The Stamp Paper Scam, Real Story by Jayant Tinaikar, on Telgi's takedown & unveiling the scam of ₹30,000 Cr. READ NOW
The Stamp Paper Scam, Real Story by Jayant Tinaikar, on Telgi's takedown & unveiling the scam of ₹30,000 Cr. READ NOW

Chandrima Chatterjee

Tragedy Crime

2  

Chandrima Chatterjee

Tragedy Crime

অভিশপ্ত সুর

অভিশপ্ত সুর

12 mins
334



               ( ১ )



রাহুলের অস্বাভাবিক মৃত্যুতে শুধু St. Augustine, Schools and Hostels for Boys-ই নয় , গোটা নগর আজ শোকস্তব্ধ। রাহুলের বাবা সেখানকার এম.এল.এ হলেও তার ছেলের মৃতদেহের ওপর সাধারণ লোকের হামলে পড়াটাকে তাঁর পুলিশবাহিনী দিয়েও রুখতে পারা যাচ্ছে না। তাঁর সমস্ত অহঙ্কার, সমস্ত দাপট আজ একটা শিথিল মৃতদেহের পাশে কোনো স্পর্ধা দেখাতে সাহস পাচ্ছে না। 



রাহুলের বয়স মাত্র চৌদ্দ। এই চৌদ্দ বছরের কচি একটা ছেলের রহস্যময় মৃত্যুটা কেউই যেন মন থেকে মেনে নিতে পারছে না। স্তব্ধতার মধ্যেও যেন একটু আংশিক কোলাহলের সৃষ্টি হয়েছে। কি ভাবে হল? কেন হল?... ইত্যাদি। যদিও সত্যিটা সবারই অজানা। তবুও যেটুকু জানা যাচ্ছে যে রাহুল সেদিন স্কুল ছুটি হওয়ার পর খেলতে খেলতে স্কুল বিল্ডিংয়ের ছাদে গিয়েছিল। সেখান থেকে পা পিছলে পড়ে যায়। তারপর নার্সিংহোমে নিয়ে যাওয়ার আগেই সব শেষ। 



ছোট্ট রাহুলের পরিবারের সঙ্গে তার বন্ধুরা, স্কুল টিচার, প্রিন্সিপাল স্যার সকলেই সমব্যথিত। আর ওর বেস্ট ফ্রেন্ড অনিষ সিনহা তো তারপর থেকে কোনো কথাই বলছে না। বড্ড চুপচাপ হয়ে গেছে। ঠিক মতো খাবারও খাচ্ছেনা।



প্রিন্সিপাল স্যার অনিষের অবস্থা দেখে ওকে কিছু দিনের জন্য হোস্টেল থেকে ছুটি দিয়ে বাড়িতে পাঠিয়ে দিলেন। বাড়ি যাওয়ার আগের দিন অনিষ অনেক রাতে ঘুম থেকে উঠে চ্যাপেলে গিয়ে বসেছিল। চ্যাপেলে যীশুখ্রীষ্টের মূর্তির নিচেই রাহুলের ছবি রাখা আছে। ওটা এখন একসপ্তাহ রাখার কথা, এটাই স্কুলের নিয়ম। অনিষ রাহুলের ছবির সামনে একটা মোমবাতি জ্বালিয়ে এক দৃষ্টে তাকিয়ে ছিল। এইসময় ফাদার তাকে দেখতে পেয়ে খুব চিন্তিত হয়ে পড়ে অনিষের কাছে যান। দেখেন অনিষ পুরো থম মেরে আছে, কোনো কথা নেই মুখে। ফাদার বুঝতে পারে অনিষের কষ্টটা। ও যে আপনজনকে হারানোর কষ্টটা বোঝে। এইটুকু বয়সেই তো ও নিজের সব থেকে বড় দুটো স্তম্ভকে হারিয়েছে। এরপরও কি এটা ওর প্রাপ্য ছিল? ''হে ঈশ্বর!"



এদিকে রাহুলের বাবা এটা কিছুতেই মেনে নিতে পারছেন না যে রাহুলের মৃত্যুটা একটা এক্সিডেন্ট মাত্র। এদিকে তাঁর সমাজে একটা প্রতিপত্তি আছে তাই পুলিশের চক্করে পরে শুধু শুধু মিডিয়ার ঝামেলায় পড়তে চান না মিস্টার অজয় কুমার। তাই তিনি ভাবলেন যে এইসময় কোনো একজন প্রাইভেট ডিটেক্টিভ পেলে ভালো হতো। কিন্তু যাকেই যোগাযোগ করছেন পুরো ঘটনাটা শুনে সেই বলছে এটা এক্সিডেন্ট। তবুও মিস্টার কুমার কিছুতেই নিশ্চিন্ত হতে পারলেন না। যতক্ষন না তিনি নিশ্চিত প্রমান পাচ্ছেন, ততক্ষণ তিনি তদন্তের জন্য একজন উপযুক্ত কাউকে খুঁজে যেতে লাগলেন।



অনিষ পরের দিন ভোরবেলা দুটো স্যুটকেস নিয়ে বাড়ি চলে গেল। ওর বাড়ি শহরের থেকে একটু ভেতর দিকে। পৌঁছতে পৌঁছতে বেলা হয়ে গেল। ওর বাড়িতে দাদু, দিদা আর জনি ছাড়া কেউ থাকে না। জনি ওদের বাড়ির পোষা এলসিসিয়ান এবং খুব বাধ্য। ওই তো বলতে গেলে অনিষের অনুপস্থিতিতে বাড়ির হর্তা-কর্তা। তবে ওকে খাওয়ানোর-বেড়ানোর জন্য একটা কুড়ি বছর বয়েসি যুবতীকে নিয়োগ করা হয়েছে। অনিষের সাড়ে পাঁচ বছর বয়সে ওদের বাড়িতে তাকে আনা হয় কাজের লোক হিসেবে। তারপর থেকে এখানেই থাকে, মাঝে মাঝে নিজের মায়ের কাছে যায়। নাম চামেলি। দাদু ও দিদা দুজনেই খুব ভালোবাসে ওকে। 



অনিষের দাদু, দিদা দুজনেরই বয়স হয়েছে। দুজনেই খুব অসুস্থ। অনিষের দাদুর কিছুদিন আগে চোখে অপারেশন হয়েছিল। এখনও ঠিক মতো দেখতে পারছে না। এটা অনিষ জানে না, কারণ ও সেইসময় হোস্টেলেই ছিল। আর হোস্টেলের নিয়ম অনুযায়ী কোনো রকম ইলেক্ট্রনিক জিনিস ব্যবহার করার অনুমতি দেওয়া হয় না। বাড়ির সঙ্গে যোগাযোগ করতে হলে হোস্টেলের টেলিফোন ব্যবহার করতে হয়। অনিষ এর মধ্যে আর বাড়িতে ফোন করেনি। তাই ও জানে না।



রাহুলের মৃত্যুর পর অনিষ শুধু মাত্র চুপচাপই হয়ে যায়নি ও নিজেকে সবার থেকে গুটিয়ে নিয়েছে। দিদারও অসুখের তালিকা বেশ লম্বা-চওড়া, সুগার, প্রেসার কিছুই বাদ নেই। হাঁটুর ব্যথাতে দিদা দোতলায় উঠতে পারে না। নিচেই থাকে সারাদিন। দাদুও তাই। অনিষের শোয়ার ঘরটা দোতলায় ডানদিকে। বাঁদিকে ওর বাবা-মার ঘর। এখন অবশ্য তালা দেওয়া পরে থাকে দোতলাটা। অনিষ এলে ওর ঘরটা খোলা হয়। সদস্যের অভাবে বাড়িটা কেমন ভুতুড়ে বাড়ি হয়ে গেছে। সন্ধ্যের দিকে সামনে দিয়ে যেতে গা ছমছম করে। তাও এখন জনিটা আছে মাঝেমধ্যে একটু বুনো বেড়াল দেখলে ঘেউ ঘেউ করে। ওর জন্যই বাড়িটায় এখনো একটু প্রানের আশা করা যায়। আজকাল চামেলিটাও কেমন হয়ে গেছে। মাসে দু-তিন বার করে বাড়ি চলে যায়। তখন কয়েকটা বাড়ি পরে থাকে কেশব নামে একটি মাঝবয়সী ছেলে, ওই একটু এদের খেতে দেওয়া, জনি কে দেখা এইসব টুকটাক করে দিয়ে যায়। অনিষের দাদু তার জন্য এক সময় কম করেনি এখনো এলে মিষ্টি খেতে টাকা দেয়। কিন্তু কেশব চামেলি না থাকলে এদিকে আসতে চায় না। জনি আবার কেশবকে খুব একটা পছন্দ করে না। ও জনিকে খুব খ্যাপায়। কিন্তু জনিই বা কি করে, ওকেও তো খেয়ে পড়ে বাঁচতে হবে তাই সব মুখ বুজে সহ্য করে নেয়।



সকালে অনিষকে চামেলি এসে দুধ-কর্ণফ্লেক্স দিয়ে গেছে বেলার দিকে কিন্তু তখন অনিষ খায় নি। কর্ণফ্লেক্স যেমন ছিল তেমনই টেবিলে পরে আছে। চামেলি এখন আর অনিষের সঙ্গে বেশি কথা বলে না। ছোটবেলায় ওরা দুজন অনিষের মায়ের কাছে একসঙ্গে পড়তে বসত। তাই চামেলি দুপুর বেলা অনিষের ঘরে এসে জিগেস করলো " কি গো খোকা বাবু খাবে না কনফ্লাক্সটা?"......"না তুমি নিয়ে যাও"  "দাদু খেয়েছে কিনা জিগেস করলে কি বলবো".... অনিষ গম্ভীর ভাবে বললো "বলবে খেয়ে নিয়েছে" "আর যদি বলে......" " আঃ বলছি না, বলবে খেয়ে নিয়েছি।"

চামেলি মুখ বেঁকিয়ে চলে গেল।



 বিকেল বেলা অনিষ জনিকে নিয়ে ঘুরতে বেরোলো পনেরো মিনিট বাদে আবার ফিরে চলে এলো। কিন্তু এসেই খুব হাঁপাতে লাগলো। সাথে জনিও নেই। দিদা সামনের ব্যালকনিতে বসে বই পড়ছিল। সঙ্গে সঙ্গে অনিষের কাছে গিয়ে ওকে একটা বেতের চেয়ারে বসালো। "কি হয়েছে অনি, এরকম করছো কেন? শরীর খারাপ লাগছে? জনি কোথায় গেল ? জনি কে দেখছি না তো? তুমি তো জনি কে নিয়ে বেরোলে?" অনিষ হাঁপাতে হাঁপাতে এক গ্লাস জল চাইলো। দিদা জল দিতে না দিতেই সেটাকে অনিষ এক ঢোকে খেয়ে কোনো কথা না বলে, এক দৌড়ে ওপরের ঘরে গিয়ে দরজা দিয়ে দিল।"



তারপর সারাটা সন্ধ্যে অনিষ দোতলার ঘরেই ছিল। জনিকে পরে কেশব নিয়ে এলো। দিদা কেশবকে কিছু জিজ্ঞেস করবার আগেই জনিকে সে ব্যালকনির একটা রেলিংয়ের সঙ্গে বেঁধে দিদা কে বললো...."আজ তুম লোগো কা জনি খো যাতা ।" ....ছোটে সাহাব তো জনি কো রাসতে মে ছোড় কে ভাগ গয়া।" "অব দাদু কো বোলো মিঠাই খানে কা পয়সা দেনে কে লিয়ে"..... দিদা একবার কেশবের দিকে তাকালো তারপর ঘরের ভিতর চলে গেল। মুখে দুঃশ্চিন্তার ছাপ। সব কিছু দেখে শুনে কেশবের মুখ থেকে একটাই কথা বেরোলো......কেশব বলে উঠলো "আজিব হে!" কেশব ছেলেটি নেপালি তাই ভালো বাংলা বলতে পারে না। বেশির ভাগ কথা হিন্দিতেই বলে। 



এদিকে ছেলের খুনের মীমাংসা না করতে পারা অবধি মিস্টার কুমার দু চোখের পাতা এক করতে পারছে না। সোশ্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে কোনো প্রাইভেট ডিটেক্টিভের খোঁজ পেলেই ডেকে পাঠাবে তার বাংলোতে। ইতিমধ্যে একটা প্রোফাইল দেখে খুব ভালো লেগেছে। একটা মেল ও পাঠিয়েছে এই প্রোফাইলে। এখন রিপ্লাই আশা করা ছাড়া কোনো উপায় নেই।



সেদিন রাতে অনিষ তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়েছিল। হঠাৎ একটা অদ্ভুত শব্দে ওর ঘুম ভেঙে যায় জানলা দিয়ে ঘন কুয়াশা ভেদ করে একটা হালকা ছায়ামূর্তি ওর নজরে পড়ে। শব্দটা শুনলে অনিষ খুব অস্বস্তি বোধ করছিল। এদিকে শব্দের প্রখরতা আরো বাড়তে লাগলো। অনিষ আর নিতে পারছে না। শরীর যেন কেমন করছে। এবার অনিষ আর সহ্য করতে না পেরে এক ছুটে বাড়ির বাইরে লনের দিকে চলে গেল। জনি আওয়াজ শুনে আবার ঘেউ ঘেউ করতে লাগলো, কিছুক্ষণ পরে দূর থেকে একটা অস্পষ্ট চিৎকার শোনা গেল ।.....আ........ আ....। কিন্তু জনির ডাকে সেটা খুব তাড়াতাড়ি বিলীন হয়ে গেল।


ভোর হতে না হতেই চারিদিকের কোলাহলে দিদার ঘুম ভেঙে গেল। দেখে দাদু জনির বেল্ট টা ধরে বসে আছে আর চামেলি চামেলি বলে চিৎকার করছে। দিদা বলছে ..."চামেলি কোথায়, যে তুমি চামেলি চামেলি বলে চিৎকার করছো"....."কি হয়েছে বাইরে এত চেঁচামেচি কিসের?" ...... এসব কথা চলার সময় ষণ্ডা মার্কা চেহারা, পরনে পুলিশের উর্দি, এক ভদ্রলোক এলেন। বললেন "আমি একবার আপনাদের ঘরটা সার্চ করবো"... দাদু হন্তদন্ত হয়ে বললেন "কেন অফিসার?" "কাল রাত্রে আপনাদের কাজের মেয়েটা কি যেন নাম.... সে খুন হয়েছে।" দাদু চমকে গিয়ে বললেন..."ওয়াট??"

"কি বলছেন"...অফিসার -"আচ্ছা বাড়িটা একবার সার্চ করতে হবে।" "আপনাদের বাড়িতে কে কে থাকেন?" 



এসব কথা বার্তা চলতে চলতেই অনিষ নীচে ওর ব্যাগ পত্র নিয়ে রেডি। আজ ওর ছুটি শেষ। আজ হোস্টেলে ফিরে যেতে হবে। যদিও ফাদার বলেছিল আরো কিছুদিন চাইলে থাকতে পারত কিন্তু ওর আর এখানে ভালো লাগছে না। অনিষের মন এখনো ঠিক হয় নি ওটা ওর মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে। তাই আজ স্কুলের ফাদার ও মিউজিক স্যার নিজে আনতে আসবে। এমনিতে অনিষের স্কুলে ওর খুব নাম ডাক আছে। এবারে ক্লাস প্রমোশনের পরীক্ষায় অনিষ প্রথম ও রাহুল দ্বিতীয় হয়েছিল। স্কুলের প্রতিটি স্যার ও ম্যাডাম ওকে ভালোবাসে। ইদানিং রাহুল এর ব্যবহারে বদল এসেছিল। কে যেন ওর মধ্যে হিংসার বীজ পুঁতে দিয়েছিল। অনিষ স্কুলে না গেলে ওকে পড়া দেখাতো না, কারুর সঙ্গে টিফিন শেয়ার করতে না, আর বন্ধুদের সাথে খুবই খারাপ ব্যবহার করত। অনিষ কিন্তু তাও রাহুলকে ক্ষমা করে কাছে টেনে নিত।


পুলিশ তার দুই কনস্টেবলকে নিয়ে ওপরের ঘর গুলো সার্চ করতে গেল। আর অনিষ ফাদারের সাথে চলে গেল। যাওয়ার আগে জনির মাথায় গায়ে হাত বুলিয়ে বিদায় নিল। জনি জিভটা বের করে লেজ নাড়াতে নাড়াতে ঘরের ভিতর চলে গেল।


               ( ২ )


পরদিন থেকে স্কুলে আবার ক্লাস শুরু হয়ে গেল। ক্লাসে গিয়ে অনিষ জানতে পারলো আজ থেকে নতুন টিচার সাইকোলজি এবং মিউজিক নেবে। আগের স্যার প্রমোশন পেয়ে টিচার ইনচার্জ হয়েছে, তাই। 



টিফিন ব্রেকের পর মিউজিক ক্লাস। মিউজিক ক্লাসটা স্কুলের বিল্ডিংয়ের চারতলায় একটা বিশাল হল ঘরে হয়। সেখানে ব্রেকের পর সব ছেলেরা গিয়ে উপস্হিত হলো। সবার মধ্যে তাদের নতুন টিচারের সঙ্গে আলাপ করার জন্য কৌতুহলের শেষ নেই। কিছুক্ষন বাদে একজন সুশ্রী নারীমূর্তি এসে দাড়ালো টিচার ডেস্কের সামনে। সবাই উঠে দাঁড়িয়ে তাকে গুড আফটারনুন বলে আহ্বান জানালো। "গুড আফটারনুন। প্লিজ সিট ডাউন।" ....এই বলে নিজের পরিচিতি দিতে শুরু করলেন। " দিস ইজ ইউর নিউ মিউজিক টিচার....মিসেস কুহেলি মিত্র"....."টুডে ইজ মাই ফার্স্ট ডে সো টুডে আই লাইক টু অর্গানাইজ এন ইন্ট্রোডাক্টরি ক্লাস.....ফ্রম নেক্সট ডে আই উইল ডেফিনিটেলি টিচ ইউ সাম ইন্টারেস্টিং ইন্সট্রুমেন্ট টু প্লে....."। এই বলে সবাইকে এক এক করে নিজেদের সম্পর্কে দু-লাইন বলতে বলল।...



সপ্তাহের শেষ দিন আবার ওদের মিউজিক ক্লাস ছিল। 

কুহেলি মিত্র ছাত্রদের সঙ্গে বন্ধুর মতো মিশলেও নিয়মানুবর্তিতাকে সমান ভাবে মর্যাদা দিতে জানে। আর চোখে মুখে ছিল মিষ্টি গাম্ভীর্যের ভাব। সেদিন ভায়োলিনের ক্লাস হলো। অনিষের মিউজিক সাবজেক্টটাতে বিশেষ আগ্রহ নেই। তাও করতে হয় করে। এরপর থেকে নাকি প্রতি ক্লাসে একটা একটা করে ইন্সট্রুমেন্ট শেখানো হবে আর শেষের পনেরো মিনিট করে গান হবে। এই ভাবে শিডিউলটাকে সাজালো কুহেলি। এর পর দিন ফ্লুট অর্থাৎ বাঁশি বাজানোর ক্লাস হবে। তাই সকলে যেন সময় মতো ক্লাসে এসে যায় এই ঘোষণা করা হলো।



অনিষ বাইরে এসে ওর বন্ধু সাগরকে বললো - "আমার এই মিউজিক ক্লাস করতে ভালো লাগে না । আর ম্যাম টাও বলিহারি। আবার বাঁশি শেখাতে যাওয়ার কি আছে.... আমি পরের দিন এবসেন্ট করবো দেখিস।" 



সাগর বললো-"সে তুই যাই বলিস, ম্যাম কে আমার হেব্বি লাগে। আমি তো বাবা ওনার একটাও ক্লাস মিস করতে চাই না।"



এদিকে চামেলির পোস্টমর্টেম রিপোর্টে বেরিয়েছে যে চামেলিকে পেছন দিক থেকে কাঁচের জিনিস দিয়ে মাথায় আঘাত করা হয়েছে। পুলিশ সকলকে জিজ্ঞাসাবাদ করে কেশবকে থানায় ধরে নিয়ে গেছে, কারণ চামেলি খুন হওয়ার দিন সন্ধ্যেবেলায় কেশব চামেলিকে নিয়ে সামনের একটা মাঠে মেলা দেখতে গিয়েছিল। কিন্তু কেশব বারবার বলছে যে সে চামেলিকে সাড়ে নয়টা নাগাদ ওর বাড়ির কাছে ছেড়ে দিয়ে সেখান থেকে শিলিগুড়ি চলে আসে। তাই চামেলির সঙ্গে ওর আর দেখা হয়নি । মেলা থেকে সেদিন চামেলিকে ও কিছু জিনিসও কিনে দেয় যেমন চিরুনি, মাথার ক্লিপ, একটা ঘড়ি ও একটা কাঠের বাঁশি। 



দু-তিন পর কেশবকে পুলিশ ছেড়ে দেয়, অপর্যাপ্ত প্রমানের অভাবে। এদিকে দাদু দিদা ও জনিকে নিয়ে বড্ডো একা পড়ে গেছে। কেশবও আজকাল ওদের বাড়িতে আসা কমিয়ে দিয়েছে। ওই মাঝেমধ্যে এসে একটু জনির সাথে খেলা করে যায়।



পরের দিন মিউজিক ক্লাস অনিষ সত্যিই কামাই করলো। সেদিন ও স্কুল যায়নি হোস্টেলেই ছিল। তার পরের দিন অনিষদের ফার্স্ট পিরিয়ডটা সাইকোলজির ক্লাস। মিউজিকের মতো এই ক্লাসটাও ওই কুহেলি মিত্রই নেবে।সেদিনও অনিষের শরীরটা ভালো ছিলো না। সকাল থেকেই মাথা ঝিমঝিম করছিল। সাইকোলজিতে ওর সিলেবাস অনুযায়ী আজ পাঁচ নম্বর চ্যাপ্টারতা পড়ানো হবে। আজকের টপিক মিসোফনিয়া। অথাৎ সাউন্ড ফোবিয়া বা শব্দ আতঙ্ক। কোনো নির্দিষ্ট শব্দ থেকে আতঙ্কিত হওয়া। মিসেস মিত্র খুব ভালো ভাবে বোর্ডে চার্ট এঁকে বোঝাতে লাগলেন। ক্লাসের তখন আর পাঁচ মিনিট বাকি হঠাৎ অনিষ উঠে দাঁড়িয়ে বলল-" এক্সকিউস মি ম্যাম, মে আই.....বলে ছুটে বাথরুমের দিকে চলে গেল। ক্লাসরুমটা টয়লেটের কাছাকাছিই ছিল তাই মনে হলে কে যেন বমি করছে.....অনিষই হবে হয়তো।



সারাদিন অনিষ সিক রুমে রেস্ট নিচ্ছিল। ছুটির পর অনিষ একবার ওর ক্লাসরুমের দিকে গেল ওর ব্যাগ আর বইখাতা ওখানেই পড়েছিল সম্ভবত সেটাই নিতে।


অনিষের শরীরটা এমনি ভালো ছিলো না। আজ খুব ক্লান্ত সে, চোখ-মুখ বসে গেছে। হঠাৎ ব্যাগটা কাঁধে নেবে এমন সময় তার কানে গেল সেই বাঁশির আওয়াজ। বাঁশির আওয়াজটা ক্রমশ তীব্র হতে থাকে। অনিষ দুটো কান তার হাত দিয়ে চেপে ধরলো। তাও সেই শব্দ ওর কানে আসছে। কে যেন ইচ্ছে করে ওকে শোনাবে বলে এগিয়ে আসছে ক্লাসরুমের দিকে । অনিষ ঠিক মতো চেয়ে থাকতে পারছে না। সব যেন আবছা। অনিষ এক ছুটে ডেস্কের ওপর থেকে ডাস্টার নিয়ে তাক করলো যে বাঁশিটা বাজাচ্ছিলো তার দিকে। 



                                ( ৩ )


হঠাৎ শব্দটা বন্ধ হলো। ডাস্টারটা এক ইঞ্চি দূর দিয়ে কুহেলির চোখের সামনে দিয়ে বেরিয়ে গেছে। কুহেলি সঙ্গে সঙ্গে এসে ক্লাসরুমের দরজাটা বন্ধ করে দিলো। এবার অনিষ কে বসে জিজ্ঞাসা বাদ করতে শুরু করলো।

"অনিষ ঠিক করে বলো কে খুন করেছে চামেলিকে?

অনিষ -"একি ম্যাম আপনি... এসব কি বলছেন আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না।"

কুহেলি বলতে লাগলো-" আমি এখন তোমার ম্যাম নই। এখন স্কুল আওয়ার শেষ হয়ে গেছে আর আমি এখন অন ডিউটি।"

অনিষ-"মানে?"

"মানে তুমি ধরা পড়ে গেছো অনিষ সিনহা।" এই বলে ব্যাগ থেকে নিজের আইডি কার্ডটা দেখালো। তাতে স্পষ্ট করে লেখা প্রাইভেট ডিটেক্টিভএন্ড সাইক্রিয়াটিস্ট কাম কাউনসিলর ডঃ কুহেলি মিত্র।

"আমাকে রাহুলের বাবা মিস্টার কুমার এপয়েন্ট করেছে। রাহুলকেও তো তুমি......"

এবার অনিষ কেঁদে ফেললো-" আমি জানি আমি ভুল করেছি। কিন্তু আমি এটা করতে চাইনি বিশ্বাস করুন।"

কুহেলি -"আমি জানি অনিষ তুমিও মিসোফনিয়ার শিকার।" " যদিও তোমার ওপর আমার সেদিনই সন্দেহ হয়ে ছিল যেদিন আমি রাহুলের কেসটা ইনভেস্টিগেট করার সময় ক্রাইম স্পটে একটা ভাঙা কাঠের বাঁশি দেখেছিলাম। আর সেই রকমই একটা বাঁশি আমি চামেলির খুন হওয়ার জায়গা থেকেও উদ্ধার করেছিলাম। আমি আরো কনফার্ম হলাম যেদিন আমার কেশবের সঙ্গে পুলিশ কাস্টডিতে আলাদা করে কথা হলো। কেশব আমায় তোমার জনিকে নিয়ে বেড়াতে যাওয়ার অভিজ্ঞতার কথা বললো। ও সেদিন লক্ষ করেছিল তোমার এই ব্যাপারটা। কেশব কে চামেলি বাঁশি বাজানো সেখাচ্ছিলো আর সেটাই তুমি না সহ্য করতে পেরে জনিকে ফেলে রেখে চলে এসেছিলে তাই তো? এবার চটপট ঘটনাটা বলো তো। এসব কি করে হলো?"



"অন্যান্যবার আমি সেকেন্ড হই আর রাহুল ফার্স্ট। এবছরে রাহুল সেকেন্ড হয়ে গেছে। আর আমি ফার্স্ট হই। তারপর থেকে রাহুল বদলে গেছিলো আর আমাকে ওর শত্রু ভাবতে শুরু করে দিয়েছিল। রাহুল কি করে জানি জানতে পেরে যায় আমার এই রোগের কথা। তাই ও সেদিন এরকম ছুটির পর আমাকে একটা বাঁশি নিয়ে এসে ইরিটেট করে। আমি বাঁশিটা ওর হাত থেকে ছিনিয়ে নিতে যাই আর ও তখনই ছাদে উঠে যায়। আমরা ছুটতে ছুটতে ছাদের কার্নিশের কাছাকাছি চলে যাই। সেখানে রাহুল আবার বাঁশি নিয়ে বিভিন্নরকমভাবে ভ্যাঙাতে থাকে। ওকে হাতের নাগালে পেয়ে বাঁশিটা ধরে টান মারি আর ওর হাত থেকে বাঁশিটা আমার হাতে চলে আসে আর রাহুল টাল সামলাতে না পেরে নীচে পরে যায়।"



কুহেলি-"কিন্তু আমি যতদূর জানি রাহুল তো বাঁশি বাজাতে পারতো না?"  

অনিষ-"না। কিন্তু ও আমাকে ভয় দেখাতো আর বলতো সবাইকে আমার ব্যাপারটা বলে দেবে।...."

 "আর চামেলি, সে কি ক্ষতি করেছিল"



"সেদিন অন্ধকারে যে চামেলি বসে ফ্লুট বাজছিল সেটা আমি বুঝতে পারিনি তাই ওটা থামানোর জন্য আমি হাতের জল খাওয়ার গ্লাস টা দিয়েই .....।

এই বলে কান্নায় লুটিয়ে পড়লো অনিষ।



তিন দিন পর কোর্টে উঠলো কেসটা। অনিষ লজ্জায় কাউকে মুখ দেখাতে পারছেনা। এই সময় কুহেলি ওর সাথে ছিল। বিচারক সবটা শুনে ধর্মসংকটে পরে গিয়েছিলেন। কিন্তু হয়তো একেই বলে খারাপের মধ্যে ভালো। কুহেলি শুনানির আগে বিচারকের কাছে একটা প্রস্তাব দিয়ে বসলো। 

"ইউর অনার। আমি জানি যদিও ছেলেটি যা করেছে তা একেবারেই ক্ষমার যোগ্য নয় কিন্তু তাও আমি বলছি ওকে হোমে পাঠিয়ে কোনো লাভ নেই। ওর যে রোগটা রয়েছে সেটার জন্য আমার মনে হয় ওর মিউজিক থেরাপির প্রয়োজন আছে আর এর ফলে ও সম্পূর্ণ স্বাভাবিক হয়ে উঠতে পারে। যদি বলেন তো আমি ওর দায়িত্ব নিয়ে ওকে মিউজিক থেরাপিস্টের কাছে নিয়ে যেতে পারি।"



কুহেলির প্রস্তাব শুনে পুরো কোর্টরুম এক মিনিটের জন্য স্তব্ধ হয়ে গেল। আর অনিষের মুখের গ্লানি এক ঝটকায় একটা নিষ্পাপ ফুলের মতো হাসিতে পরিবর্তিত হয়ে গেল।।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy