অঙ্গচ্ছেদ
অঙ্গচ্ছেদ
সকালে এলার্মটা বাজতেই কোনোরকমে বন্ধ করে বিছানা ছেড়ে উঠে বসলো কুহু।শীতের সকাল, ঘুম প্রিয় মানুষের এমনিতেই ঘুম ভাঙতে চায়না,কিন্তু ঘাড়ের উপর কাজের বোঝা নিয়ে কতক্ষণ আর নিদ্রাদেবীর সঙ্গ দেওয়া যায়?আড়মোড়া ভেঙে গায়ে সোয়েটারটা দিয়ে বাথরুমে ঢুকে যায় ফ্রেশ হতে। ঘুম যদিও বিছানা ছাড়তেই চলে গেছে কিন্তু শরীর, তা যে দুদিন ধরে সত্যিই খারাপ। সকালে যেন আরও বেশি খারাপ লাগে,হয়তো এই সময় মর্নিং সিকনেস হয়।কিন্তু ভয়ে বলে উঠতে পারেনি কাওকেই নিজের শরীর খারাপের কথা। ফ্রেশ হয়ে নীচে রান্নাঘরে এসে সকলের চা বসিয়ে দিয়ে একটা চেয়ার নিয়ে এসে চুপচাপ ওখানেই বসে রইলো কিছুক্ষণ। শ্বাশুড়ি মা উঠে পড়েছেন অবশ্য ঘুম থেকে, তবে চা না খাওয়া অবধি বাড়ির কোনো কাজেই হাত তিনি দিচ্ছেন না। সকলের চা করে নিয়ে একে একে শ্বশুর শ্বাশুড়ি, জা ভাসুর সকলকে দিয়ে এসে নিজের চা টা রান্নাঘরে কাজের মাঝেই খেতে শুরু করেছিল কুহু। ঘড়ির কাঁটা তখন প্রায় ৮টায়,কলিংবেলের আওয়াজে নিজেই গিয়ে দরজা খুলে দেয়।
“কি ব্যাপার দিদিভাই!!তুমি এতো সকালে??”
“কেন কুহু?আমি আসতে পারিনা নিজের বাড়িতে? “
“এমা!!তা কখন বললাম,এসো ভেতরে এসো”। বড় ননদিনীর সাথে আর কোনো কথা বাড়ালো না সে,কথার ভঙ্গিতে বুঝে গিয়েছিল মুড তার ভালো নেই।
রান্নাঘরে এসে সকালের জলখাবারটা চটপট বানাতে শুরু করে দেয়। শ্বশুর ঘরে কাজ তার সকালে এটুকুই।হ্যাঁ বিয়ে হয়ে আসার পর প্রথম প্রথম সবটা করতে হয়েছে তাকে। বড় জা তখন কুটোটিও নাড়তো না। পদে পদে অপদস্ত হতে হয়েছিল শ্বাশুড়ি মা আর তার জায়ের কাছে। কারণ একটাই,কুহুকে বাড়ির কারোরই পছন্দ ছিলো না। বাড়ির ছেলে বেকার অবস্থায় পালিয়ে বিয়ে করে বউ নিয়ে চলে এসেছিলো। ছেলেকে সামান্য ওই বকাঝকা অবধিই সীমাবদ্ধ রইলো কিন্তু হাড়মাস টের পাচ্ছিল মেয়েটা। প্রায় একটা বছর গাধার খাটুনি খাটার পরে ভগবান মুখ তুলে চেয়েছিলেন জন্য কুহুই চাকরি পেয়ে গেছে,কিন্তু তার স্বামী অংশু এখনো বেকার। বাড়ির বউ চাকরি করবে এই নিয়ে প্রথম প্রথম অনেক অশান্তিই হয়েছিল কিন্তু অংশুর সাপোর্ট পেয়ে সব অগ্রাহ্য করে নিজের বুঝটা বুঝে নিয়েছিল সে। পুরো সংসারটা বড়ভাসুরের টাকায় আর শ্বশুর মশাইয়ের পেনসনের টাকায় চলছিলো ঠিকই কিন্তু পাশাপাশি এই বউও যে মাস গেলে তার সাধ্যমতো টাকা সংসারে দিত তার কোনো দাম ছিলো না।
ব্রেকফাস্ট রেডি করে স্নানে চলে গিয়েছিল কুহু।প্রায় ৯টা নাগাদ উঠে ছোটোছেলে মায়ের কাছে এসেই সকালের চা টা চেয়ে বসলো। কিন্তু তার মা তখন মেয়ের সংসার বাঁচাতে ব্যাস্ত।
“তুমি এর একটা বিহিত করো মা।আমার শ্বাশুড়ি জানতে পারলে বাচ্চাটা রাখতে দেবে না আমাকে”।
“বললেই হলো নাকি হ্যাঁ!! ওনার কি অসুবিধে??”
