Sayani Chakraborty

Inspirational Thriller

3  

Sayani Chakraborty

Inspirational Thriller

দশমী

দশমী

75 mins
1.7K


    


"বিনী!!!! ও বিনী!!! বিনীরে!!!! কোথায় গেলি রে মা আয় না একটু,এই কোমর নিয়ে তো আর পারছিনা,একটু মশলাটুকু বেটে দিয়ে যা না রে মা!! বিনী!!!!!" মেয়ের নাম ধরে ডাকতে ডাকতে সারাবাড়ি মাথায় তুলেছেন উমাদেবী। শহরের বাইরের এক গ্রামাঞ্চলের সামান্য গৃহবধূ। আর গলা ফাটিয়ে যাকে ডাকছে সে হলো বিনী,ভালো নাম বিজয়া,অনুপ দাস আর উমা দাসের বড় মেয়ে। দুই মেয়ে আর ছেলেকে নিয়ে তাদের ছোট্ট সংসার। গ্রাম হলেও আগেকার দিনের মতো অবস্থা এখন নেই,স্কুল,হাঁটবাজার, ছোটো হাসপাতাল সবই আছে। জমিদার রাধারমণ ব্যানার্জি জীবিত থাকতেই সব করে দিয়ে গেছেন। বর্তমানে গ্রামে জমিদারের দাপট না থাকলেও রাধারমণ ব্যানার্জির বড় ছেলেই এখন গ্রামের সর্বেসর্বা। জমিদারি রক্ত শরীরে বইছে তার,সাবেকি চালচলন ছেড়ে দেয়নি এখনো ব্যানার্জি বাড়ির কেউই।আর গ্রামের এমন কোনো মানুষ নেই যে বীরপ্রতাপ ব্যানার্জিকে এড়িয়ে চলে। 


যাই হোক, এখন বিজয়া মানে আমাদের বিনী সম্পর্কে একটু জানা যাক। বয়স তার সবে ১৭,দেখতে শুনতে ভালোই। গায়ের রং ধবধবে ফর্সা না হলেও শ্যামবর্ণা বলা যায়না,মুখশ্রীও তার খুব সুন্দর। হাসলে গজদাঁত দুটো বের হয়ে যেন আরও সুন্দর করে তোলে তাকে।শহুরে মেয়েদের মতো পার্লারের হাতের যাদু তার আজ অবধি শরীরের কোনো অংশে পরেনি,তবুও কোমর ছাড়িয়ে চুল,সৃষ্টিকর্তার নিজের হাতে আঁকানো ভ্রু সব মিলিয়ে আমাদের বিনী মা দুর্গা। মহাদশমীর দিন উমাদেবীর কোল আলো করে এসেছিলো বিনী,তাই নিজেই সখ করে নাম দিয়েছেন বিজয়া।গ্রামের স্কুলেই পড়াশুনো করতো সে। স্কুলের গন্ডী মাধ্যমিক অবধি ছিলো জন্য সেটুকুই কপালে জুটেছে তার।সামান্য মুদিখানা চালিয়ে বাবা আর পারেনি মেয়েকে শহরের স্কুলে ভর্তি করিয়ে পড়াশুনো করাতে। আর পাঁচটা মেয়ের মতো বিনীও স্বপ্ন দেখতো সে পড়বে,বড় হবে অনেক, বাবা মায়ের মুখ উজ্জ্বল করবে কিন্তু যেই বাতিতে তেলই ছিলো না সেই বাতি আর জ্বলবে কি করে!!! মেধাবী হওয়া সত্ত্বেও ডিগ্রির পথচলা বন্ধ হলো বিনীর ক্লাস টেনের পরেই। সারাদিন মায়ের হাতেহাতে কাজ করতো, পাশের বাড়ির মেয়েদের সাথে আড্ডা দিয়ে এদিক ওদিক ঘুরে বেড়াতো,আর গল্পের বই ধার করে নিয়ে এসে লুকিয়ে লুকিয়ে ঘরে পড়তো।


বেলা ১২টার দিকে হাতে একটা থলের মধ্যে বেশকিছু পেয়ারা নিয়ে নাচতে নাচতে বাড়িতে ঢোকে বিনী।মা যতই হাকডাক করুক না কেন সে ছিলো না বাড়ির আশেপাশে। 

"এই যে মহারানী, কোথায় গিয়েছিলি তুই??? কখন থেকে ডেকে ডেকে আমার গলা শুকিয়ে কাঠ হয়ে গেলো আর তোর পাত্তা নেই"।

" আরে মিলিদের বাড়িতেই তো ছিলাম মা,গল্প করতে করতে মিলি বললো পেয়ারা পারতে যাবে,তাই গেলাম আর কি"!!!!

"কি!!!!! তুই পেয়ারা পারতে গিয়েছিলি??? গাছে উঠেছিলি আবার তাইনা??? বলি ধিঙ্গিপনা কবে বন্ধ করবি তুই??? তোর বয়সী মেয়ের বিয়ে থা হয়ে বাচ্চার মা হয়ে গেলো আর এই বুড়ি এখনো গাছে উঠে পেয়ারা পারে"।

" আহঃ মা!!! কেন কথায় কথায় বিয়ে নিয়ে আসো বলতো?? কোন মেয়ের ১৮ বছরের আগে এখন বিয়ে হয় বলতো??? জেলে যাবার ভয় সবারই আছে।যাই হোক, বাজে কথা রাখো।ও মা!! দাও না একটু পেয়ারা কেটে, নুন লঙ্কা কাসুন্দি দিয়ে খাই"।

"আমার সময় নেই,নিজে করে খা।যতসব ছাইপাঁশ খাওয়া সারাদিন। এসব খাবে আর রাতে পেট জ্বালা করছে পেট জ্বালা করছে বলে বাড়ি মাথায় তুলবে"। বলতে বলতে নিজের কাজে মননিবেশ করলেন উমাদেবী। মায়ের কথা কান দিয়ে তার একদমই ঢুকলোনা,নিজেই দাঁ নিয়ে বসে পেয়ারা কেটে মনমতো তৈরি করতে শুরু করলো, করে নিয়ে বোনকে ডাক দেয় বিনী। 

" এই মিনি!! খাবি তো আয়।পরে কিন্তু বাটি চাটতে হবে"। দিদির ডাকে একটুও দেরি না করে ছোটোবোন মিনি এসে বাটি হাতে বসে পরে। দুবোন মিলে বেশ আয়েস করেই খাচ্ছিলো। তখনই বাইরে থেকে এক পুরুষকণ্ঠির আওয়াজ আসে।বিনীর নাম করেই ডাকছিলো। মেয়ে যাবার আগেই হাত থেকে ভাতের হাড়িটা রেখে উমাদেবী বাইরে যান। পুরুষকণ্ঠি আর কেউ না জমিদার বীরপ্রতাপ বাবুর ছোটোছেলে। বিনীর থেকে বয়সে একটু বড়,তবে বিনীর সাথে বেশ ভাব তার। নিজের ঘর থেকেই গল্পের বইগুলো পড়ার জন্য দেয় বিনীকে।আজ বাড়িতে আসার কারণ এটাই, দেখা করে বই নিয়ে যেতে বলেছিল বিনীকে কিন্তু সে কেন জায়নি তা একমাত্র বিনীই জানে।তাই বাড়ি বয়ে এসে নিজেই বই দিতে এসেছিলো তাকে।

"আরে ছোটোকত্তা!! আসুন আসুন!! বসুন না" বলে একখানা চেয়ার বারান্দায় টেনে দেন উমাদেবী। 

"আজ বসবোনা উমাকাকি,বাবা কিছু কাজ দিয়েছে করতে হবে এক্ষুনি। বিনী কোথায়???"

"ও ঘরে, পেয়ারা খাচ্ছে।দাঁড়ান ডেকে দিই। বিনী!!!! ওরে মুখপুড়ি এদিকে আয়, ছোটোকত্তা তোর খোঁজ করছেন"। 


ঘর থেকে রুদ্রর ডাক যে বিনী শোনেনি তা একদমই না। শুনেও না শোনার ভান করেছিলো কেননা ডাক কানে আসতেই তার ঠোঁটদুটো যেন বেশিই জ্বালাপোড়া শুরু করেদিয়েছে।মুহুর্তেই গতকালের ঘটনা মাথায় আবার ফিরে আসে তার। এখন যেহেতু মা ডাকছে,না গেলে ঘরে এসে বকাবকি শুরু করবে,তাই অগত্যা পেয়ারামাখার বাটিটা নিয়েই বাইরে যায় বিনী।


" বলো কি বলবে"??

"এই নাও বই,আজ আসতে বলেছিলাম এলে না কেন??"

"ভুলে গিয়েছিলাম তাই"।

" ঠিকাছে, নাও এটা। পড়া হয়ে গেলে দিয়ে এসো"। বলে বিনীর বাটি থেকে একটুকরো পেয়ারা খেয়ে নেয়।

"হুম!!" 


আর কোনো কথা হয়নি দুজনের মধ্যে। আর এতোটুকু সময় যে বিনী কথা বললো,একটিবারের জন্যও তাকিয়ে দেখেনি রুদ্রর দিকে। উমাদেবী সামনেই দাঁড়িয়ে ছিলেন তাই আর কথা না বাড়িয়ে রুদ্র চলে যায়। 

"ছোটোকত্তার থেকে বই নিয়ে এসে পড়িস তুই???"

"হ্যাঁ, কেন??"

"কখন পড়িস?? তোকে তো দেখিনা কোনোদিন বই নিয়ে বসতে"।

" রাতে পড়ি,কেন মনে নেই মেলা থেকে গল্পের বই কিনেছিলাম জন্য বাবা যে সেটাকে ছিড়েখুঁড়ে জ্বালিয়ে দিলো।তো এর পরেও তুমি আশাকরো আমি দিনের বেলা বই খুলে বসবো?? রাতে পড়ি,তোমরা ঘুমোনোর পর।দয়াকরে এটা আবার বাবার কানে দিতে যেও না।পড়াশোনা তো আর করতে পারলাম না।গল্পের বই পড়েই বাঁচি"। মেয়ের কথায় আর কোনো উত্তর দিতে পারেননি উমাদেবী। উনি নিজেও তো চেয়েছিলেন বিনী পড়ুক,কিন্তু স্বামীর আর্থিক অবস্থা সম্পর্কে অবগত ছিলেন জন্য মুখফুটে বলতে পারেননি।


বইটা বালিশের নীচে লুকিয়ে রেখে মায়ের হাতেহাতে সাহায্য করার জন্য যায় বিনী। মায়ের কাছে যেতেই উমাদেবী জিজ্ঞেস করে বসলেন।

"হ্যাঁ রে,ছোটোকত্তার সাথে তোর এতো ভাব কবে হলো???"

"কেন?? নিজেই তো নিয়ে যেতে আমাকে ছোটোবেলায়। আর উনি তো ঘরে বসে থাকেন না যে আমাকে দেখবেন না বা আমিও ঘরে বসে থাকিনা যে আমাকে চিনবেনা। পথচলতি কথাবার্তা,একদিন পড়া নিয়ে কথা উঠেছিল তখন নিজেই বলেছে বই নিয়ে গল্প পড়ার জন্য"।

" অমনি তুই হ্যাংলার মতো ছুটলি।বলি বুদ্ধিশুদ্ধি কবে হবে তোর?? বয়স হয়েছে, ওনার সাথে এমন ওঠাবসা থাকলে লোকে কি বলবে?? হ্যাঁ রে,শুধুই বন্ধুত্ব তো??" মায়ের প্রশ্ন শুনে কপালে বিন্দুবিন্দু ঘাম ফুটে উঠেছে তার।

"কিরে!!! কি ভাবছিস??? তোর কি ছোটোকত্তার সাথে....."

"না,শুধুই বন্ধুত্ব মা,কোথায় উনি আর কোথায় আমি"।

" সেটাই রে মা,নিজের ওজন বুঝে চলিস"। আর বসে থাকেনি বিনী মায়ের সামনে। উঠে এসে নিজের বিছানার উপর বসে ভাবতে থাকে কথাগুলো। সত্যিই কি বন্ধুত্ব????? হ্যাঁ, খুব ভালো বন্ধুত্ব ছিলো দুজনের কিন্তু গতকাল যখন বিনী বই দিতে গিয়েছিল রুদ্রকে,নিজের মনের কথা আর চেপে রাখতে পারেনি রুদ্র।বলেই ফেলে যে সে বিনীকে ভালোবাসে।বিনী অস্বীকার করে দেয় তার প্রস্তাব। তারও বক্তব্য এটাই ছিলো যে কোথায় রুদ্র জমিদার বংশের ছেলে আর কোথায় বিনী এক সামান্য দোকানদারের মেয়ে।এই সম্পর্ক কেউ কোনোদিন মেনে নেওয়া তো দূর,স্বপ্নেও ভাববে না। প্রত্যাখ্যান মেনে নিতে পারেনি রুদ্র।নিজের রাগকে নিজের বশবর্তী করতে না পেরে নিজের ঠোঁট দিয়ে জ্বালিয়ে দিয়েছিল বিনীর ঠোঁটদুখানি। নিজেকে ছাড়িয়ে নিয়ে বই না নিয়েই চলে এসেছিল বিনী। রুদ্রকে তার ভালো লাগলেও সমাজের কাছে হার মানলো বিনী। কিন্তু হয়তো এতেই ওর কপালে সুখ ছিলো। 


রাতে দোকান বন্ধ করে এসে ছেলেমেয়েদের সাথে গল্পে মেতে উঠেছিলেন অনুপবাবু। ঘড়ির কাঁটা তখন দশটা,বাড়ির সামনে কোনো গাড়ি এসে থামলো তা বেশ বুঝতে পারেন তিনি।


"অনুপ!!! বাড়ি আছো??? অনুপ!!!" ডাক শুনে গায়ে শার্টটা জড়িয়ে বের হন অনুপবাবু। জমিদার বীরপ্রতাপ ব্যানার্জি স্বয়ং হাজির তার বাড়িতে। 

"আরে কত্তা আপনি!!! আসুন আসুন!! ভেতরে আসুন!!! " বলে ঘরে নিয়ে যান ওনাকে। 

"উমা!!! দেখো কে এসেছে!! স্বয়ং দেবোতা আমাদের বাড়ি এসেছে গো!!" অনুপবাবুর ডাকে রান্নাঘর থেকে ছুটে আসেন উমাদেবী। জমিদার বাবুকে দেখে ছেলেমেয়েদের পাশের ঘরে পাঠিয়ে দেন উমাদেবী। 

"আসুন কত্তা!! বসুন!! এই গরীবের ঘরে এলেন আজ,কষ্ট করে বসুন।আমি জলমিষ্টি নিয়ে আসি"।

" ব্যাস্ত হয়োনা বউমা!! আমি অনুপের সাথে কিছু দরকারি কথা বলতে এসেছি।তা তোমরা সবাই ভালো আছো তো??"

"হ্যাঁ, কত্তা আপনার আশীর্বাদে চলে যাচ্ছে আমাদের দিন।তা কত্তা আপনি কষ্ট করে আসতে গেলেন কেনো?? আমাকে ডাকলেই তো আমি চলে যেতাম"।

" সে তো অবশ্যই। কিন্তু আমি ভাবলাম সুখবর যখন দেবো,তা নিজেই গিয়ে দিয়ে আসি"।

"সুখবর???"

"হ্যাঁ অনুপ,তোমার তো কপাল খুলে গেলো"।

" আজ্ঞে কত্তা আমি আপনার কথা কিছু বুঝে উঠতে পারছিনা"।

"বলছি,আমার এক বন্ধু এসেছিলো কালকে বাড়িতে।শহরে থাকে, ও ছেলের বিয়ের জন্য মেয়ে খুঁজছিলো। আমার বড়ছেলের বিয়েতে এসেছিল ওরা বাড়ির সবাই। তোমার বড় মেয়েকে দেখে খুব পছন্দ হয়েছে ওদের।ওরা তোমার মেয়েকে বাড়ির বড়বউ করে নিয়ে যেতে চায়।কোনোরকম দেনাপাওনার ব্যাপার নেই অনুপ।এককাপড়ে মেয়ে নিয়ে যাবে।বাকি বিয়ের আয়োজন নিয়ে তোমার চিন্তা নেই, এই নাও ১লক্ষ টাকা,এ দিয়ে মেয়ের বিয়ে মিটিয়ে দাও তুমি"। বলে অনুপবাবুর হাতে টাকা ধরিয়ে দিলেন তিনি। বীরপ্রতাপবাবুর কথা শুনে অনুপবাবুর চোখে আনন্দের জল।কথা হারিয়েছিলেন তিনি। 

" চিন্তা করোনা অনুপ,তোমার মেয়ে ভালো থাকবে। ওদের অবস্থা আমার থেকেও ভালো। প্রাসাদসম বাড়ি, গাড়ি, ব্যবসা সবমিলিয়ে এলাহি কারবার। ছেলে দেখতেও ভালো, স্বভাবেও"।

"আপনাকে যে কি বলে ধন্যবাদ জানাবো কত্তা জানিনা। আপনি নিজে আমার মেয়েটার জন্য এতোভালো সম্বন্ধ নিয়ে এলেন।আমি তো নিজের কপালকে নিজেই বিশ্বাস করতে পারছিনা"।

" আমি থাকতে তোমার চিন্তা কিসের অনুপ।তোমার মেয়ে তো আমার মেয়ের মতোই তাইনা"।

"কিন্তু কত্তা ওর বয়স যে এখনো ১৮ হয়নি??"

"ও নিয়ে তুমি ভেবোনা,আমি সামলে নেবো। আমি নিজে দাঁড়িয়ে থেকে তোমার মেয়ের বিয়ে দেবো অনুপ।তুমি বিয়ের আয়োজন শুরু করে দাও।সামনের মাসের ১২তারিখ তোমার মেয়ের বিয়ে"।


ঘরের ভেতর ভাইবোনদের সাথে থাকলেও কান বাইরের ঘরেই ছিলো বিনীর।জমিদার বাবুর সাথে বাবার হওয়া সব কথাই শুনেছে সে।উনি চলে যেতেই উমাদেবী এসে মেয়েকে আদর করতে শুরু করেন। 

"বিনীরে!! তোর তো সোনায় মোড়ানো কপাল রে।আমি খুব খুশি রে মা,এতো ভালো ঘরে তোর বিয়ে দিতে পারছি,ক'জন সাধারণ ঘরের মেয়ের এমন কপাল হয় বলতো???" 

মায়ের কথার কোনো উত্তর দিতে পারেনি বিনী।মুখখানা কালো করে বসেছিলো। কেননা তখন কিছু বললে আর কে কি বলবে না বলবে জানানেই তবে বাবা যে দক্ষযজ্ঞ শুরু করে দেবে তা ভালো করেই জানতো সে।তার চেয়ে মুখ বন্ধ রাখাই শ্রেয়। সবার সামনে তখনই বাবা এককথায় আদেশ করে দিলেন মেয়েকে, যে এইকদিন যেন সে বাইরে ঘোরাঘুরি না করে, বাধ্য মেয়ের মতো যেন থাকে। ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানিয়েছিলো বিনী। সেদিন সারারাত দুচোখের পাতা এক করতে পারেনি সে,বিয়ে করতে চায়না এখনি,আর পাঁচটা মেয়েরমতো সেও স্বাভাবিক জীবন কাটাতে চায়।কিন্তু এই কথা মুখে বলার সাহসটুকু করে উঠতে পারলোনা আর সে। তিনচারদিন স্বাভাবিক ভাবেই চলে যায়, আজকাল গল্প পড়তেও ভালো লাগেনা বিনীর। এদিকে বিনীর কোনো খবর না পাওয়ায় রুদ্রও অস্থির। না পেরে বিনীর এক বান্ধবীর হাত দিয়ে একখানা চিঠি পাঠায় সে।

"বিনী!!! ওই বিনী!!!!"

"কে রে???? ও সুধা!!! আয় ঘরে আয়,বিনী রান্না করছে।ভালোই হয়েছে এসেছিস।শুনেছিস তো বিনীর বিয়ে ঠিক হয়েছে??"

"হ্যাঁ কাকি,শুনেছি। কিন্তু বিনী এখন যায়না কেন আমার বাড়ি???"

"ওর বাবা না করেছে এইকটাদিন বাইরে ঘোরাঘুরি করতে, তাই।আসিস তোরা বাড়িতেই,মেয়েটা দুদিন পর চলে যাবে,তোরা আসলে ওরও মন ভালো লাগবে। সারাদিন তো মুখ কালো করে বসে থাকে মেয়েটা। ও বিনী!! যা তুই গিয়ে গল্প কর সুধার সাথে,আমি এটুকু করে নিতে পারবো "।

মায়ের কথায় হু হা কিছু না করেই সুধাকে নিয়ে চলে যায় পাশের ঘরে। 

" তুই এতো তাড়াতাড়ি বিয়ে কেন করছিস বিনী??? কি এমন বয়স তোর???"

"নিজের কপালটা কি আর নিজের লেখার ভাগ্যি আছে আমার সুধা??? আমি যে অভাগী, জন্মের পর থেকে যা মনে চেয়েছি হয়েছে কি?? যে এখন নিজের বিয়ে আটকাবো???"

"আইন বলে কিছু আছে তো দুনিয়াতে বিনী!!!"

"টাকার কাছে আইনও নস্যিরে সুধা!!! ছাড় ওসব, বল তোর কি খবর??"

"আমার খবর ছাড়,ছোটোকত্তা তোর জন্যে চিঠি দিয়েছে। আমি এটা দেওয়ার জন্যই এসেছি"।

" ছোটোকত্তা??"

"হ্যাঁ, উনি কোনো খোঁজ পাচ্ছিলেন না তোর, কাল আমার হাতে এটা দিয়েছেন।"

"কই দেখি!!" বলে বিনী সুধার হাত থেকে কাগজটা একপ্রকার ছিনিয়েই নেয়। 

"হ্যাঁ রে বিনী!! তোর সাথে ছোটোকত্তার এতো ভাব হলো কি করে?? তুই কি ভালোবাসিস তাকে???"

"চুপ কর সুধা চুপ কর।এ কথা এখন মুখেও আনিসনা"। বলে সুধার মুখ চেপে ধরে। 

" আমি যাই রে বিনী,পরে আসবো অন্যদিন।মা বকবে বেশি দেরি হলে"।

"আচ্ছা,আয়"। চলে যায় সুধা,ও চলে যেতেই চিঠিটা খুলে বসে। তাতে লেখা 

" আমি জানি তোমার বিয়ে ঠিক হয়েছে। এই মুহূর্তে বাবার বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোর সাহস বা ক্ষমতা কোনোটাই নেই আমার। তুমি ভেবোনা,আমি জানি তোমার বয়স এখনো ১৮ হয়নি। বিয়ের দিন আমি কোনো না কোনো ব্যাবস্থা করবোই।ততদিন ধৈর্য ধরে থাকো,আমি আছি তোমার পাশে।ভালোবাসি তোমায়,ভালোবাসবোও সারাজীবন, সে তুমি নাই বা বাসলে"। চিঠিটা পড়তেই চোখ দিয়ে জল গড়িয়ে পরলো বিনীর। সেও তো ভালোবাসে এই মানুষটাকে,কিন্তু সমাজ,বাবা-মা সবার কথা ভেবে সেদিন অস্বীকার করে দিয়েছিল তার প্রস্তাব। চিঠিটা বইয়ের ভেতর লুকিয়ে রেখে স্নানে চলে যায় সে।


এদিকে অনুপবাবু মেয়ের বিয়ের ব্যাবস্থা করতে শুরু করে দিয়েছেন। হাতেগুণে আর কটাদিন মাত্র।কিন্তু একটাই আশ্চর্য ব্যাপার যে ছেলের বাড়ি থেকে কেউই বিনীকে দেখতে আসেননি, এমনকি বিয়ে নিয়ে কোনো কথাবার্তা হয়নি অনুপ বাবুর সাথে। যার বাড়িতে মেয়ে দেবেন তাদের মুখখানাও আজ অবধি দেখতে পেলেন না। পাকাকথা, আশীর্বাদ কিছুই কি হবে না??? যেহেতু জমিদার বীরপ্রতাপ বাবু সবটা দায়িত্ব নিয়েছেন, আগ বাড়িয়ে তাকে গিয়ে কিছু বলেও উঠতে পারছেন না তিনি। এদিকে উমাদেবী দিনদিন একই কথা বলে মাথার পোকা খেয়ে ফেলছিলেন। অগত্যা সাহস করে একদিন দোকান বন্ধ করে চলেই গেলেন জমিদার বাড়ি। জমিদার বাবু তার বৈঠকখানাতেই বসেছিলেন। দরজার সামনে গিয়ে জিজ্ঞেস করে 

"আসবো কত্তা???"

"আরে,অনুপ যে। এসো এসো,তা কি মনে করে।বসো এখানে"।

" আজ্ঞে কত্তা কিছু কথা ছিলো"।

"বলো কি বলবে??"

"কত্তা ছেলের বাড়ি থেকে কি পাকাকথা আশীর্বাদ হবেনা????"

"ও!!! এই ব্যাপার??? ওরা বিয়ের দিনই তোমার মেয়েকে আশীর্বাদ করবে।আর এই যে পাকাকথার লেখা কাগজ,ওরা নিজেরাই করে কাল পাঠিয়ে দিয়েছে"। বলে অনুপের হাতে দিয়ে দেন উনি।

" ওনারা এলেন না কেন?? আমি গরীব বলে???"

"এমা!! না না,আসলে ওরা খুবই ব্যাস্ত মানুষ অনুপ।একটা দিন কাজের বাইরে থাকা মানে অনেক ক্ষতি। তাই আর কি, তাছাড়া ওরা আসলেও তোমার বেশ খরচা হতো।তাই আমিই না করে দিয়েছি"।

" ওহ্!!! "

"তা তুমি কি ছেলেকে আশীর্বাদ করতে চাও বিয়ের আগেই???"

