STORYMIRROR

Trisha Chakraborty

Abstract Horror Thriller

3  

Trisha Chakraborty

Abstract Horror Thriller

অজানা রহস্য

অজানা রহস্য

11 mins
341

ছোটো থেকেই ডাক্তার হয়ে গ্রামের লোকের সেবা করব এই স্বপ্ন ছিল। তাই ডাক্তারি পাস করেই প্র‍্যাকটিস করতে চলে এলাম আমার বাব-ঠাকুরদার গ্রামের বাড়ি তাবাডুংরা। বীরভূম জেলার বাংলা-ঝাড়খণ্ড সীমান্তে অবস্থিত এই গ্রাম। এই একবিংশ শতাব্দীতেও সেই গ্রাম-গ্রামই রয়ে গেছে । সীমান্তবর্তী এলাকা হওয়ায় উন্নয়নের ছিটেফোঁটাও স্পর্শ করেনি ওকে। বৈদ্যুতিক খুঁটি-তার বাড়ি বাড়ি বিদ্যুতের কানেকশন সবই আছে, কিন্তু আসল জিনিসটার দেখা পাওয়া যায় মাঝে মাঝে তাও দিনের বেলা। রাতে সেই লন্ঠনের আলো। আদিবাসী প্রধান গ্রাম।জন মজুরের কাজ করা এদের জীবিকা। গ্রামে প্রাইমারি-হাইস্কুল আছে,কিন্তু স্কুলে যাচ্ছে কে! মাস্টার মশাইরা বাড়ি থেকে খেলার মাঠ থেকে ছেলে-মেয়েদের ডেকে মানে একপ্রকার ধরে বেঁধে নিয়ে যায় মিড-মিলটুকু খাওয়ানোর জন্য। শিক্ষাদীক্ষার বড়োই অভাব এখানকার অধিবাসীদের।আদিবাসীদের গ্রাম হলেও দু-একটা তথাকথিত ভদ্রলোকের বাড়ি আছে বইকি। ওই দু-একটা চাষা,এক দু-ঘর ব্রাহ্মণ,গোয়ালা এই নিয়ে গ্রাম। গ্রামের মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থাও খুব একটা ভালো নয়। সমস্ত কাজের জন্য তাদের বেশ কিছু দূরে শহরে আসতে হয়। যোগাযোগের মাধ্যম বলতে ওই দুটি বাস। তাও মাঝে মাঝে একটা চলে,মাঝে মাঝে চলেই না।  শহরের সঙ্গে যুক্তকারী প্রধান রাস্তার অবস্থাও তথৈবচ। কোনো এককালে পিচের চাদর দিয়ে ঢাকা হয়েছিল। কোথাও কোথাও সেই চাদরের শেষ চিহ্ন বুকে নিয়ে শুয়ে থাকতে দেখা যায় তাকে।

আপনারা ভাবতেই পারেন এই অজ গ্রামে আমি কোন্ সুখে ডাক্তারি করতে গেলাম। তার কারণ আছে।বাবার মুখে শুনেছি আমার ঠাকুরদা-ঠাকুরমা সহ গ্রামের অনেকেই বিনা চিকিৎসায় মারা গেছেন। সেই তখন থেকেই আমি ঠিক করি ডাক্তার হয়ে এসে এখানের মানুষের চিকিৎসা করব। ঠাকুরদা ঠাকুরমার মৃত্যুর পর বাবা কাজে বদলি নিয়ে শহরে চলে আসে সে আমার জন্মের বহু আগে। ফলে গ্রামের পূর্ব পুরুষের মাটির বাড়ি দেখ ভালের অভাবে কালের হাতে আত্মসমর্পণ করে। বাড়ির অস্তিত্বের শেষ চিহ্ন টুকুও ক্রমে মেদিনী গ্রাস করে। এখন ওখানে ছোটো ছেলেমেয়েরা খেলাধূলা করে। গ্রামের মানুষ ছাগল গরু বেঁধে রাখে।