“উনি যদি জানতে পারে আবার মেয়ে হবে তখন কি করবে তোমার ধারণা নেই মা। আর আমি বাচ্চা নষ্ট করবোনা। আমি ডিভোর্স দিয়ে দেবো তমালকে”।
“এমন করিস না টুসি।তুই এখানেই থাক কিছুদিন।আমি আর তোর বাবা কথা বলে দেখি তমালের সাথে”।
“যা ভালো বোঝো তোমরা করো মা।বাট কিছু একটা করো,নিজের সন্তানকে আমি আর মারতে পারবোনা”। বলে মায়ের হাত ধরে কাঁদতে থাকে টুসি।
এতোক্ষণ নিজেই চা বানাতে বানাতে মা দিদির সব কথাই শুনছিলো অংশু।নিজের চায়ে চুমুক দিয়ে দিদির সামনে কাপটা দিয়ে বলে
“নে চা খা,ভালো লাগবে”। মায়ের সাথে কিছুক্ষণ কথা বলার পর মুডটা ঠিক হয়ে যেতেই ভাইকে বলতে শুরু করে টুসি।
“তোদের কি প্ল্যান ছটু?? দুবছর হতে চললো বিয়ের।এখন তো অন্তত ফ্যামিলি প্ল্যানিং কর”। দিদির কথার কোনো উত্তর না দিয়ে আড়চোখে মায়ের দিকে তাকিয়ে ছিলো সে।
“ওদের আর কি!! বউ চাকরি করছে আর ও কবিতা লিখে যাচ্ছে বাড়ি বসে।বাচ্চা নেবো বললেই তো আর হয়না টুসি। একটা বাচ্চার পেছনে অনেক খরচ। যে নিজেই এখনো বাপ দাদার ঘাড়ে বসে খাচ্ছে সে আবার কি বাচ্চার দায়িত্ব নেবে? বই বেচে যা টাকা পায় তা তো সিগারেট খেয়েই উড়িয়ে দেয়”। মায়ের বলা তীক্ষ্ণ কথাগুলো বুকে এসে বিঁধছিল অংশুর।কিছু না বলেই উঠে ঘরে এসে চুপচাপ বসেছিলো মাথা নীচু করে। কুহু তখন প্রায় রেডি অফিস যাবার জন্য। বর তার মুখখানা ব্যাজার করে বসে আছে দেখে কাছে এসে জিজ্ঞেস করে
“কি হয়েছে???”
“আমি খুব খারাপ তাইনা কুহু?”
“আবার মা খোটা দিয়েছে তাই তো?? ওসব নিয়ে ভেবোনা। আমি জানি তুমি একদিন অনেক বড় রাইটার হবে।তাছাড়া আমি তো তোমাকে কিছু বলিনি,আমার তো কোনো অসুবিধে হচ্ছেনা তোমার সাথে, তাহলে”!!
