Partha Pratim Guha Neogy

Thriller

4  

Partha Pratim Guha Neogy

Thriller

অবগুন্ঠিত বাস্তব

অবগুন্ঠিত বাস্তব

7 mins
642


বিকেল থেকেই পরিবেশ ভীষণ থমথমে, চারিদিক কিরকম একটা দমবন্ধ করা মনে হচ্ছে। আসলে এরকম দুর্ঘটনা এই প্রথম। এর মধ্যে আবার আবহাওয়াটা আরো খারাপ হয়ে গেল, ঘন ঘন আকাশে বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। চারদিকে শোঁ-শোঁ শব্দে ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। এ বাতাস আমাদের সবারই খুব পরিচিত, বৃষ্টির পূর্ব মুহূর্তের বাতাস। মথুর মিত্র অফিস রুমে বসে আছেন। খোলা জানলা দিয়ে বাতাস ঢুকে পুরো রুমটা ঠাণ্ডা হয়ে গেছে। মথুর মিত্র চেয়ার থেকে উঠে ফ্যানের সুইচটা বন্ধ করে দিয়ে জানলার পাশে দাঁড়িয়ে রইলেন। বাইরে বৃষ্টি শুরু হয়েছে। ফোটা ফোটা বৃষ্টি হচ্ছে। বৃষ্টির তুলনায় মেঘের গর্জন বেশি।


এলোমেলো বাতাসের সাথে বৃষ্টিও বাড়তে শুরু করল। বাতাসের সাথে অফিসের সামনের বড় আম গাছটি থেকে আম ঝরে পড়ছে। । সন্দীপ সেগুলো কুড়িয়ে এনে টিচার্স রুমের সামনে একটা বালতিতে রাখছে। সন্দীপ এ স্কুলের অবৈতনিক কর্মচারী। আংশিক ভুল বললাম, সে এখানে সম্পূর্ণ অবৈতনিক কর্মচারী নয়, মাস শেষে স্কুলের সব শিক্ষকের পক্ষ থেকে সামান্য কিছু পরিমাণ পারিশ্রমিক পায়। সেটা নিয়েই সে খুশি। তার কাজ শুধু ঘণ্টা বাজানো। প্রত্যেক ক্লাসের শেষে সে ঘণ্টা বাজায়। এর বাইরেও তার একটা কাজ আছে, সেটা হচ্ছে সময়ে -অসময়ে মথুর স্যারের জন্য চা নিয়ে যাওয়া।


মথুর স্যার জানলার ফাঁক দিয়ে সন্দীপকে চোখের ইশারায় ডাকলেন। এ ইশারা গত কয়েকবছর আগে থেকেই সে খুব ভালো করে বুঝে নিয়েছে। সে স্যারের জন্য চা নিয়ে এলো, সাথে একটা খামও নিয়ে এলো। খামের উপর দশম শ্রেণির সবার পক্ষ থেকে কয়েকজন ছাত্রছাত্রীর নাম। সন্দীপের মুখে চিন্তার ভাব। সে খামটি স্যারের টেবিলে রেখে বের হয়ে গেলো। স্যার খাম থেকে কাগজটা বের করে পড়তে শুরু করলেন। শুরুতে তিনি ভ্রু কুচকালেন। কিন্তু পুরোটা পড়ে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে কাগজসহ খামটি একটি ফাইলে রেখে দিলেন।


ক্লাসের বাকি তিন মিনিট। তিনি তাই রুম থেকে বের হয়ে ক্লাসের দিকে গেলেন। ক্লাসে মাত্র পাঁচজন ছাত্র এক কোণে বসে গল্প করছে। বাকিরা কোথায় গেলো সেটা খামের ভিতর লেখা আছে। স্যারকে দেখে ক্লাসে থাকা পাঁচজন নিজেদের আলোচনা থামিয়ে দাঁড়িয়ে গেলো। রবি, মৃনাল , রাজু প্রথম টেবিলে এসে বসলো। রথীন , আনন্দ দুই টেবিল পিছনে বসলো। স্যার কোনও কথা বলছেন না, ছাত্ররাও কোনও কথা বলছে না। মনে হচ্ছে নীরব থাকার প্রতিযোগিতা চলছে। প্রায় আট মিনিটের মাথায় স্যার প্রতিযোগিতা থেকে বের হয়ে গেলেন। ছাত্রদের জিগ্যেস করলেন, "তোমাদের ক্লাসের বাকিরা কোথায় গেছে তোমরা জানো?"


রবি বলল "হ্যাঁ,স্যার।"


"তোমরা কেন যাওনি ?"


সবাই একসাথে বলল, "স্যার আমাদের যাওয়ার ইচ্ছে ছিল না।"


যাওয়ার ইচ্ছে যে তাদের ছিল না সেটা পুরোপুরি মিথ্যা। তারাও বাকিদের সাথে স্কুল বয়কট করে প্রতিবাদী মানব-বন্ধনে অংশ নিতে চেয়েছে। কিন্তু ক্লাস টপার রূপম , এ পাঁচজনকে তাদের সাথে অংশ নিতে দেয়নি। কারণটা অবশ্য খুব যুক্তিসংগত। স্কুলে খারাপ ছেলেদের তালিকায় এ পাঁচজনের নাম শীর্ষে আছে। কিন্তু কেন যে তারা পাঁচজন সবার চোখে এত খারাপ সেটা তারা বুঝে উড়তে পারে না। ক্লাস টপার রূপম এবং ক্লাস ক্যাপ্টেন জয়ন্ত সবার সামনে ঘোষণা দিয়েছিলো, "আমরা অপরাধের বিপক্ষে দাঁড়িয়েছি, কাজেই আমাদের সাথে কোনও অপরাধী থাকতে পারে না।"


স্যার রাজুকে কাছে ডেকে বললেন, "তোমারও বসে না থেকে নিজেদের মতো চেষ্টা করে কিছু একটা কর।"


রাজু কোনও কথা না বলে মাথা নেড়ে সম্মতি দিল। স্যারের হয়তো আরও অনেক কিছু বলার ছিল, কিন্তু বলতে পারেনি। ক্লাস থেকে বের হয়ে তিনি টিচার্স রুমে গেলেন। কেউ মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে, কেউ গালে হাত দিয়ে বসে আছে। ধর্মের শিক্ষক ফজলুল উদ্দিন স্কুলের সবচেয়ে প্রবীণ শিক্ষক। গত আটাশ বছর ধরে এ স্কুলে শিক্ষকতা করছেন। তার কষ্টটা তাই সবার থেকে একটু বেশি, চশমার ফাঁক দিয়ে গড়িয়ে পড়া চোখের জল মুছে যাচ্ছেন অবিরত। বাইরে পুলিশের গাড়ি দেখা যাচ্ছে, কয়েকজন পুলিশ নেমে মথুর স্যারের রুমে ঢুকল। তার আগে অবশ্য দুজন সাংবাদিকও স্যারের রুমে ঢুকেছে। আলোচনা পর্যালোচনা শেষে ঘটনার সত্যতা উদ্ঘাটন জন্য একটা তদন্ত কমিটি গঠন করা হল। আন্দোলনরত ছাত্রদের সামনে এসে জেলা প্রশাসক সবাইকে শান্ত হওয়ার আহ্বান জানান। তিনি সবার উদ্দেশ্যে বললেন, "আমরা ইতিমধ্যে একটা তদন্ত কমিটি গঠন করেছি, কেউ আইনের হাত থেকে বাঁচতে পারবে না। তোমরা সবাই নিজের ঘরে ফিরে যাও।"


জেলা প্রশাসকের এসব পরিচিত কথায় ছাত্ররা সন্তুষ্ট হলো না। তারা আন্দোলন আরও কঠোর করার হুমকি দিল। শুরুটা জোরালো ভাবে হলেও শেষ পর্যন্ত তারা আন্দোলন চালিয়ে যেতে পারলো না। বিকেলের দিকে পুলিশের কয়েকটা রাবার বুলেটের শব্দ শোনার পর আর কোনও আন্দোলনকারীকে খুঁজে পাওয়া যায়নি।


সন্ধ্যার সময় রাজু আর রথীন টং দোকানে বসে চা খাচ্ছে। তাদের মধ্যে কেমন যেন একটা অস্থিরতা কাজ করছে। রথীন রাজুর কানের কাছে মুখ এনে বলল,"আমাদের কিছু করতে হবে..."


রাজু তার কথায় সম্মতি জানালো। রবি , মৃনাল , আনন্দকে কল করে নিয়ে আসলো। স্কুলের পাশে একটা বহুতল ভবনের কাজ চলছে। তারা পাঁচজন মিলে সে ভবনের ছাদে একটা গোপন মিটিং করলো। মিটিং-এ সিদ্ধান্ত হল, তারা গতকালের ঘটনার সিসি-টিভি ফুটেজ উদ্ধার করবে। স্কুলে একটা মাত্র সিসি ক্যামেরা, সেটা অফিস বিল্ডিংয়ের সামনে লাগানো। কে অফিসে ঢুকল, কে বের হল, শুধু সেটা দেখা যায়। এটা দিয়ে পুরো সত্য জানা যাবেনা, কিন্তু মোটামুটি একটা ধারণা পাওয়া যাবে। গতকালের ঘটনায় কে কে জড়িত সেটা জানা যাবে।


অদিতির মায়ের বর্ণনা মতে বিকাল চারটা ত্রিশ মিনিটে তার মোবাইলে একটা অপরিচিত নাম্বার থেকে কল আসে। অদিতির মা পরিচয় জানতে চাইলে লোকটি বলে, "আমি অদিতির স্কুলের অফিস থেকে বলছি, অদিতিকে শীঘ্রই স্কুলে আসতে হবে। তার এসএসসির প্রবেশপত্রে কিছুটা ভুল হয়েছ..." এ কথা বলে লোকটা ফোন রেখে দিল। অদিতির মা তাকে বিষয়টি জানালে সে কয়েক মিনিট পরই স্কুলের দিকে রওয়ানা হয়ে যায়। তার বাসা থেকে স্কুলে আসতে বারো-তেরো মিনিট সময় লাগে। সে হিসেবে বিকাল পাঁচটার কাছাকাছি সময়ে সে স্কুলে পৌঁছানোর কথা। সন্ধ্যায় অদিতিদের কাছের ইলেকট্রিক শ্মশানে তার লাশ সৎকার করা হয়। অন্যদের পাশাপাশি এই পাঁচ সহপাঠিও অদিতির লাশ সৎকার করে ফিরছে। তাদের চোখে জল, মুখে ঘৃণার আগুন। পাঁচজন মিলে ঠিক করলো তারা অদিতির ধর্ষককে খুঁজে চিহ্নিত করে নিজেরাই শাস্তি দিবে। তাদের ধারণা প্রশাসনের গঠিত তদন্ত কমিটির কাজ শুরু হতে-হতে অন্য কোনও মেয়ে এ ধর্ষকের শিকারে পরিণত হবে।


রাত এগারোটার দিকে তারা স্কুলের দেয়াল টপকে স্কুলে ঢুকল। টিম-লিডার রথীন তাদের পরিকল্পনা শেষবারের জন্য সবাইকে বলে দিচ্ছে, "প্রথমে আমরা অফিসের পিছনের দিক দিয়ে একতলার ছাদে উঠবো। সেখান থেকে দ্বিতীয় তলার ছাদে। তারপর অফিস রুমে ডুকে সিসি-টিভি ফুটেজ বের করবো।"


অফিস বিল্ডিংটা একপাশে একতলা, অন্যপাশে দুইতলা। পরিকল্পনা মতো সবাই খুব সহজেই জানলার সেল ধরে প্রথমে সেলে এবং সেখান থেকে ছাদে উঠলো। সেখান থেকে দ্বিতীয় তলার ছাদে উঠতে তাদের কষ্ট করতে হল না। ছাদে থাকা মই দিয়ে তারা উপরে উঠে গেলো। দুতলার ছাদের দরজাটা সামান্য একটু ভাঙা তাই বন্ধ করা যায় না। দরজা ঠেলে তারা চারজন ভিতরে ঢুকল। একজন ছাদে রইলো নজরদারির জন্য। বাকি চারজন পা টিপে-টিপে অফিস রুমে ঢুকল। কিন্তু ভিতরে কিছুই নেই। সিসি-টিভির সব জিনিস উধাও। রথীন জানলা দিয়ে বাইরে তাকালো, ক্যামেরা টাও নেই। ক্যামেরাটা গতরাত থেকেই নেই। সেটা অবশ্য তারা খেয়াল করেনি। ঘটনা ধামাচাপা দেওয়ার একটা অংশ হিসেবে সেটা লুকিয়ে ফেলা হয়েছে। মনে হচ্ছে ঘটনার সাথে স্কুলের ক্ষমতাধর কারও যোগসূত্র আছে। হতাশ হয়ে তারা অফিস থেকে বের হয়ে ছাদে চলে এলো। একতলা থেকে জানলার সেল, সেখান থেকে মাটিতে লাফ। রাজু সবার প্রথমে লাফ দিলো। তার পা মাটিতে না পড়ে একটা লাশের উপর পড়লো। তার উচিৎ ভয় পেয়ে চিৎকার করা। কিন্তু সে সাহস আর বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিলো। সে আস্তে -আস্তে শব্দ করে টিম মেম্বারদের ডাকলো। সবাই নিচে নেমে এসেছে। লাশটা উল্টে আছে। সবাই মিলে সোজা করলো। সর্বনাশ! সন্দীপের লাশ, লাশের চোখ উপড়ে ফেলা হয়েছে। তারা লাশটা সেখানেই রেখে চলে এলো। আসার পথে একটা রক্তমাখা কলম পেলো, স্কুলের নাম খচিত বিশেষ কলম। সাধারণত এ কলমগুলো স্কুলের স্যার এবং পুরস্কার সূচক ক্লাস টপারদের কাছে থাকে। সম্ভবত এ কলম দিয়েই সন্দীপের চোখ উপড়ে ফেলা হয়েছে।


স্কুলের রাতের পাহারাদার পরেশ । কোনোমতে লাশটা তার চোখে পড়ে। ভীতু পরেশ তখন চিৎকার দিয়ে মথুর স্যারের বাসার দিকে ছুটে যায়। স্যারের বাসা স্কুল ক্যাম্পাসেই। পরেশ লাশের ব্যাপারে স্যারকে জানালে তিনি স্কুল ক্যাম্পাসে থাকা আরও দুজন স্যারকে ডেকে নিয়ে আসেন। চারজন মিলে লাশের সামনে হাজির হলেন। সবার মুখে চিন্তার ভাব। কি করবে কেউই বুঝতেছে না। চারজন মিলে লাশটা স্কুলের অফিসের সামনে নিয়ে রাখলো। লাশ পাহারার দায়িত্ব পড়লো পরেশর উপর। মথুর স্যার বাকি দুজন স্যারকে নিয়ে তার বাসায় গেলেন। কিভাবে কি করা যায় সেটা নিয়ে আলোচনা হবে। গতরাতে একটা ধর্ষণ আর আজকে রাতে একটা খুন। স্কুল তো বন্ধ হয়ে যাবে। এমন কিছু করতে হবে যেন দুটো ঘটনা একসাথে চাপা পড়ে যায়। দুই ঘণ্টার আলোচনা পর্যালোচনা শেষে স্যাররা সিদ্ধান্ত নিলেন, সন্দীপের লাশটাকে ধর্ষকের লাশ হিসেবে চালিয়ে দিয়ে দুটো ঘটনা একসাথে চাপা দিবেন। সিদ্ধান্ত মতো কাজ হল। পরদিন খুব ভোরেই মথুর স্যার একটা বিবৃতি দিলেন। বললেন, "গতকাল রাতে কোনও একদল আগন্তুক এসে অদিতির ধর্ষককে হত্যা করে গেছে।" মুহূর্তেই সংবাদটা চারদিকে ছড়িয়ে পড়লো। সংবাদ মাধ্যমেও প্রচারিত হল। চারদিকে হৈ-চৈ পড়ে গেলো। ছাত্ররা স্কুলে ফিরে এলো।


একটা খুনের নাটক দিয়ে ধর্ষণের ঘটনা চাপা দেওয়া হল। ধর্ষক বেঁচে রইলো। নতুন শিকার খুঁজতে লাগলো। এভাবেই সত্য আবৃত থেকে যায় কিছু লোকের ব্যক্তিস্বার্থ আর ক্ষমতার প্রভাবে। দোষী অপরাধ করেও সমাজে বুক ফুলিয়ে ঘুরে বেড়ায় আর সাধারণ মানুষ তাঁদের অত্যাচারের কাছে আত্মসমর্পন করতে বাধ্য হয়। জানিনা কবে এর পরিবর্তন আসবে, আজও আশায় আছি......


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Thriller