বাবার কাছে ফোনে আমার উদ্দেশ্যের কথা শুনে গ্রামে বাবার বাল‍্যকালের বন্ধু হরিচরণ মুখোপাধ্যায় অত‍্যন্ত খুশি হয়ে তার বাড়িতে থেকেই আমাকে প্র‍্যাকটিস করার কথা বলেন। বাবার বন্ধু হওয়ায় হরিচরণ মুখোপাধ্যায় কে আমি কাকু বলি। হরিচরণ কাকু বাবার সঙ্গেই আবগারি দফতরে চাকরি করতেন। চাকরি থেকে অবসর গ্রহণের পর গ্রামের পৈত্রিক মাটির বাড়ি ভেঙে পাকা বাড়ি তৈরি করেছেন। তিনি অকৃতদ্বার মানুষ। চাকরি থেকে অবসর নিয়ে তন্ত্র সাধনা করে তিনি এখন আগাগোড়া তান্ত্রিক। বাড়িতে পৈত্রিক কালী মন্দির আছে। সব সময় লাল পোশাক পড়ে থাকেন।গলায় রুদ্রাক্ষির মালা।মুখ ঢেকেছে সাদা পাকা গোঁফ দাঁড়িতে। তান্ত্রিক হিসাবে তার যথেষ্ট নাম-ডাক আছে। শোনা যায় তিনি কামাখ্যায় এক সন্ন্যাসীর শিষ্যত্ব গ্রহণ করে তন্ত্রসাধনা শিখেছেন।

গ্রামের মানুষের আমার চিকিৎসার থেকে হরিচরণ কাকুর মন্ত্র-তন্ত্র মাদুলি কবচ তাবিজ জলপড়া তেল পড়ায় বেশি ভরসা। হরিচরণ কাকুর ও চিকিৎসা ব‍্যবস্থায় ভরসা কম।

প্রত‍্যেক দিন আমাদের সান্ধ্য আড্ডা বসে কালীমন্দিরের চাতালে। সেখানে আমি ও হরিচরণ কাকু ছাড়াও উপস্থিত থাকেন শ‍্যামল ঘোষ,উৎপল মোড়ল সহ গ্রামের কয়েকজন বয়স্ক মানুষ। এরা সবাই বাবার পরিচিত বা বন্ধু হওয়ায় কাউকে কাকু জ‍্যেঠু প্রভৃতি সম্বোধন করি।

আজ তিনদিন অবিশ্রান্ত বৃষ্টির কারণে সান্ধ্য আড্ডায় কেউ আসতে পারে না।আমি আর হরি কাকু ঘরে বসে বসে গল্প করি--কখনও আমার ডাক্তারি বিষয়ে তো কখনও হরি কাকুর তান্ত্রিক হওয়ার বা তন্ত্র সাধনার জোড়ের কথা গল্পের বিষয় হয়ে ওঠে। সেদিন হরি কাকুর একটা কথা শুনে ভারি আশ্চর্য হলাম। কথা প্রসঙ্গে তিনি বললেন, -- "আমি মৃতদেহের ভিতর আত্মাকে আটকে রাখতে পরি। অবশ‍্য সেটা করতে হবে মৃত্যুর মিনিট দশকের মধ‍্যে।"

কথাটা শেষ করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আমার চোখে মুখে অবিশ্বাসের ছাপ লক্ষ করে বেশ গম্ভীর সুরে বললেন,--"কথাটা বিশ্বাস হলো না বোধহয়!" 

--"না,তা নয়,আসলে এরকম কখনও শুনিনি তো। "

আমার কথা শুনে গলার সুর চড়িয়ে বললেন,--- "যদি কখনও সুযোগ হয় তো চাক্ষুষ দেখিয়ে দেব।আসলে তোমাদের মতো শিক্ষিত ছেলে ছোকরাদের এই এক দোষ। তোমরা আমাদের পূর্ব পুরুষদের অধীত বিদ‍্যাকে মানতে চাও না।"

সেদিন হঠাৎ রাত্রে-- কটা হবে এই আটটা কি সোওয়া আটটার দিকে বৃষ্টিটা একটু ধরেছে এমন সময় হঠাৎ দেখি ছাতা মাথায় টর্চ হাতে উঠেনে দাঁড়িয়ে" ঠাকুর মশাই...ও... ঠাকুর মশাই" বলে কেউ ডাকছে।হরি কাকুকে গ্রামের লোক "ঠাকুর মশাই" বলে ডাকে। ডাক শুনে হরি কাকু--"কে রে ভোলা নাকি ?"বলতে বলতে হ‍্যারিকেনটা হাতে নিয়ে ঘরের বাইরে দাঁড়ালেন। আমিও পিছন পিছন উঠে এলাম।

--"হ‍্যাঁ,গো ঠাকুর মশাই,আমি ভোলা।"

--"কী হয়েছে রে ভোলা?" হরিকাকু জিজ্ঞাসা করলেন।

--"কর্তা কেমন করছে ঠাকুর মশাই।খুব ছটফট করছে।আপনি এখুনি একবার চলুন।"

--"আচ্ছা তুই যা আমি আর ডাক্তার দাদা এক্ষুনি যাচ্ছি।"

ভোলা উৎপল মোড়লের বাড়ির চাকর। উৎপল কাকুর স্ত্রী গতবছর তিনদিনের জ্বরে মারা গেছেন।ছেলে আধাসামরিক বাহিনীতে চাকরি করে।বাবা কে বহুবার সঙ্গে করে নিয়ে যেতে চেয়েছে কিন্তু উৎপল কাকু বাবার ভিটে ছেড়ে যেতে রাজি হননি।তাই তিনি গ্রামেই থেকে যান। উৎপল কাকুর ছেলে অসুস্থ বাবাকে সর্বক্ষণ দেখাশোনা করা স্নান করানো রান্না করে খাওয়ানো টাইমে ওষুধ দেওয়া প্রভৃতি সমস্ত কাজের জন‍্য গ্রামেরই মাঝবয়সী চাষাদের ছেলে ভোলাকে রেখে গিয়েছে মোটা টাকা বেতনে।

আমি চিকিৎসার জিনিসপত্র ভরা ব‍্যাগটা এক হাতে আর একহাতে ছাতাটা নিলাম। আর হরিকাকু অন‍্য একটা ছাতা আর টর্চ নিয়ে রাস্তা দেখিয়ে চললেন।

উৎপল কাকুর বাড়িতে ঢুকে তার শোওয়ার ঘরে গিয়ে প্রথমে তার পালস চেক করলাম তারপর যা যা আমাদের ডাক্তাররা করে থাকে সে সব করলাম--মানে প্রেসার মাপলাম,বুকে স্টেথো দিয়ে রোগ নির্ণয়ের চেষ্টা করে যেটুকু বুঝলাম অবস্থা খুব খারাপ।তাই চিকিৎসার সমস্ত প্রাথমিক পর্ব সেরে হরিকাকুকে বললাম--"অবস্থা ভালো না। শহরে নিয়ে গিয়ে হাসপাতালে ভর্তি করতে হবে। কিন্তু হাসপাতাল পর্যন্ত নিয়ে যাওয়া যাবে না বলে মনে হচ্ছে । যে কোনো সময় কোলাপ্স করবে।"

--"কিছু ওষুধ দিয়ে নিয়ে যাওয়া যাবে না হাসপাতাল।"--হরিকাকু জিজ্ঞাসা করলেন।

--"এতো দূর,তারপর রাস্তার যা অবস্থা তাতে রাস্তাতেই শেষ হয়ে যাবে মনে হয়।আর হাসপাতালে ভর্তি করেও কিছু হবে বলে মনে হয় না।বরং ওনার ছেলেকে খবর দিয়ে দেন।যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বাড়ি আসুক।" কথা গুলো বলেই আমি আবার পালস মাপতে উৎপল কাকুর হাতটা নিয়ে দেখলাম-- শেষ। সেকথা বলতেই হরিকাকু বললেন,"সেদিন তোমাকে যে বিদ‍্যার কথা বলেছিলাম তুমি বিশ্বাস করোনি আজ তার চাক্ষুষ প্রমাণ তোমাকে দেখাব।"

আমি বললাম "ও ওই দেহে প্রাণ আটকে রাখা।"

"হ‍্যাঁ"বলেই হরি কাকু ঘর থেকে দ্রুত গতিতে বেরয়ি ছাতা মাথায় চলে গেলেন। আবার মিনিট দুই-তিনের মধ‍্যে ফিরেও এলেন। হাতে কয়েকটা বই ও কিছু জিনিস নিয়ে।

