,যে ছিল নিজের ছেলের থেকেও বেশি,সেই বিজয়ের চোখে জল নেই। বড়মাইমাও শেষ জীবনে বড়মামাকে শুধু কষ্টই দিয়ে এসেছে, আর অন্যরা???

বিজয়ের মনে পড়ল,বাবা বলতেন "তোমার মা'র মধ্যে সমস্ত দুঃখ পাথর হয়ে জমে যেত,তিনি খুব একটা কাঁদতেন না,বুঝলে বাবা?" বাবা বিজয়কে 'বাবা' বলে ডাকত, আর মা'র সম্পর্কে সবকিছু ভক্তি ভরে উচ্চারণ করতেন।আজ হঠাৎ বড়মামার ছেলে রাজু,যে বিজয়ের থেকে বছর চারেকের ছোট,তেকে নেড়া মাথায় কাছা নিয়ে ঘুরতে দেখে ,বিজয় ভাঙা দেওয়ালের দিকে মুখটা ঘুরিয়ে নিল ।নিজের জীবনের যে ছবিতে বিজয় শুধু অবাক হয়েছিল,মামাতো ভাইয়ের সেই ছবি দেখে, বিজয়ের নিঃশ্বাস নিতে কষ্ট হতে লাগল।একটু আগেই সে দেখে এসেছে ছোটমামা পুরোনো ল্যাম্পশেডটা খুলে ফেলেছেন। অন্ধকার রাতে ,দেওয়ালের যে লাইটশেডে এক স্বপ্নের ঘোর এসে ঘিরে ধরত,আর না দেখা মা'র একটা অস্তিত্ব এসে ভালবাসার পরশ দিয়ে যেত, সেই লাইটশেডটা আর নেই।একটা কঠিন পাথরের মত কি,গলা দিয়ে যেন উঠে আসতে লাগল ।পড়াশোনা আর বোধহয় হল না।কে পড়াবে? এখন কি তবে চাকরির চেষ্টা করতে হবে ?সেটাই বা কে বলে দেবে?বিজয়ের প্রথমবার মনে হল এই পৃথিবীতে সে সম্পূর্ণ একা।মনে হল,"বাবা ,মামা ,তোমাদের শেষ ইচ্ছে আমি বোধহয় রাখতে পারলাম না ।"

দুপুরের কাঠফাটা রোদে আবারও বড়রাস্তায় চোখ চলে যায় ,ছাতা মাথায় একটা লোককে অনেক চেনা ভঙ্গিতে হেঁটে আসতে দেখে, ওর চোখ মুখ গলা বুক বেয়ে ঝর্ণার মত কান্না উথলে উঠল ।বালিশে মুখ গুঁজে হুহু করে কেঁদে উঠল সে। সারা জীবনের সব আবেগ, সব জমে থাকা কান্না, যেন সেদিন বেরিয়ে এল ওর হৃদয় থেকে ।"মাগো তোমায় আমি কোথায় পাব, মা ?আর বাবা ও তো নেই ।মামা ও যে চলে গেল ।"

বিজয়কে সেই প্রথমবার কেউ হয়তো কাঁদতে দেখলো।কিন্তু তারপর সে যখন ধীরে ধীরে, দুহাতে সে কান্না দৃঢ়ভাবে মুছে ফেলল,সে দৃশ্য কিন্তু নিশ্চিতভাবেই কেউ দেখল না।এসব জিনিস কেউ কোনদিনও দেখে না।



Rate this content
Log in

More bengali story from SUBHAYAN BASU

Similar bengali story from Romance