"আসলে কত্তা.... আমি..... আসলে... "

"বুঝেছি। কাল দিন ভালো আছে,চলো তাহলে, গিয়ে আশীর্বাদ করে এসো"।

" কিন্তু কত্তা আমি তো এখনো ছেলের জন্য কিছু বানিয়ে উঠতে পারিনি সোনার জিনিস"।

"সে আমি দেখে নেবো। চলো,মেয়ের শ্বশুরঘর দেখে আসো নাহয় ,তবে তুমি একা যাবে,আর কেউ না। আমি আর তুমি যাবো"।

" আচ্ছা কত্তা,আসি তাহলে"।

"এসো,সকাল ১০টায় তৈরি থেকো"।

" আচ্ছা!!" বলে চলে যান অনুপবাবু।বেশ খুশি উনি,বাড়ি গিয়ে উমাদেবীকেও সবটা বলেন খুলে। তার খুব ইচ্ছে ছিলো যাবার কিন্তু যেহেতু জমিদারবাবু না করেছেন তাই আর মুখ ফুটে বলে উঠতে পারেননি।


পরদিন সকালে ১০টায় জমিদার বাবুর সাথে রওনা হলেন অনুপবাবু ছেলেকে আশীর্বাদ করতে। নিজের সাধ্যমতো মিষ্টি,মাছ,পানসুপুরি,ছেলের জন্য জামা কিনে চললেন। রাস্তা প্রায় ৩ঘন্টার। পথ পেরিয়ে গাড়ি গিয়ে থামলো এক প্রাসাদসম বাড়ির সামনে। গাড়ি থেকে নেমে হা করে তাকিয়ে ছিলেন উনি।নিজের চোখকে যেন বিশ্বাস করে উঠতে পারছেন না।

"কি দেখছ অনুপ!!!"

"এটা!!!!!"

"হ্যাঁ অনুপ, দুদিন পর তোমার মেয়ে এই বাড়ির বড়বউ হয়ে আসবে"।


অনুপবাবুর ইচ্ছে করছিলো ওখানেই জমিদারবাবুর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে।তার এই ঋণ যে উনি কোনোদিনই শোধ করে উঠতে পারবেনা।ভেতরে চলে গেলো দুজন। আশীর্বাদ, খাওয়া দাওয়া শেষ করে বিকেলে ৫টা নাগাদ রওনা হলেন বাড়ির উদ্দেশ্যে দুজন। বাড়ি ফিরে ঘরে ঢুকতে না ঢুকতেই উমাদেবী ছুটে আসেন। 

" হ্যাঁ গো!! দেখে এলে,করেছ তো ঠিকমতো আশীর্বাদ??"

"হুম!!!"

"তোমার মুখটা এমন শুকনো শুকনো লাগছে কেন গো??"

"কই!!! এতোটা পথ গেলাম,ফিরে আসলাম। সারাদিন ধকল গেছে তাই"। 

"আচ্ছা তুমি হাতমুখ ধুয়ে এসো,আমি চা দিচ্ছি"। 

" হ্যাঁ, দাও"। বলে গায়ের জামা,প্যান্টটা খুলে চলে যান কলপাড়ে হাতমুখ ধুতে।এসে এককাপ চা নিয়ে বসলেন। 

"কেমন গো মানুষজন?? ভালো তাইনা??? আর বাড়িঘর???"

"বাড়ি না বিনীর মা,ওটা প্রাসাদ। বাড়ি ভর্তি লোক,বাবা মা,কাকা কাকি,ভাই বোন,সবাই আছে।বাড়িতে কাজের লোকই তো ৮জন"।

" হ্যাঁ!!!!!! কি বলো???"

"তা নয় তো কি?? দুজন রাঁধছে,একজন তোমার বেয়ানের সেবা করছে। গাড়ি চালায় দুজন, আর কে যে কি করে তা ভগবান জানে"।

" আমাদের বিনীর কপালটা সত্যিই খুব ভালো তাইনা??"

"হুম!!! জামাইবাবাজিও খুব ভালো, আমি যেতেই পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলো।কতো গল্প করলো,বাড়ির সব মানুষগুলো খুব ভালো জানো"। মাথা নিচু করে চায়ের কাপের দিকে তাকিয়ে এক নিশ্বাসে বলে গেলেন অনুপ বাবু।

" যাক!! ঠাকুর মুখ তুলে চেয়েছেন আমাদের দিকে। বিনী ভালো থাকুক,আর কি চাই।তা ছেলেকে কি দিয়ে আশীর্বাদ করলে??"

"জমিদার বাবু সোনার চেইন নিয়ে গিয়েছিলেন"।

" কি বলো!!! আমরা তো ওনার কাছে শুধু ঋণি হয়ে যাচ্ছি গো"।

"হুম!!! আচ্ছা এই ব্যাগটা রাখো তোমার কাছে। সাবধানে রেখো"।

" কি আছে এতে??"

"টাকা দিয়েছেন জমিদারবাবু কিছু। বলেছেন কাল শহরে গিয়ে ব্যাঙ্কে মিনি আর অপুর নামে রেখে আসতে"।

" দেবতা দেবতা!!! জমিদার বাবু আমাদের সাক্ষাৎ দেবতা!!" বলে ব্যাগটা নিয়ে নিজের মতো রাখতে চলে যান উমাদেবী। মুখটা কালো করে বসে রইলেন অনুপবাবু। এতোগুলো কথা বানিয়ে নাও বলতে পারতেন স্ত্রীকে।

দেখতে দেখতে বিয়ের দিন এসে উপস্থিত, একটা মাস যে কি করে চলে গেলো টের পেলোনা বিনী। বাড়ি থেকে বেরও হতে পারেনি যে রুদ্রর সাথে দেখা করবে। এদিকে অনুপবাবু জমিদারবাবুর সহায়তায় বেশ এলাহি আয়োজনই করেছেন। চেনা পরিচিত, আত্মীয়স্বজন এমন কেউ বাদ নেই যে বিয়েতে বলেননি। শহরে গিয়ে বিনীর জন্য ভালো বেনারসি শাড়ি, গয়নাগাটি, সাজানোর জিনিসপত্র সবই কিনেছেন। সবাই-ই খুশি,শুধু বিনী বাদে। এদিকে সকাল গড়িয়ে দুপুর হতে চললো ছেলের বাড়ি থেকে গায়ে হলুদ আসার কোনো নাম নেই। কিছুক্ষণ পর জমিদার বাবু নিজেই এসে বললেন হলুদ আসবে না,এতোদূর আসা সম্ভব না, তাই নিজেদেরই করে নিতে বলেছেন। আর দেরি করা হয়নি,গায়ে হলুদের পর্ব শেষ হয়ে যায় বিনীর। বারবার শুধু গেটের দিকে তাকিয়ে দেখছিল, এই বুঝি রুদ্র এসে সব থামাবে। কিন্তু হায়রে,কোথায় রুদ্র?? তার কোনো খবর নেই। আসবে কি করে?? তাকে ঘরের ভেতর আটকে রেখে দিয়েছিলেন বীরপ্রতাপ বাবু।সকালে রুদ্র ফোন করে থানায় জানিয়েছিল যে ১৭ বছর বয়সী মেয়ের বিয়ে দেওয়া হচ্ছে,ওনারা যেন এসে বিয়ে আটকান। সে ফোন রাখতেই বড়বাবু জমিদার বাবুকে ফোন করেন। আগে থেকেই মোটা অঙ্কের পুঁজি পাঠানো হয়েছিল তাকে,কৃতজ্ঞতার খাতিরে ছেলেকে আটকানোর সাবধানবানী বড়বাবুই দিয়ে দেন জমিদার বীরপ্রতাপ বাবুকে। 

সন্ধ্যায় সাজগোছ করিয়ে বিনী তৈরি বধূবেশে। অপেক্ষা করতে করতে হাপিয়ে উঠেছিল সে,শেষ পর্যন্ত আশা ছেড়েই দিলো। প্রায় ৬টার দিকে বর এসে উপস্থিত, কিন্তু বরযাত্রী কোথায়??? কেউ আসেনি। একটা গাড়িতে শুধু ছেলে,তার বাবা,কাকু, আর এক ভদ্রমহিলা, ব্যাস শেষ। গন্ডগোলটা বাঁধলো উমাদেবী যখন ছেলেকে বরণ করতে গেলেন। গাড়ি থেকে ছেলেকে কোলে করে নামিয়ে হুইলচেয়ারে বসিয়ে নিয়ে আসা হলো। দেখামাত্রই চমকে হাত থেকে বরণডালাটা পরেই গেলো। অনুপবাবু নিজেই দৌড়ে এসে সব উঠিয়ে স্ত্রীর হাতে তুলে দেন। চোখের চাউনিতেই বুঝিয়ে দেন যাতে ভালোমতো বরণ করে জামাইকে ঘরে তোলেন। ইচ্ছে না থাকলেও কাজটা করতেই হলো উমাদেবীকে। বরণ শেষ করে অনুপবাবুকে টেনে নিয়ে গিয়ে ঘরে দোর দিলেন উমাদেবী। 

"পাগল হলে কি তুমি??? পঙ্গু ছেলের সাথে মেয়ের বিয়ে ঠিক করেছ?? হাঁটতে পারেনা, কথা বলতে পারেনা,এর সাথে আমার মেয়ে সারাজীবন কি করে থাকবে?? আমি হতে দেবোনা এই বিয়ে,তুমি ফিরিয়ে দাও ওনাদের"।

" এই বিয়ে হবে উমা,ভুলে যেওনা এর পেছনে জমিদার বাবু আছেন। সারাজীবনের জন্য আমাদের বাকি দুটো ছেলেমেয়েদের দায়িত্ব উনি নিয়েছেন। ওনার বিপক্ষে গেলে ভাতে মরতে হবে আমাদের "।

" মরবো,ভাতেই মরবো আমি, তাও বিনীর জীবন আমি নষ্ট হতে দেবোনা"।

"বাওয়াল করোনা উমা।আমি যখন বলেছি এই বিয়ে হবে তো হবে। দরকার পরলে তোমাকে আটকে রেখে দেবো আমি"।

" আসতে পারি???" দরজার বাইরে থেকে বিনীর হবু শ্বশুর মশাই অনিন্দ্য চ্যাটার্জি কড়া নাড়লেন। উমাদেবীর কোনো কথা না শুনেই দরজা খুলে দেন অনুপ বাবু। 

"আরে বেয়াই মশাই!! আসুন!!"

"মাফ করবেন আপনাদের কথায় ব্যাঘাত ঘটালাম,আমি কি একটু বিজয়ার সাথে কথা বলতে পারি???"

"অবশ্যই, এতে আবার জিজ্ঞেস করার কি আছে?? আসুন এই ঘরে আসুন,বিনী এখানে আছে"। বলে পাশের ঘরে নিয়ে যান ওনাকে। বাইরে এতোক্ষণ হইহট্টগোল, মা বাবার পাশের ঘরে হওয়া কথাবার্তা সবই শুনেছে বিনী।নিজে রুখে দাঁড়ানোর ক্ষমতা তার নেই, সবটা শুনেও চুপচাপ মাথা নিচু করে চোখের জল ফেলছিল বিনী।

" বিনী!!!! উনি তোর শ্বশুর মশাই, কথা বলবেন তোর সাথে "। বাবার বয়সী ভদ্রলোককে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলো বিনী। 

" থাক মা থাক!! বেঁচে থাকো,বিজয়ী হও"। অনিন্দ্য বাবুর মুখ থেকে এহেন শব্দ শুনে হা করে ছিলো বিনী।

"অনুপবাবু আপনি একটু বাইরে যান,আমি আমার মায়ের সাথে একটু একান্তে কথা বলতে চাই"।

" ঠিকাছে, আপনি কথা বলুন,আমি আসছি"। বলে চলে যান অনুপবাবু।

"দাঁড়িয়ে আছেন কেন?? বসুন না"। 

" হুম!! দেখো মা আমি জানি তুমি এখন সবটা জানো যে আমার ছেলে আর পাঁচটা ছেলের মতো স্বাভাবিক না।ধরে নাও ওকে স্বাভাবিক করার জন্যই আমি তোমাকে নিয়ে যাচ্ছি"।

"মানে??? সেবা করার জন্য???"

"হা হা!!! না মা,আমি তোমাকে সবটা আজই বলে তোমাকে নিয়ে যাবো। যাতে তুমি বাড়িতে পা দিতেই যুদ্ধ শুরু করতে পারো"।

" আমি বুঝতে পারছিনা কিছু আপনার কথা"।

"আমার ছেলের আজ থেকে ৮ বছর আগে স্বাভাবিক জীবনটাই ছিলো। এক্সিডেন্ট করলো আট বছর আগে। কোমড় থেকে পুরোটাই ওর প্যারালাইজড হয়ে গেলো। আমার টাকাপয়সার কোনো অভাব নেই মা,বিদেশেও নিয়ে গিয়েছিলাম।ভালোও হয়েছিল, আস্তেধীরে হাটতেও শুরু করেছিল। কিন্তু আবার একদিন সিঁরি থেকে পরে গিয়ে একই অবস্থা হয়ে গেলো ওর। ওর কোনো মাথায় সমস্যা নেই মা,ও পাগল না। আসলে ওর এই ঘটনার পর আমি আমার সমস্ত বিষয় সম্পত্তি,আমার যা আছে সবটা ওর নামে করে দিয়েছি। আর এই ডিসিশন আমার বাড়ির কেউ মেনে নিতে পারেনি। এমনকি ওর মাও না।আসলে সৌমাদ্রি আমাদের নিজের ছেলে না,বিয়ের সাতটা বছর নিসন্তান ছিলাম, তখন নিজের এতোকিছু আমি করে উঠতে পারিনি যে স্ত্রীর চিকিৎসা করাবো। তাই ওকে দত্তক নিয়েছিলাম আমরা। আমার স্ত্রী কৌশিকিও তখন ওকে ভালোবাসত।কিন্তু আমার অলক্ষ্যে আমার স্ত্রী নিজের গয়না বেঁচে নিজের চিকিৎসা করিয়েছিল যাতে নিজের সন্তানের মা হতে পারে। ও সাকসেসফুল হয়,সৌমাদ্রির যখন পাঁচ বছর বয়স তখন আমাদের মেয়ে হলো।আর তারপর থেকে ছেলের প্রতি ওর কোনো টান নেই। ওর ইচ্ছে ছিলো আমার ব্যাবসা,সম্পত্তি সবকিছুর উত্তরাধিকারী যেন আমাদের মেয়ে হয়।কিন্তু তা না হওয়ার জন্য খুবই ভায়োলেন্ট হয়ে গেলো, ছেলের এই অসুস্থতার সুযোগ নিয়ে দিন কে দিন ওর খাবারে ওষুধ মিশিয়ে ওকে এই হাল করে রেখেছে। আমি হাতেনাতে ধরেও আটকাতে পারিনি। বরং মিথ্যে বলে আমার নামে কেসও করে দিয়েছিল আমার স্ত্রী। দিনের পর দিন এসব দেখতে দেখতে হাপিয়ে উঠেছি আমি বিজয়া বিশ্বাস করো। আমি বাদে বাড়ির একটা প্রানীও আমার ছেলেটাকে ভালোবাসেনা শুধুমাত্র আমার মেয়ে ছাড়া,ও থাকলে হয়তো ও আটকাতে পারতো।কিন্তু ও থাকেনা এখানে, ও যখন আসে ওর দাদাভাইয়ের সবটা নিজের হাতে করে। ওইকটাদিন ওর খাবারের মধ্যে ওষুধ পরেনা।তখন আমার ছেলেটা একটু হলেও ভালো থাকে। ওর তো নিজেরও জীবন আছে,বাইরে পড়াশুনো করে,ও কতদিন থাকবে বলো। তাই আমি সেদিন বিয়েবাড়িতে দেখার পর অনেক ভাবলাম,যদি কেউ একজন আমার ছেলেটার পাশে থেকে ওকে এই মৃত্যুর হাত থেকে বাঁচাতে পারে। বিয়েতে বাড়ির কারোর মত নেই মা,আমি শুনিনি কারোর কথা। আজ শুধুমাত্র আমি আমার ছেলেটার মুখের দিকে তাকিয়ে তোমার কাছে ভিক্ষা চাইছি,আমার ছেলেটাকে তুমি বাঁচাও,ওকে ওর স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে দাও। আমি তোমার কাছে আর কিচ্ছু চাইনা। তোমার ওই বাড়িতে জলগড়িয়েও খেতে হবে না। আমার ছেলেকে শুধু নিজের করে দেখে রেখো তাহলেই হবে। আর বাকি তুমি যা চাইবে তাই পাবে। আমি কথা দিচ্ছি তোমাকে, অনিন্দ্য চ্যাটার্জি কথার খেলাফ করে না।আমি তোমার কাছে ভিক্ষা চাইছি মা,এই পোড়াকপাল বাবাটার দিকে তাকিয়ে তুমি চলো"। বলে বিনীর হাতদুটো ধরে হাউহাউ করে কেঁদেদেন অনিন্দ্যবাবু। 


সবটা শুনে বিনী কি বলবে কিছুই ভেবে উঠতে পারছিল না। শুনে তার নিজেরও খুব খারাপ লাগছে। অনিন্দ্যবাবুকে সান্ত্বনা দিলো শেষে বিনী।

"কাঁদবেন না,ভগবান আছেন, উনি সব ঠিক করে দেবেন। আচ্ছা একটা কথা বলবো???"

"বলো না মা কি বলবে??"

"আমি কি লেখাপড়া করতে পারি???"

"আলবাত পারবে,আমি পড়াবো তোমাকে। তুমি যতদূর পড়তে চাইবে আমি তোমাকে পড়াবো।কেউ বাঁধা দেবেনা,আমি কথা দিচ্ছি"।

" হুম!!!"

"তুমি যাবে তো মা?????"

"হুম!!!" 

সম্মতি দিয়ে দিলো বিনী,কি ভেবে দিলো তা সে জানে আর ভগবান জানে। অবশ্য বিয়ে না করলে লগ্নভ্রষ্টা হবে, বাবার মুখটা পুড়বে।যাও একজনের উপর আশা করেছিলো যে তাকে বাঁচাবে এই বিপদ থেকে, সেই রুদ্রর কোনো পাত্তা নেই। বাবা মায়ের করা অবিচার, রুদ্রর উপর রাগ সবটা বুকে চেপে বিয়ের পিড়িতে বসে পরলো বিনী।ছেলেটা কোনো কথা বলেনা,মাঝেমধ্যে হাত নাড়াচ্ছিল, রাগ করছিলো আবার হাসছিলও,যেই ভদ্রমহিলা সাথে এসেছিলেন উনি ধরে ধরে বিয়ের সমস্ত নিয়ম করিয়েদেন। বিয়ের আগে শুধু অনিন্দ্যবাবুই আশীর্বাদ করেছিলেন। বিয়ে শেষ হতে না হতেই অনিন্দ্যবাবুর মদ্যপ ভাই এসে উপস্থিত ঘরে। উনি ঢুকতেই ঘরের রজনীগন্ধার সুগন্ধ মদের গন্ধে চাপা পড়লো। ঢুকে বিনীর দিকে হা করে তাকিয়ে ছিলেন। পা থেকে মাথা অবধি অশ্লীল নজরে বিনীর দিকে চেয়েছিলেন উনি। হুজুগ উঠিয়েছিলেন আশীর্বাদ করবেন। কিন্তু ভাইয়ের অবস্থা শোচনীয় দেখে তাকে সড়িয়ে দেন অনিন্দ্য বাবু। সবকিছু শেষ করে ওইদিনই রাতে বাপের ঘরের সাথে মনে মনে সমস্ত সম্পর্ক চুকিয়ে বিনী পারি দিলো তার শ্বশুরঘরে। একটুও কাঁদেনি সে,একটা দিনে রক্তমাংসের জলজ্যান্ত মেয়েটা পাথরের ন্যায় শক্ত হয়ে গেলো।

রাত প্রায় সাড়ে বারোটা নাগাদ বিনী রওনা হয়েছিল তার বাড়ি থেকে শ্বশুরবাড়ির উদ্দেশ্যে, এতো রাত করে বের হবার কারণ তার জানা নেই। গাড়ি গিয়ে থামলো একবারে বাড়ির সামনে, সারারাস্তা একটুও ঘুমোয়নি বিনী। স্বাভাবিক বিয়ে বাড়ির মতো কোনোরকম জাকজমক নেই, শুধু ফুল দিয়ে একটা ছোটো গেট বানিয়ে রেখেছে। গাড়ি থেকে নেমে অনিন্দ্য বাবু সদর দরজার সামনে ছেলে ছেলের বউকে দাঁড় করিয়ে ভেতরে যান। প্রায় ১৫ মিনিটের মতো দাঁড়িয়ে ছিলো বিনী,কিন্তু কারোরই পাত্তা নেই। কিছুক্ষণ পর বাইরে থেকেই শুনতে পারে বিনী এক ভদ্রমহিলার গলা,তার সাথে অনিন্দ্য বাবুর বাড়ির ভেতর একচোট হচ্ছে। 

"আমি বরণ করবো না,তোমার ছেলে ছেলের বউকে তুমি বরণ করো"।

" তোমার বরণ করতে কি অসুবিধে শুনি??"

"আমি মানিনা এই বিয়ে। যে ছেলে আজ আছে কাল নেই, তার বউ এনে বাড়িতে বিধবা বানানোর কোনো মানে হয়না।মাঝে থেকে সারাজীবনের জন্য ঘাড়ের ওপর বোঝা হয়ে থাকবে"।

" কৌশিকি!!!! মুখ সামলে কথা বলো,ছেলের কি পরিস্থিতি তা আমার থেকে ভালো কেউ জানেনা আর এরজন্য কারা দায়ী সেটাও আমি ভালো করে জানি।করতে হবেনা তোমার বরণ,আমার ছেলে ছেলের বউকে আমিই বরণ করবো। ছন্দা!!!!!! ছন্দা!!!!! ঠাকুর ঘর থেকে বরণ ডালা এনে দাও আমাকে, আর কি কি করনীয় আমায় বলে দাও তুমি"।

"আচ্ছা দাদাবাবু"। 

অনিন্দ্য বাবু এসে দরজার সামনে দাঁড়িয়ে বরণ করলেন ছেলে ছেলের বউকে। ছন্দা,মানে চ্যাটার্জি বাড়ির সবচেয়ে অনুগত পুরনো কাজেরমহিলা অনিন্দ্যবাবুকে সব বলে দেন।নিজে উলুধ্বনি দিয়ে শাঁখ বাজিয়ে সবটা করান। বরণ করে ঘরে তুললেন দুজনকে অনিন্দ্যবাবু। এতোবড় বাড়িটায় একটা জনপ্রানীয় সেই মুহূর্তে নেই। সাথে যারা ছিলো তারাও যে যার মতো চলে যায় ঘরে। ছেলেকে তার ঘরে রেখে ছন্দাকে দিয়ে অন্যঘরে পাঠিয়ে দেন অনিন্দ্যবাবু। 

" এসো বউরানী এসো!! এই ঘরেই থাকবে তুমি আজকে"। ছন্দার কথায় হু হা না করে বিনী ঘরে ঢোকে। এই একটা ঘরই যেন তার পুরো বাড়িটার সমান। হা করে তাকিয়ে পুরো ঘরটা দেখছিল বিনী।

"তুমি শাড়ি পরতে পারো???" ছন্দার প্রশ্নে হুশ ফিরে আসে বিনীর।

"হ্যাঁ, পারি"।

" তাহলে তুমি এই শাড়িটা পাল্টে আলমারি থেকে পছন্দ মতো একটা শাড়ি পরে নাও,আমি এসে বাকিটা করে দিচ্ছি"।

"আমি পারবো"।

" তা বললে শুনছিনা। রান্নাঘরের কাজ ছাড়িয়ে দাদাবাবু আমাকে তোমার সাথে সারাদিন থাকতে বলেছে।ঠিকমতো কথা না মানলে আমার চাকরিটা যাবে"। বলে চলে যায় দরজার বাইরে ছন্দা। 

বেনারসি শাড়িটা খুলে আলমারি থেকে একটা শাড়ি বের করে নেয়।আগে থেকেই সেখানে প্রচুর শাড়ি, কুর্তি প্লাজো,জিন্সটপ সব আছে।পাশাপাশি বিভিন্ন সাজার জিনিস। শাড়ি চেঞ্জ করা হয়ে গেলে ছন্দা ভেতরে আসে। আলমারি থেকে ক্লিনজার,দুটো ক্রিম বের করে নিজেই বিনীর মুখের মেকাপ তুলে একদম পরিষ্কার করে দেয়।চুল খুলে ভালো করে আছড়ে বিনুনিও বেঁধে দেয়। 

"নাও তুমি এখন ঘুমোও, আমি সকালে আসবো। দরজা আটকে শোবে ঠিকাছে???"

"ঠিকাছে"। চলে যায় ছন্দা। সে যেতেই বিছানায় শুয়ে গায়ে চাদরটা টেনে দিলো বিনী। চোখে তখনও ঘুম নেই,এতোক্ষণ অনেক কষ্টে নিজেকে সামলে রেখেছিল, অবশেষে চোখের জলের বাঁধ ভেঙেই গেলো। পাশে একটা এমন কেউ নেই যে তাকে সান্ত্বনা দেবে। নিজেকে এই জগতে বড্ড একা মনে হচ্ছিলো তার। কাঁদতে কাঁদতে হয়রান হয়ে ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পরে বিনী। 


কথামতো পরদিন সকালে ৮টা নাগাদ এসে ছন্দা দরজা ধাক্কাতে থাকে বিনীর। শব্দে ঘুম ভেঙে যায়, উঠে গিয়ে দরজা খুলে দিয়ে এসে চোখ ডোলতে ডোলতে বিছানায় এসে বসে।

" ঘুম হয়েছে??"

"হ্যাঁ"।

" এই নাও তোমার ব্রাশ,পেস্ট,তোয়ালে। যাও ব্রাশ করে একবারে স্নান সেরে এসো। চা দিয়ে যাবে একটু পরে"।

"বাথরুম??"

"কেন?? এই যে??? চলো আমি দেখিয়ে দিই কোনটা কিসের,আর স্নান শেষ হলে এটা পরে বের হয়ে এসো,পরে শাড়ি পরে নিও"। বলে বাথরুমে সব দেখিয়ে দিয়ে ছন্দা বাইরে এসে বিছানায় বসে, কিছুক্ষণের মধ্যে স্নান সেরে বের হয়ে আসে বিনী। 

" তোমার কতবড় চুল গো। ভেজাতে গেলে কেন?? এই চুল কি অল্প সময়ে শুকোয়??? দাঁড়াও আমি শুকিয়ে দিচ্ছি"। বলে আলমারি থেকে ড্রায়ারটা বের করে আয়নার সামনে বসে চুল শোকাতে থাকে বিনীর। 


তখনই দরজা কোনোরকম নক না করেই ভেতরে ঢুকলেন অনিন্দ্য বাবুর স্ত্রী আর ছোটো ভাইয়ের বউ।

"কই দেখি,অজগ্রামের থেকে কাকে ধরে এনেছে???" বলে বিনীর থুতনি ধরে উপর দিকে তোলে। 

"দেখতে তো ভালোই, কি বলো দিদিভাই???"