সদ‍্য মৃত উৎপল বাবুর ঘরে ঢুকে আমাকে দরজা জানলা সব লাগিয়ে দিতে বললেন ও দূরে দাঁড়িয়ে দেখার নির্দেশ দিলেন । তারপর মেঝেতে আসন পেতে বসে কী সব আঁকিবুকি আঁকতে লাগলেন। তারপর "ওঁ হিং টিং সট ছট শৃণু" মন্ত্র বলতে বলতে উৎপল বাবুর খাটের চারকোণে চারটি পেরেক পুঁতে লাল সুতো জড়াতে লাগলেন। সুতো জড়ানো শেষে মন্ত্র বলতে বলতে একটা পাত্র থেকে হাতে করে জল ছিটাতে লাগলেন উৎপল কাকুর গায়ে। তারপর একদম উৎপল কাকুর মুখের উপর ঝুঁকে তার কপালে একটা লালা টিপ পড়িয়ে দিয়ে বুকের মাঝে হাত রেখে উৎপল কাকুর নাম ধরে ডাকলে লাগলেন ।বেশ কয়েকবার ডাকার পর একটা অর্ধস্ফুট ও অদ্ভুত শব্দ শুনতে পেলাম।কেউ যেন সাড়া দিল।কিন্তু কী অদ্ভুত আওয়াজ।ঠিক যেন অনেক দূর থেকে বা কোনো খালি পাত্রের ভিতর মুখ ঢুকিয়ে কথা বললে যেমন হয় তেমন শব্দটা।

সাড়া দেওয়ার সাথে সাথে হরি কাকু বললেন--কী হয়েছে তোমার উৎপল?

--"আমি মরে গেছি।আমাকে আবার ডাকছ কেন?আমাকে যেতে দাও।বিরক্ত করো না।"

সেই অদ্ভুত ভাবে শব্দ করে হরিকাকুর কথার উত্তরে কেউ এ কথা গুলো বলল?তাহলে কী উৎপল কাকু!কারণ ঘরের ভিতর আমি আর হরিকাকু ছাড়া কেউ নেই।আশ্চর্য হয়ে গেলাম।গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল।নিজের চোখ আর কানকে যেন বিশ্বাস করতে পারছি না। এমন সময় হরিকাকু গলা মোটা করে বললেন," আমি না ছাড়া পর্যন্ত তুমি কোথাও যাতে পারবে না।তুমি এখন আমার হাতে বন্দি।মনে রাখবে আমি তোমাকে তোমার দেহের ভিতর আটকে রাখলাম।যখন ডাকব তখন সাড়া দেবে--বুঝেছ।"

আবার সেই দূর থেকে ভাঙা ভাঙা গলায় কেউ যেন অর্ধস্ফুটভাবে বলল "আচ্ছা! জ্বালাতন তো।আমাকে ছেড়ে দাও"

--"না, এখন তোমার ছাড়া নেই। তুমি মনে কর তুমি ঘুমাচ্ছো---ঘুমিয়ে যাও---গভীর ঘুমে ঘুমিয়ে যাও---আবার পরে তোমাকে ডাকব।" উৎপল কাকুর বুকের মধ‍্যে একটা হাত ও অর্ধেক খোলা চোখে চোখ রেখে হরিকাকু গম্ভীর ভাবে কথা গুলো বললেন।

এই দৃশ‍্য দেখে আমি আরও অবাক হয়ে গেলাম।সব শেষ করে হরিকাকু আমাকে ঘরের বাইরে বেরিয়ে যেতে বলে নিজেও বেরিয়ে এসে দরজায় বাইরের ছিটকিনি লাগিয়ে মন্ত্র বলতে বলতে লাল কাপড় আর লাল সুতো বেঁধে দিলেন। ভোলাকে ডেকে বলে দিলেন ঘরের দরজা যেন কেউ না খুলে। তিনি আবার কাল সন্ধ্যায় এসে খুলবেন।

এরপর বাড়ি ফিরে উৎপল কাকুর ছেলেকে ফোনে সব জানান হলো। এমনকি এই আত্মা ধরে রাখার বিষয়টাও। ছেলে জানাল সে ছুটির ব‍্যবস্থা করছে।আশা করছে দু-তিনদিনের মধ‍্যেই বাড়ি চলে আসবে।

এই সমস্ত কিছুর মধ‍্যে হঠাৎ করে হরিকাকুকে কেমন অদ্ভুত লাগতে লাগল।তাকে দেখে যেন খুব অসুস্থ মনে হচ্ছে।সদা হাস‍্য মানুষটি কেমন যেন ঝুম মেরে গেল। উৎপল কাকুর বাড়ি থেকে ফেরার পর থেকে হরিকাকু আমার সঙ্গে কোনো কথা বলেননি।রাত্রে খাবারও কিছু খেলেন না।আমিও আর বিরক্ত করলাম না।কোনো রকম একটু খেয়ে নিজের ঘরে শুয়ে পড়লাম কিন্তু একফোঁটা ঘুম এলো না। এখনও পর্যন্ত গোটা ঘটনাটাকে বিশ্বাস করতে পারছি না। কে সাড়া দিল---এরকম হয় কিনা বিবিধ চিন্তা তখনও আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে।


পরদিন সকালেও দেখি যে হরিকাকু ভোর উঠে স্নান সেরে পুজোর আয়োজন করেন তিনি আজ এখনও বিছানা থেকে উঠেননি। আজ পর্যন্ত যে কটা দিন আমি এখানে আছি এমন কখনও দেখিনি। তাই কাকুর ঘরের ভিতর ঢুকে জিজ্ঞাসা করলাম--"আপনার কি শরীর খারাপ।" বিছানায় শুয়েই কাকু উত্তর দিলেন "প্রকৃতির নিয়মের বিরুদ্ধ কাজ করেছি সে কি আমাকে ছেড়ে দেবে ভাবছ।যতদিন না আমি উৎপলের আত্মাকে মুক্তি দিচ্ছি ততদিন আমার শরীরের উপর অত‍্যাচার চলবে।বেশি দিন ধরে রাখলে আমার মৃত্যুও হবে।" কাকুর কথা শুনে আমি অবাক হয়ে গেলাম বললাম --"তাহলে আজ রাতেই মুক্ত করে দিন।" কাকু বললেন --"থাক ছেলেটা তো চলে আসবে বলেছে।"

কাকুকে জোড় করে দুপুরে একটু খাওয়ালাম।খাওয়ার সাথে সাথে বমি করে সব বের করে দিলেন।সন্ধ্যা নামতেই কাকুর চোখ মুখের আকৃতি বদলে গেল।আমাকে সঙ্গে নিয়ে গেল উৎপল কাকুর বাড়ি।ঘরের দরজা খুলে আগের দিনের পেতে রাখা আসনে বসে বেশ কিছুক্ষণ মন্ত্র পাঠ করে উঠে আগের দিনের মতো উৎপল কাকুর মুখের উপর ঝুঁকে লাল টিপ পড়িয়ে বুকের মাঝে হাত রেখে নাম ধরে ডাকতে লাগলেন। বেশ কিছুক্ষণ ডাকার পর সাড়া পাওয়া গেল।

হরি কাকু জিজ্ঞাসা করলেন--"উৎপল তুমি কোথায় আছো?কেমন আছো?"

সেই খোনা খোনা গলায় নাকি সুরে উত্তর শুনতে পেলাম।আজকের আওয়াজটা যেন আরও দূর থেকে আরও গভীর থেকে আসছে বলে মনে হল।

--"আমাকে ছেড়ে দাও।খুব কষ্ট হচ্ছে।আমি ভালো নেই। আমাকে আমার দেহ থেকে মুক্তি দাও।"

এই কয়েকটা কথা অনেকক্ষণ ধরে ভাঙা ভাঙা গলায় বললেন মৃত উৎপল কাকু।

সত‍্যি আশ্চর্য চব্বিশ ঘন্টা পেরিয়ে গেলেও মৃতদেহের কোনো ক্ষতি হয়নি একটু গন্ধ ছাড়েননি--কিচ্ছু হয়নি।শরীরটা শুকিয়ে দড়ি হয়ে গেছে।

হরিকাকু বললেন,--"খুব তাড়াতাড়ি তোমাকে ছেড়ে দেব।এখন তুমি ঘুমাও।মনে করো তুমি জল খেয়েছ।তোমার তেষ্টা মিটে গেছে।তুমি আরামে ঘুমাচ্ছো।আবার কাল জাগাব।" এই বলে আবার আগের দিনের মতো আমাকে ঘর থেকে বের করে হরি কাকু কিছুক্ষণ পরে ঘর থেকে বেরলেন।তারপর আগের দিনের মতোই মন্ত্র বলে দরজা বন্ধ করে লাল কাপড় আর লাল সুতো বেঁধে দিলেন।তারপর আমরা বাড়ি ফিরে এলাম।বাড়ি এসে উৎপল কাকুর ছেলেকে ফোন করে জানালাম যে আত্মা ধরে রাখায় হরিকাকুর শরীর ক্রমশ খারাপ হয়ে যাচ্ছে।তাই তাড়াতাড়ি আত্মার মুক্তি দিতে হবে।ছেলে জানাল সে ছুটির দরখাস্ত করেছে।ছুটি মঞ্জুর হলেই সে বেরিয়ে যাবে।

আজ তিনদিনে পড়ল।হরিকাকুর শরীর আগের থেকে আরও খারাপ হয়েছে।সকাল থেকে রক্ত বমি শুরু হয়েছে।তাকে দেখে আমার খুব একটা ভালো লাগছে না ।তাই উৎপল কাকুর ছেলেকে ফোন করে ছুটি হয়েছে কিনা জানতে চাইলাম।সে জানাল তার ছুটি মঞ্জুর হয়নি।তাই আমরাই যেন তার বাবার মৃতদেহ সৎকার করে দিই।সে পরে এসে সমস্ত পারলৌকিক ক্রিয়া করবে।

হরিকাকুকে সব জানালাম সেই সঙ্গে বললাম আজ রাত্রে উৎপল কাকুকে মুক্তি দিয়ে দিতে। কাকু রাজি হলেন।কিন্তু সন্ধ্যা নামার সাথে সাথে হরি কাকুর সঙ্গে অদ্ভুত সব ঘটনা ঘটতে লাগল।হঠাৎ করে তার চোখ মুখ থেকে গড়গড় করে রক্ত পড়তে লাগল।হরিকাকু দাঁত মুখ খিঁচিয়ে কেমন একটা চিৎকার করতে লাগল।এইসব দেখে আমি খুব ভয় পেয়ে গেলাম।হরিকাকুর গায়ে হাত দিয়ে জোড়ে ডাকতেই কাকু একটু প্রকৃতস্থ হলেন।তখন রক্ত পড়াটাও বন্ধ।কাকুর আর হেঁটে উৎপল কাকুর বাড়ি যাওয়ার মতো শক্তি নেই।আমি আর ভোলা কোনো রকমে কাঁধে তুলে নিয়ে গেলাম।সেখানে পৌঁছানো মাত্র আবার এক অদ্ভুত ঘটনা ঘটল।যে ঘরে উৎপল কাকুর মৃতদেহ আছে সেই ঘরের ভিতরের জিনিস পত্র কেউ যেন ছুড়ে ছুড়ে মেঝেতে ফেলছে --দরজাটা ধরে খুব জোড়ে জোড়ে ধাক্কা দিচ্ছে--আর সেই অদ্ভুত বিৎকুটে গলায় চিৎকার করছে।হরি কাকু বাইরে থেকে মন্ত্র পড়তে আরম্ভ করলেন। মন্ত্র পড়া শেষ করে বললেন --"আজ তোমাকে ছেড়ে দেব।তুমি শান্ত হও।আর শান্ত না হলে আজও ছাড়ব না। "

হরিকাকুর বার কয় এই কথা বললে জিনিস পত্র ভাঙার আওয়াজ ও বিদঘুটে চিৎকার করাটা বন্ধ হয়। আজ আমাকে ঘরের ভিতর ঢোকার আগে গলায় একটা মাদুলি পড়িয়ে দিলেন। তারপর কাকু আস্তে আস্তে দরজা খুলে ভিতরে ঢুকলেন। আমিও তার পিছন পিছন ঢুকলাম। বারান্দায় রাখা লন্ঠনের আলোয় ঘরের ভিতরের যতটুকু দেখা যাচ্ছে তাতে দেখলাম গোটা মেঝেতে ঘরের জিনিস পত্র ছড়ানো ছিটানো।এমনকি কাকুর পুজোর জিনিস গুলোও ছড়িয়ে ছিটিয়ে দিয়েছে।কাকু সেই আলো-অন্ধকারে অসুস্থ শরীরে আসন পেতে বসে মন্ত্রোচ্চারণ শুরু করলেন। আসন থেকে উঠে কাকু মৃত দেহের উপর জল ছিটাতে ছিটাতে আমাকে ইশারায় সব জানলা দরজা খুলে দিতে বললেন।তার নির্দেশ মতো আমি দরজা জানলা সব খুলে দিয়ে প্রথম দিনের মতো দূর দাঁড়িয়ে কাকুর কান্ডকারখানা দেখতে লাগলাম ।

দেখলাম কাকু মৃতদেহের উপর ঝুঁকে কপালের তিলকটা মুছে দিলেন।তারপর বুকের মাঝে হাত দিয়ে আবার নাম ধরে ডাকতে লাগলেন।আজ অনেক দেরিতে সাড়া পাওয়া গেল। হরি কাকু বললেন,--"আজ তোমাকে ছেড়ে দেব।তার আগে তুমি কথা দাও আর কখনও এই বাড়িতে এই গ্রামে আসবে না। কাউকে জ্বালাবে না। তুমি যেখানে যাচ্ছিলে সেখানে চলে যাবে। এখন থেকে তুমি মনে করবে তুমি মরে গেছ। " ---কাকুর এই কথা শুনে ভাঙা ভাঙা খোনা গলায় ঠিক হাঁড়ির ভিতর থেকে আওয়াজের মতো করে কেউ যেন সাড়া দিয়ে বলল---"না আমি আসব না।কাউকে জ্বালাব না।আমাকে ছেড়ে দাও খুব কষ্ট আমার।"

একথা শেষ হতেই কাকু বললেন,--"যাও আজ থেকে তুমি মুক্ত।এই শরীরে আর তোমাকে বন্দি থাকতে হবে না।যাও তোমাকে মুক্তি দিলাম।"

এই বলেই কাকু মৃতদেহের কপালের সব সিঁদুর মুছে দিলেন।তারপর মন্ত্র বলতে বলতে পেরেকে বাঁধা সুতো গুলো সব একে একে খুলে দিলেন।সুতো খোলা শেষ করে একটা একটা করে পেরেক মন্ত্র বলতে বলতে তুলতে লাগলেন।শেষ পেরেকটা যখন তুললেন তখন স্পষ্ট দেখলাম মৃত দেহটা নড়ে উঠল।আর সমস্ত ঘর পচা গন্ধে ভরে গেল। ততক্ষণে মৃতদেহে পচন শুরু হয়ে গেছে। এতক্ষণ হরিকাকুর দিকে নজর ছিল না। এখন তাকিয়ে দেখি তিনি মেঝেতে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছেন।সবাই ধরাধরি করে তাকে ঘরের বাইরে নিয়ে এসে জল পাখা করাতে তার জ্ঞান ফিরল। পরে কাকুকে বাড়িতে শুয়ে রেখে আসি। তারপর গ্রামের সকলে মিলে মৃতদেহ সৎকারের ব‍্যবস্থা করলাম।

সৎকার করে ফিরতে ফিরতে সকাল হয়ে গেল।নদীতে স্নান সেরে বাড়িতে ঢুকে অবাক হয়ে গেলাম। দেখলাম হরিকাকু বিছানা থেকে নীচে পড়ে গেছেন।আর তার চারদিকে তাজা রক্ত।এগিয়ে গিয়ে দেখলাম কাকুর গলায় কিছু একটা কামড়ের দাগ সেখান থেকে তখনও রক্ত বেরচ্ছে।গায়ে হাত দিয়ে বুঝলাম কাকু আর নেই।হঠাৎ চোখে পড়ল খাটে রাখা একটা কাগজ।তাতে আমার নামে লেখা--

স্নেহের সন্তু,

ফিরে এসে তোমাদের আবার শ্মশান যেতে হবে আমার নশ্বর দেহটা নিয়ে। কারণ তোমাকে যে বিদ‍্যার প্রয়োগ দেখিয়েছি তাতে শেষে যে তান্ত্রিক এই বিদ‍্যা প্রয়োগ করে মৃতদেহের আত্মার মুক্তির কিছু পরেই তার মৃত্যু হয়।তাই ফিরে এসে তুমি আর আমাকে দেখতে পাবে না। তবে শুধু তোমাকে বিষয়টা চাক্ষুষ দেখানোর জন্য নয় নিজের অধীত বিদ‍্যার পরীক্ষার জন‍্য আমি এটা করেছিলাম। প্রকৃতির নিয়মের বিরুদ্ধে কাজ করার শাস্তি আমাকে পেতে হবে। আশাকরি এবার নিশ্চয় তোমার তন্ত্র সাধনার শক্তিতে বিশ্বাস জন্মেছে। আমার সেদিনের বলা কথায় এখন নিশ্চয় তোমার আর কোনো সন্দেহ নেই।আমার

এরপর হয়তো কিছু লিখতে গিয়েছিলেন কিন্তু সেই সময় ও সুযোগ পাননি বলে মনে হল। আজও পর্যন্ত এই ঘটনাটা আমার কাছে রহস্য হয়ে রয়ে গেছে।


Rate this content
Log in

More bengali story from Trisha Chakraborty

Similar bengali story from Abstract