অদ্ভুতুড়ে কান্ড ।
অদ্ভুতুড়ে কান্ড ।


দুপর দুটো নাগাদ ভাত খাওয়া দাওয়ার পরে একটা ভাত ঘুম দেওয়ার চেষ্টা করছি , হঠাৎ ঘরের বাইরে একটা সাইকেলের ঘন্টির শব্দ ও সাথে সাথে " চিঠি আছে".....একটা হাঁক শুনতে পেলাম। অনেকদিন পরে পিয়নবাবুকে দেখে কিঞ্চিত কৌতূহলের সাথে সাথে অবাকও হলাম। তার থেকেও বেশি অবাক হলাম যখন দেখলাম চিঠিটা সনাতন গোস্বামী লিখেছে।
চিঠি টা ঠিক এই রকম,---
ভাই তমাল,
তোর সাথে মাস ছয়েক হল কোন যোগাযোগ নেই। শুনেছিস হয়ত আমি এখন পড়াশোনা ছেড়ে বাড়িতে বসে আছি। আসলে আমি খুব বিপদের মধ্যে আছি। আমার সমস্যা টা একটু অন্যরকমের, কাউকে বোঝাতে পারছি না। কেউ বুঝতে চাইছে না রে। আমি জানি তুই ঠিক পারবি আমাকে বিপদের হাত থেকে বাঁচাতে।
ইতি
সনাতন ।।
সনাতন আমার স্কুলের প্রিয় বন্ধু। পড়াশোনায় যেমন চৌখস তেমনি ছিল খেলাধুলায়। মাধ্যমিকে ও আমাদের স্কুলে প্রথম হয়েছিল। ডাকাবুকো টাইপের ছেলে ছিল সে। গাছে চড়া , নদীতে জাল ফেলা, নৌকা চালানো সব বিষয়ে সমান পারদর্শী । ভয় যে কি জিনিস সে জানত না। ব্রাহ্মণ বাড়ীর ছেলে সনাতনের ঠাকুর -দেবতার উপর যথেষ্ট ভক্তি ছিল। ওর বাবা এলাকার কালিমন্দিরের প্রধান পুরোহিত । সনাতনও নিয়ম করে প্রতিদিন সন্ধ্যা আহ্নিক করতো। পাড়ায় কয়েক বার সরস্বতী পুজোর পুরোহিত ও হয়েছিল । উচ্চমাধ্যমিকেও নজরকাড়া রেজাল্টের পর শহরের কোন এক নামী মেডিকেল কলেজে ডাক্তারী পড়তে যায়। তারপর কি একটা মানসিক সমস্যার কারণে পড়াশোনার মাঝপথেই বাড়ি চলে আসে। মাধ্যমিক পর্যন্ত ওর সাথে আমার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক ছিল। উচ্চমাধ্যমিকে আমার বাণিজ্য বিভাগ থাকায় যোগাযোগ কিছুটা কমতে থাকে। তবে ছুটির দিনে বা কোন পুজো পার্ব্বনে আমরা চুটিয়ে আড্ডা দিতাম। কলকাতার হস্টেলে থাকাকালীন ও মাঝে মাঝে আমাকে চিঠি লিখত। আমি উচ্চমাধ্যমিক পাস করার পর একটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরী পেয়ে শিলিগুড়ি তে চলে আসি ও পাকাপাকি ভাবে সেখানে থাকতে শুরু করি।
ওর ওই বিপদের কথা পড়ে মনটা খারাপ হয়ে গেল। ওর মত শক্ত-সামর্থ, সাহসী ছেলের বিপদে পরা অর্থাৎ ও যে সত্যি ভয়ানক সমস্যার মধ্যে রয়েছে , এটা বুঝতে আর বাকি রইল না। তাই যত তাড়াতাড়ি সম্ভব ওর কাছে গিয়ে দেখা বিষয়টি না জানতে পারা অবধি ঠিক মানসিক শান্তি পাচ্ছিলাম না। পরদিনই অফিসে এক সপ্তাহের ছুটি মঞ্জুর করে নিয়ে রাতেই সনাতনের বাড়ির উদ্দেশ্যে রওনা দিলাম।
বেশ কয়েক মাস পর গ্রামের বাড়িতে এসে খুবই ভালো লাগছে। ব্যাগ-পত্র রেখে একটু ফ্রেশ হয়ে জ্যাঠামশাই এর সাইকেল নিয়ে সনাতনের বাড়ির দিকে রওনা দিলাম। তালধরা গ্রামের শেষ প্রান্তে ওদের বাড়ি।ওদের বাড়ি থেকে ইছামতী নদী হাটা পথে ত্রিশ মিনিটের মত। তখন দুপুর গড়িয়ে বিকেল হবে হবে , বাড়ির সামনের বিশাল বট গাছে একটা অচেনা পাখি কাতর সুরে ডেকেই চলেছে। বাড়ির বড় লোহার গেট ঠেলে ভেতরে প্রবেশ করলাম। মেসমশাই গত হয়েছেন মাস ছয়েক হল। বিছানায় শয্যাশায়ী অসুস্থ মাসিমা আমায় দেখে একপ্রকার কেঁদেই ফেলল। বিশেষ কোন কথাই তিনি বলতে পারলেন না। কাঁপা কাঁপা হাতে আমার দিকে হাত বাড়িয়ে কি যেন বলতে চাইলেন , পারলেন না। অদ্ভুত কয়েকটা শব্দ করে ক্লান্ত হয়ে থেমে গেলেন। আমার খুব অসহায় মনে হল মাসিমাকে ।
দোতলায় সনাতনের ঘর। আমি সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় উঠতে লাগলাম। অতবড় পেল্লায় বাড়ি, একসময় গম গম করতো। আজ আমার একটু অন্যরকম লাগছে। অস্বস্তিকর একটা দম বন্ধকরা পরিস্থিতি সমগ্র বাড়িটাকে যেন গ্রাস করে আছে। আমি একটা একটা সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠতে লাগলাম। মনে মনে ভাবছি সনাতনের কি বিপদ হতে পারে? ওপরের সব ঘর গুলি বন্ধ। চার চারটি ঘর পেরিয়ে সনাতনের পড়ার ঘর। ওঘরেই ও ঘুমতো এবং এখনোও ওই ঘরটাতেই থাকে। ওপরের জানালাগুলো বন্ধ থাকায় কেমন যেন অদ্ভুত অন্ধকার ছড়িয়ে রয়েছে হেটে যাওয়ার লম্বা প্যাসেজটিতে। বেড়ালের মতো পা টিপে টিপে এগোতে এগোতে দূর থেকে মৃদু গুন গুন একটা শব্দ কানে এলো। কে যেন খুব স্পট ও মৃদু স্বরে মন্ত্র উচ্চারণ করে চলেছে। শব্দটিকে লক্ষ্য করে ধীর পায়ে একটু একটু করে এগোচ্ছি এমন সময় মনে হল কে যেন খুউব কাছ থেকে প্রায় ঘাড়ের কাছে ঝুকে দেখছে। চমকে উঠলাম আমি। সারা শরীর জুড়ে একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে গেল। গায়ের প্রতিটা রোম অজান্তেই খাড়া হয়ে ওঠে। ঘাড় ঘুরিয়ে পেছনে দেখলাম , কেউ নেই। নিশ্চিন্ত হয়ে ঘুরে সামনে এগোতে যাব, বুকের ভেতরটা দ্রাস দ্রাস করে উঠলো -- সামনে সশরীরে সনাতন দাঁড়িয়ে। ও কখন এল। কি ঘটে চলেছে কিছুই বুঝতে পারছি না। খুব ভয় পেয়ে সনাতন কে দেখে একটু সাহস পেলাম। আমি বললাম, সনাতন, কেমন আছিস? কি হয়েছে রে তোর? সে শান্ত স্থির দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকিয়ে মুখে আঙ্গুল দিয়ে বলল, চুপ...... চুপ......, চুপ কর,...... ওরা শুনতে পাবে চল,....ভেতরে চল।
আমি অবাক হয়ে বললাম.....কারা শুনতে পাবে? ওরা কারা ? সনাতন কোন উত্তর না দিয়ে আমার হাত চেপে ধরে একপ্রকার টানতে টানতে ওর ঘরে নিয়ে দ্রুত দরজা বন্ধ করে দিল। ঘরে ঢুকে আমি প্রায় অবাক হয়ে গেলাম। যে ঘরে শুধু বই আর বই ছড়ানো স থাকতো, সেই ঘরের দেওয়াল জুড়ে শুধু ঠাকুর দেবতার ছবি আর বৈদিক মন্ত্রের ছবি লাগানো। আমি ওকে জিজ্ঞেস করলাম এসব কি সনাতন? ও কিছুক্ষন চুপ করে থেকে যা বলল তাতে আমি আমার নিজের কানকেও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না।
সনাতন বলতে শুরু করল......
বাবা গত হওয়ার কিছু মাস পর মা বাবার আলমারি থেকে একটি কাঠের বাক্স বের করে দেয় আমাকে দেখার জন্য । তাতে বেশ কিছু কাগজপত্র ও কিছু পুরোনো দিনের তালপাতার পুঁথি ছিল। গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাগজপত্র, দলিল ইত্যাদির সাথে দুখানি লাল কাপড়ে জড়ানো ও তার ওপর মানুষের জটা যুক্ত মাথার চুল দিয়ে গিঠ দিয়ে পেঁচানো একটা লম্বা আকৃতির দুটি থলে দেখতে পাই। চুলের গিঠ এর ওপর গালা দিয়ে আটকানো । গালার ওপরে অস্পষ্ট ত্রিসুলের ছাপ আঁকা। থলির একটির ওপরে সাদা রঙের এক নং ও দ্বিতীয় থলির ওপরে দুই নং লেখা আছে। ওগুলি ভালকরে দেখে ও হাত দিয়ে ধরে বোঝা যাচ্ছিল যে এর ভেতরে কোন পাতার পুঁথি আছে যেটা খুব মূল্যবান অথবা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মায়ের কাছে এই থলের বিষয়ে জানতে চাইলে তিনি বলেন এগুলি নাকি বাবা ঠাকুরদার কাছ থেকে পেয়েছিল। এর বেশি মা কিছুই বলতে পারল না। মা বাবার ওই কাঠের বাক্স টা আমার ঘরেই রাখতে বলেন। অত্যান্ত কৌতূহলবশত ওই দুটি থলির মধ্য থেকে এক নং থলিটি সন্তর্পনে খুলেফেলি। চুলের গিঠটা খোলার সাথে সাথেই অদ্ভূত একটা শিহরণ খেলে যায় সমস্ত শরীরজুড়ে। কালচে লাল রঙের কালি দিয়ে সংষ্কৃত ভাষায় লেখা কিছু শ্লোক। সেই সব শ্লোকের বেশিরভাগ প্রেত তত্ব, শব সাধনা, মৃত ব্যক্তির আত্মা কে দিয়ে কাজ করানো ইত্যাদি নিয়ে লেখা।
পুঁথি টা পড়ে আমার খুব বোকা বোকা মনে হল । লেখাগুলোকে স্রেফ গাঁজাখুরি বলে মনে হচ্ছিল কিন্তু বাবার আলমারী থেকে বের হওয়া এত যত্নে থাকা পুঁথি গাঁজাখুরি হবে???......মেনে নিতেও খুব কষ্ট হচ্ছিল।
মনে মনে ভাবলাম একবার পরীক্ষা করেই দেখা যাক। ওইদিন রাতে ধরে ধরে প্রতিটা পাতা পড়লাম । তের পাতার পুঁথিতে তেরটি ভয়ানক ও অদ্ভুত পদ্ধতি আছে । যার মধ্য একটি আমি অতি সহজেই করতে পারব বলে মনে হল। ওই পদ্ধতি অনুযায়ী যে সমস্ত উপাচার লাগবে তা সবই আমাদের মত যে কোন ব্রাহ্মণ বাড়িতে পাওয়া যাবে, শুধু একটি জিনিস ছাড়া। সেটা হল কোন মৃত ব্যক্তির দেহাংশ। আর আমি একজন ডাক্তারীর ছাত্র হিসেবে অতি সহজেই জোগার করতে পারব ভেবেই মনে মনে ভয়ানকভাবে উত্তেজিত ও রোমাঞ্চিত হলাম। মেডিক্যাল কলেজে এক সিনিয়র দাদাকে একটি বিলিতি মদের বোতলের বিনিময়ে কব্জি থেকে কাটা একটা হাত জোগাড় করতে বিশেষ বেগ পেতে হয়নি। ঠিক পরের শনিবার মধ্য রাতে পুঁথি অনুযায়ী সমস্থ উপাচার জোগাড় করে প্রেত সাধনায় বসে যাই। কাটা হাত সামনে রেখে অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে ঠিক যা যা করতে লেখা ছিল , তাই করে যাচ্ছিলাম। যত সময় গড়াচ্ছিল নিজেকে ততই একটা ঘোরের মধ্যে পাচ্ছিলাম। এক সময় মনে হচ্ছিল অন্য কোন শক্তির দ্বারা চালিত হয়ে চলেছি, নিজের ওপর কোন নিয়ন্ত্রণই নেই। ঠিক কতক্ষন ওভাবে ছিলাম বলতে পারব না। হুস ফিরলো বন্ধ ঘরে কিছু অদৃশ্য অশরীরি র ফিসফিসানিতে। চমকে উঠলাম আমি । নিজেই নিজেকে মনে মনে প্রশ্ন করলাম এরা কারা? চার পাঁচ টা অস্পষ্ট ছায়া মূর্তি আমার আসে পাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। প্রায় সর্বক্ষণ আমায় ঘিরে থাকে ,সমগ্র বাড়ি জুড়ে এরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওঁদের একটাই কথা কথা.. ..."আমাদের জাগলে কেন?....মুক্তি চাই,.....মুক্তি"। এখন একমাত্র এই ঘরটিতেই ওরা বিশেষ কিছু করতে পারে না। পরদিন সকালে পুঁথি অনুযায়ী ওই কাটা হাত টাকে লাল শালু কাপড়ে পেঁচিয়ে বাড়ির উঠানে পুঁতে রাখি। মা ওদের সরাসরি দেখতে পায় না ঠিকই কিন্তু ওদের উপস্থিতি ও অদ্ভুতুড়ে কর্মকান্ডে দিন দিন আরও অসুস্থ হয়ে পড়ছে i সনাতনের মুখ সমস্ত ঘটনা শুনে আমার হাত পা ঠান্ডা হয়ে যায়। এই মুহূর্তে ঠিক কি করা উচিৎ, সেটা বুঝে উঠতে পারছিলাম না। এই অবস্থায় নিজের মানসিক উত্তেজনা যতটা সম্ভব প্রশমিত রেখে ওকে বললাম, ভাই ....দুই নং পুঁথিতে কি লেখা আছে দেখেছিস? সানাতন বলল ...না । আমি ওকে দ্বিতীয় পুঁথির থলিটি বের করতে বলি। সনাতন প্রায় কাঁপতে কাঁপতে খাটের তলা থেকে একটা পুরনো সেগুন কাঠের বাক্স টেনে বের করে তার ভেতর থেকে লাল কাপড় জড়ানো পুঁথি
বের করে আনে। চুলের দড়ির গিঠ খুলে অদ্ভুত ধরণের ধূসর কাল তালপাতার ওপর সাদা কালিতে সংষ্কৃত হরফে শ্লোক লেখা। এই ধরণের জিনিস আমি আগে কখনও দেখেছি বলে মনে পড়ে না। আমি সংস্কৃত পড়তে পারি না। সনাতন কে বললাম ঠান্ডা মাথায় প্রথম থেকে পর আর তার মানেটা বল। সনাতন এক একটা শ্লোক পরে খুব সোজা ভাষায় তার বাখ্যা করতে লাগল। ব্রাহ্মণ হওয়ার সুবাদে সংস্কৃত সে খুব ভাল ভাবেই রপ্ত করেছে।
দ্বিতীয় পুঁথির বিষয়বস্তু প্রথম পুঁথির থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। পড়তে পড়তে সনাতনের চোখ চিক চিক করে উঠলো কয়েকটা সংস্কৃত শ্লোক পড়ার সময়। ওর উচারণেই বেশ বুঝতে পারছিলাম কিছু একটা গুররুত্বপূর্ণ বিষয় সে জানতে পেরেছে। আমি আগ্রহের সাথে জানতে চাইলে সে বলল, প্রেতযোনী জাগরণের ফলে এমন কোন প্রতিকূল সমস্যার সৃষ্ট হয় তাহলে তার থেকে মুক্তি পাওয়ার উপায়।অনেক গুলি পদ্ধতির মধ্যে একটি সরল পদ্ধতিটি হল পুঁথিতে বর্ণিত নিয়ম অনুযায়ী দুটি পুঁথি ও দেহাংশ শ্মশানে দাহ করা।
তাতে জাগ্রত হয়ে যাওয়া আত্মা গুলি মুক্তি পেয়ে যাবে। আমি তৎক্ষণাৎ স্থির করলাম আজ রাতেই পুঁথিদ্বয় ও কাটা হাত শ্মশানে দাহ করার। ওই রাতেই আমরা ইছামতী তীরে এক শ্মশানে নিয়ম অনুযায়ী দাহ করে কোনমতে ওই প্রেতাত্মা গুলির হাত থেকে নিস্কৃতি পাই।
আজ সনাতন কলকাতার এক নামকরা মেডিকেল কলেজের অধ্যক্ষ। সবার অলক্ষে যে ভয়াবহ ঘটনার সন্মুখীন আমরা হয়েছিলাম এতবছর পরেও সেই স্মৃতির রোমন্থন করলে আজও শিরদাঁড়া বেয়ে হিমশীতল স্রোত নেমে আসে।