“অফিসে গিয়ে আজকে ছুটির কথা বলে ন
িও”।
“ছুটি! কেন?”
“সুখবরটা তুমি মুখে না বললেও লুকিয়ে তো রাখতে পারলেনা কুহু”।
“কি করে জানলে??”
“টেস্টকিটটা এতো যত্নে রেখেছ,না জানাটা কি খুব স্বাভাবিক??”
“বাড়িতে কাওকে বলো না প্লিজ অংশু।আমি চাইনা ওই বিষাক্ত দিনটা আমার জীবনে আবার ঘুরে আসুক। আমি মা ডাক শুনতে চাই অংশু,পারবোনা আমি ওই কষ্ট আবার সহ্য করতে”। বলে জড়িয়ে ধরে কাঁদতে থাকে টুসি।
“ভেবো না এতো। আমি আছি না,কোনো চিন্তা নেই। তুমি শুধু ছুটি নিয়ে নাও,বাকি যা ব্যাবস্থা করার আমি করছি”।
প্রায় সাতদশদিন বাড়ির কেউ জানলোনা কুহুর প্রেগন্যান্সির কথা।সময় সুযোগ বুঝে রাতে খাবার টেবিলে বসে সবার সামনে অংশুই বললো বাবা মাকে “কুহু ৯মাসের জন্য ট্রেনিং-এ যাচ্ছে।ততদিন ওর এই বাড়িতে যা দায়িত্ব সব অংশুই সামলে দেবে।সেসময় বাবা মা আর দাদা খেতে বসেছিলো, অংশুর মুখ থেকে এমন কথা শুনে কুহুই অবাক।মাঝে আর কোনো কথা বলেনি সে।তবে তার এই ট্রেনিং করতে যাওয়া নিয়ে বাড়িতে কোনোরকম ঝুটঝামেলা হলোনা,ট্রেনিং করলে প্রোমোশন, প্রোমোশন হলেই টাকা।
দুদিন বাদে কুহুর সবকিছু নিজের হাতে গুছিয়ে দিয়ে তাকে বাপের বাড়ি দিয়ে আসে অংশু।সব থেকে সেফ জায়গা, কোনো চিন্তা নেই। মেয়ে চলে যাবার পর প্রথম প্রথম বাবা মা মেনে নেননি ঠিকই কিন্তু পরে মেনে নিয়েছিলেন মেয়ে জামাইকে,কেননা আর যাই হোক অংশু খুবই ভালো ছেলে সেটা বুঝে গিয়েছিল কুহুর বাড়ির লোক।তবে দুইপরিবারের মধ্যে কোনোরকম ভালো আত্মীয়তার সম্পর্ক আজও হয়ে ওঠেনি।
দেখতে দেখতে প্রায় আটমাসের উপর কেটে গেলো। বিভিন্ন কাজের বাহানা দিয়ে বা কখনো সত্যি বলেই কুহুর কাছে গিয়ে থাকতো অংশু।সময়ের আগেই মায়ের হাকডাকে ঘুম ভেঙে যায় প্রত্যেকের টুসির কোল আলো করে ফুটফুটে মেয়ে জন্ম নিয়েছে। বাড়ির সকলেই খুব খুশি। বাবা তো চা খেয়েই মিষ্টি আনতে চলে গেলেন। কোনোরকম প্রতিক্রিয়া না দেখিয়ে নিজের মতো চা বানিয়ে খেয়ে ঘর থেকে ব্যাগটা নিয়ে নিচে নেমে আসতেই মা জিজ্ঞেস করে বসলেন
“কি রে,তুই আবার কোথায় চললি আজকের দিনে???”
“উলুধ্বনি দাও মা,কাল তোমার ঘরেও কন্যা সন্তান জন্ম নিয়েছে”।
“মানে???”
“আমি বাবা হয়ে গেছি গো মা,বাবা হয়ে গেছি। কাল কুহুও মেয়ের জন্ম দিয়েছে। হবেনা খুশি তুমি এখন???”
“কি বলছিস তুই এসব ছটু?? কুহু তো ট্রেনিং করতে গেছে”।
“না মা,যায়নি।ওকে ওর বাবা মায়ের কাছে রেখে এসেছিলাম আমি। আচ্ছা তুমি না মা,তুমি না একজন মেয়ে,বুঝতেও পারনি তাইনা যে ওই সময় কুহু প্রেগন্যান্ট। খেতে পারতো না,মাথা ঘুরতো,শরীর চলতো না ওর,বোঝোনি তাইনা??”
“ও তো কোনোদিন মুখ ফুটে বলেনি আমাকে”
“কেন বলবে??যাতে আবার তুমি ওষুধ খাইয়ে বচ্চাটা নষ্ট করিয়ে দাও তাই তো?জানি জন্মের আগে ভ্রুণ নির্ধারণ করা অপরাধ, তবে এটা কুহু করেছে নিজের সার্থে,যাতে মা ডাকট শুনতে পারে, আর আমি বাবা”।
“দ্যাখ ছটু,তখন আমার কিছু করার ছিলো না।তুই কিছু করিসনা,কুহুও তখন চাকরি পায়নি। বাচ্চা এলেই তো আর হলোনা,তার মধ্যে মেয়ে।বড় করা,তার বিয়ে থা কত দায়িত্ব। তাই আমি…”
“তাই তুমি নিজের হাতে ওষুধ খাইয়ে দিলে কুহুকে ওর অজান্তেই।দিদির মেয়ে হলো সে নিয়ে তুমি খুশি,দিদির শ্বাশুড়ি ছেলে চাই ছেলে চাই করে আর তুমি তার দোষ দেখে বেড়াও।সত্যি করে বলতো শুধুই আমাদের আর্থিক দিকটা দেখেছিলে নাকি বড়বউদির পর এখন কুহুর পালা ছিলো যে ছেলেই চাই।যাই হোক,আমাকে ক্ষমা করে দিও মা,আজ অনেক বড়ো বড়ো কথা বলে ফেললাম।তোমরা ভালো থাকো,আমিও আমার বউ মেয়ে নিয়ে ভালো থাকি”।
“তুই চলে যাচ্ছিস???”
“হ্যাঁ মা,যাচ্ছি। আমার কি মনে হয় বলো তো,প্রত্যেকেরই জীবনে একবার না একবার কষ্টের মুখোমুখি হওয়া উচিত। তুমিও আজ মুখোমুখি হও,সন্তান হারানোর কষ্টটা কেমন। তবে আমাদের বাড়ির দরজা তোমার জন্য খোলা থাকবে,যখন খুশি তোমরা এসো”।
“কোথায় থাকবি?? কুহুর বাড়িতে,ঘর জামাই হয়ে??”
“আপাতত কিছুদিন। ওহ্, তোমাকে তো বলাই হয়নি,আমার মেয়ে সত্যিই লক্ষ্মী গো মা,কেন্দ্রীয় বিদ্যালয়ে আমার চাকরিটা হয়ে গেছে।কুহুর বাড়িতে কিছুদিন থাকবো,তারপর একটা ভাড়াবাড়ি খুঁজে নেবো।চলি মা,ভালো থেকো”।বলে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে বের হয়ে যায় অংশু।নীরব হয়ে দাঁড়িয়ে রইলো তার মা।একরাশ চাপা কষ্ট নিমেষের মধ্যে হাজির হয়ে গেলো এক মায়ের বুকে,এ যেন এক অসহ্য যন্ত্রণা। এই যন্ত্রণা শারীরিক ব্যাথাকেও হার মানায়। এই যন্ত্রণা শুধু মাত্র সন্তান হারানোর,এ যন্ত্রণা এক অঙ্গচ্ছেদের,আর কিচ্ছুটি না ।