আস্তিক না নাস্তিক?
আস্তিক না নাস্তিক?
প্রত্যেকের জীবনে কোন না কোন সময় এমন কিছু মানুষ আসে যারা খুব সহজেই তার আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্বের ছাপ ফেলে যায়।
রামকিঙ্কর চক্রবর্তী এই রকমের একজন ব্যক্তি যার আকর্ষণীয় ব্যক্তিত্ব ও চারিত্রিক বৈশিষ্ট আমার জীবনের ওপর একটা গভীর রেখাপাত করেছিল। জমিদার ব্রাহ্মণ বাড়ীর ছেলে রামকিঙ্কর ছিল একরোখা গোঁয়ার নাস্তিক প্রকৃতির।
আমি নরেন্দ্রপুর গ্রামের স্কুল মাস্টারের ছেলে সৈকত রায়, প্রথমবারেই জয়েন্টে পাশ করে কলকাতার এক নামকরা মেডিক্যাল কলজে চান্স পেয়ে যাই। রামকিঙ্করদা ছিল আমাদের ওই মেডিক্যাল কলেজের ফোর্থ ইয়ারের সিনিয়র দাদা। কলেজ উনিয়নের নেতাও বটে। কলেজ পরিচালন কমিটিতে তার যথেষ্ট প্রভাব ছিল। কলেজ হোস্টেল এর তিনতলার শেষ ঘরে থাকতেন। কলেজে জয়েন করার দিন পনেরো পর থেকেই প্রায়শই মধ্যরাত্রে বা শেষ রাত্রের শুরু হয়ে যেত রিগিং নামেরে একটা ভয়ানক শারীরিক অত্যাচারের নোংরা খেলা।
সেদিন কিঙ্করদা কে প্রথম দেখলাম। রাজপুত্রের মত দেখতে। আকন্ঠ পান করে বাদশাহী মেজাজে চেয়ারে বসে । হাতে জ্বলন্ত সিগারেট। ঐ হাড় কাঁপানো শীতের ঠান্ডায় নবাগত প্রত্যেকেই অর্ধ নগ্ন অবস্থায় সারিবদ্ধভাবে তার সামনে বসে। প্রত্যেকেরই সাথে পরিচয় করে এক একজনকে এক এক রকম অদ্ভুত আদেশ দিচ্ছে। আদেশ পালন করলে ছাড়। নতুবা অকথ্য অত্যাচার। প্রায় প্রতি মাসেরই, তার মর্জিমত একটা দিন নির্ধারিত ছিল এই খেলার। প্রায় মাস তিনেক চলার পর ধীরে ধীরে কিঙ্করদার সাথে আমাদের সম্পর্ক একটা স্বাভাবিক স্থানে আসে। পড়াশোনার ব্যপারে কারো কোন বোঝার সমস্যা বা অনন্য অসুবিধা হলে নির্দ্বিধায় তার কাছে পৌঁছে যাওয়া যেত। পড়াশোনা, খেলাধুলা, সাংস্কৃতিক চর্চা সব ব্যাপারেই কিঙ্করদা ছিল সমান পারদর্শী। সংস্কৃতিতে অনর্গল গীতার শ্লোক বলে যেতে পারতেন। গলায় পৈতে থাকলেও সব রকম আমিষ খেতেন। বাবার চাপেই সে নাকি গলায় ওই পৈতে পরেছিল। আদতে মনে প্রানে সে ছিল চরম নাস্তিক প্রকৃতির। ঠাকুর দেবতার তার বিন্দু মাত্র বিশ্বাস ছিল না।
এরপর অনেকগুলো বছর কেটে যায়। ডাক
্তারী পাশ করে আমরা এক একজন এক একদিকে চলে যাই। কিঙ্করদা এখন দেশের মস্ত বড় হার্ট সার্জেন্ট। একদিন হঠাৎ খবর পাই কিঙ্করদা আমাদের হাসপাতালে সিনিয়র হার্ট কনসালট্যান্ট হিসেবে আসছেন। একই হাসপাতালে কিঙ্করদার সাথে কাজ করব জেনে মনে মনে খুবই আনন্দ হচ্ছে। ইতিমধ্যেই কিঙ্করদা দিল্লি থেকে সপরিবারে কলকাতায় সেটেল্ড হয়েছেন ।
রাত তখন আটটা হবে, আমার এক বন্ধু ডাক্তারের কাছ থেকে একটা ফোন পেয়ে আমি খুবই চিন্তিত হয়ে পড়ি। বিকেলের দিকে বাইপাসের উপর কিঙ্করদার স্ত্রীর গাড়ী একসিডেন্ট হয়। স্ত্রী র আঘাত সামান্য হলেও তার তিন বছরের শিশু কন্যার অবস্থা খুবই সংকটজনক। শিশুটিকে বাইপাসের ধারে কোনও এক বেসরকারি হাসপাতালে রাখা হয়েছে। যন্ত্রের সাহায্যে কৃত্তিম উপায় বাঁচিয়ে রাখা হয়েছে। ওইটুকু শিশুর হার্ট ও লাং গুরুতর ভাবে আঘাত প্রাপ্ত , কার্যত সে এখন মৃত্যুর সাথে লুকোচুরি খেলছে। কিঙ্করদা তখন একটা সেমিনারে বক্তব্য রাখছিল। খবর পাওয়া মাত্র তড়িঘড়ি হাপাতালে পৌঁছে মেয়ের ওই অবস্থা দেখে সে পুরোপুরি দিশেহারা। দুর্ঘটনার খবর পেয়ে পরিচিত সব ডাক্তার সেখানে উপস্থিত। অবস্থা এতটাই জটিল যে কেউই কোন আশ্বাসবাণী দিতে পারছে না। প্রত্যেকের মুখ থেকে শুধুমাত্র একটি কথা বেরিয়ে আসছে।……
'একমাত্র ঈশ্বরই পারেন কিছু করতে ।'
কথা গুলো নাস্তিক কিঙ্করদার কানে আসলেও সে কোনরূপ বিরক্ত হচ্ছে না। যতই সময় গড়াচ্ছে শিশুটির অবস্থা ততই অবনতির দিকে ক্রমে সরে যাচ্ছে।
ইতিমধ্যে তার বৃদ্ধ বাবাও ওই হাসপাতালে এসেছেন। সাথে নিয়ে এসেছেন বাড়ীর কুলদেবতার প্রসাদি ফুল। নাস্তিক ছেলের বউকে নিয়ে নাতনীর কপালে ওই প্রসাদি ফুল ঠেকিয়ে তারা পাশের মন্দিরে চললেন প্রাণভিক্ষার প্রার্থনা করতে। সারা রাত তারা ওই মন্দিরে বসে প্রার্থনা করলেন।
ভোরের দিকে কিঙ্করদা জীবনের প্রথম বার মন্দিরে এসে মাথা ঠুকলেন। নিজ মুখে স্বীকার করলেন যে মেডিকেল সাইন্সে যেটা হওয়ার কথা নয়, এক্ষেত্রে নাকি সেটাই হয়েছে। শিশুটি এখন বিপদমুক্ত।