"হুম!!তা বেশ,বলি লেখাপড়া জানো নাকি শুধু সই করতে পারো??"

"জানি"। 

"কতদূর পড়েছ??"

"ক্লাস টেন"।

" অশিক্ষিত। বিয়ে হয়ে এসেছ জন্য নিজেকে মহারানী ভেবে বসোনা আবার। নিজের ওজন যেটুকু, সেটা বুঝেই চলো।আর একদম আমার ছেলের ধারেকাছেও যাবেনা, বলে দিলাম কিন্তু"। কৌশিকিদেবী বেশ গলা উঁচু করেই বললেন। 

"কেন যাবোনা?? উনি আমার স্বামী। ওনার কাছে যাবো কি যাবোনা সেটা তো আমার ব্যাপার"।

" কি বললে?? মুখ তো ভালোই আছে দেখছি।আমার কথাটা কি কানে যায়নি?? টাকাপয়সার লোভে বিয়ে করেছ তা বেশ ভালোই জানা আছে আমার। নাহলে সুন্দরী হয়ে পঙ্গু ছেলের গলায় মালা দিতে না"।

"কোন পরিস্থিতিতে কি ভেবে বিয়ে করেছি তা আমার চেয়ে ভালো কেউ জানেনা। উনি সুস্থ হলেও আমার স্বামী, পঙ্গু হলেও আমার স্বামী"।

" এই ছেলে সুস্থ হবার নয়,চিতায় উঠলো বলে"। 

"চিতায় ওঠে নাকি দৌড়ে বেরায় তা তো ভগবানই জানে"।

" দিদিভাই!! এই মেয়ে বড্ড মুখকাটা আর অবাধ্য। চলো এখান থেকে"। বলে চলে যান দুজন। 


নীচের ড্রয়িং রুমে অনিন্দ্যবাবু বসে খবরের কাগজ পড়ছিলেন। স্ত্রী এসেই শুরু করে দিলেন 

"কাকে নিয়ে এসেছ তুমি?? অশিক্ষিত বেহায়া মেয়েছেলে একটা। অভদ্রের মতো মুখেমুখে তর্ক করে!!"

"নিশ্চয়ই তুমি এমন কিছু বলেছ যার পাল্টা জবাব দিয়েছে"।

" বাহঃ!! এখন আমার দোষ??? খুব সুন্দর, থাকো তুমি তোমার ছেলে ছেলের বউকে নিয়ে"। বলে নিজের ঘরে চলে যান তিনি। 


দুপুরে রান্নাবান্না সব কমপ্লিট হয়ে গেলে অনিন্দ্যবাবুর কথামতো ছন্দা বিনীকে নিয়ে নীচে আসে। অনিন্দ্যবাবু নিজে ছেলের ঘরে গিয়ে তাকে তৈরি করে নিয়ে আসেন ভাত-কাপড়ের অনুষ্ঠানের জন্য। এখনো পর্যন্ত স্বামীর মুখ থেকে কোনোরকম কথা শোনেনি বিনী। নীচে আসার পর বাবার হাতটা ধরে শুধু বললো অস্পষ্ট ভাবে

"কি হবে এসব করে??" ছেলের কথায় কোনো উত্তর না দিয়ে ভাত-কাপড়ের থালাটা তাকে ধরতে সাহায্য করে বিনীর হাতে তুলে দেওয়া হয়। অস্পষ্ট ভাবেই বলেছিল, তাও বলেছিল সৌমাদ্রি। ব্যাস,বিয়ের নিয়মরীতি শেষ, না হলো বউভাত না হবে ফুলসজ্জা। সে নিয়ে অবশ্য বিনীর কোনো মাথাব্যথা নেই।  

এই বাড়িতে আসার পর থেকে হাতেগুণে কটা মানুষের সাথেই দেখা হয়েছে বিনীর। আর কারোর দেখা পায়নি। ভাত-কাপড়ের অনুষ্ঠান শেষ হলে ছন্দা বিনীকে তার ঘরে নিয়ে গিয়ে গল্প করছিলো, কাল এই বাড়িতে আসার পর থেকে এই ছন্দাই অনেকটা কাছের হয়ে উঠেছিল বিনীর। যার কাছে সারাদিন বকবক করে মাথা শেষ করা মেয়েটার মৌনব্রত ভঙ্গ হয়েছে। কেটে গেলো এভাবে সারাটা দিন, রাতে ছন্দা যখন খাবার আনতে যাচ্ছিলো বিনীর জন্য তখন তাকে নিজে থেকে ডেকেই জিজ্ঞেস করে বিনী

" উনি কখন খাবার খান কখন???"

"কে বড়দাদা?? মানে তোমার বর??"

"হ্যাঁ "।

" এই তো সময় হয়ে গেছে, ১০টার দিকে মন্দিরাদি গিয়ে খাবার খাইয়ে দিয়ে আসে"।

"সবার যা রান্না হয় তাই খান নাকি আলাদা "??

" আলাদা রান্না হয়"।

"আচ্ছা"। 

" তুমি বসো, আমি নিয়ে আসি তোমার খাবার। তারপর ওই ঘরে গিয়ে শুয়ে পরো"।

"ওই ঘরে কেন??"

"বাব্বা!! বরের ঘরে থাকবে না তো কি একা থাকবে?? যদিও এটাও তোমার ঘর,তোমার যা ইচ্ছে"। বলে চলে যায় ছন্দা।


প্রথম দিন খাবার নিয়ে অশান্তি করলে বাড়িতে বেশ গন্ডোগোল হবে,এই ভেবে সেদিনের মতো চুপ থাকে বিনী। হঠাৎই লক্ষ করে তার কাকাশ্বশুর ঢুলতে ঢুলতে তার দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে হা করে তাকিয়ে আছে বিনীর দিকে। বেশ অনেকক্ষণ ওভাবেই দাঁড়িয়ে ছিলো, কিছুক্ষণ পর বিনীর দিকে এগিয়ে আসতে থাকলে তখনই ছন্দা ভেতরে ঢোকে। বুঝে যায় বদলোকের টেন্ডেন্সি ভালো না,নিজেই তার স্ত্রীকে ঘর থেকেই চিতকার করে ডাক দেয়।মাতালের স্ত্রী এসে ধাক্কাতে ধাক্কাতে ওই ঘর থেকে নিয়ে চলে যায় তাকে।

" এই বুড়োর থেকে সাবধানে থেকো বুঝলে? ঘরে ঢুকতে দেবেনা কিন্তু"।

"আচ্ছা!!"

"আচ্ছা না,চোখকান খোলা রেখো এই বাড়িতে। এক একজন মানুষ কিন্তু একএকটা যন্ত্র"।

" কেন??"

"কাল শুক্রবার, কাল সন্ধ্যায় তোমার শ্বাশুড়ির রূপ দেখতে পারবে"।

" মানে?? উনি কি বার হিসেবে পাগল হয়ে যান নাকি??"

"না না,চেহারা দেখেছ?? কে বলবে মহিলার ৫২ বছর?? এটুকু এটুকু ড্রেস পরে নাচতে যায়।ওই যে কি যেন বলে.... বড়লোক গুলোর নাচার জায়গা.. ধুর!! মনেও পরছে না। যাক গে বাদ দাও,কালকে নাচতে যাবে কতগুলো বদমহিলা নিয়ে, রাত পার করে ঢুলতে ঢুলতে বাড়ি আসবে"।

" আর বাকিরা??"

"তার বাধ্য জা অন্যলোকের সাথে শোয়। ছেলে মদ গেলে বাপের মতো।এমন কোনোদিন নেই যে ওইসব জায়গায় যায়না"।

" কোন জায়গায়??"

"তুমি দেখি কিছুই জানোনা। আরে মেয়েমানুষের জায়গা.. ও আমি ওতো খুলে বলতে পারবোনা আমার লজ্জা লাগে"।

" ওহ্!! বুঝলাম। আর মেয়ে আছে শুনেছিলাম যে??"

"ও বাইরে থাকে, সারাবাড়িতে বদগুনীদের মাঝে ও আর বড়দাদাবাবুই রত্ন"।

সেদিন রাত থেকে সৌমাদ্রির সাথেই থাকতে শুরু করে বিনী। যেহেতু সেদিনও খাবারের সাথে ওষুধ মিশিয়ে খাওয়ানো হয়েছিল তাকে,তার ফল বেশ ভালোই পায় বিনী নিজে। পাগলের মতো অত্যাচার শুরু করেছিল সৌমাদ্রি। সারারাত মেয়েটা ঘুমোতেও পারেনি। মনে মনে ঠিক করে নেয় আর হাল ছেড়ে রাখা যাবেনা। হলো ও তাই,পরদিন কোনোরকম ভাবে চলে যায় পুরো, রাতে ঘড়ির কাঁটা যখন ৯টায়,তখন বিনী যায় রান্নাঘরে। সময় ঠিকই ধরেছে, মন্দিরা সৌমাদ্রির খাবার রেডি করছিল, রান্না শেষ হয়নি। ছন্দার মতো ভালো সে একেবারেই নয়,বিনীকে দেখে বলে 

"কি চাই বউরানী??"

"কিছুনা,ওনার খাবার বানাতে এলাম"।

" কেন?? সে তো আমিই বানাই,আমিই খাইয়ে দিই"।

"এতোদিন করেছ,আর লাগবেনা।এখন তো আমি আছি,আমিই করে নেবো"।

" তা কেন?? ম্যাডামের আদেশ আছে,ওনার কথার খেলাফ আমি করতে পারবোনা"। এককথায় দুকথায় তখনই কৌশিকিদেবী রান্নাঘরে আসেন জল খেতে।

"কি ব্যাপার মহারানী??তুমি এখানে কি করছো??"

"দেখুন না ম্যাডাম, বলছে বড়দাদার রান্না নাকি আজ থেকে বউরানীই করবে"।

" কেন?? কোন আনন্দে??"

"কোনো আনন্দেই না মা।এতোদিন মন্দিরাদি করেছে। এখন তো আমি আছি।ওনার স্ত্রী হিসেবে ওনার যাবতীয় সমস্ত খেয়াল রাখা আমার দায়িত্ব, তাই আজ থেকে আমি করবো"।

" প্রথমত আমাকে মা বলে ডাকবেনা তুমি। আর বাবুর রান্না তুমি পারবেনা। তেল,ঝাল, মশলা সব বারণ।এসব তো জন্মে খাওনি,রাঁধোওনি। আর দুদিন ভালো মনে করবে,তিনদিনের দিন বাপের বাড়ি জানাবে যে আমরা তোমাকে দিয়ে কাজ করাই।ওসব ব্লেম আমরা ঘাড়ে নিতে পারবোনা।মন্দিরা এতোদিন ধরে করে আসছে,ওই করবে"।

"আমার বাপের বাড়ির সাথে সম্পর্ক ঘুচে গেছে, ও নিয়ে ভাববেন না আপনি মিসেস চ্যাটার্জি। আমার দায়িত্ব আমাকে পালন করতে দিন,ব্যাস আমি তাতেই খুশি"।

" হোয়াট ডিড ইউ সে?? মিসেস চ্যাটার্জি??? হাও ডেয়ার ইউ!!!!!" 

"ইয়েস মিসেস চ্যাটার্জি!! এ হোয়াইল এগো ইউ সেইড দ্যাট ডোন্ট কল মি ইয়র মাদার। দেন হোয়াট এলস ক্যান আই সে এক্সেপ্ট মিসেস চ্যাটার্জি ?? প্লিজ লিভ নাও,লেট মি ডু মাই ওয়ার্ক"। গ্রামের একটা সাধাসিধে মেয়ের মুখ থেকে ইংরেজি কথা শুনে হা হয়ে যান কৌশিকিদেবী। রাগের বশে গায়ে জাত তুলতে যান বিনীর,কিন্তু অনেকক্ষণ ধরে রান্নাঘরে কোনো গন্ডগোল হচ্ছে শুনে দরজার সামনে এসে দাঁড়িয়ে ছিলেন অনিন্দ্যবাবু,স্ত্রীর হাতটা ধরে ফেলেন। 

" নিজের রাগকে বশে রাখো,সবাই তোমার পোষা ঝি না যে যা বলবে মুখ বুজে তাই শুনবে। যাও এখান থেকে, আজ থেকে বাবুর সবটা বিনীই করবে"। দাঁড়িয়ে থাকেননি আর কৌশিকিদেবী, রাগে গজগজ করতে করতে বের হয়ে যান,পেছন পেছন মন্দিরা। দুজন চলে যেতে বিনীর মাথায় হাত দিয়ে অনিন্দ্য বাবু বলেন 

"খারাপ ভাবিস না,দেখবি একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। আচ্ছা,তুই না বলেছিলি টেন অবধি পড়েছিস,এতো ভালো ইংরেজি বলা কোত্থেকে শিখলি তুই??"

"স্কুল ছেড়েছিলাম,পড়া ছাড়িনি। গল্পের বই পড়তাম বিভিন্ন, রবীন্দ্রনাথ, শরৎচন্দ্র থেকে শুরু করে শেক্সপীয়ার, সক্রেটিস, পড়েছি"।

" বাপরে!! তুই তো দেখি দারুণ স্টুডেন্ট রে।পড়াবো মা,পড়াবো।তোকে আমি নিশ্চয়ই পড়াশোনা করিয়ে একদিন একজন বড়মানুষ করে তুলবো তুই দেখিস।তুই সব বিসর্জন দিয়ে আমার কাছে আমার ছেলের জন্য এসেছিস,এই বাপও তোর জন্য কি কি করে তুই দেখিস।ভালো থাক মা"।

"আচ্ছা বাবা,উনি কি রান্না খান বলুন তো। এখানে তো দেখছি কিছু সবজি আর মুরগী ছাড়া আর কিছুই নেই"।

" রাতে চিকেন স্টু খায় বাবু"।

"কিন্তু আমি যে বানাতে পারিনা"।

" তাতে কি?? আমি আছি তো, দাঁড়া"। বলে নিজের ফোন বের করে ইউটিউব চালিয়ে বিনীকে বলে দিতে থাকেন আর বিনী কথামতো বানাতে থাকে। 

"নাও, রেডি। যাই আমি খাইয়ে দিয়ে আসি ওনাকে"।

" হুম!! যা,কাল তোকে ফোন এনে সব শিখিয়ে দেবো।যা দরকার এখন এই ফোনেই সব পাবি"।

"আচ্ছা!!" বলে চলে যায় বিনী। রান্নাঘরের কারনামা এতোক্ষণ আড়ালে দাঁড়িয়ে সবটাই দেখেছিলেন কৌশিকিদেবী। সেদিন ওষুধ মেশানোর জন্য কোনো চান্স নিতে গেলে বিপদ ছাড়া আর কিছুই হবে না,তাই সেদিনকার মতো ছেড়ে দিলেন হাল। বিনী গিয়ে নিজের নানাগল্পে সৌমাদ্রির মন ভুলিয়ে তাকে খাবার খাইয়ে দেয়। তারপর নিজে খেয়ে ঘরে চলে আসে। ওষুধ পরেনি পেটে,আগের দিনের মতো ওতোটাও জ্বালায়নি বিনীকে সৌমাদ্রি। 


এভাবেই চলতে লাগলো দিন। আজকাল বিনী কাওকে সৌমাদ্রির ধারেকাছেও আসতে দেয়না। তার স্নান,খাওয়া, দেখাশোনা সবটা বিনী নিজের হাতেই করে। কাজের মহিলা হয়ে যায়নি,অনিন্দ্যবাবুর কড়া নির্দেশ ছিলো ছন্দার উপর, বিনীকে যেন রানীর মতো রাখা হয়,হয়েছিলোও তাই। আর বিনীর এমন পরিবর্তন কাজে ব্যাঘাত ঘটালো কৌশিকিদেবীর। দুপুর, রাত্রি কোনোসময়েই সৌমাদ্রির খাবার অন্যকাওকে করতে দেয়না বিনী। আর যতক্ষণ না রান্না শেষ হয়ে খাওয়ানো হচ্ছে বিনীকে সরানো যায়না। আজকাল ওষুধ পেটে না পরতে পরতে কিছুটা হলেও স্বাভাবিক হয়েছে সৌমাদ্রি। আগের মতো ওতোটাও পাগলামি করেনা সে। চিতকার চেচামেচিও কম করে। অসুবিধে হয়ে যাচ্ছিলো খুবই কৌশিকিদেবীর। রাগের বশে বিনীকে যা না তা বলতেন।তাকে অপদস্ত করার জন্য খাবারে ইচ্ছে করে নুন,ঝাল মিশিয়ে দিতেন যাতে বিনী খেতে না পারে। ইচ্ছাকৃত ভাবে ধাক্কা মেরে ফেলেদিয়েছিলেন বিনীকে একদিন। ভেবেছিলেন পরে গিয়ে হাত ভাঙবে,ব্যাস কাজ বন্ধ,উনি আবার নিজের মতো কাজ চালাবেন। কিন্তু হলোনা, একগাছ থেকে আরেকগাছে বিরিং করে লাফিয়ে ফুলফল পাড়া মেয়েটার এতো সহজে হাতটা ভাঙলো না,সামান্য চোট পেয়েছিল শুধু। 


অনিন্দ্যবাবু বুঝেছিলেন যে এই মেয়েই পারবে তার ছেলেকে ঠিক করতে। দুমাসে বিনীও অনেকটা পাল্টে গেছে। তাকে দেখে কমবয়সী মনে হলেও, ম্যাচুরিটির দিক থেকে তার বয়স অনেক বেড়ে গেছে। আসার পর থেকে যেমন গুম হয়ে বসে থাকতো,কথা বলতো না,এখন আর তা হয়না। ছন্দা,শ্বশুর মশাইয়ের সাথে মাঝেমধ্যে বেশ গল্প জমে যায়। আর যখন ঘরে থাকে,সৌমাদ্রির সাথে নিজেই বকবক করতে থাকে একাএকাই। অস্পষ্ট ভাবে সৌমাদ্রিও উত্তর দেয় মাঝে মাঝে। ৮ বছরের ওষুধের ফলাফল তো আর এতো সহজে যায়না,তবুও সে আগেরমতো নেই। মাঝে মাঝে হাসে,বিনীকে দেখে মাঝে মাঝেই সে কাঁদে,মনে মনে নিজেই ভাবে মেয়েটার জীবন নষ্ট হচ্ছে। 


বাড়ির আর কোনো লোকের সাথে বিনীর কোনো সম্পর্ক বা কথাবার্তা কিছুই নেই। মাঝেমধ্যে বদ বাপ ব্যাটার মুখোমুখি হলেও ছন্দার কথা অনুযায়ী তখনই এড়িয়ে চলে যায়। একদিন হাত চেপে ধরেছিল বিনীর অনন্ত,সৌমাদ্রির কাকাতো ভাই।কিন্তু ছন্দা চলে আসায় তখনই চলে যায় ওখান থেকে। বাপটার কথা নাই বা বললাম,তার চোখে বিনী যেন তন্দুরি চিকেন। দেখতে দেখতে চলে এলো বাঙালির সার্বজনীন উৎসব, মানে আমাদের দুর্গাপূজা। চ্যাটার্জি বাড়িতে আগে ঘটা করে পুজো হতো।তবে এখন আর হয়না। অনিন্দ্যবাবুকে কারণ জিজ্ঞেস করেছিল বিনী,উনি বলেন বাড়ির কোনোবউই এগিয়ে আসে না,আর তারপক্ষে এতোবড় পুজো সামাল দেওয়া মুশকিল তাই আর করেন না,অমানুষগুলোর জন্য নিজের বংশপরম্পরায় চলে আসা পুজো শিকেয় উঠেছে। শুনে খুবই খারাপ লাগে বিনীর,নিজেই বলে 

"বাবা!! এবার পুজো হবে। আমি দায়িত্ব নেবো"।

" তুই পাগল?? এটা কি সরস্বতীপুজো?? জানিস কত নিয়ম,কত বড় দায়িত্ব??"

"জানি,তুমি নাহয় বলে দিও,আমি সব পারবো। কাওকে সাহায্য করতে হবে না। পাড়ারমোরে পুজো হতো, করতাম ওখানে সবটা।আমি পারবো বাবা,পুজো হবে। এই বাড়ি অমঙ্গলের ছায়ায় ভরে গেছে। মা কে নিয়ে আসো বাবা,সব কালোছায়া মা'ই দূর করবে"। 

বিনীর কথাগুলোতে নিজের মনে বল পেলেন অনিন্দ্যবাবু। কথাদিলেন যে পুজো হবে। হাতে গুনে আর ১০দিন বাকি।সারাবাড়ি জুড়ে পুজোর ব্যাস্ততা তুঙ্গে। বিনীও সাহায্য করছিলো অনিন্দ্যবাবুকে এই বিষয়ে,আবার স্বামীর দিকেও নজর ছিলো কড়া। যতই এইকাজ করুক,সৌমাদ্রির প্রতি কোনো ত্রুটি নেই বিনীর,আর এটা অনিন্দ্যবাবুও বেশ লক্ষ করেছেন। মহালয়ার দিন থেকেই বাড়ির সেই খালি পুজোমন্ডপটা সেজে উঠলো। নিজে হাতে সাজিয়েছিলো বিনী। মায়ের চক্ষুদান শুরু করে পুজোর দিনের অপেক্ষা শুরু হলো। চতুর্থীর দিন রাতে বাড়ির সবাইকে এক জায়গায় ডেকে অনিন্দ্যবাবু বলে দিয়েছিলেন এই কটাদিন কোনোরকম যেন অমঙ্গল কাজকর্ম না হয়। পুজোয় কেউ না থাকতে চাইলে না থাকবে কিন্তু পুজোয় যে ব্যাঘাত ঘটাতে চাইবে তাকে বাড়ি ছাড়া করবেন অনিন্দ্যবাবু। তাকে কেউ পাত্তা দেয়না ঠিকই,কিন্তু এই নিয়ে কোনো কথা বাড়ায়নি আর কেউই। কল্পারম্ভ, বোধন আমন্ত্রণ, অধিবাসের মধ্যে দিয়ে শুরু হলো চ্যাটার্জি বাড়ির মহাষষ্ঠী।

চণ্ডীপাঠ, দেবীমন্ত্র,ঢাক কাসড়ের আওয়াজ সব মিলিয়ে চ্যাটার্জি বাড়ির দুর্গাপুজো দেখার মতো। অনিন্দ্য বাবু বিনীকে দেখে খুবই খুশি, তার যেমন বলা তেমন কাজ,একা হাতে দক্ষতার সাথে পুরো পুজো সামাল দিয়ে দিলো বিনী। গ্রাম থেকে বাবা-মাও এসেছিল একদিন, কিন্তু মেয়ে যে সেদিন তাদের সাথে মনখুলে কথা বলেনি ভালো করেই বুঝতে পারেন উমাদেবী। একান্তে বিনীর সাথে কথাও বলতে চেয়েছিলেন কিন্তু বিনীর আর কাওকেই নিজের বলে মনে হয়না,কাজের বাহানা দিয়ে এড়িয়ে গিয়েছিল। দেখতে দেখতে চারটা দিন কোনদিক দিয়ে চলে গেলো কেউ বুঝতে পারলোনা। দশমীর দিন দেবীর দর্পণ বিসর্জন, সিঁদূরখেলা দিয়ে শেষ হলো সব। বিকেলের দিকে সবাই প্রস্তুত প্রতিমা বিসর্জ্জনে যাবার জন্য। বাড়ির প্রত্যেকেই গিয়েছিল, কেউ বাদ নেই। অনিন্দ্য বাবু বিনীকেও বলেছিলেন যাবার জন্য, কিন্তু সে চলে গেলে সৌমাদ্রি একা থাকবে।আর বাড়ির কারোর উপর বিনীর ভরসা নেই যে ছেড়ে যাবে। তাই সে মানা করে দেয়, বাড়ির সবাই চলে যায়, পুরো বাড়িটাতে এখন খালি ওরা দুজন। বিনীর এই সীদ্ধান্তটা তার কাল হলো নাকি তাকে জীবনের সবচেয়ে বড় শিক্ষা দিলো, সেটাই দেখার। 


বাড়ির সবার মধ্যে অনিন্দ্যবাবুর ছোটোভাইও গিয়েছিল। স্বাভাবিক দিনে যে মদের গামলায় ডুবে থাকে সে দশমীতে কি পরিমান নেশায় বুঁদ থাকতে পারে তা বলার প্রয়োজন নেই। ঘাট পারে গিয়ে বোতল নিয়ে বসেছিলেন। শুধু চ্যাটার্জি বাড়িই না,ঘাটে বিভিন্ন বনেদি বাড়ি তথা কিছু ক্লাবের প্রতিমাও আছে। এতো তাড়াতাড়ি হবে না বিসর্জন। লোকেরও ভীড় বেড়েছে। এই সুযোগে হাওয়া হয়ে গেলো অনিন্দ্য বাবুর ভাই। এদিকে বাড়িতে কেউ নেই, বিনী ঘরে বসে সৌমাদ্রির সাথে রোজেরমতো বকবক করছিলো। কিছুক্ষণ পর দরজায় নক করার আওয়াজ পায় বিনী। ভেবেছিল চলে এসেছে হয়তো সবাই। উঠে গিয়ে দরজাটা খুলে দিতেই অতিন্দ্র, মানে অনিন্দ্য বাবুর ভাই ঢুকেই সৌমাদ্রিকে দড়ি দিয়ে বাঁধতে শুরু করে। বিনী আটকাতে গিয়েছিল, কিন্তু পারেনি।তার এক ধাক্কায় কপালটা এসে পড়লো খাটের কোনায়। মাথাটা ভনভন করে উঠলো তার। সৌমাদ্রিকে বেঁধে তার মুখে কাপড় গুজে দেয় অতিন্দ্র। তারপর বিনীর চুলটা ধরে উঠিয়ে এক ধাক্কায় বিছানায় ফেলে দেয়। ১৭ বছরের মেয়েটার রোগাপটকা শরীরটা শক্তি দিয়ে পেরে উঠলো না এতোবড় চেহারার পুরুষালি শক্তির সাথে। ছিড়েখুঁড়ে খুবলে গিললো বিনীর শরীরটা নরখাদক। চিতকার যাতে কেউ শুনতে না পারে তাই মুখটাও চেপে ধরেছিল বিনীর। চোখের সামনে স্ত্রীর ধর্ষণ দেখতে হলো অসহায় স্বামীকে। বাঁধন অবস্থায় পাগলের মতো ছটফট করছিলো, চিতকার করতে না পারায় গোঙাচ্ছিলো,আর চোখ দিয়ে ঝড়ছিলো অঝোর ধারায় জল। অবশেষে ক্লান্ত হয়ে ছেড়ে দিলো বিনীকে অতিন্দ্র,আর দাঁড়িয়ে না থেকে উঠে চলে গেলো ঘর থেকে। এতোবড় একটা ঘটনার সাক্ষী কেউ রইলোনা,হয়তো এই দিনটারই অপেক্ষা করছিল বদমাশটা। স্বামী তার পঙ্গু, কথাও ঠিক মতো বলেনা,সে আর কাকে জানাবে?? আর এই মেয়ে মুখ খুললে বাড়ির কেউই বিশ্বাস করবেনা। তাই সাক্ষী হিসেবে রয়েগেলো শুধু বিছানায় লেগে যাওয়া রক্ত। 


নড়তে পারছিল না বিনী,অচৈতন্যের মতো পরেছিলো বিছানায়। পুরো শরীরে অসম্ভব যন্ত্রণা, পাশাপাশি মনেও।চিতকার করে কাঁদতে লাগলো বিছানায় শুয়েই। ঘাটপারে বিসর্জন হলো দেবীর,বাড়িতে সম্মান বিসর্জন হলো আরেক দেবীর। কেউ নেই পাশে তার,যে তাকে তুলবে। শুধু তোলা বা ব্যথার যন্ত্রণায় পাশে থাকা না,সারাজীবনের জন্য তার সব যন্ত্রণা গুলোতে সান্ত্বনা, আশ্বাস, বা মলম দেওয়ারও কেউ নেই। মহাবিশ্বে এতোবড় এই গোল পৃথিবীতে সে একা,একদমই একা। নিজের যন্ত্রণা নিজের কাছে ধরে রেখেই আস্তেধীরে উঠে দাঁড়ালো বিনী। বিছানার চাদরটা উঠিয়ে সরিয়ে রেখে সৌমাদ্রির বাঁধন গুলো খুলে দেয়। খুলতেই চিতকার করে কাঁদতে শুরু করে সৌমাদ্রি,অস্পষ্ট ভাবে বারবার বলছিলো শুধু "পারলাম না"। কিন্তু বিনীর চোখে কোনো জল নেই আর,ঠোঁটের কোনায় তার হাসি। কিন্তু এই হাসি কিসের তা বোঝার ক্ষমতা হয়ে ওঠেনি সৌমাদ্রির। 


বাথরুম থেকে জল নিয়ে এসে সৌমাদ্রির চোখমুখ মুছিয়ে ফ্রেশ করে দেয়। হাঁটতে চলতে কষ্ট হচ্ছিলো, তাও সে নিজেকে যতটা পেরেছে, স্বাভাবিক রেখে চলেছে। প্রায় রাত ৯টা নাগাদ বাড়ির সবাই ফিরে আসে। অনিন্দ্য বাবু এসে বিনীর খোঁজ করছিলেন। বিনী তখন রান্নাঘরে ব্যাস্ত সৌমাদ্রির খাবার বানাতে। অনিন্দ্য বাবু আসতেই বিনী পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে তাকে

" শুভ বিজয়া বাবা"।

"শুভ বিজয়া মা,ভালো থাক,অনেক বড় হ।বছর বছর যেন এই দিনটা ফিরে আসে এই বাড়িতে"।

" আসবে বাবা!! মা জেগে গেছে, তাকে কি আর ঘুম পারিয়ে রাখা যায়???"

"ঠিক বলেছিস"। 

" যাই আমি খাইয়ে দিয়ে আসি ওনাকে"। বলে সৌমাদ্রির খাবার নিয়ে চলে যায় বিনী। কিন্তু খাবার মুখেই তুলছিলো না সৌমাদ্রি। তখনও কেঁদে চলেছে। 

"কেঁদোনা। বিসর্জন হলো আজ,এই দিনে কাঁদতে নেই। দুর্গার বিসর্জন হলেই কি আর অসুরদমন বন্ধ হয়?? কেঁদোনা,খেয়ে নাও"। 

বিনীর এতো শক্তভাষার কথা সৌমাদ্রি বুঝেছিল।খাইয়ে দিতে দিতে বিনী বলেছিল 

" তুমি আজকে কিচ্ছু দেখোনি। কাওকে কিছু বলবে না এই অবস্থায়। নিজের দিন আসুক,তখন দেখবো।"


কিন্তু চেপে রাখতে চাইলেও চেপে থাকলোনা ব্যাপারটা। ঘর পরিষ্কার করতে গিয়ে চাদরটা হাতে পরলো ছন্দার। কাওকে কিছু বলার আগে বিনীকে একান্তে পাকরাও করলো 

"এটা কি করে হলো???"

"হাত কেটে গিয়েছিল, ওটারই রক্তের দাগ,এই দ্যাখো"।

" আমাকে ভুল বোঝাতে এসোনা বউরানী। এই সামান্য হাতকাটায় এতো রক্ত বের হয়না। তোমার মাসিকও শেষ যে মাসিকের দাগ হবে ,সত্যি বলো বউরানী। কাল থেকে তোমার হাটাচলাও লক্ষ করছি। আমি বয়সে তোমার থেকে বড়,অভিজ্ঞতা বা বোঝার ক্ষমতা আছে আমার, সত্যিটা বলো।কি করে হলো?? কে করলো এই কাজ??"

"ভুলে যাও এই চাদরটা তুমি দেখেছ।ভুলে যাও তুমি আমাকে অস্বাভাবিক ভাবে হাঁটতে দেখেছ"। 

" কিন্তু কেন???"

"নিজের জীবনের আরেকটা দশমীর জন্য অপেক্ষা করো ছন্দাদি। আমি চাইনা সব কিছু এতো সহজে লিপটে যাক"।

" তোমার বয়স কম,তাই এসব বলছো"।

"বয়স কম তাতে কি?? অভিজ্ঞতা তো মনে হয় তোমার থেকে বেশি।কথা বাড়িও না আর,যাও।চাদরটা যেখানে ছিলো, ওভাবেই রেখে দাও"। বিনীর কথাবার্তা আজ বড়ই অস্বাভাবিক লাগলো ছন্দার। এতো নম্রভাষী বাচ্চা মেয়েটার গলা,হাবভাব সব একটা রাতে পাল্টে গেছে। আজ তার কথায় যেন আদেশ পেলো ছন্দা,আর চোখে আগুন। তাই কথা না বাড়িয়ে চলে যায় সেখান থেকে। 


ছন্দা চলে যেতে হুশ আসে বিনীর যে সে রান্না বসিয়ে এসেছিল সৌমাদ্রির। দৌড়ে রান্নাঘরে গিয়ে দেখে মন্দিরা খাবারের মধ্যে কিছু একটা মেশাচ্ছে। গিয়েই খপ করে হাতটা ধরে ফেলে পেছন থেকে। 

" কি মেশাচ্ছো???"

"কই কিছুনা!!" হাত থেকে ওষুধের শিশিটা ছিনিয়ে নেয় বিনী। তারপর দেয় হাতটা মচকে।

"ওমা গো!!!! মরে গেলাম গো!!! ও মা!!!!" চিতকার করতে থাকে মন্দিরা। তার চিতকার শুনে বাড়ির দুইবউ চাকরবাকর সব ছুটে আসে। 

"কি করছ টা কি??? ছাড়ো ওকে"। কৌশিকিদেবী বলেন। 

" যে বাঁচাতে আসবে তার গলা টিপে ধরবো, নাহলে এই চাকু দিয়ে কোপ মারবো।দূরে যাও!!!" 

"পাগল হলে কি তুমি???"

"অমানুষের সাথে থাকলে মানুষ থাকা যায়না। ওষুধ কার কথায় মেশাচ্ছিলে?? বলো????! জিজ্ঞেস করতে কৌশিকিদেবীর দিকে তাকায় মন্দিরা। উনি চোখ কটমট করে তাকিয়ে আছেন তার দিকে। ইশারায় বলতে বারণ করছেন আর কি। 

" কারোর না"।

"নিজের থেকে করছো তাই তো??? দেখাচ্ছি"। বলে হাতটা ছেড়ে দিয়ে ওষুধের শিশিটা খুলে পুরোটা মন্দিরার মুখ চেপে ধরে ঢেলে দেয় বিনী।ফেলতে যাতে না পারে মুখে চেপে ধরে রেখেছিল।ছাড়াতে পারেনি নিজেকে বিনীর থেকে। আর বাড়ির আর কেউ সাহসও পায়নি তাকে বাঁচানোর,কেননা বিনী নিজের হাতের সামনে ধারালো চাকুটা রেখেছিল। ফেলতে পারেনি মন্দিরা,চলে যায় পেটে ওষুধ। আর কিছুক্ষণের মধ্যে তার একশনও শুরু হয়। এতোগুলো একবারে পেটে যাওয়ায় সেন্সলেস হয়ে গিয়েছিল সে। তড়িঘড়ি করে তাকে হাসপাতালে পাঠানো হয়। কৌশিকিদেবী দাঁত চিবিয়ে বলছিলেন তখন বিনীকে,

" ওর কিছু হলে জেলে পাঠাবো তোমায় আমি"।

"যাবার আগে সবগুলোর হাটে হাড়ি ভেঙে দিয়ে যাবো। একটাকেও শান্তিতে থাকতে দেবোনা। সবগুলোকে যদি দশঘাটের জল না খাইয়েছি আমার নামও বিজয়া না"। বলে চলে যায় বিনী নিজের ঘরে। 


অনিন্দ্য বাবু অফিস গিয়েছিলেন। এসে সবটা জানতে পেরে বিনীকে নিজের স্টাডি রুমে ডাক দেন। 

" আমায় ডেকেছিলে বাবা??"

"আয় মা!! বস"। অনিন্দ্য বাবুর পাশের চেয়ারটাতে গিয়ে বসলো বিনী।উনি কিছু বলার আগেই বিনী নিজের থেকে বলে 

" আমায় ক্ষমা করে দিও বাবা,আজ রাগ সামলাতে পারিনি"।

"যা করেছিস বেশ করেছিস। তবে এসবের চক্করে তুই নিজেকে হারিয়ে ফেলছিস বিনী"।

" মানে??"

"আমি কথা দিয়েছিলাম যে তোকে আমি বড় করে তুলবো।কিন্তু আমার ছেলের জন্য তুই সারাটা দিন তার পেছনেই সময় দিস। তোকে ঘরে বইখাতা, মাস্টার দিয়ে তো লাভ হচ্ছে না কোনো।"

"চিন্তা করোনা বাবা,হবে সব"।

" চিন্তা করতে বাধ্য হচ্ছি মা। শরীরটা ভালো নেই আমার, আজ ডাক্তার দেখালাম। উনি কমপ্লিট রেস্ট নিতে বলেছেন। কিন্তু আমি শুয়ে থাকলে তো আমার এই সাম্রাজ্যটাও শুয়ে থাকবে।আর যে কেউ নেই আমার"।

"কেন তোমার মেয়ে??"

"ও এসবের প্রতি কোনোদিন ইন্টারেস্ট দেখায়নি।ও আসবেও না"।

" তাহলে করনীয়??? কারণ তোমাকে যখন ডাক্তারবাবু রেস্ট নিতে বলেছেন,তুমি রেস্টই নেবে"।

"হুম!! সেই ভেবেই একটা সীদ্ধান্ত নিয়েছি আমি"।

" কি বাবা??"

"কাল থেকে তুই অফিস যাবি"।

" আমি???? আমি কি করে যাবো বাবা?? আমি তো এসব কাজ সম্পর্কে কিছুই জানিনা।না কোনোদিন দেখেছি না আগের অভিজ্ঞতা আছে"।

"সে ব্যাবস্থাও করে এসেছি। অফিসে ইন্দ্রনীল তোকে সবটা শিখিয়ে দেবে। আর বাড়িতে আমি তোকে নিয়ে রোজ রাতে বসবো বাবু ঘুমোনোর পর। এই নে তোর ল্যাপটপ, এটায় শিখিয়ে দেবো, এটাতেই কাজ করবি"।

" আর আমার পড়াশোনা??"

"সকালে ৫টায় উঠবি,৬টায় একজন পড়াতে আসবে। তারপর তুই বাবুর যা করার করবি। তারপর দশটায় অফিস আর সন্ধ্যা ৬টায় একজন আসবে। দুজন পড়াবে। আর আমি তোর কলেজের এডমিশনের ব্যাবস্থা করে এসেছি"।

" আমি তো উচ্চমাধ্যমিকই দিলাম না,কলেজ যাবো কি করে??"

"তা নিয়ে তোর ভাবতে হবে না। আমি চাই চ্যাটার্জি সাম্রাজ্যের পরবর্তী উত্তরসূরী তুই হবি।এটা আমার আবদার তোর কাছে। তারজন্য তুই নিজেকে কিভাবে গোড়ে তুলবি তুই ভাব।সারাজীবন বাবুর সেবা করবি নাকি সবার নাকে দড়ি দিয়ে ঘোড়াবি। ক্ষমতা না আসলে রক্তের বোঝা ঘাড় থেকে যাবেনা বিনী। লোহাকে পেটাতে হলে নিজেও লোহা হয়ে ওঠো।" 

"তুমি কি করে জানলে???"

"ছন্দা বলেছে। ইচ্ছে করছিলো জেলে দিয়ে দিই।কিন্তু আমি তোর হাতে এসবের শেষ দেখতে চাই।তৈরি কর নিজেকে। তোর এই বাবা তোর পাশে আছে"।

" আর তোমার ছেলের দেখাশোনার কি হবে??"

"রান্না নাহয় আমিই করলাম,রাতে নাহয় তুই করে খাওয়ালি।"

অনিন্দ্য বাবুর কথামতো পরদিন বিনী সকাল সকাল উঠে পড়ার পাশাপাশি সৌমাদ্রির সবটা করে রেখে ছন্দাদির উপর দায়িত্ব দিয়ে দেয় সৌমাদ্রির। প্রথম দিন অফিসে অনিন্দ্য বাবুই নিয়ে যাবেন। রেডি হয়ে ড্রয়িং রুমে অপেক্ষা করছিলেন বিনীর জন্য। 

"কিরে বিনী!!! তোর হলো????" 

"আসছি বাবা!!!" কিছুক্ষণের মধ্যে বিনী নিচে নেমে আসে। সোফায় বসে কৌশিকিদেবী নিউজ পেপারে চোখ বোলাচ্ছিলেন। বিনী নিচে আসতেই অনিন্দ্য বাবুকে জিজ্ঞেস করলেন 

"কোথায় যাওয়া হচ্ছে মহারানীকে নিয়ে??"

"অফিসে"।

" কেন?? ঝারপোছ করার জন্য ওকে নিয়ে যাচ্ছো নাকি??"

"ঝারপোছ করার লোক আছে গিন্নী। মহারানীকে দিয়ে কি আর ঝারপোছ করানো মানায়?? যতদিন না ছেলে ঠিক হচ্ছে ততদিন মহারানীকে আমার চেয়ারটাতে বসিয়ে রাখি"।

" কি!!!!!!!!! পাগল হয়ে গেছো কি তুমি??? ওকে অফিসের দায়িত্ব দিচ্ছো??? কোম্পানি ডুবিয়ে ছাড়বে। পড়াশুনো যানেনা কিছুনা ও কি অফিস সামলাবে??"

"সেটা আমি বুঝে নেবো। চল বিনী"। বলে চোখের সামনে দিয়ে বিনীকে নিয়ে বের হয়ে গেলেন অনিন্দ্য বাবু। রান্নাঘর থেকে ছোটোবউ সবটাই শুনেছে। এসে কৌশিকিদেবীর কানে বিষ ঢালতে শুরু করলেন 

" হাল টেনে ধরো দিদিভাই। এ মেয়ে কিন্তু সর্বস্ব হাত করে ছাড়বে।"

"সেটাই তো দেখছি। কিছু একটা করতেই হবে ছোটো।আমি একটু বের হবো এখন বুঝলি।কেউ জিজ্ঞেস করলে বলবি শপিং মলে গেছি"।

" ঠিকাছে দিদিভাই"। 

নিজের ঘরে গিয়ে শাড়ি চেঞ্জ করে হালকা মেকঅাপ করে বের হয়ে গেলেন কৌশিকিদেবী একাই। ড্রাইভারকেও নিলেন না,একাই ড্রাইভ করে বের হয়ে গেলেন নিজের সার্থ পূরণের উদ্দেশ্যে। ১৫ মিনিটের মধ্যে পৌঁছেও গেলেন নিজের গন্তব্যে। ডোরবেল টিপতেই দরজা খুললো এক কমবয়সী মেয়ে। 

"কাকে চাই???"

"মানালি আছে??"

"হ্যাঁ আছে,আসুন।। আপনি বসুন আমি ম্যাডামকে ডেকে দিচ্ছি"। বলে মেয়েটি চলে যায়। খানিক সময় বাদে নিচে নেমে আসলো এক ভদ্রমহিলা। ঘরেও মেকাঅাপ করে বসে আছে। পরণে হাল্কা গ্রিন কালারের হাউজ কোট। কৌশিকিদেবীকে দেখে বললেন। 

" কি ব্যাপার!! আজ দেখি মেঘ না চাইতেই জল। চল আমার ঘরে, ওখানে কথা বললো"। বলে নিয়ে যান তাকে ঘরে। 

"রেড ওয়াইন না স্কচ???"

"স্কচ!!" 

দুটো গ্লাসে দুপেগ বানিয়ে টেবিলে রেখে বসলেন ভদ্রমহিলা। 

"তাহলে আজ কি মনে করে সখী"???

" আই নিড ইউর হেল্প মানালি"। 

"হোয়াট হ্যাপেন বেব!! ইজ এভ্রিথিং অলরাইট"।

" নো ইটস নট!!! আই কান্ট টোলারেট দ্য বুলশিট এনি মোর"!!!

"হু!!!???"

"কে আবার, ওই দুপয়সার ভিখিরিটা,যাকে আমার হাসবেন্ড বাড়ির লক্ষ্মী বানিয়ে এনেছে"।

" কি করেছে??"

"বিয়ের বছরও পার হলোনা,সব নিজের হাতের মুঠোয় আনতে শুরু করেছে। ভ্যাবলা ছেলেটাকে যাও ওষুধ দিতে পারতাম,এখন এই মেয়ের জন্য তাও পারিনা। আজ তো আরও বাড়াবাড়ি, অফিসে নিয়ে গেলো,বলে ও কিনা অফিস সামলাবে। তুই বল, সহ্য করা যায় এগুলো???"

"তাহলে?? কি চাইছিস কি তুই এখন??".

" এনি হাও মেয়েটাকে সরাতে হবে বেব!! নাহলে আমার কোনো কাজ সফল তো হবেই না। ওই পঙ্গুটাও ঠিক হয়ে যাবে। তুই একটা বুদ্ধি দে প্লিজ!! আর নিতে পারছিনা এসব আমি"।

"ডোন্ট ওয়ারি!! এনজয় দ্য ড্রিংক। আই উইল হ্যান্ডেল ইট!!"

"আর ইউ শিয়র???"

"থাউজ্যান্ড পারসেন্ট!!! ইউ জাস্ট ট্রাস্ট মি,আই উইল টেককেয়ার অফ দ্য রেস্ট!!"

"থ্যাংকস ডিয়ার "!! 


অনেক বসে দুজন গল্পগুজব খাওয়াদাওয়া করে বিকেলে বাড়ি ফিরলেন কৌশিকিদেবী। বাড়ি ফেরার পর থেকে ভোল পাল্টে গেলো কৌশিকিদেবীর। সন্ধ্যা ৭টায় বিনী ফিরে আসে বাড়িতে। ও ঢুকতেই কৌশিকিদেবী বললেন 

" যাও ফ্রেশ হয়ে এসো। আমি চা বানাচ্ছি,একসাথে খাবো"। শ্বাশুড়ির মুখ থেকে এই কথা শুনে বিনীর ভিড়মি খাবার যোগার। অনিন্দ্যবাবুও হা হয়ে যান। কথা বাড়িয়ে বিনী চলে যায় ঘরে, গিয়ে ফ্রেশ হয়ে ঘরে আসতে না আসতেই নিচের থেকে কৌশিকিদেবী ডাকাডাকি করতে থাকেন। শুনে বিনী ড্রয়িং রুমে যেতেই তাকে সোফায় বসিয়ে গরম গরম চা আর কুকিজ হাতে তুলে দেন কৌশিকিদেবী। পাশাপাশি অনিন্দ্য বাবুকেও। দুজনের মুখ বন্ধ, নিজেই বলতে শুরু করলেন 

"জানি আমার এগুলো তোমাদের নাটক মনে হবে। কিন্তু আমি সত্যি আজ যা করেছি মন থেকে। আর বিনী,এক্সট্রিমলি সরি,এতোদিন তোমাকে অনেক কষ্ট দিয়েছি। কিন্তু আজ রিয়েলাইজ করলাম যে আমিই ভুল করে এসেছি এতোদিন। আমাকে ক্ষমা করে দিও প্লিজ"। 

" এভাবে বলোনা। আমি বয়সে অনেক ছোটো, তুমি তো আমার মায়ের মতোই। ক্ষমা চেয়ে আমাকে ছোটো করোনা"। বিনীর কথা শেষ হতেই তাকে জড়িয়ে ধরলেন কৌশিকিদেবী। তার এমন পরিবর্তন সত্যিই হজম হচ্ছিলো না অনিন্দ্য বাবুর। 


আসলে এতো ভালো অভিনয় ক'জন ধরতে পারে?? বিনীও সন্দেহ করতে শুরু করেছিল। কিন্তু অফিস যাবার সময় জোর করে খাইয়ে দেওয়া। রাত করে কাজ পড়া করার সময় কফি করে খাওয়ানো। মাথা ব্যাথা হলে তেল দিয়ে দেওয়া,সব দেখতে দেখতে বিনীর সন্দেহ বেশিদিন স্থগিত হলোনা। ভাবলো সত্যিই পাল্টে গেছে। কিন্তু এই অভিনয় যে বিনীকেই শেষ করার তা হতভাগী বুঝতে পারলোনা। কেটে গেলো আরও একটা মাস,বিনী এখন দক্ষতার সাথে নিজের অফিস,পড়া,স্বামীর সেবা সবটা সামলায়। মাঝে একদিন সৌমাদ্রিকে নিয়ে ডাক্তার দেখাতে নিয়ে গিয়েছিল। সব টেস্ট করিয়ে নতুন ওষুধ পত্র আর একজন ফিজিওথেরাপিস্টের সাথে কথাবার্তা বলে সবটা ঠিক করে নেয়। সৌমাদ্রির দেখা শুনো করার জন্য ছন্দাদির পাশাপাশি আরেকজন মহিলাকেও রেখেছে বিনী। আর ছেলের ওপর নজর রাখার জন্য তো বাবা ছিলেনই।


এমনই একদিন কাজ সেরে অফিস থেকে ফিরতে বিনীর খুবই লেট হয়ে গিয়েছিল। আর কপালটাও এমন সেদিন বাড়ির গাড়ি নিয়ে অফিস যাওয়া হয়নি। ড্রাইভার মা অসুস্থ বলে ছুটি নিয়েছে,আসলে এটা টাকার বিনিময়ে মিথ্যে বলা।অফিস থেকে বের হয়ে কিছুটা দূর হাটতে হাটতে চলে আসে বিনী ট্যাক্সি ধরার জন্য। হ্যাঁ, এসেছিল ট্যাক্সি,এসে তাকে তুলে নিয়ে চলে গেলো। এদিকে ঘড়ির কাঁটা ১২টা ছুই ছুই। অনেকবার ফোনও করেছিলেন কিন্তু ফোন বন্ধ বিনীর। গাড়ি নিয়ে অফিসেও যান,সেখানেও সে নেই। অনেক খোঁজ করার পর বাধ্য হয়ে পুলিশের কাছে যান অনিন্দ্য বাবু। বিনীর একখানা ছবি দিয়ে মিসিং ডায়েরি করে আসেন। প্রায় ৭দিন হতে চললো, বিনীর কোনো খোঁজ পাওয়া যায়নি। পুলিশকেও তখন অকর্মন্য বলে মনে হচ্ছিলো অনিন্দ্য বাবুর। বিনীকে খুঁজে বের করতে কোনো রকম চেষ্টা বাদ রাখলেন না,তাও আসলোনা মেয়েটা বাড়ি ফিরে। 


ঘরের লক্ষ্মী ঘর ছাড়া হলো,না ঘর ছাড়া করা হলো। নিজের আনন্দ আর মনে চেপে রাখতে পারলেন না কৌশিকিদেবী। ঘটা করে নাইট ক্লাবে পার্টির ব্যাবস্থা করেছিলেন। ধীরে ধীরে এই বাড়িটাও তার পুরোনো অবস্থাতেই ফিরে আসতে শুরু করলো। সারাদিন ঝগড়া কেচার। অশ্রাব্য ভাষায় গালাগালি,যে যার মতো দিন নেই রাত নেই বের হচ্ছে। কেউ ঢুলতে ঢুলতে বাড়ি ঢুকছে বা কেউ শার্টভর্তি লিপস্টিকের দাগ নিয়ে আসছে। খুবই ভেঙে পরেছিলেন অনিন্দ্য বাবু।তার শরীর আগের থেকে আরও বেশি খারাপ হতে শুরু করলো। অফিস যেতে পারছেন না,কাজ লাটে উঠছে। কোনো উপায় না পেয়ে হিমাদ্রিকেই অফিস পাঠানোর কথা বললেন যেটা তার একদমই ইচ্ছে ছিলোনা।সৌমাদ্রির উপর প্রতিটা সময় নজর দেওয়াও সম্ভব হচ্ছিলো না তার পক্ষে। তাকে আবার যে ওষুধ দেওয়া শুরু হয়েছে ভালো করেই বুঝতে পারলেন তিনি। বাধ্য হয়ে ছেলেকে বাড়ি ছাড়া করলেন অনিন্দ্য বাবু সকলের অলক্ষ্যে । নিজের বিশ্বস্ত একজন পরিচিত ভদ্রমহিলার বাড়িতে তার থাকার ব্যাবস্থা করে দিলেন। সমস্ত খরচ নিজে তুলে দিয়ে আসেন তার হাতে। ছেলে ঘরে নেই কোথায় গেলো এ নিয়ে খুবই অশান্তি করেছিলেন কৌশিকিদেবী, কিন্তু মুখ খুললেন না অনিন্দ্য বাবু।

" দিদি!!!! ও দিদি!!!! আরে ওঠো!!! বেলা যে গড়িয়ে এলো। সকালের চা কি দুপুরের ভাতের সাথে খাবে নাকি???" দরজার বাইরে থেকে পরমা গলা ফাটিয়ে ডাকা শুরু করেছে। খেয়াল করেনি বড়দি যে বাড়িতে। বলতে না বলতেই বড়দি এসে দিলো এক ধাওয়া 

"কি হচ্ছেটা কি পরমা??? কতবার বলেছি তোকে যে ওকে ডাকবিনা!!! জানিস ও কখন ঘুমোয়??? যা নিজের কাজে যা,ওর যখন ওঠার ও উঠবে"।।

" ভুল হয়ে গেছে দিদি!!" বলে চলে যায় পরমা। কিন্তু এতো ডাকাডাকিতে ঘুমটা ভেঙেই গেলো বিনীর।চোখ ডোলতে ডোলতে নীচে এসে সোফায় ধপ করে বসে পরলো। 

"কিরে!! ঘুম হয়নি???"

"না গো বড়দি। কাল খুব ঘুমের ডিস্টার্ব হয়েছে"।

" সারাদিন মাথায় হাজার চিন্তা নিয়ে থাকলে তো হবেই এমন। এই নে চা,খেয়ে নে।"

"হুম!!!" 

"তোর কাজ কতদূর???"

"হয়েই এসেছে। কাল দিয়ে দেবো তোমাকে"।

" আমাকে দিতে হবে না,কাল নিজে অফিস গিয়ে মিটিং জয়েন করবি"।

"আমি????"

"হ্যাঁ, তা না তো কে?? সে আমি চেক করলেই বুঝে যাবো এতদিনে কি শিখেছিস"!!

" হুম!!!" 

"তাহলে কাল থেকে তোর নিউ জার্নি শুরু"।

" মে বি!!!" 


বিনী নিখোঁজ হবার পর তিনতিনটা বছর কেটে গেছে। আশ্চর্য ব্যাপার এটাই যে মেয়েটা যে হারিয়ে গেলো এটা কেউই তেমন ভাবে গায়ে মাখলো না। নিজের সাধ্যমতো অনিন্দ্য বাবু চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু পারলেন না,কিছুদিনের মধ্যে হার্ট অ্যাটাক করে গত হলেন তিনি। সৌমাদ্রির খোঁজ তখনও কেউ জানতো না। জ্যেঠিমার ব্রেইন ওয়াশ করে এখন সর্বস্ব নিজের হাতের মুঠোয় নিয়েছে সৌমাদ্রি। এর ফল অবশ্য এখন কৌশিকিদেবীকে হারে হারে পেতে হচ্ছে। বাড়িতে শুধু এখন ওনাকে খেতে দেওয়া হয় কোনোরকম। একঘরে করে দিয়েছে মা ছেলে। আর বাড়িতে চলছে চরম লেভেলের বেলেল্লাপনা। বাড়িতে নতুন বউও এসেছে, সাধারণ কোনো মেয়ে বিয়ে করে আনেনি হিমাদ্রি, কলগার্ল বিয়ে করে নিয়ে এসেছে বাড়িতে।  সৌমাদ্রিও এখন সুস্থ, বাবা যার কাছে রেখে এসেছিলেন তার সেবায়,ডাক্তার দেখিয়ে, ফুল ট্রিটমেন্ট পাবার পরে সুস্থ হয়ে উঠেছে সে। বাড়িতেও এসেছিল কিন্তু হিমাদ্রি গলা ধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছিল তাকে। একলা মানুষটার পাশে সাপোর্ট দেবারমতো কেউ ছিলোনা,ফিরে গেছে সে সেই ভদ্রমহিলার কাছেই। এককথায় চ্যাটার্জি পরিবারকে মাটিতে মিশিয়ে দিয়েছে হিমাদ্রি।


কৌশিকিদেবীও বুঝতে পেরেছেন এতোদিনে তার ভুল।কিন্তু তার হাতে না আছে এখন কোনো পাওয়ার, না পাশে আছে কেউ।যেই জা এতোদিন ছায়ার মতো ঘুরতো,সে এখন পারলে লাথি মারে।বুঝতে পারেন যে যেই পাপ উনি করেছেন,তা ভগবান এখন সুদেআসলে ফেরত দিচ্ছেন। পাপের প্রসঙ্গে আসা যাক। প্রিয় বান্ধবীর সাহায্যে বাড়ি থেকে সরাতে সাকসেসফুল হয়েছিলেন কৌশিকিদেবী। বিনী অফিস থেকে ফেরার সময় তিনজন লোক লাগিয়ে তাকে কিডন্যাপ করা হয়।কথা হয়েছিল তাকে শহরের বাইরে চালান করে দেওয়ার। কিন্তু কাজ প্ল্যান মাফিক হয়নি।তিন গুণধর তাকে রীতিমতো তিনদিন ধরে কন্টিনিউ রেপ করেছে,আর বাকিটা নাই বা বললাম, যখন দেখেছে অবস্থা ঠিক নেই, মরলো বলে, তখন আর কোনো উপায় না পেয়ে এই শহরের বাইরে হাইরোডের ধারে ফেলে দিয়ে পালায়। খবর দেয় বিনী মারা গেছে, সেই খবর অনুযায়ী বিনী মৃত সবার কাছেই। কিন্তু বিনীর ভাগ্যে হয়তো মরণ এতো তাড়াতাড়ি ছিলো না,যম নিতে পারেনি। সেদিন রাতেই বিয়ে বাড়ি থেকে ফিরছিলেন ড. সুরভি রায়,বিনীর বর্তমানের বড়দি। উনিই বিনীকে লক্ষ করে তাকে হাসপাতালে ভর্তি করায়। প্রপার ট্রিটমেন্ট, বড়দির আদর যত্ন সবেতে যমের দুয়ার থেকে ঘুরে চলে আসে বিনী। সুস্থ হবার পর ফিরতে চেয়েছিল সে,কিন্তু তার মুখ থেকে সবটা শোনার পর না করেছিল বড়দি। সৌমাদ্রির সব খবর এনে দিতো বিনীর কাছে কিন্তু তাও ফিরতে দেয়নি,কেননা তিনি কথা দিয়েছিলেন বিনীকে নিজের হাতে তৈরি করে যুদ্ধক্ষেত্রে পাঠাবেন। কথামতো তিনবছর ধরে এই মাটিটা তিনিই একটু একটু করে দুর্গামূর্তি বানাচ্ছেন। 


দিনরাত বসে বড়দির কথামতো কাজ করেছে এতোদিন বিনী। সেদিন রাত করে ঘুমোলেও সকালে ৮টা বাজতে না বাজতেই বড়দি তুলে দেয় ঘুম থেকে। উঠে ফ্রেশ হয়ে ব্রেকফাস্ট সেরে স্নান করে অফিসে রওনা হয় বিনী। বড়দি নিয়ে গিয়েছিল তার সাথে। অফিসে গিয়ে প্রত্যেক এমপ্লয়িদের সাথে আলাপ করিয়ে দেয় বিনীর। তারপর নিজের রুমে নিয়ে গিয়ে এতোদিনের কষ্টে অর্জন করা চেয়ারটায় বিনীকে বসালেন।  

"আজ থেকে এটা তোর জায়গা,আমি নাহয় পাশের রুমে বসলাম!!!"

"কিন্তু বড়দি এটা তো......"

"শুধু মুখে বললে তুই মানবিনা আমি জানি,এই নে পেপারস,আজ থেকে কাগজে কলমে এই কোম্পানির মালকিন তুই।নে এখন শুরু কর দেখি তোর যুদ্ধ। কি তৈরি হলি এই বড়দির কাছে,সেটা আমিও একটু দেখি"!!!!


মুখের কথা হারিয়ে ছিলো বিনী,জড়িয়ে ধরে তার বড়দিকে। সত্যিই, আজ অবধি এতো মানুষ দেখেছে বিনী,কিন্তু বড়দির মতো আপন তার আর কাওকে মনে হয়নি। মা বাবার কথাও এই হতভাগীর এখন মনে পরেনা,হয়তো রাগে,অভিমানে। জোর করে সংসারে ঢুকিয়ে দিয়েছিল তাকে, কিন্তু তাও তো সুখের সংসার পায়নি। যার হাত ধরে বিয়ে হয়ে এসেছিল তার কি আদেও এখন বিনীকে মনে আছে নাকি তার জানা নেই। কেননা খোঁজ নেয়নি কোনোরকম সুস্থ হবার পরেও।নেয়নি খোঁজ, কারণ সে তো জানে বিনী মৃত। 


পুরনো সব হিসেব নিজের মাথায় গুছিয়ে রেখে কাজে মন দিলো বিনী। ১টার দিকে ম্যানেজার বিভাসবাবু এসে বলে গেলেন মিটিং রুমে সবাই অপেক্ষা করছে। নিজের রুম থেকে বের হয়ে বড়দির কাছে যায় আগে বিনী। গিয়ে পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে। 

" কি করছিস কি পাগলি???"

"যুদ্ধ শুরুর আগে গুরুকে প্রণাম করবোনা তা হয়???"

"ভয় নেই, তুই যা,আমি আসছি। আর এই ফাইলটা নিয়ে যা"।

" এটা কিসের??"

"আজ যেই কোম্পানি এসেছে ডিল করতে, তাদের ডিটেইলস আছে এটাতে।তোর জন্য সারপ্রাইজ অপেক্ষা করছে, যা"। মুচকি হেসে চলে যায় বিনী। মিটিং রুমে ঢুকতেই সবাই দাঁড়িয়ে যায় ঠিকই, তবে উল্টোপাশে বসে থাকা ভদ্রলোক বাদে। বিনী গিয়ে নিজের চেয়ারটাতে গিয়ে বসে।

" প্লিজ বসুন সবাই!!" কথায় এতোক্ষণ পর ভদ্রলোক মুখ তুলে তাকাতেই চেচিয়ে ওঠে 

"হোয়াট আর ইউ ডুয়িং হেয়ার বিচ!!!"

"মাইন্ড ইউর ল্যাঙ্গুয়েজ মিস্টার হিমাদ্রি চ্যাটার্জি!!!ডোন্ট ফরগেট দিস ইজ মাই অফিস এন্ড ইউ আর মাই ক্লাইন্ট!!"

"হোয়াট দ্য ফাক!!!!! ফাজলামো হচ্ছে নাকি হ্যাঁ??? সুরভি রায় কোথায়?? যা কথা হয়েছে আমার ওনার সাথে, যা ডিল হবে ওনার সাথে কথা বলে হবে। তোমার মতো দুপয়সার মেয়ের সাথে হিমাদ্রি চ্যাটার্জি ডিল করে না"।

" গেট লস!!!!"

"হোয়াট!!!! কি বললে তুমি??"

"অশিক্ষিত নাকি?? ইংরেজি জানেন না??? নাকি ইংরেজিতে গালাগালটাই জানেন। বেরিয়ে যান,আমার অফিসে দাঁড়িয়ে আমাকেই গালাগাল দেবেন,আমার সাথে কথা বলবেন না,তাহলে দাঁড়িয়ে আছেন কেন?? বেরিয়ে যান"।

" লিসেন বিনী!! ইউ আর ক্রসিং ইয়র লিমিটস!!!"

"আম নট ক্রসিং মাই লিমিট!!! দেখুন আপনার মতো লোকের সাথে ডিল করতে এসেছিলাম এটাই আপনার ভাগ্য। এটা তো আপনার ফাইল তাইনা!! ওয়েট,লেট মি চেক!!!" বলে ফাইলটা ভালো করে দেখতে থাকে বিনী।

"বাপরে!!! নিজের কোম্পানির অবস্থা তো যায় যায়,সাহসের বলিহারি দেখি আপনার!! এখন এসেছেন আমার কোম্পানির বারোটা বাজাতে তাই তো??? আমি আপনার সাথে ডিল করে তারপর পথে বসি আর কি!! যান যান,ফালতু আমার সময় নষ্ট করলেন। সরি এভ্রিওয়ান!! দিস ইজ মাই মিসটেক,আমার আগেই খবর নেওয়া উচিত ছিলো কার সাথে কাজ করতে যাচ্ছি।"

"আমি অলরেডি ফিফটি ল্যাখ পে করে দিয়েছি সুরভি রায়কে,ডিল তো করতেই হবে। নাহলে আমি কেস করে দেবো"।

" বিভাসবাবু!!!! "

"ইয়েস ম্যাম!!!"

"ওনাকে ৭০ লাখ টাকা দিয়ে ঢাকঢোল পিটিয়ে বিদায় করুন!!" 

"ওকে ম্যাম!!!" 


বের হয়ে যায় বিনী রুম থেকে। বের হতেই দেখে বড়দি দরজার সামনে দাঁড়িয়ে হাসছে।

"তুমি হাসছ???" 

"হাসবো না তো কি করবো??? চল আমার রুমে"। পা বাড়াতেই পেছন থেকে হিমাদ্রি ছুটে আসে। 

" মিস. রায়!!! এটা কি হলো??? আপনি নিজে না এসে এই মেয়েটাকে কেন পাঠিয়েছেন???"

"আমি আর এই কোম্পানিতে নেই মি. চ্যাটার্জি!! এক্সট্রিমলি সরি, আজ থেকেই বিজয়া জয়েন করেছে, তাই সব কাজ তো ওকেই দেখতে হবে তাই না??"

"দ্যাটস নট ফেয়ার!! একজন অশিক্ষিত গেঁয়ো ভূতকে আপনি কোম্পানির মালকিন কি করে করতে পারেন??"

"ও অশিক্ষিত নাকি শিক্ষিত তা ওর ফাইল দেখলেই বুঝতে পারবেন মি. চ্যাটার্জি। আর রইলো কোম্পানির মালকিন, দেখুন আমার বয়স হয়েছে, বিয়েও করিনি যে নিজের ছেলেমেয়ে আমার এই সাম্রাজ্য সামলাবে। ও আমাকে বড়দি ডাকলেও আমার মেয়ের মতো। আমার আজ যা আছে,তা বিজয়ার,ভবিষ্যতেও ওরই।আর আমি কি করবো না করবো সেটা আমাকেই বুঝতে দিলে ভালো হয়। আপনি ৫০লাখ দিয়েছিলেন, বিজয়া আপনাকে ৭০লাখ দিলো,ক্ষতি তো হয়নি,যান ফিরে যান"। আর কোনো কথা বাড়ায়নি হিমাদ্রি। বিনীর দিকে কটমট করে তাকিয়ে চলে যায় অফিস থেকে।

অফিস থেকে বাড়ি ফেরার পর বিনী একদম চুপচাপ হয়ে গিয়েছিল। অন্যান্য দিন তাও নীচে ড্রয়িং রুমে বসে বড়দির সাথে গল্পগুজব করে, আজ তাও না। বুঝতে না পেরে বড়দি নিজেই যায় বিনীর ঘরে। 

"কি হয়েছে তোর???"

"উনি ঠিক হয়ে গেছেন এটা শুনেছি, সুস্থ হয়েও নিজের ঘরে কেন ফিরলেন না?? তার জায়গায় আজ তার ভাই কেন???"

"কি জানি???"

"আর সবচেয়ে বড় কথা হলো বাবা সবকিছু ওনার নামে করে দিয়েছিলেন। হিমাদ্রি কি করে সব হাতিয়ে নিলো??"

"খবর নিতে হবে "।

" বড়দি আমাকে ওনার কাছে যেতে হবে। এভাবে দূর থেকে আমার মনে হয়না আমি সবটা করতে পারবো,আমার ওনার সাথে কথা বলা দরকার "।

"তার মানে তুই ফিরতে চাইছিস সৌমাদ্রির কাছে???"

"হ্যাঁ বড়দি। জানিনা ওনার আমাকে মনে আছে নাকি বা চিনতে পারবে নাকি,কিন্তু আমার মনে হয় আমার ফেরা উচিত"।

" ঠিকাছে, আমার কাছে আছে ঠিকানা, কাল চলে যা তাহলে "।

" হুম!!!" 


আর কোনো কথা হয়নি দুজনের মধ্যে। সেদিন রাতে ঘুম এলোনা একদমই বিনীর।পরদিন উঠে বড়দির কথামতো বিনী আগে অফিসে যায়। গিয়ে তাড়াতাড়ি কাজকর্ম সেরে বের হয়ে যায় নিজেই গাড়ি নিয়ে। বড়দি ঠিকানা দিয়ে দিয়েছিল বিনীকে। অফিস থেকে বেশ অনেকটাই দূর। ঠিকানা ধরে চলে যায় সেখানে। বাড়ির সামনে গিয়ে গাড়িটা পার্ক করে গেট খুলে ঢোকে বিনী। গিয়ে কলিংবেল টিপতেই এক বয়ষ্ক ভদ্রমহিলা বের হয়ে আসেন। 

"কাকে চাই???"

"সৌমাদ্রি আছে??"

"সৌমাদ্রি থাকেনা এখানে" বলে দরজা বন্ধ করে দিচ্ছিলেন। 

"আন্টি!! আন্টি!! এক সেকেন্ড, আমি সৌমাদ্রির স্ত্রী!!!"

"সৌমাদ্রির স্ত্রী!!!! ইয়ার্কি হচ্ছে??? ওর স্ত্রী সেই কবে মারা গেছে!! "

"আন্টি, আপনি তো আমাকে চেনেন না তাই বলছেন, আপনি সৌমাদ্রিকে ডাকুন!! ও চিনবে আমাকে, প্লিজ আন্টি আমাকে ফিরিয়ে দেবেন না,প্লিজ!!!!" 

"আচ্ছা নাছোড়বান্দা মেয়ে তো!!! এসো ভেতরে"। বলে ভেতরে নিয়ে যায় বিনীকে।

" বসো,আমি ফোন করি সমুকে,বাড়ি নেই"।

"আচ্ছা!!" 


ভেতর ঘরে গিয়ে সৌমাদ্রিকে ফোন করে সবটা বললেন ভদ্রমহিলা। শুনে দেরি করেনি,দোকান বন্ধ করে চলে আসে বাড়ি। বিনী ড্রয়িং রুমেই বসেছিলো একাই। কেননা সোমাদেবী একদমই বিশ্বাস পাচ্ছিলেন না বিনীর উপর, ভাবছিলেন সৌমাদ্রির ক্ষতি করার জন্য হয়তো ওই বাড়ি থেকে কেউ পাঠিয়েছে। একটা কথাও বলেননি বিনীর সাথে। সৌমাদ্রি ঘরে ঢুকে হা হয়ে তাকিয়ে ছিলো বিনীর দিকে। তাকে দেখেই বিনী উঠে তার কাছে গিয়ে দাঁড়ায়।

"চিনতে পারছ???"

"পঙ্গু ছিলাম, স্মৃতি শক্তি হারায়নি।কোথায় ছিলে এতোদিন??"

"যে বাঁচিয়েছে,তার কাছেই ছিলাম।কি ভেবেছিলে,বেঁচে নেই??"

"যা শুনেছি, তাই বিশ্বাস করেছি। খোঁজ করার ক্ষমতা হয়ে ওঠেনি।অনেক পাল্টে গেছো বিনী!!"

"পাল্টে গেছি মানে??"

"মাথাভর্তি কালোচুল আঁকাবাঁকা করে কাটা,হাইলাইট করা।পরনের শাড়ি বদলে ডেনিম আর টিশার্ট"।আগের বিনী আর নেই "।

" তুমি ফিরে যাওনি কেন বাড়ি?? "

"কে বললো যাইনি??? গিয়েছিলাম তো,গলাধাক্কা দিয়ে বের করে দিয়েছে"।

" আর তুমি চুপচাপ চলে এলে!!! নিজের বুঝটা কবে বুঝতে শিখবে তুমি??? এতোদিন নাহয় পারোনি শারীরিক কারণে, এখন তো সুস্থ। আর অসুস্থ যে ছিলে তাও তো ওদের কারণেই। তোমার কি একটা বারও মনে হয়না যে নিজের অধিকার এখন বুঝে নেওয়া উচিত, নিজের প্রতি হওয়া অন্যায় গুলোর জবাব দেওয়া উচিত???"

"এসবের মানে তো ঘুরেফিরে একটাই বিনী।নিজের সম্পত্তি ফিরে পাওয়া। আর ওই সম্পত্তির প্রতি আমার কোনো লোভ বা মায়া কিছুই আর নেই "।

" কেমন হয়ে গেছো গো তুমি??? নাকি আগে থেকেই এমন ছিলে??? নিজের চেহারা ছবির দিকে তাকিয়ে তোমার নিজেকে অনিন্দ্য চ্যাটার্জির ছেলে বলে মনে হয়???"

"কে বলেছে আমি অনিন্দ্য চ্যাটার্জির ছেলে???"

"দেখো আমি সব জানি,বিয়ের দিন বাবা আমাকে সবটা বলেছিলেন। এনি ওয়ে,তুমি চুপ করে আছ জন্য যে আমি চুপ থাকবো তা একদমই না"।

" তোমার যা ইচ্ছে হয় তুমি করো বিনী,দরকার পরলে আমি অবশ্যই সাহায্য করবো তোমাকে। যাক গে!! ওসব কথা ছাড়ো,পড়াশোনা করছ নাকি কোনো চাকরি পেয়েছ???"

"রায় ইন্ডাস্ট্রিতে আছি"।

" সুরভি রায়????"

"হ্যাঁ, বড়দি মানে সুরভি রায়ই আমাকে বাচিয়ে ছিলেন।"

"খুব ভালো মানুষ উনি"।

"হুম!!!"

"কাজ বাদে বাকিসব???"

"বাকিসব বলতে??"

"মানে নতুন করে জীবন শুরু করেছ,নতুন সঙ্গী....... " কথাটা শুনে তেলেবেগুনে জ্বলে উঠলো বিনী।

"কি মনে হয় কি আমাকে তোমার??? আমি ভুলে গেছি তোমাকে তাইনা??? নাকি মনে করো বিয়ের দিন থেকে তোমার সেবাই করে গেছি নার্সের মতো, বউ হয়ে উঠিনি বা উঠতে চাইনি??? কিসের জন্য আসলাম আজ??? তোমার সম্পত্তি নেওয়ার জন্য?? দিনের পর দিন খোঁজ নিয়ে গেছি তোমার। যেদিন শুনলাম সুস্থ হয়েছ,ইচ্ছে করছিলো ছুটে চলে আসি।আর আজ তুমি এই কথা বললে আমাকে??? এই চিনলে তুমি??? নাকি নিজেই কোনোদিন স্ত্রী হিসেবে মেনে নিতে পারোনি???"

"শান্ত হও বিনী!!! আমি সেভাবে বলতে চাইনি কথাটা।তুমি এতোদিন ছিলেনা। শহরের বাইরে ছিলে,এদিকের কোনো কিছুর সাথেই তোমার কোনো যোগাযোগ নেই। আর তাছাড়া তোমার বয়সই বা কত,২১ বছর বয়সে আমার মতো ৩৩বছর বয়সী দামরাটার জন্য তুমি বসে থাকবে এমনটা আশাকরি কি করে বলো??? আর না হলেও আমি বলছি তোমাকে, আমি তোমাকে পুরনো বিষাক্ত জগতটা থেকে মুক্ত করে দিতে চাই বিনী। কম কষ্ট তো পাওনি,অনেক!!! কিসের জন্য আবার নোংরা জগতটাতে ঢুকবে?? তার চেয়ে নিজের ভালো বোঝাটাই তো বেস্ট তাইনা???আর আমার এখন আছেই বা কি বলো,ছোটো একটা দোকান করে মা ছেলে মিলে দিন কাটাচ্ছি,তুমি ছোটো থেকে অনেক কষ্ট করেছ বিনী,আর না।এখন সুখটা আগলে ভালো থাকো"।

" বাহঃ!!!! বাহঃ!!! এক্সিলেন্ট!!! দারুণ!!!! কি দিয়ে তৈরি গো তুমি??? ভেতরে কি আছে তোমার??? সব ভুলে গুলে খেয়েছ তাইনা??? নাকি সেদিন বাঁধা অবস্থায় থেকে আমাকে বাঁচানোর জন্য নাটক করেছিলে??? খুলে দেওয়ার পর কুমিরের কান্না কেঁদেছিলে তাইনা??? ভুলে গেছো রক্তের দাগগুলো তাইনা???? না না না!!! ভুলবে কেন?? ভোলার তো কথা না,তাহলে তো আমাকেও ভুলে যেতে।আই থিংক তুমি এখন আমাকে এক্সেপ্ট করতে চাইছ না। তোমার আগে অন্যকেউ আমাকে ছুয়েছে সেই জন্য তাইনা!!!!!"

"বিনী!!!!!!!"

"চিতকার করোনা,তোমার ভালো ভালো কথাগুলোর পেছনে যে এই সত্যি লুকিয়ে আছে এতক্ষণে বুঝলাম। করতে হবে না গো আমাকে এক্সেপ্ট, কেনই বা করবে বলো,বারবার রেপ হবার পর কোন মেয়েকে তার বর এক্সেপ্ট করবে তাইনা!!! ভালোবাসলে তবে সে না কাছে টেনে নিতে তাইনা!!ভালো থেকো,আর জ্বালাবোনা।তোমাকে কিচ্ছু করতে হবে না,তবে আগাম ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি,তোমার পরিবারকে আমি নিঃস্ব করে ছাড়বো,আর তোমার কাকার কপালে শনি নাচছে,চলি,বেঁচে থাকতে আর কোনোদিন এই কলঙ্কিনীর মুখ দেখতে হবে না তোমার আর"। বলে উঠে বের হয়ে চলে আসে বিনী। 

" বিনী!!! বিনী দাঁড়াও!!!! ভুল বুঝলে তুমি আমাকে বিনী!!!" সৌমাদ্রির ডাকে কোনোরকম সারা না দিয়ে গাড়িটা ধোঁয়া উড়িয়ে চলে গেলো। অসহায় ভাবে একমনে দাঁড়িয়ে ছিলো সৌমাদ্রি। 


বিনী যে তার কথাগুলো একদমই ভুল বুঝলো। সে যে বিনীর ভালোই চায়,কেননা আগে ভালোবাসার কথা মুখে না বললেও সে প্রথম দিন থেকে বিনীকে ভালোবেসে এসেছে। বিনী যা চাইছে তা যে বড়ই কঠিন, ওই বাড়ির প্রতিটা মানুষ যে আর মানুষ নেই। সে কোনো ভাবেই চায়না বিনীর আর কোনোরকম ক্ষতি হোক,তাই বলে ফেলেছে এসব, কিন্তু বিনী যে ভুল বুঝে চলে গেলো। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে ঘরে এসে সোফায় বসে মাথা নিচু করে একভাবে তাকিয়ে ভাবছিল সৌমাদ্রি। সোমাদেবী এতক্ষণ রান্নাঘর থেকে সবটাই শুনেছেন। কিন্তু দুজনের কথার মাঝে আসেননি। ছেলেকে এভাবে দেখে পাশে এসে কাঁধে হাতটা দিয়ে বললেন 

"এসব কথা তো আজ নাও বললে পারতি সমু"।

" আমি বুঝতে পারিনি গো মা,ও এভাবে ভুল বুঝবে আমাকে "।

" উড়তি বয়সের মেয়ে সমু,চাইলে ঠিক পারতো অন্যকাওকে ভালোবেসে সংসার পাততে।তা তো করেনি,কেননা তোকে ভালোবাসে জন্য, সাতপাক ঘুরে মাথায় সিঁদুর দিয়ে বিয়ের মর্ম বুঝতে পেরেছে জন্য আজও তোকে ভালোবেসে ছুটে এসেছিল। ওর সিথিতে আজও সিঁদূর জ্বলজ্বল করছে, সেটা তোর মঙ্গলের জন্যই। কেন বললি!! বয়সটাই সব?? নাকি ক্ষমতা??? কিসের ভয় তোর???"

"ওর যদি আবার ক্ষতি হয়???"

"ওর চোখে কোনো ভয় নেই সমু,আগুন জ্বলছে। আজ হয়তো তোর কাছে সাহায্যের জন্যই এসেছিলো। একজন স্ত্রীর কাছে যতই আর্থিক ক্ষমতা থাক,স্বামী পাশে থাকলে সবদিক থেকে মনবল পায় একজন মেয়ে। তুই নাহয় ওর পাশে থেকে হাতটাই ধরে থাকতি।তুই তো এমন ছিলিস না সমু"।

" কি মনে করে ও,শুধু ও আমাকে ভালোবাসে,আমি বাসিনা?? ভালোবাসি জন্য ওর কোনো ক্ষতি চাইনা আর।তুমি তো জানো ওই লোকগুলো কেমন??? কতটা ভয়ংকর???"

"লোহার টুকরো পিটিয়ে পিটিয়ে আগুনে পুড়িয়ে সেটাকে দাঁ,কুড়ুল, তরবারি বানানো হয় জানিস তো??? কতটা কষ্ট সহ্য করে আজ এই জায়গায় এসেছে ও ভাব একবার। তোর অক্ষমতার সময়ও তোর কাছে ছিলো। তুই শারীরিক বিকারগস্ত ছিলিস তাও তোকে বিয়ে করে তোর কাছে ছিলো, এর পরেও কি তোর ওকে সাধারণ মেয়ে মনে হয়??? যা ওর কাছে, এই ভুল ধারণা নিয়ে বসে থাকলে আমার মনে হয় তুই ওর কাছে সারাজীবন ঋণি হয়ে থাকবি,একজন স্বামী হিসেবে তোর উচিত এখন কর্তব্য পালন করা। আর কিছু না পারিস,স্ত্রীর সম্মানটা অন্তত ফিরিয়ে দে"।

ছোটোবেলা থেকেই তানভি বাড়ির বাইরে। লেখাপড়া নামকরা ইংরেজি মিডিয়ামে করা, ছোটো থেকেই হোস্টেলে থেকে বড় হয়ে ওঠা। বাড়ির কোনো ব্যাপারেই সে ছোটো থেকে জড়ায়নি। এমনকি বিয়ের পর বিনীর সাথে ফোনে কথা হলেও তার জীবনে ঘটে যাওয়া কালোদিন গুলোর কথা কোনোদিনই তানভিকে জানায়নি সে। কিন্তু সেদিন তাকে ভালোমতোই চেপে ধরলো তানভি। চা খেতে খেতে বিয়ে হয়ে আসার দিন থেকে বর্তমান পরিস্থিতি পর্যন্ত সবটা খুলে বললো তানভিকে বিনী। সবটা শোনার পর মাথা গরম হয়ে যায় তানভির। রেগে যায় খুবই, পারলে তখনই গিয়ে তার কাকুকে গিয়ে গলা টিপে ধরে। অনেক কষ্টে বোনকে শান্ত করে সৌমাদ্রি। বিনীও বোঝায় অনেক। তারপর শুরু করে তাদের প্ল্যান। 

"তোকে আমাদের হেল্প করতে হবে তানভি"!!

" অফকোর্স করবো দাদাভাই, আর আমি নিজেও চাই যে ক্রিমিনালগুলো শাস্তি পাক।তোরা শুধু বল আমাকে কি করতে হবে " 

"তোকে ওই বাড়িতে যেতে হবে তানভি"।

" কেন?? ওই বাড়িতে গিয়ে কি করবে ও?? ওর যদি কোনো ক্ষতি করে দেয় ওরা,তখন??"

"শান্ত হও বিনী।কিচ্ছু ক্ষতি করবেনা। দ্যাখ তানভি তুই ওখানে যাবি ওই বাড়ির মেয়ে হয়েই।ছুটি পেয়েছিস,তাই ঘুরতে গেছিস। তোর কাজ ওদের ব্রেইনওয়াস করা,যাতে যে করেই হোক আমি আর বিনী ওই বাড়িতে ঢুকতে পারি"।

" সে বুঝলাম,বাট ব্রেইনওয়াসটা করবো কোন টপিকে???"

"হিমাদ্রি লিগালি ওই বাড়ি বা অফিসের মালিক না তানভি। আমার সই নকল করে ও একের পর এক ডিল করে যাচ্ছে,জোচ্চুরি জালিয়াতি করে যাচ্ছে। নেহাত আমি লুকিয়ে আছি জন্য কেউ খোঁজ পাচ্ছেনা,কিন্তু সামনে পেলে লোকে আমাকে পুঁতে ফেলবে। তুই ওদের এনিহাও কনভেন্স কর যাতে আমি ওই বাড়িতে ঢুকতে পারি"।

" ওকে দাদাভাই, লেট মি থিংক এবাউট ইট,আমি কালই চলে যাবো"। 

"বাট তানভি,সাবধানে, কোনো ভাবেও যেন ওরা টের না পায় যে তুই আমাদের কথায় গিয়েছিস"!!

" তুমি চিন্তা করোনা ভাবি ডার্লিং, আমি সাবধানে থাকবো"।


প্ল্যান-প্রোগ্রাম সেদিন সেরকমভাবে আর কিছু হয়নি।সৌমাদ্রি খাওয়া দাওয়া করে চলে আসে, তানভি ওখানেই থেকে যায় তিতলির সাথে। সারারাত দুজন মিলে গল্পগুজব করে প্রায় ৩টে নাগাদ ঘুমোয়।পরদিন সকালে ব্রেকফাস্ট সেরে তানভিকে একটা ক্যাব ভাড়া করে দিয়ে অফিস চলে যায় বিনী। 

তানভি বাড়িতে ঢুকতেই মা মা করে চিতকার করে বাড়ি মাথায় তুলতেই বের হয়ে আসে তার কাকিমা। 

"আরে তুই!!! কি মনে করে??? এতো লাগেজ?? থাকবি নাকি??"

"হ্যাঁ কাম্মা!!ছুটি পেয়েছি কিছুদিনের, তাই চলে এলাম!"

"জানালি না একবারও "।

" নিজের বাড়ি আসবো এতে জানানোর কি আছে??? মা কোথায়??"

"নিজের ঘরেই,রুহির সাথে তো তোর দেখা হয়নি তাইনা??"

"না,বিয়ে তো আর ধুমধাম করে হয়নি ছোড়দার,তাই আসিনি,আর ছুটিও ছিলো না। তারপর যে কাজের চাপ,আর হয়ে ওঠেনি কথা বলা"।

" ঠিকাছে, ও তো বাবানের সাথে অফিস গেছে, এলে সাক্ষাৎ করিয়ে দেবো,যা তুই দিদিভাইয়ের সাথে দেখা করে আয়,তোর সাথে আমার অনেক কথা আছে"।

"ওকে কাম্মা!! ফ্রেশ হয়ে আসি,দেন চা খেতে খেতে কথা হবে"। বলে মায়ের ঘরে চলে যায় তানভি। 


মেয়েকে দেখে চোখের জলের বাঁধ ভাঙে কৌশিকিদেবীর। কেননা এই বাড়িতে এখন তার অবস্থা খুবই শোচনীয়, একঘরে করে দেওয়া হয়েছে। নিজের বলতে আর কেউ নেই। মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেন তিনি আর বলতে থাকেন। 

" আমাকে এখান থেকে নিয়ে যা তানি,আমি এখানে থাকলে আর বাঁচবো না"।

"কেঁদোনা মা!!! প্লিজ!!! আমি আছি তো, কিচ্ছু হবে না।কিছুদিন অপেক্ষা করো,সব ঠিক হয়ে যাবে। এভ্রিথিং উইল বি অলরাইট!!" 

"আমি ভাবতে পারিনি কোনোদিন জানিস,যে ওরা এতোটা খারাপ"।

" চুপ করো মা!! কেউ শুনতে পেলে সব গন্ডগোল হয়ে যাবে। তুমি কিচ্ছু ভেবো না,চুপচাপ থাকো,যা করার আমরাই করবো"।

"আমরা মানে???"

"আছে তো এই বাড়ির দেবী দুর্গা!!! সে থাকতে কি অসুর কোনোদিন বেঁচে থাকে???"

মেয়ের কথার কোনো মানে বুঝে উঠতে পারলেন না কৌশিকিদেবী। তবে অনেকদিন পর নিজের কাওকে পাশে পেয়ে অনেকটা হাল্কা লাগছে তার।তানি নিজের ব্যাগগুলো ঠিক করে রেখে ফ্রেশ হতে চলে যায়। এসে চেঞ্জ করে মায়ের কপালে চুমু খেয়ে নিচে চলে আসে ড্রয়িং রুমে। কাম্মা ততক্ষণে চা নিয়ে ওয়েট করছিলেন। সোফায় শরীরটা হেলিয়ে দিয়ে বসে চায়ের কাপটা নিয়ে বলতে শুরু করে তানি।

"বলো তোমার কি কথা আছে কাম্মা!!!"

"তোর সাথে সমুর কথা হয়???"

"না,ওর আগের সিমটা আর নেই, নতুন নম্বর পাইনি কারোর কাছেই, কোথায় থাকে তাও তো জানিনা"।

" এসেছিল ও কয়েক মাস আগে"।

"এসেছিল??? চলে গেলো কেন তাহলে???"

"অনেক বলেছি যে বাড়ি ছেড়ে যাসনা বাবা!!! নিজের বাড়িঘর নিজের লোকজনদের ছেড়ে থেকে কি লাভ??? ও বলে আমরা নাকি ওর কেউ নই,তাই ও থাকবে না এখানে। আর এই বাড়িঘর বিষয় সম্পত্তির প্রতি ওর কোনো টান নেই, তাই চলে গেছে "।

" এটা কোনো কথা??? দাদাভাই এটা বলতে পারলো?? আমরা ওর কেউ নই???"

"সেটাই তো।জানিনা কোথায় আছে এখন, সন্ন্যাসী হয়ে গেছে নাকি কে জানে।তা বাপু তুই যাবিই যখন সবকিছু ভাইটার নামে করে দিয়ে তারপর যা"।

" মানে??"

"না মানে আমি বলতে চাইছি যে এই বাড়ি, সম্পত্তি সব তো সমুর নামেই। ও যখন থাকবে না তাহলে এগুলো তোর নামে, বা দিদিভাই বা ধরে নে বাবানের নামে করে দিয়ে যেতো"।

" আচ্ছা তাহলে ছোড়দা কাজ করছে কি করে?? মানে অফিসে কাজ করতে গেলে তো সইসাবত লাগে, টাকা তুলতেও লাগে, তাহলে???"

"সে আর বলিসনা, বাবান যে কত দৌড়াদৌড়ি করে সব ম্যানেজ করেছে। এগুলো কি চাট্টিখানি কথা???"

"তাহলে এখন কি ভাবছ??"

"আমি আবার কি ভাববো,কষ্ট তো হচ্ছে আমার ছেলেটার।সেদিন কোন এক নামি কোম্পানির সাথে কাজের কথা বলতে গিয়েছিল, ওই মালকিন নাকি তাড়িয়ে দিয়েছে। বাবান তো খুলে বলেনা সবটা,শুধু এটুকুই বললো।তুই একটু কথা বল না ওর সাথে "। 

" কি নিয়ে কথা হচ্ছে এতো???" বলতে বলতেই হিমাদ্রি হাজির বাড়িতে তার সহধর্মিণীকে নিয়ে। 

"কখন এলি তানি???"

"এই তো,কিছুক্ষণ "।

" ছুটি নাকি??"

"হ্যাঁ"।

" মিট মাই ওয়াইফ,রুহি। রুহি,ও তানি,আমাদের একমাত্র বোন,বাড়ির লাডলি"।

"হাই তানি"।

" হাই!!" 

"বিয়েতে এলে না কেন??"

"ছুটি পাইনি গো,তাই"।

" এনি ওয়ে, কি নিয়ে কথা হচ্ছিলো দুজনের???"

"তেমন কিছুইনা ছোড়দা,কাম্মা দাদাভাইয়ের ব্যাপারে বলছিল"।

" ওহ্!!!"

"ওকে, রুহি তুমি যাও ফ্রেশ হয়ে নাও,আমি একটু তানির সাথে কথা বলে আসছি"। হিমাদ্রির কথায় চলে যায় রুহি।

" বড়দাভাইয়ের সাথে তোর যোগাযোগ আছে??"

"না রে ছোড়দা,না ফোন না দেখা, কোথায় যে আছে কে জানে!!"

"হুম!!!"

"কাম্মার কাছে যেটুকু শুনলাম তাতে আমি বুঝলাম যে তোরা খুবই সাফার করছিস। আই থিংক দাদাভাইয়ের দরকার আছে এখনো"।

" মানে???"

"মানে কাম্মা যা বললো ও এই বাড়িতে থাকবেনা, প্রপার্টির ব্যাপারেও ওর কোনো ইন্টারেস্ট নেই। বাট আমাদের তো আছে।দ্যাখ ছোড়দা,ফ্র‍্যাঙ্কলি বলছি,আমি বাইরে থাকি,বিয়ে আমি করবো না।হ্যাঁ জব করছি তাও আমার তো একটা লাইফ আছে।আমাকে শেষ বয়স অবধি চলতে তো হবে। সে আমি স্যালারি যেটুকু পাই তা দিয়ে আমার চলে যায়, বাট কোনোদিন যদি বড়কোনো বিপদ হয় তখন??? আর আমি তো এই বাড়িরই মেয়ে, আমার তো আছে অধিকার প্রপার্টিতে"।

" হুম!! অফকোর্স!! তো তুই কি ভাবছিস???"

"আমি ভাবছিলাম যে যদি টোটাল প্রপার্টিটা ভাগ করে দিতো দাদাভাই আমাদের দুজনের মধ্যে"।

" মানে তুই আর আমি???"

"হ্যাঁ, বিকজ বাড়ির মধ্যে ছেলে মেয়ে বলতে তো খালি তুই আর আমি। আমার বেশি দরকার নেই, ২০% দিলেই হবে। বাকিটা তোর। অফিস তুই তোর নামে করে নিবি"।

" হুম!!! বুঝলাম, কিন্তু ওকে তো পাওয়াই যাচ্ছেনা"।

"আমি কি চেষ্টা করে দেখবো???"

"আমিই লোক লাগিয়ে খুঁজে পেলাম না,তুই কি পাবি"।

" আরে চেষ্টা করতে তো ক্ষতি নেই তাইনা???ও এই বাড়িতে থাকলো নাকি না ওসব তো আমার দেখার দরকার নেই। আমার ভালো আমাকেই তো বুঝতে হবে, আর তোরাই বা কেন একটা অনাথের জন্য সাফার করবি দিনের পর দিন??? "

"তুই আমাদের আগের তানি কি????"

"মানে???"

"না মানে আগে তো দাদাভাই অন্ত প্রাণ ছিলিস,তাই বললাম,এই রূপ তো আগে দেখিনি"।

" শোন ছোড়দা,এখন নিজের সার্থ ছাড়া আর কেউ কিছু বোঝেনা। যেদিন জানলাম ও আমার নিজের রক্তের দাদা না,সেদিন থেকে আমার মন উঠে গেছে"।

"হুম!!! ওকে তুই দ্যাখ ওর খোঁজ পাস নাকি,দেন কি করা যায় আমি দেখছি"।

চ্যাটার্জি বাড়ির সবাইকে নিজের কথার জালে বেশ পটিয়ে ফেলেছিল তানভি। সৌমাদ্রিকে খোঁজ করার বাহানা দিয়ে বের হতো।কিন্তু হিমাদ্রি এতো সহজে পটে যাবার মানুষ না। তানভির পেছনে লোক লাগিয়ে দিয়েছিল ঠিকই কিন্তু হিমাদ্রি যতই বুনোওল হোক,তানভি বাঘা তেঁতুল,ঠিক বুঝে গিয়েছিল হিমাদ্রি যে লোক লাগিয়েছে। খোঁজ করার নাটক করেছিল সৌমাদ্রির কিছু ক্লোজ বন্ধু,চেনাপরিচিতদের বাড়ি গিয়ে। দুতিনদিন এভাবে চালিয়েছিলো যাতে তার পিছু নেওয়া বন্ধ হয়। এদিকে ফোনে কথা বলে সৌমাদ্রি আর বিনীকে সবটা জানিয়ে দিয়েছিল সে। আর সৌমাদ্রিও তার প্ল্যান মাফিক কাজ শুরু করে, শুধু তানভিকে বলেছিল কোনোভাবে যেন সাতদশদিন তাদের সাথে দেখা না করে। ওর কথামতোই চলেছিলো তানভি। আর পরবর্তীতে কি করতে হবে সেটাও সৌমাদ্রি ফোনেই বুঝিয়ে দিয়েছিল তাকে। 


এইকদিনে চ্যাটার্জি বাড়ির বর্তমান পরিস্থিতি তানভির চোখে বেশ ভালোভাবেই পরে। দিন নেই রাত নেই তার কাকু মদ্যপ অবস্থায় ঘুরেবেড়াচ্ছে।কাকিমনি যখন তখন উদঘট ভাবে সাজগোজ করে বের হয়, রাত করে ফিরে আসে। হিমাদ্রি বাড়িতে অগাধ বন্ধুবান্ধবদের আড্ডা শুরু করিয়েছে, রাত করে মদের আসর,অশ্লীল কথাবার্তা, বউ থাকা সত্ত্বেও অন্য মেয়েকে বিছানায় তোলা। আর তার বউয়ের লেভেল তো আলাদাই,হিমাদ্রির সামনেই তার বন্ধুদের সাথে গায়ে ঢলাঢলি, মদ্যপ অবস্থায় তার চোখের সামনেই অশ্লীল কারবার,আর খুলে নাই বা বললাম। নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছিল না তানভি। তার বাবা অনিন্দ্য বাবুর কোনো আদর্শ আর এই বাড়িতে নেই,তার মতোই চিতায় পুড়ে ছাই হয়ে গেছে। না দেখতে পারছিল না সহ্য করতে পারছিল।রাগের মাথায় একদিন হিমাদ্রিকে বলেই বসলো সে

"এসব কি হচ্ছে ছোড়দা?? এটা তো ভদ্রলোকের বাড়ি"।

" দ্যাখ এসব হলে কেউ অভদ্র হয়ে যায়না। তুই না বাইরে থাকিস?? কাজের সূত্রে দেশবিদেশ ঘুরে বেড়াস।এসব তো তোর কাছে কিছুইনা!!"

"দেশবিদেশ ঘুরলেই যে নিজের শিক্ষা গুলে খেতে হবে এমন কোনো কথা নেই। তুই এগুলোকে ফ্যান্টাসি ভাবতে পারিস বাট আমার কাছে এগুলো ফ্যান্টাসি না,নোংরামি। এসব বন্ধ কর"।

" দ্যাখ তানভি তুই এখানে থাকিস না।কিছু দিনের জন্য এসেছিস।ঠিকঠাক থাক,ঘোরাফেরা কর,মজম্যাস্তি কর,চলে যা। নাক কম গলালে তোরই ভালো। নাহলে এক কানাকড়িও পাবিনা। ওই অনাথটাকে পাকরাও করে দুটো ঘুসি দিলে সুরসুর করে সব আমার নামে লিখে দেবে। ভালো মতো থাক,ভালো মতো সুস্থ অবস্থায় ফিরে যা বোন,তোর কিছু হলে অনাথটার খোঁজ পাবো কি করে???" বলে একটা বাঁকা হাসি দিয়ে চলে যায় হিমাদ্রি।৷ 


দিনকে দিন পরিস্থিতি সহ্যের বাইরে চলে যাচ্ছিলো তানভির। না পেরে সৌমাদ্রির কথামতো হিমাদ্রিকে বলেই বসলো সবটা। হিমাদ্রি অফিস থেকে ফেরার পর খাবার টেবিলে সবটা বললো তানভি।

"দাদাভাইয়ের খোঁজ পাওয়া গেছে ছোড়দা"।

" কোথায়??? কবে???"

"আজই, একজন বন্ধুকে কাজে লাগিয়েছিলাম,ও সব খবর এনে দিয়েছে "।

" তোর আবার এখানে বন্ধু কবে হলো??"

"দুনিয়া আগের মতো নেই যে সাক্ষাতেই বন্ধুত্ব হবে। ফেসবুক মারফত। এনি ওয়ে কাজের কথায় আসা যাক???"

"হুম বল!! কি খবর দিলো???"

"দাদাভাই একভদ্রমহিলার বাড়িতে ভাড়া থাকে এখান থেকে অনেকটা দূরে।একটা দোকান খুলেছে, ওটা দিয়েই নিজে চলছে"।

" যার যেমন স্টেটাস। তাহলে ওকে এখন নিয়ে আসতে হবে আর কি "।

"শুধু ওকে আনলে লাভ হবে না,আরেকজনকেও আনতে হবে "।

" আরেকজন??? কে???"

"বড়বৌদি"।

" কি!!!!!!!!!! কক্ষনো না!!! ইম্পসিবল!!!!! " বেশ রেগে গিয়েই বললো হিমাদ্রি। 

"কুল ডাউন ছোড়দা,কুল ডাউন!!! এছাড়া আমাদের হাতে আর কোনো রাস্তা নেই "।

" কেন???"

"দাদাভাই ওর সমস্ত প্রোপার্টি বড়বউদির নামে করে দিয়েছে "।

" হোয়াট দ্য ফাক!!!!! ধুর!!!!!! "

"কিচ্ছু করার নেই দাদাভাই, আমাদের স্বার্থে এখন এটুকু করতেই হবে। হয়তো নাটকও করতে হবে অনেকটা। ওদের নিয়ে এসে আগের জায়গায় বসাতে হবে। যেহেতু বাবা নেই, বাবার পরে দাদাভাইকে এই বাড়ির সর্বেসর্বা করে রাখতে হবে এটলিস্ট যতদিননা বড়বউদিকে টোপ দিয়ে প্রোপার্টি হাত না করা যায়"।

" এছাড়া আর কোনো রাস্তা নেই?? আমি কি আমার মতো করে দেখবো???"

"কি করবি?? লোক লাগিয়ে তুলে এনে মার দিয়ে সই করাবি?? নাকি বন্দুকের ভয় দেখাবি। ভুলে যাসনা সবকিছু গায়ের জোরে হয়না। মাথাখাটিয়ে শান্ত ভাবেও অনেক কিছু হাসিল করা যায়। আর আমি যা খোঁজ পেলাম বউদির পেছনে এখন শহরের নামকরা এক মহিলার সাপোর্ট আছে। উনি তুরি মারলে তুই উড়ে যাবি"।

" হুম!! জানি... সুরভি রায়।" বলে মাথায় হাত দিয়ে বসেছিলো হিমাদ্রি। অঅনেকক্ষণ ভাবার পর তানভিকে বলে 

"ঠিকাছে কাল সকালে রেডি হয়ে থাকিস।আমি আর তুই যাবো।ঠিকানা পেয়েছিস???"

"হ্যাঁ "।

" ওকে, ১১টায় বের হবো"।

"ওকে "। 


সেদিনের মতো কথাবার্তা এটুকুই হয় নিজেদের মধ্যে। ঘরে গিয়ে সৌমাদি আর বিনীকে কনফারেন্স কলে সবটা জানিয়ে দেয় তানভি। বিনীকে বলে দিয়েছিল সকালে যেন সে সৌমাদ্রির বাড়িতেই থাকে।আর তার দাদাভাই যেন কাজে না যায়।পরদিন সকালে ব্রেকফাস্ট সেরে হিমাদ্রি আর তানভি বের হয়ে পরে। ঠিকানা ধরে ঠিক পৌঁছে যায় সৌমাদ্রির বাড়ি। গিয়ে কলিংবেল টিপতে দরজা খোলে বিনী।সৌমাদ্রি আগেই বলেদিয়েছিল ঠান্ডা মাথায় চুপচাপ নাটক করে যেতে,তাই হলো।

" কি চাই???"

"দাদাভাই কোথায় বউদি???"

"কেন কি দরকার তোমাদের??? ও বাড়ি নেই,যাও"। বলে দরজা আটকে দিতে গেলেও হিমাদ্রি আটকে দেয়। 

" বউদি প্লিজ!! আমি ক্ষমা চাইছি তোমার কাছে সেদিনের ঘটনার জন্য। এতোদিন বুঝিনি,কিন্তু এখন বুঝতে পারছি বড়দা আর তোমার ভ্যালু কতটা। ক্ষমা করে দাও প্লিজ!! আমি তোমার পায়ে পরছি "।

" থাক!! ওসবের কোনো দরকার নেই, ভেতরে এসো"। বলে ভেতরে নিয়ে এসে ওদের বসিয়ে সৌমাদ্রিকে ডেকে দেয়। তানভিও ওর নাটকের পার্ট অনুযায়ী সৌমাদ্রিকে গিয়ে জড়িয়ে ধরে। 

"তুই কি মনে করে ছটু???"

"বড়দাভাই!!!" বলে উঠে গিয়ে জড়িয়ে ধরে তাকে।

"আম এক্সট্রিমলি সরি বড়দাভাই।আমার খুব ভুল হয়ে গেছে। এতোদিন অনেক অন্যায় করেছি তোদের সাথে। সবকিছুর মূলে বাবা মা।কিন্তু আমি বুঝতে পারছি তোরা আমার কাছে কতটা ইম্পর্ট্যান্ট। আম সরি বড়দাভাই, প্লিজ আমাকে ক্ষমা করে দে"। বলে সৌমাদ্রির পা ধরে বসে পরে। 

" আরে আরে!! কি করছিস!! ওঠ!!"

"না তুই বল আমাকে ক্ষমা করে দিয়েছিস???"

"ভাইবোনের উপর কি রাগ করে থাকা যায়???"

"তাহলে চল আমাদের সাথে তোরা দুজন বাড়িতে"।

" না ছটু,আমরা ওই বাড়িতে যাবোনা"।

"কেন???ওটা যেমন আমাদের বাড়ি তেমন তো তোরও বাড়ি "।

" আমার কোনো টান নেই আর ছটু"।

"টান নেই বললেই হবে?? আমরা নেই?? তোর ভাইবোন নেই?? একটা বারও ভাবিস না আমরা কি করে চলবো তোদের ছাড়া?? বাবা-মায়ের কেমন মেন্টালিটি তোরা তো জানিস।পারবো শান্তি মতো থাকতে?? তোরা যদি হাল না ধরিস তাহলে কে ধরবে???"

"কেন, তুই আছিস তো"।

" না বড়দাভাই। তোরা থাকতে ওই বাড়ির সর্বেসর্বা আমি হবোনা।প্লিজ ফিরে চল দাদাভাই প্লিজ!! ও বউদি!! তুমি একটু বোঝাও না বড়দাভাইকে,চলোনা।আমাদের আর ভালো লাগছেনা "।

" আমি কি বলবো?? ও যা বলবে তাই"।

"তোকে আমার মাথার দিব্যি বড়দাভাই,ফিরে চল।আর যদি না যাস তাহলে আমার মরা মুখ দেখবি"।

" ছিঃ ছিঃ!! এসব বলতে নেই ভাই।ঠিকাছে, আজ তো হবে না,আগামীকাল যাবো"।

"ঠিকাছে, তাহলে তোরা সব গোছগাছ করে নে,আমি কাল এসে নিয়ে যাবো"।

" তোর আসতে হবে না,আমরাই চলে যাবো"।

"না আমি এসে নিয়ে যাবো।তোরা আমার হাত ধরেই ঢুকবি। কারোর ক্ষমতা নেই আর তোদের কিছু বলার"।

" ঠিকাছে" 

"হুম!! আমরা আসি তাহলে "।

" সে কিরে!!! খাওয়া দাওয়া করে যা"।

"না আমি অফিস যাবো।তানি তুই থাক,আমি ফেরার সময় তোকে নিয়ে যাবো। কিছুক্ষণ সবাই মিলে থেকে তারপর নাহয় রাতে ফিরবো"।

" ওকে ছোড়দা!!" 

চলে যায় হিমাদ্রি। ওর নাটক দেখে তিনজন অবাক হয়ে যায় । কতটা ধুরন্ধর হলে একটা মানুষ এমন নাটক করতে পারে। তাও এটলিস্ট তানভির জন্য বাড়ি যাবার রাস্তাটা পরিষ্কার হলো দুজনের। দাদাবউদি দুজনেই ধরে আদর করে দিয়েছিল বোনকে।আর তার কাজের গিফট হিসেবে বিনী দিয়েছিল একটা ঘড়ি।

রাতে হিমাদ্রি আর তানভি চলে যাবার পর বিনীও ফিরে যায় বড়দির বাড়িতে। কেননা বড়দির সাথে সমস্ত বিষয় নিয়ে কথা বলার দরকার আছে। বাড়ি ফিরে ফ্রেশ হয়ে বড়দির ঘরে যায় বিনী। এতোদিন ওদের প্ল্যান সম্পর্কে বড়দি সবটাই জানতো। বাড়ি ফিরে এসে আজকের ঘটনা সবটা খুলে বলার পর বড়দি বলে দেয় কাল ওইবাড়ি যাবার পর পরশু থেকে সে যেন হিমাদ্রির অফিসে চলে যায় সকালে। এই অফিস কিছুদিন বড়দি সামলে দেবে। বিনী যেন পুরোপুরি ভাবে সব দিক থেকে সবাইকে নাকে দড়ি দিয়ে ঘোরায়। আরও অনেক কিছুই বুঝিয়ে দিয়েছিল। 


পরদিন অফিসের কাজ তাড়াতাড়ি শেষ করে বাড়ি এসে নিজের কিছু জিনিস গুছিয়ে নেয় বিনী। সবকিছু নেয়নি, কেননা বড়দি নিতে দেয়নি। এতোদিনে মেয়েটার প্রতি বড্ড বেশি মায়া জমে গেছে তার। মাঝে মাঝে যেন এখানে তার কাছে এসে থাকে তেমনটাও বলেছিলেন। এতে বিনীও রাজি হয়ে যায়। কারণ আর যাই হোক, দুনিয়ায় সবাই যখন তাকে দূরে সড়িয়ে দিয়েছিল তখন এই বড়দিই তাকে কাছে টেনে নিয়ে ভালোবাসা, ভরসা দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে আসতে সাহায্য করেছে। সেও যে খুবই ভালোবাসে তার বড়দিকে। খাওয়া দাওয়া শেষ করে বড়দিকে জড়িয়ে ধরে আদর করে চলে আসে বিনী সৌমাদ্রির বাড়ি। বিকেলে হিমাদ্রি নিতে আসবে তাদের। প্ল্যান মাফিক সব চললেও মনের মধ্যে একটু ভয় ছিলো বিনীর। কেননা হিমাদ্রিকে বিশ্বাস নেই তার একদমই,কি করতে কি করে বসবে তা ভগবান ছাড়া আর কেউ জানেনা। বুকের মধ্যে একরাশ চাপা ভয় নিয়ে বিকেলে রওনা হলো বিনী আর সৌমাদ্রি চ্যাটার্জি বাড়ির উদ্দেশ্যে। 


চ্যাটার্জি বাড়িতে পা দিতেই সদর দরজার সামনে হিমাদ্রির মা আর স্ত্রী এসে দাঁড়ায়। বিনী আর সৌমাদ্রি দুজনেই ভেবেছিল যে এইদুজনই হয়তো এখন ঝামেলা শুরু করবে,কিন্তু সেটা হলোনা,হিমাদ্রির কথায় দুজনেই জবরদস্ত একখানা নাটক করে ফেলে। হিমাদ্রি নিজে ওদের ব্যাগগুলো সৌমাদ্রির রুমে রেখে আসে। সৌমাদ্রিকে নিয়ে তার কাকিমা আদেখলেপনা শুরু করলেও বিনী ঘুরে ঘুরে বাড়িটাকে দেখছিল। ইট,বালু,সিমেন্ট দিয়ে তৈরি বাড়িটা আগের মতোই আছে,কিন্তু তাকে পরম যত্নে, ভালোবেসে সাজিয়ে তোলা অনিন্দ্য বাবুর কোনো রকম চিহ্ন আর নেই। বদলেছে প্রতিটা ফার্নিচার, বদলেছে দেয়ালের ছবি গুলো,স্টোর রুমে স্থান পেয়েছে অনিন্দ্য বাবুর প্রিয় গ্রামাফোন, বদলেছে প্রতিটা মানুষ। আগের কোনো কাজের লোক বাড়িতে নেই, আসার পর থেকে যাদের দেখেছে বিনী,সকলেই নতুন। সেদিন রাতে তেমন আর কোনো কথা বা কিছু গন্ডগোল হয়নি। পরদিন সকালে বিনী উঠে স্নান করে রান্নাঘরে এসে চা বসিয়েছিল। তাকে রান্নাঘরে দেখে কাকিমণি ছুটে আসে। 

"একি!! তুমি চা করছ কেন??? সরমা কোথায়???"

"এসেছিল, বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি"।

" মানে???"

"মানে আর কাজে আসতে হবে না,টাকা দিয়ে বিদেয় দিয়েছি"।

" তাহলে রান্না কে করবে??? তুমি????" 

চায়ের কাপে চুমুক দিতে দিতে ড্রয়িং রুমে সোফাটায় গা হেলিয়ে দিয়ে বসে বিনী বললো

"কেন!!! তুমি!!!"

"আমি!!!!! আমি কেন রান্না করতে যাবো???"

"সে তোমার একার পক্ষে অসুবিধে হলে তোমার বউমাকে ডেকে নেবে।" কথাটা শেষ না হতেই রুহি পেছন থেকে বলে 

"আমি কেন রান্না করতে যাবো?? আমি কি রান্না করতে এসেছি নাকি এই বাড়িতে??? তাছাড়া রান্নাবান্না নিয়ে বসলে আমি অফিস কখন যাবো???"

"কোন অফিস??? তুমি জব করো???"

"কেন আমাদের অফিস???"

"ওখানে তোমার কোনো দরকার নেই। যা কাজ আমি আছি,বুঝে নেবো"।

" মানে??? তুমি অফিস যাবে???"

"কেন?? এতে এতো অবাক হবার কি আছে?? আমার অফিসে আমি যাবো এটা তো স্বাভাবিক ব্যাপার তাইনা!!!"

"কিন্তু আমি এতোদিন হিমুর সাথে অফিসে গিয়ে সবটা সামলেছি"।

" আর দরকার নেই। আমার অফিসে কে থাকবে কে কি কাজ করবে সেটা আমাকেই বুঝতে দাও।আর এতোদিন কি হয়েছে না হয়েছে সবই আমার জানা আছে "। 

" সে যাই হোক, আমি রান্নাবান্না করতে পারবোনা"।

"তাহলে বের হয়ে যাও বাড়ি থেকে। যেখান থেকে এসেছ সেখানেই ফিরে যাও।বসে বসে গিলিয়ে আমি আমার টাকা ধ্বংস করবো না"।

" দেখেছেন মা দেখেছেন!!!! খাল কেটে কেমন কুমির নিয়ে আসলেন!!! বারবার বলেছি এই ভুল করবেন না"।

"এই তুমি চুপ করতো!!! আমাকে কথা বলতে দাও!!! বিনী!! মা!!!! তুমি তো জানো আমার বয়স হয়েছে, এই সময় কি এতো কাজ করা যায় তুমি বলো????"

"বিয়ের পর থেকে বসে বসে গিলে শরীরে রোগের ডিপু বানিয়েছেন। এখন কাজকর্ম করুন,দেখবেন শরীর ভালো থাকবে। আজ বেশি রান্না করতে হবে না,শুক্ত,ডাল,ভাজা,মাছের ঝোল আর চাটনি বানিয়ে ফেলুন। আমি অফিস থেকে আসার সময় মাংস নিয়ে আসবো,রাতে জমিয়ে মাংসটা রাধবেন ঠিকাছে??? জমিয়ে খাওয়া দাওয়া হবে"।

" আমি পারবো না!!!"

"যান ব্যাগ গুটিয়ে বের হয়ে যান!!!"

"কি!!!! তোমার তো সাহস কম না তুমি আমার বাড়িতে দাঁড়িয়ে আমাকে চলে যেতে বলছ???"

"ভুল বললেন!! এটা আপনার না,আমার বাড়ি। কথা না বাড়িয়ে দুজন কাজে লেগে পরুন!! নাহলে কিন্তু আজ খাওয়া পাবেন না"। 

" তুমি আমাদের খেতে দেওয়ার কে হে????" 

"তিরু!!!!! এই তিরু!!!! তিরু!!!! এই হতচ্ছাড়া কোথায় মরলি!!! এদিকে আয়!!!" 

"আসছি দিদি!!!! বলো কি বলবে!!" 

"এ আবার কে বিনী????"

"ও তিরু!! আজ থেকে আপনাদের দুজনের ওপর ও নজর রাখবে। শোন তিরু!! যদি দেখিস কাজ না করে বসে আছে বা লুকিয়ে লুকিয়ে খাচ্ছে,খেতে দিবিনা। ঘাড় ধরে বের করে দিবি,নাহলে তুলে নিয়ে গিয়ে পাশের বাড়ির পচা পাগাড়ে ফেলে দিবি। আর যদি বেগতিক কিছু করতে যায়,সাথে সাথে আমাকে ফোন করবি। এসে চাপকে পিঠের ছাল তুলে দেব"।

" আচ্ছা দিদি!!!" 

"যান এখন গিয়ে ফটাফট ব্রেকফাস্ট রেডি করুন।আমি ১০টায় বের হবো!!" বলে চায়ের কাপটা ওখানে রেখে বিনী নিজের ঘরে চলে যাচ্ছিলো। পেছন থেকে রুহি বলে 

"চায়ের কাপটা যে রেখে গেলে?? কে ধুয়ে রাখবে???"

"কেন?? তুমি!!" 

"রান্না করবো আবার বাসনও মাজবো????"

"হ্যাঁ!!! রান্না করে সব বাসন ধুয়ে রাখবে। জামাকাপড় যা থাকবে ওয়াসিংমেশিনেই কাচবে,হাতে ধুতে হবে না। তারপর বাড়ি ঘর মুছে ফেলবে। কে কোনটা করবে ভাগাভাগি করে নাও নিজেদের মধ্যে। মাথায় রেখো,একটা কাজের লোকও কিন্তু আসবে না।আর কোনোরকম চালাকি করলে মুশকিল আছে"। বলে বিনী চলে যায়। 


স্নান সেরে রেডি হয়ে নিচে এসে দেখে, হিমাদ্রি, সৌমাদ্রি দুজনেই বসে আছে। হিমাদ্রির মুখ রাগে লাল হয়ে আছে পুরো। 

" মায়ের কাছে যা শুনলাম সেটা কি সত্যি???"

"অবশ্যই!! "

"এর জন্য তোমাকে এই বাড়িতে আনলাম??? তোমার পেটে পেটে এতো????"

"পেটে পেটে কার কি আছে সে আমার ভালো করে জানা আছে। তুমি বেশি কথা না বলে রেডি হও।সাড়ে দশটার এক সেকেন্ড লেট হলে অফিসে ঢুকতে দেবোনা। ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দেবো"। 

" কি বললে??? তোমার এতো বড় সাহস???" বলে মারতে গেলে বিনী হাতটা ধরে ফেলে। 

"নিজের হাতকে নিজের বশে রাখো আদরের ঠাকুরপো। নাহলে যে এই এতো সুন্দর হাতদুটোতে হাতকড়া মানাবে না"।

" কি বলতে চাইছ তুমি???"

"আমি কি বলতে চাইছি তা তোমার থেকে ভালো আর কেউ জানেনা বাবু। সো কিপ ইউর মাউথ শাট এন্ড ফলো এভ্রিথিং এস আই সে"।

" বেশি বার বেরোনা কিন্তু, তুমি কিন্তু আমাকে চেনো না"।

"চিনি!!! খুব ভালো করে চিনি। কিন্তু তুমি এখনো আমাকে চিনে উঠতে পারোনি। অলরেডি পৌনে দশটা,এখান থেকে অফিস যেতে আধঘন্টা লাগে। এনি ওয়ে, আমার ব্রেকফাস্ট???" রুহিকে জিজ্ঞেস করে বিনী।

"দিচ্ছি!!!" বলে রান্নাঘরে চলে যায়। 

"তুমি বসে আছো কেন??? যাবেনা অফিস???"

"তুমি যাচ্ছো আমি আবার গিয়ে কি করবো???" সৌমাদ্রি বলে। 

"কথা কম বলতো,এমনিতেই সকাল থেকে এদের পেছনে কেচর কেচর করতে করতে আমার মাথা ধরে গেছে। যাও ফটাফট স্নান সেরে ব্রেকফাস্ট করে অফিস চলে আসো।"

"জো হুকুম রানী সাহেবা!!" বলে হেসে সৌমাদ্রি চলে যায়।

বাড়িতে এমন তান্ডব করার পর বিনী যে অফিসে গিয়ে সবার সামনে তান্ডব করতে পারে সেই ধারণা হিমাদ্রির ছিলো না। এদিকে বিনী অফিসে যাবার পর সোজা চলে যায় সেই রুমে, যেখানে একদিন পরম যত্নে তার শ্বশুর মশাই তাকে বসিয়ে ছিলেন আর এতোদিন হিমাদ্রি এই চেয়ারে বসে তার রাজত্ব চালিয়েছে। বিনী ওই রুমে গিয়ে বসতেই এক কমবয়সী মহিলা ছুটে আসে রুমে। 

"একি একি!!! কে আপনি??? দুম করে অফিসে ঢুকে এই ঘরে এসে বসে পরলেন যে?? কে ঢুকতে দিয়েছে আপনাকে?? সিকিউরিটি!! সিকিউরিটি!!! " বলে চিতকার করতে থাকে। অবশ্য এতে তারও কোনো দোষ নেই, কেননা সে বিনীকে আজ অবধি দেখেনি,হিমাদ্রি তাকে চাকরিতে রেখেছে। তার চিতকারে বেশ কিছু স্টাফ ছুটে আসে। বেশিরভাগই নতুন,তার মাঝে দুজন ছিলো যারা পুরনো আর বিনীকে চিনতো। সিকিউরিটিও চলে আসে, এসে বিনীকে আজেবাজে কথা বলা শুরু করে। 

"থাপ্পড় মেরে না গাল লাল করে দেবো।একদম চিতকার চেচামেচি করবেনা কেউ অফিসে। বের হও রুম থেকে সব,বের হও"।

" আরে পাগল নাকি হ্যাঁ!!!! নিজে ঢুকে পরে এখন দাপট দেখাচ্ছে"।

"অস্মিতা, থামো,উনি আমাদের ম্যাডাম "। কমলবাবু বলে উঠলেন, যিনি কিনা অফিসে আগে ম্যানেজার হিসেবে ছিলেন।

" ম্যাডাম মানে??? কিসের ম্যাডাম???? এই যে স্যার,আপনি পেছনে চুপ করে দাড়িয়ে আছেন কেন??" এসবের মাঝে ততক্ষণে হিমাদ্রি অফিস চলে আসে। 

"অস্মিতা, উনি আজ থেকে আমার কাজ সামলাবেন"।

" এক সেকেন্ড এক সেকেন্ড!!! কি বললে??? তোমার কাজ??? ভুল হয়ে গেলো না একটু বলতে,বরং তুমি এতোদিন আমার কাজ সামলেছ, আমি ছিলাম না জন্য। এখন আমি চলে এসেছি তাই আর তোমার এই চেয়ারে বসার কোনো প্রয়োজন নেই। যাই হোক, নাটক শেষ!!! সবাই সবার কাজে যান। আর এই যে,অস্মিতা, কোন সেক্টরে আছো???"

"স্যারের পি.এ"।

" আজ থেকে ওর পি.এ দরকার নেই, তুমি আমার হয়ে কাজ করবে। আর হিমাদ্রি তুমি অলরেডি ১০ মিনিট লেট,সো চলে যাও"।

"মানে??? এটুকু রাস্তা আসতে এই সময় তো লাগবেই"।

" সেটা আমার জানার কোনো দরকার নেই। তুমি হেটে আসবে না উড়ে আসবে। আমি আগেই বলে দিয়েছিলাম সাড়ে দশটার এক সেকেন্ড লেট হলে মুশকিল আছে।তুমি বাড়িতে মা বউয়ের সাথে বসে প্ল্যান করবে সেটা তো আমি বসে দেখতে যাবোনা। চলে যাও" 

"এবার কিন্তু বেশি বাড়াবাড়ি হয়ে যাচ্ছে!!" 

"কি বললে???? তোমার সাহস তো কম না তুমি আমার অফিসে দাঁড়িয়ে আমার উপর গলা উঁচু করে কথা বলছো???"

"এটা খালি তোমার না আমাদের সবার অফিস"।

" তাই নাকি???? আচ্ছা ঠিকাছে, যাও একাউন্টসের ফাইল গুলো নিয়ে এসো দেখি।চটপট যাও,উনিশ বিশ থাকলে সবার সামনে কান ধরে ওঠবস করাবো"।

"ওগুলো অস্মিতার কাছে,আমি জাস্ট সই করতাম কিন্তু সবটা ওই সামলে দিতো"।

" তুমি অফিসে বসে কি করতে??? ফিমেল স্টাফদের মাথা থেকে পা অবধি মাপ দিতে????"

"বউদি!!!!!"

"এটা অফিস তোমার বাড়ি না,ম্যাডাম বলবে।আর এই যে ঢ্যাপের মোয়া অস্মিতা। দাঁড়িয়ে আছো কেন হা করে??? যাও আগের ৬ মাসের আপডেট দেখাও আমাকে। দুজনেই রুমে থাকবে। এই রুম থেকে বের হলে পা ভেঙে দেবো দুটোর"। বিনীর কথা শুনে অস্মিতা তখনই চলে যায় তার রুমে ফাইল আনতে,হিমাদ্রি ওই রুমেই বসেছিলো। কিছুক্ষণ পর হাফাতে হাফাতে এসে অস্মিতা ফাইল গুলো টেবিলে রাখে। 

" এই যে ফাইল!!" 

"দাদুর অফিস????"

"মানে????"

"পারমিশন নিয়ে ঢুকতে হয় জানোনা??? ম্যানার্স শেখো নি??? নাকি এতোদিন হুটহাট ঢুকে পরতে জন্য অভ্যাস হয়ে গেছে"???

" সরি ম্যাম!!" 

"বসো!!" বলে ফাইল গুলো নিয়ে ঘাটতে শুরু করে বিনী। কিছুক্ষণ পর কমলবাবুকেও ডেকে পাঠায় সে। 

"আসবো ম্যাম!!!"

"আসুন!!! আপনাকে যেই কাজটা দিয়ে গিয়েছিলাম করেছেন???"

"হ্যাঁ ম্যাম,আপনি দিয়ে যাবেন আর আমি করবোনা??? এই যে পেনড্রাইভ,এতে সমস্ত ডেটা আপলোড করা আছে একাউন্টের। কবে কোথায় কত ডিল হয়েছে, কত প্রফিট, কত লস সব আপডেট আছে"। 

" একদম পারফেক্ট তো???"

"হ্যাঁ ম্যাম,আপনি এই ফাইলগুলো আর এই ল্যাপটপটার ডেটার সাথে মিলিয়ে দেখুন। কিছু কাগজ আমি জেরক্স করে সরিয়েও রেখেছি"।

" ভেরি গুড!! আম ইম্প্রেশড!! কাল থেকে আপনি আগের জায়গাতেই কাজ করবেন। মানে ম্যানেজার হিসেবে"।

"থ্যাঙ্কিউ ম্যাম!! থ্যাঙ্কিউ সো মাচ!!" 

"আপনি আসুন এখন, কোনো দরকার হলে আমি ডেকে নেবো"। 

" ওকে ম্যাম!!" বলে চলে যান উনি। কমলবাবু যেতেই হিমাদ্রি বলে ওঠে 

"কিসের কাজ??? এগুলো কিসের ডেটা???"

"তোমার বেলেল্লাপনার"।

" মানে???"

"এতগুলো বছর ছিলাম না জন্য কি আমার কারোর সাথেই যোগাযোগ ছিলোনা??? তোমার কি আমাকে এতোটাই গাধা মনে হয়??? তুমি যা খুশি করে যাবে আর আমি কিচ্ছু জানতে পারবোনা তা হয় কি???" 

"সাপের ল্যাজে পা দিয়ে ফেলেছ"।

" সাপের ল্যাজে দিনের পর দিন তোমরা নেচেছ,এখন ছোবল খাবার জন্য তৈরি হও।যাও একটা খালি পেনড্রাইভ নিয়ে এসো"। বলতেই হিমাদ্রি চলে যায় পেনড্র্বাইভ আনতে। এনে বিনীর হাতে দেবার পর কিছুক্ষন ফাইল,ল্যাপটপ, ফোন সব ঘেটে দেখার পর বলে,


"আজ কিছু বললাম না,বাড়ি গিয়ে সব মিলিয়ে দেখি,সহ ঠিক থাকলে প্রোমোশন হবে, আর গন্ডগোল থাকলে কান ধরে ওঠবস হবে"। 

" ম্যাম!!! সরি ম্যাম!!! আমি ইচ্ছে করে কিছু করিনি আমাকে স্যার যা বলেছিলেন আমি তাই করেছি"। অস্মিতা কাঁদোকাঁদো গলায় বলতে থাকে। 

"তার মানে গন্ডগোল আছে। বেড়াল নিজেই ঝুলি থেকে বের হয়ে পরলো।যা হবার সব আগামীকাল হবে। আমি বের হবো এখন, কিছু কাজ আছে।তবে এতে আনন্দের কিছু নেই,তোমাদের স্যার এসে বসবেন এখন। আর কাল যদি ১০টার পর কাওকে অফিসে ঢুকতে দেখি,তার আর অফিসে আসতে হবে না"। বলে ব্যাগটা নিয়ে বের হয়ে যায় বিনী। ও চলে যেতেই রাগে নিজের চুল ধরে নিজেই টানতে থাকে হিমাদ্রি। পারলে সে তখনই বিনীর গলা টিপে ধরে মেরে ফেলে,কিন্তু সে উপায়টাও যে আর নেই। কেননা খাল কেটে কুমির সে নিজেই নিয়ে এসেছে। আর কুমির হাতে একগাদা প্রমাণ নিয়ে বসে আছে, যেসব কান্ডে হিমাদ্রির জেল যাওয়া কেউ আটকাতে পারবেনা।


অফিস থেকে বের হয়ে বিনী কোথায় গিয়েছিল কারোরই জানা নেই। এদিকে সৌমাদ্রি অফিসে আসার পর ভাই একগাদা অভিযোগ নিয়ে বসলো বউদির বিরুদ্ধে। কিন্তু আর যাই হোক বেচারা সৌমাদ্রির কিছু করার নেই, বরং মুখ বেজার করে বলে দিলো " আমি কি করবো??? ওকে এখন আমিই ভয় পাই"। মুখে অবশ্য এটা বললেও মনে মনে বিনীর তান্ডবে বেশ খুশি হয়েছিল সে। 


এদিকে বাড়িতে রুহি আর তার শ্বাশুড়ি মায়ের অবস্থা টাইট। একজন রান্না করে রান্নাঘর সামলাতে হিমসিম খেয়ে যাচ্ছিলেন আরেকজন পুরো বাড়ি মুছতে মুছতে। মাঝে এসে একটু সোফায় বসে যে জিরিয়ে নেবে সেই উপায়টাও নেই। বিনী তিরুকে দুজনের পেছনে লাগিয়ে দিয়ে চলে গেছে। কিন্তু কুকুরের লেজ তো আর এতো সহজে সোজা হয়না। কাকিমার বয়স হয়েছে জন্য অভিজ্ঞতা বেশি,কোনোরকম ভুল হলে বিপদ হতে পারে সেই আন্দাজ তিনি করতে পেরেছেন জন্য নিজের কাজ ঠিক করেই করে রেখেছিলেন। সমস্ত রান্না হবার পর সৌমাদ্রি, আর বিনীর খাবার ভাগে ভাগে বেড়ে রেখেছিলেন। কিন্তু তার আদরের বউমা সব পরিশ্রম পন্ড করে দিলো রাগে। বিনীর খাবার গুলোতে ইচ্ছে করে নুন,লঙ্কারগুড়ো মিশিয়ে দিয়ে আবার নিজের কাজে চলে যায়। এতে বিপদ যে কতটা বাড়তে পারে সেই আন্দাজ করে উঠতে পারেনি। 


নিজের কাজ সেরে সময় মতো বিনী চলে আসে বাড়িতে। এসে সব ঠিকঠাক দেখে কোনো আওয়াজ দেয়নি কাওকেই। ফ্রেশ হয়ে এসে রান্নাঘর থেকে নিজেই শ্বাশুড়ি মায়ের খাবার বেড়ে নিয়ে গিয়ে খাইয়ে দিয়ে আসে নিজের হাতেই। এই একজনকেই বিনা শাস্তিতে ক্ষমা করেছিলো বিনী কেননা কৌশিকিদেবী নিজের ভুল বুঝতে পেরে ক্ষমা চেয়েছিলেন বিনীর কাছে। তার খাওয়া শেষ হলে বউ শ্বাশুড়ি আর ননদের মধ্যে কিছুক্ষণ গুপ্ত আলোচনা হয়।কথা বলতে বলতে ঘড়ির কাঁটা তিনটা,তানভির খুব ক্ষিদে পেয়ে গিয়েছিল জন্য আদরের ভাবিকে টানতে টানতে খাবার টেবিলে নিয়ে চলে আসে। ততক্ষণে দুজনের খাবার টেবিলে গুছিয়ে দিয়েছিল কাকিমণি। খেতে বসার আগে বিনী সৌমাদ্রির খাবার প্যাক করে তিরুর হাত দিয়ে পাঠিয়ে দেয় অফিসে। 


সকাল থেকে বাড়ির সকলের উপর ভালোই অত্যাচার করেছিল বিনী।কিন্তু সে তো এতো অত্যাচারী নয়,যতই কঠোর হোক না কেন বাইরে থেকে, মনটা তার একটু হলেও নরম এখনো। তাই ভালো মনে কাকিমণি আর রুহিকেও তাদের সাথে খেতে বসতে বলেছিল। এতে কাকিমণি বেশ খুশি হয়ে খাবার বেড়ে নিয়ে আসেন দুজনের কিন্তু রুহি আর খেতে বসে না। শেষে বিনীর চাউনি দেখে ভয়ে বসে পরে। ডালের বাটি থেকে একটু ডাল ঢেলে ভাত মেখে মুখে দিতেই ফেলে দেয় বিনী। কিন্তু এদিকে তানভি দিব্যি খেয়ে যাচ্ছে।

"তোর মুখের স্বাধ কি চলে গেছে???"

"কেন???"

"নুন পোড়া ডালটা এভাবে গিলছিস যে??"

"কোথায় নুন?? ঠিকই তো আছে"।

" দেখি"। বলে তানভির বাটি থেকে একটু খেয়ে দেখে। বুঝতে পারে গন্ডগোল করে রেখেছে। তারপর সবগুলো খাবারই দুজন দুজনেরটা চেখে দেখে। দুজনেই বুঝতে পারে তানভিরটা ঠিক, যত গন্ডগোল বিনীরটাতেই।

"এটা কে করেছে??"

"আমি কিচ্ছু করিনি। আমি তো ভালো করে সব রান্না করে বেড়ে রেখে দিলাম"।

" তাহলে কি ভূতে করলো???"

"আমি সত্যি বলছি বিনী বিশ্বাস করো??? আমি বেড়ে রেখে স্নানে গিয়েছিলাম।তুমি তো নিজেই দেখলে সবারটা ঠিক আছে। আমি শুধুশুধু তোমার পেছনে কেন লাগতে যাবো বলো???"

"ঠিকাছে, ওতো কথা বলার কোনো দরকার নেই, দুজন মিলে খাও এটা"। বলতেই রুহি বলে 

" না,আমি খাবোনা,মা দোষ করেছে মা খাবে,আমি একটুও খাবোনা"।

"তাহলে এখন পুরোটাই তুমি খাবে"।

" কেন আমি কেন খেতে যাবো এই নুন পোড়া ডাল,ঝাল মেশানো মাছের ঝোল????" 

"তুমি কি করে জানলে কোন রান্নায় কি বেশি হয়েছে?? আমি তো একবারও মুখে বলিনি এটা।বুঝতে পারলি তানি,এটা কার কাজ???"

"হুম ভাবি ডার্লিং!!! দাও না মুখে ঢুকিয়ে, বুঝুক কত ধানে কত চাল"। 

" না আমি খাবোনা!! আমি কিছু করিনি"।

"হয় এটা খাও,নাহলে বাড়ি থেকে বের হও"।

" কথায় কথায় বাড়ি থেকে বের হয়ে যাবার ভয় কেন দেখাও তুমি??? বরের মাথায় হাত বুলিয়ে সমস্ত সম্পত্তি নিজের কবজায় এনে কি ভাবো তুমি নিজেকে??? থাকতে তো এক অজগ্রামে। ছোটোলোক ঘরের মেয়ে হয়ে এখন কি ভাবো নিজেকে?? মহারানী????" কথা শেষ হতে না হতে ঠাস করে একটা থাপ্পড় গিয়ে পড়ে রুহির গালে। 

"আমি গরীব ঘরের মেয়ে হলেও তোর থেকে অনেক ভালো। তুই তো আগেও যা ছিলি এখনও তাই আছিস।আরেকদিন আজেবাজে বললে জিভ টেনে ছিড়ে কুকুরকে খাইয়ে দেবো,মনে থাকে যেন"। বলে চলে যায় নিজের ঘরে বিনী।

চ্যাটার্জি বাড়িতে পা দেবার পর থেকে রোজই বিনী কোনো না কোনো তান্ডব করেই চলেছে। আর এতে অতিষ্ট হয়ে উঠেছিল বাড়ির প্রতিটা সদস্য। শুধু সৌমাদ্রি ব্যাপারটাকে বেশ এঞ্জয় করছিলো। বাড়িতে এখন কোনো কাজের লোক নেই। রান্নাবান্না বাড়িঘর পরিষ্কার করা সব দায়িত্ব এখন কাকিমণি আর তার বউমার।সে ইচ্ছে না থাকলেও বিনীর ভয়েই,ভাবেন এই বুঝি ভুল হলে ঠাটিয়ে একখানা চড় দেবে নাহলে সারাদিন না খাইয়ে রেখে দেবে। 


যেই কৌশিকিদেবীকে একঘরে করে দিয়েছিল একসময় তাকে ক্ষমা করে দিয়ে ঘরের বাইরে স্বাভাবিক জীবনে টেনে নিয়ে এসেছিলো বিনী। এতে অবশ্য খুবই অবাক হয়েছিল সৌমাদ্রি ও কৌশিকিদেবী। নিজেদের মনে এই প্রশ্ন বেশ কিছুদিন চেপে রেখেছিল দুজনেই কিন্তু সেটা বেশিদিন পারেনি। একদিন মা ছেলে মিলে ঘরে বসে এ বিষয়েই আলোচনা করছিল তখন বিনী নিজের হাতে চা করে নিয়ে এসে ঘরে ঢুকতেই কৌশিকিদেবী হাতটা চেপে ধরেন বিনীর।

"কিছু বলবেন মা????"

"হ্যাঁ বলবো,বসো এখানে"। বলে নিজের পাশে নিয়ে এসে বসান বিনীকে।

" বিনী তুমি বিয়ে হয়ে আসার পর থেকে আমিও তোমাকে মেনে নিতে পারিনি। ছোটোর বুদ্ধিতে তাল মিলিয়ে পদে পদে তোমাকে অপদস্ত করার চেষ্টা করেছি। সমুকেও মেনে নিতে পারছিলাম না,ছোটোর বুদ্ধিতে দিনের পর দিন আমি ওর সাথে অন্যায় করে গেছি। তোমার সর্বনাশের পেছনে আমার হাত যথেষ্ট, তাও তুমি আমাকে ক্ষমা করে দিলে??? কেন বিনী??? আজ ছোটো যেমন শাস্তি পাচ্ছে তেমন শাস্তি তো আমারও প্রাপ্য"।

"আপনার শাস্তি আপনি আগেই পেয়েগেছেন মা!!! কেন, এতোদিন তো একঘরে হয়ে ছিলেন এদের জন্যেই। যাদের সাথে তালে তাল মিলিয়ে আপনি দিনের পর দিন অন্যায় করে গেছেন। সারাদিনে দুটো ডালভাত আর জল ছাড়া তো আর কিছু আপনার কপালে জোটেনি। কারোর সাথে কথা বলতে পারতেন না। ছেলে নিজের পেটের না হওয়ায় যাকে অবহেলা করে গেছেন নিজের পেটের মেয়ের জন্য, তার সাথেও তো দেখা করতে পারেননি,ফোনে দুটো কথাও বলতে পারেননি। এই শাস্তি কি যথেষ্ট না???? আজ আমি আসার পর যদি আপনার ওপরেও চড়াও হতাম,তাহলে তো আমার আর আপনার মধ্যে কোনো তফাৎ থাকতোনা মা??? তাছাড়া নিজের পেটের না হলেও সমু আপনার ছেলে আইনত। আইনত আপনি ওর মা,আর নিজের স্বামীর মাকে এতোটা অবহেলা তো আমি করতে পারবোনা মা। হাজার হোক মা তো আপনি"। বিনীর কথা শেষ হতেই তাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে দেন কৌশিকিদেবী। 

" আমাকে ক্ষমা করে দিও মা!!! জানি আমি যা করেছি তা ক্ষমা করার মতো কাজ না,ক্ষমা পাবার যোগ্য না। তাও বলছি,আমি তোমার কাছে সারাজীবনের জন্য ঋণী হয়ে থাকলাম,তোমাকে আর পেছন ঘুরে তাকাতে হবে না বিনী। তোমার পেছনে ঢাল হয়ে আমি থাকবো,তুমি দেখো!!"

"কাঁদবেন না মা!!! এতোদিন যা হয়েছে হয়েছে। এখন আর কিচ্ছু খারাপ হবে না। যা হবে ভালোই হবে"। 


কথা বলতে বলতে হঠাৎই গানের আওয়াজ কানে আসে সবার। বাড়িতে বেশ জোড়েই গান বাজছে,তাও আবার অশ্লীল টাইপের। দেখার জন্য বিনী আর সৌমাদ্রি বের হয়ে আসে ঘর থেকে। আওয়াজ হিমাদ্রির ঘর থেকেই আসছে। কাছে গিয়ে দরজার সামনে কান পাততে বেশ কিছু গলার আওয়াজ শুনতে পায় দুজনেই। দরজা ধাক্কাতে শুরু করে বিনী। আগের মতো সেদিনও বন্ধুবান্ধব মিলে ঘরের ভেতর তান্ডব শুরু করেছিলো কিন্তু বিনী যে আগেই অফিস থেকে চলে এসেছে সেটা জানা ছিলো না হিমাদ্রি আর রুহির।দরজা ধাক্কানোর আওয়াজ শুনে ভেবেছিল হয়তো মা এসেছে। মদ্যপ অবস্থায় গিয়ে দরজা খুলতেই তাকে ধাক্কা দিয়ে ঘরে ঢুকে পরে বিনী। সারাঘরে মদের বোতল ছড়ানো। ঘরে তিনজন ছেলে আর একটি মেয়ে সাথে হিমাদ্রি আর রুহি। প্রত্যেকের অবস্থা তখন চোখে দেখার মতো না,বিশেষ করে রুহির। সে যেন তার পুরনো জীবনে ফিরে গিয়েছে।এসব দেখে মাথা গরম হয়ে যায় বিনীর। 

" কি হচ্ছে এসব???"

"কিছুনা,ছোটো পার্টি,তমালের বার্থডে আজ তাই"।

" তোমার ফ্রেন্ডের বার্থডে পার্টি এই বাড়িতে কেন??? এটা কি বার???"

"না তা নয়,আমরা মাঝে মাঝেই ছোটোখাটো পার্টি করে থাকিতো,তাই আর কি".

" ছোটোখাটো পার্টি??? আর ওই পার্টিতে রুহি এই অবস্থায় থাকে??? অন্য ছেলের কোলে??? এই বের হ সব,বের হ এই বাড়ি থেকে"।

"বৌদি!!! ওরা আমার গেস্ট!!! তুমি এভাবে অপমান করতে পারোনা!!!"

"দেখবি আমি কি পারি???" বলে ঘরের বাইরে বের হয়ে পাশের স্টোর রুম থেকে একটা লোহার রড নিয়ে আসে বিনী। হুড়মুড় করে ঢুকে বাড়ি দিয়ে সব মদের বোতল ভেঙে ফেলে। 

"বের হ!!! এই হারামজাদা!!! এই মাতাল, ওঠ!! ওঠ!!! বের হ বাড়ি থেকে "। বলে সব গুলোকে লাথি মেরে রডের বাড়ি মেরে ঘর থেকে বের করে মারতে মারতে ঘরের বাইরে বের করে দেয়। হিমাদ্রি অনেক ভাবে আটকানোর চেষ্টা করেছিলো কিন্তু পারেনি। সবগুলোকে বের করে হিমাদ্রিকে এসে বলে বিনী।

" আরেকদিন যদি দেখি সেদিন তোমাদের এই বাড়িতে শেষ দিন"। বলে নিজের ঘরে চলে যায় বিনী। 

সেদিনের ঘটনার পর বিনীর উপর রাগ চুড়ান্ত পরিমাণে উঠেছিল হিমাদ্রির। লোক দিয়ে বিনীকে তুলে নিয়ে গিয়ে মার্ডার করে দেবার প্ল্যান করে ফেলেছিল। কিন্তু বিনীকে যে কাঁচা হাতে খেলতে আসেনি সেটা জানা ছিলো না হিমাদ্রির। বিনীকে তুলে নিয়ে বেশিদূরেও যেতে পারেনি লোকগুলো, পুলিশ এসে গাড়ি আটকে দেয়। থানার ওসির সাথে বাড়িতে আসার আগেই সুরভিদির সাথে গিয়ে সমস্তটা বলে নিজের প্রোটেকশনের কথা জানিয়ে এসেছিলো বিনী। ছেলেগুলোকে হাতেনাতে ধরে এরেস্ট করে পুলিশ। চলে আসে বিনী বাড়িতে, ওকে বাড়িতে দেখে অবাক হয়ে যায়। কিছুক্ষণ বাদে ফোন বেজে ওঠে হিমাদ্রির। ফোনটা রিসিভ করে সে,

"আপনাকে কি আজ এরেস্ট করবো নাকি অন্যদিন"??

" কে আপনি???"

"লোকাল থানার ওসি বলছি"।

" আমাকে কেন এরেস্ট করবেন?? আমি কি করেছি???"

"ন্যাকামো না করলেও হবে। শাগরেদদের তুলেছি,প্রমাণ হাতে আছে। নেহাৎ ম্যাডাম বললেন তাই আপনাকে ছাড়লাম,আরেকদিন বেগতিক কিছু দেখলে সাথে সাথে তুলে নিয়ে আসবো,মনে থাকে যেন?? আর ম্যাডামের গায়ে যদি একটা আঁচড়ও আসে তাহলে বাড়ির সবগুলোকে তুলে নিয়ে আসবো, মাইন্ড ইট"। বলে ফোন কেটে দেয় অফিসার। হাল ছেড়ে দিয়েছিল হিমাদ্রি সেদিন, বুঝে গিয়েছিল এভাবে অপদস্ত করা তার পক্ষে আর সম্ভব না। 


এভাবেই চলতে লাগলো দিন। দেখতে দেখতে দুর্গাপুজোর আর ক'টা দিন বাকি। বিনীর কথায় সেই আগের মতো এবারও বাড়িতে ধুমধাম করে দুর্গাপুজো হবে যেটা অনিন্দ্য বাবুর স্বপ্ন ছিলো। বিনীর প্রস্তাবে সকলেই সায় দিয়েছিলেন। সৌমাদ্রি আর কৌশিকিদেবী মন থেকে আর বাকিরা ভয়ে।বলার সাথে সাথেই কাজ শুরু। ঠাকুরদালানে ঠাকুর বানানোর কাজও শুরু হয়ে যায় বলার পর দিন থেকেই। মহালয়ার দিন থেকেই বাড়িতে পুজোর আড়ম্বর শুরু হয়ে যায়। দিনগুলো বেশ দ্রুত গতিতেই পাড় হয়ে যাচ্ছিলো যেন দেবীর অসুর বধের বড্ড তাড়া। আগের নিয়মেই কলারম্ভ,বোধন আমন্ত্রণ, অধিবাস দিয়ে শুরু হলো মহাষষ্ঠী।আগের থেকে এবারের পুজোর আড়ম্বর অনেক বেশি। সমস্ত খরচ বিনী নিজের থেকেই করেছে, এমনকি পুজোর সব কাজ নিজের হাতেই। আত্মীয়স্বজন পাড়াপ্রতিবেশি কেউ বাকি নেই। দেখতে দেখতে তিনটে দিন কেটে গেলো। দশমীর দিন সকালে পুজোর যোগাড় করে দিয়ে ঠাকুরদালানে দাঁড়িয়ে পূজো দেখছিল বিনী। তখন মদ্যপ অবস্থায় অতিন্দ্র চ্যাটার্জি বিনীর পাশে এসে দাঁড়িয়ে মায়ের সামনে হাত জোর করে বিনীকে বলে 

"মনে আছে আজকের দিনটা???"

"সারাদিন আমি মদ গিলে থাকিনা যে ভুলে যাবো"।

" খুব বাড় বেড়েছিস তুই হারামজাদি। তৈরি থাক,আজকেও তাই হবে। ভাসানে সবাই গেলেও তোকে আজ আমি যেতে দিচ্ছিনা। দেবীর সাথে আজ তোর বিসর্জন হবে।তোর বাড়বাড়ন্ত আজ ঘুচিয়ে দেবো আমি "।

" হারামজাদি আমি না,হারামজাদা তুই।কে কার বাড়বাড়ন্ত কমায় আজ দেখবি। ইচ্ছে ছিলো মায়ের ত্রিশূল তোর বুকে বিধে দিই,কিন্তু তোর মতো নরকের কীটের রক্তে ওই ত্রিশূলটার অপমান হবে। সব হিসেব খাতায় লিখে রেখেছি। আর কিছুক্ষণ অপেক্ষা কর,একটু পরেই হিসেবের খাতা খুলবে"। বলে হেসে নিজের কাজে চলে যায় বিনী। 


বিনীর কথাই খাটলো,দশমী পুজো তখনও চলছে। থানা থেকে পুলিশ এসে উপস্থিত। ঠাকুরদালানের সামনে দাঁড়িয়ে বলে 

"অতিন্দ্র চ্যাটার্জি কে আছেন???"

টলমল পায়ে এগিয়ে এসে বেশ ডাটেই বলেন 

"আমি!! কেন কি হয়েছে???"

"আপনার নামে এরেস্ট ওয়ারেন্ট আছে"।

" কিসের???"

"৫ বছর আগে বিজয়া চ্যাটার্জিকে রেপ করার জন্য আর নিজের দাদাকে খুন করার জন্য। চলুন আমাদের সাথে"।

" প্রমাণ আছে??? প্রমাণ নিয়ে এসেছেন ধরতে???"

"প্রমাণ আমার কাছে আছে অফিসার"। সবকিছু নিজের হাতে নিয়ে ঠাকুরঘরের থেকেই বিনী বলে। 

" এই যে বেডশিট, ধুইনি,ওমনটাই আছে,এখনো রক্তের দাগ আছে দেখুন।"

"নিজের বরের সাথে ফষ্টিনষ্টি করে এখন আমার দোষ দিচ্ছিস শালী???" কথাটা বলতেই ঠাস করে গালে চড় মেরে দেয় বিনী অতিন্দ্রবাবুকে।

"পঙ্গু মানুষের সাথে বিছানায় শোয়া যায়না হারামি। অফিসার, আমার স্বামী তখন শারীরিক ভাবে সুস্থ ছিলেন না। এই যে রিপোর্ট, আর সেদিন ওই ঘরে উনিও ছিলেন। ওনার হাত পা বেধে শয়তান ওনার চোখের সামনেই আমার সর্বনাশ করেছিল। আর এটা যে রেপ সেটারও প্রমাণ আছে আমার কাছে, এই যে মেডিক্যাল রিপোর্ট। আর উনি যে আমার শ্বশুরমশাইকে খুন করেছেন তারও প্রমাণ আছে। বাবা হার্ট অ্যাটাক করেননি। ঘুমন্ত অবস্থায় মুখে বালিশ চাপা দিয়ে মেরেছেন উনি। এই যে সেগুলোর ফরেনসিক রিপোর্ট। আশাকরি আর কোনো প্রুফ লাগবে না"। 

" না ম্যাডাম, যথেষ্ট। শুধু কোর্টে গিয়ে আপনার স্বামীকে উইটনেস দিতে হবে যেহেতু উনি সেদিন ওইঘরে উপস্থিত ছিলেন"। কথাটা শুনে সৌমাদ্রি এগিয়ে এসে বিনীর কাঁধে হাত রেখে বলে 

" সাক্ষী আমি দেবো অফিসার, আপনি চিন্তা করবেন না"। 

" থ্যাঙ্কিউ, এই যাও ওনাকে এরেস্ট করো"।

"এক মিনিট অফিসার, আরেকজন আছে। হিমাদ্রি চ্যাটার্জি"। কথাটা শুনে হিমাদ্রি তেড়ে আসে বিনীর দিকে। 

" আমি কেন??? আমি কি করেছি???"

"বাবাকে মারার পেছনে প্ল্যানটা তো তোমার তাইনা??? সবার অনুপস্থিতিতে দিনের পর দিন টাকা চুরি করেছ আমার স্বামীর সই জাল করে। আমাকে লোক দিয়ে তুলিয়ে আবার রেপ করিয়েছ,কিছুদিন আগে মার্ডার করার চেষ্টা করেছিলে এগুলো কি কাফি না???"

"মিথ্যে কথা!!! অফিসার, সব মিথ্যে কথা, আমি এসব কিছুই করিনি"।

" এই ফাইলটা নিন অফিসার, এখানে হিমাদ্রি চ্যাটার্জির সব অপকর্মের সাক্ষী আছে। আর ওনাদের প্ল্যানের একজন আই উইটনেস আছে,আমাদের বাড়ির পুরনো কাজের মহিলা ছন্দাদি।ওর সাহায্যেই আমি সব সাক্ষী জোগাড় করতে পেরেছি। ও চলে যাবে কোর্টে"।

"থ্যাঙ্কিউ ম্যাম,আমাদের আর কোনো প্রমাণের দরকার নেই। এতেই হয়ে যাবে,অপরাধীদের শাস্তি দেবার জন্য এগুলো যথেষ্ট। এই ধরো এদের,নিয়ে চলো"। বলে দুজনকে ধরে হিড়হিড় করে টানতে টানতে নিয়ে চলে যায় পুলিশ। 

ওদের ধরে নিয়ে যেতেই কান্নায় ভেঙে পরলো দুজনের স্ত্রী। বিনীকে গালমন্দ করলেও সেদিন রুখে দাঁড়িয়েছিলেন কৌশিকিদেবী। কথা শুনিয়ে গালমন্দ করেও শান্তি হয়নি তার। বলে দেন বিসর্জন হয়ে গেলে যেন দুজনেই বাড়ি ছেড়ে বের হয়ে যায়। 


সন্ধ্যায় বিসর্জনের সময় বাড়ির সকলেই রওনা হয়েছিল ঘাটের দিকে। বিনী যেতে চাইছিলোনা,সৌমাদ্রি একপ্রকার জোর করেই নিয়ে যায় তাকে। ঘাটপাড়ে ঢাক কাসরের আওয়াজে মেতে উঠেছিল চারদিক। দেবীমূর্তিটা জলে ভাসাতেই অজান্তেই চোখের জল বের হয়ে এসেছিলো রিনির।পাশে গিয়ে তার কাঁধে হাত রেখে সৌমাদ্রি বলে 

" চোখের জল ফেলছ কেন??? আজ তো তোমার চোখের জল ফেলার দিন না বিনী।পেরেছ তুমি অন্যায়ের বিচার করতে। জানি খারাপ লাগছে তোমার, কিন্তু নিজে খারাপ হয়ে যদি ভালো কাজ করা হয় তখন তো খারাপ লাগাটা খুবই সামান্য সোনা। অনেক বড় হও,সারাজীবন দুইহাতে দশহাত সমান কাজ করে যেও দেবীর মতোই।আর আমাকে ছেড়ে যেওনা গো,অনেকটা ভালোবাসি তোমাকে, অনেকটা"। বলে জড়িয়ে ধরেছিল বিনীকে নিজের বুকের মাঝে।

 


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational