আপনজন
আপনজন
নিজের পরিচয়, অস্তিত্ব, আপনজন, পরিবার, সবকিছু হারিয়ে একেবারে ভেঙ্গে পড়েছিলেন উত্তরা দেবী। কোনদিনও কল্পনা করতে পাড়েননি এই রকম পরিস্থিতির সম্মুখিন হতে হবে জীবনে!!!! জ্ঞানত তিনি কোনদিন কারোর খারাপ করেননি!! এমনকি মনে মনেও কাউকে নিয়ে খারাপ ভাবেননি!! জীবনের এই চরম সত্যের মুখোমুখি হয়ে উত্তরা দেবী এক মুহুর্তের জন্য বাঁচতেই যেন ভুলে গেছিলেন। তবে উত্তরা দেবীকে নতুন করে বাঁচার মন্ত্র শিখিয়েছেন তার বৌমা। যখন নিজের স্বামী, এবং নিজের রক্তের অংশ উত্তরা দেবীকে অস্বীকার করল তখন এই পরের বাড়ির মেয়েটা ঢাল হয়ে উত্তরা দেবীর পাশে দাঁড়াল এবং সমাজে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দিল পরও কখনও কখনও আপন হয়!
উত্তরা দেবী বুঝতে পাড়েননি এই এক টুকরো সাদা কাগজের ওপর কালো কালি দিয়ে লেখা কয়েকটা শব্দ তার আপনজনেদের মুখোশ টেনে খুলে দেবে!!! চোখের সামনে তাদের আসল রূপ ফুটে উঠবে, এবং সেই রূপ যে কতটা নীচ তা... কল্পনাও করা সম্ভব নয়!!! উত্তরা দেবী ভাবতেই পাড়েননি এতদিন ধরে যত্ন,স্নেহ, ভালোবাসা দিয়ে আগলে রাখা তার সংসার তাকে এক মুহুর্তের মধ্যে পর করে দেবে!!! তবে সত্যি তো.... সত্যিই হয়!!!! তাকে অস্বীকার করা যায় না...!!! তবে এত বছর পরে সেই সত্যির উন্মোচন হবে উত্তরা দেবীর জীবনে, সেটা বুঝতে পাড়েননি!
চিঠিটা এসেছিল গতকাল!!! যখন উত্তরা দেবীর ছেলের বৌভাতের অনুষ্ঠান চলছিল। উত্তরা দেবীর ছেলে ভাত, কাপড়ের দায়িত্ব গ্রহন করছিল। বাড়ি ভর্তি আত্মীয় স্বজন, চারিদিকে খুশির আমেজ ছড়িয়ে ছিল!!! কিন্তু সবাই যখন সত্যিটা জানলো কেমন যেন এক অদ্ভুত দৃষ্টিতে দেখছিল উত্তরা দেবীকে!!! পরিবার, পরিজন সবার মুখের ভাব কেমন পাল্টে গেছিল, এক মুহুর্তে সবাই যেন পর করে দিয়েছিল উত্তরা দেবীকে। চেনা মানুষের ভীড়ে অচেনা হয়ে উঠেছিল উত্তরা দেবী!
উত্তরা দেবী ছোট থেকে যে মা, বাবার কাছে মানুষ হয়েছেন তারা নাকি তার আসল মা..., বাবা নয়! এবং উত্তরা দেবী আসল পরিচয় হল অন্য!!! আসলে ঝাঁ.. চকচকে শহরের বুকে অবস্থিত এক অন্ধকার গলির কোন এক ঘুপচি ঘরে রাতের অতিথিদের মনোরঞ্জন করা কোন এক অসহায় মেয়ের অসাবধানতার ফসল হলেন উত্তরাদেবী!!! কিন্তু উত্তরাদেবীর জন্মদাত্রী চাননি উত্তরাদেবীর জীবনটা ওনার মত অন্ধকার গলির স্যাঁতস্যেঁতে ঘুপচি ঘরে কেটে যাক!!! এইজন্য নিজের জীবনকে বাজি রেখে উত্তরা দেবীর জন্য বাঁচার আলোর সন্ধান করে ছিলেন। সত্যি করে উত্তরা দেবী সেইদিন বেঁচে গেছিলেন!!!! কিন্তু আজ আবার তাকে সেই মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেওয়া হচ্ছে সমাজের দোহাই দিয়ে!! আসলে সমাজের নাম দিয়ে আমরা আমাদের মনের অন্ধকার দিকটাকে চালনা করি!!
কিন্তু সেইদিন উত্তরা দেবীর জন্মদাত্রি উত্তরা দেবীকে বাঁচিয়ে ছিলেন!!! আর আজ তার বৌমা!!! যে মেয়েটা মাত্র কয়েক ঘন্টা হল এই পরিবারের সদস্য হয়ে এসেছে, কিন্তু সেই মেয়েটা সবার বিরুদ্ধে গিয়ে মেয়ে হয়ে মাকে রক্ষা করেছে। আসলে মেয়েরা বড় হলে মারা তাদের কাছে সন্তানের মতই হয়ে যায়!!! যখন সত্যি জানার পর উত্তরা দেবীকে বাড়ি থেকে চলে যেতে বলা হয়েছিল সমাজের দোহাই দিয়ে তখন উত্তরা দেবীর বৌমা উত্তরা দেবীর হাতটা শক্ত করে ধরে বলেছিল
-চলো মা.... আমরা নতুন করে নতুনভাবে বাঁচবো!!! আমাদের কাউকে প্রয়োজন নেই!!!, যে.... ছেলে নিজের মায়ের পাশে দাঁড়িয়ে ভরসার লাঠি হতে পারেনা!!! যে...... ছেলের কাছে মায়ের ভালোবাসা, স্নেহ, মমতার চেয়েও পরিচয় বড় হয়ে ওঠে!!!! সেই রকম মানুষের সাথে আমি সারা জীবন কাটাতে পারবোনা!!!! আর সে..... আমার পাশে সারাজীবন থাকবে এই নিয়ে যথেষ্ট দ্বন্দ আছে আমার মনের মধ্যে!!!! তাছাড়া অনেক ছোট বেলায় মাকে হারিয়েছি তাই মা.... যে... কি.... তা খুব ভালো করে বুঝি!!! তাই আর কোনো মাকে হারাতে চাই না!!!! আমরা একে অপরের ভরসার লাঠি হব, এবং সমাজে সমস্ত অসহায়, জীবনে হেরে যাওয়া মানুষদেরকে বাঁচানোর মন্ত্র শেখাবো!! আমরা সবাই কে... এটাই শেখাবো, কারোর জন্য নয়.... নিজের জন্য নিজেকে ভালোবেসে..... বাঁচো।
উত্তরা দেবীর চোখে জল ভরে এসেছিল তিনি শাড়ির আঁচলে চোখটা মুছে বৌমাকে বুকে টেনে নিয়ে বলেছিলেন.
আজ থেকে আমি তোর মন্ত্রে দীক্ষিত হলাম। আর নতুন করে বেঁচে থাকার সাহস পেলাম!!! আমারও আর কাউকে চাইনা!!! আমরা আমাদের মত করে বাঁচবো, যেখানে কোন রকম বাঁধা থাকবেনা!!!, কেউ আমাদের ওপর আঙ্গুল তুলবেনা!!! আমরা স্বাধীন ভাবে নিজেদের ভালোবেসে বাঁচব!! প্রিয়জনের প্রয়োজন হয়ে আর বাঁচতে চাইনা!! নিজেকে ভালোবেসে বাঁচার মাঝেই জীবনের আসল স্বার্থকতা খুঁজে নেব।
শুরু হয়েছিল নতুন করে পথ চলা দুটো মানুষের যারা একে অপেরর কেউ নয় অথচ একে অপরের ভরসা, সাহস এবং বেঁচে থাকার প্রেরনা।