আঁধারমানিকের পিশাচ ও পাতালঘরের অভিশাপ
আঁধারমানিকের পিশাচ ও পাতালঘরের অভিশাপ
স্থান: আঁধারমানিক গ্রাম (সময়টা ১৯৫০-এর দশকের মাঝামাঝি)।
পর্ব ১: নতুন মাস্টারমশাই
আঁধারমানিকে বৃষ্টি কেবল ঝরে না, মনে হয় আকাশটা যেন কাঁদছে।
সৌমিত্র রায়, গ্রামের নতুন অঙ্কের মাস্টারমশাই, তাঁর কোয়ার্টারের দাওয়ায় বসে সেই মুষলধারে বৃষ্টি দেখছিলেন। কলকাতা ছেড়ে এই অজ পাড়াগাঁয়ে এসেছেন মাস তিনেক হলো। গ্রামটি সুন্দর, বাঁশবন আর পুরোনো বটগাছে ঘেরা, কিন্তু সূর্য ডুবলেই একটা অদ্ভুত নিস্তব্ধতা গ্রাস করে পুরো এলাকাকে।
এই নিস্তব্ধতার উৎস গ্রামের একপ্রান্তে পাহাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে থাকা জরাজীর্ণ জমিদারি মহল। বর্তমান জমিদার রুদ্রপ্রতাপ চৌধুরী লোকটা এমনিতে নিরীহ, কিন্তু বড়ই একা। গ্রামের লোকে ফিসফিস করে বলে, জমিদার নাকি তাঁর ঠাকুরদাদার আমলের সিলগালা করা ‘পাতালঘর’ আবার খুলেছেন। তারপর থেকেই গ্রামে অঘটন শুরু হয়েছে। প্রথমে গবাদি পশু উধাও হতে শুরু করল, আর গত সপ্তাহে তো এক জেলে নিরুদ্দেশ হয়ে গেল।
সন্ধ্যা নামতেই জমিদারি বাড়ির এক চাকর হন্তদন্ত হয়ে সৌমিত্রর দরজায় কড়া নাড়ল। হ্যারিকেন হাতে কাঁপতে কাঁপতে সে বলল, "মাস্টারমশাই, বাবু আপনাকে তলব করেছেন। এখনই যেতে হবে। বাবু বলছেন... অঙ্কটা কিছুতেই মিলছে না।"
পর্ব ২: পোড়ো বাড়ি ও পচা গন্ধ
সৌমিত্র যখন প্রাসাদে ঢুকলেন, নাকে এল এক ভ্যাপসা গন্ধ—পুরোনো চুন-সুরকি আর পচা ফুলের গন্ধ মেশানো এক বিচিত্র বাসি বাতাস।
লাইব্রেরি ঘরে কেরোসিনের ল্যাম্পের আলোয় বসে ছিলেন রুদ্রপ্রতাপ। মানুষটাকে দেখে সৌমিত্র চমকে উঠলেন। গায়ের চামড়া ধূসর হয়ে গেছে, চোখের নিচে গভীর কালি, হাত দুটো অনবরত কাঁপছে।
"এসো সৌমিত্র," রুদ্রপ্রতাপের গলাটা শুকনো পাতার মতো খসখসে। "তুমি বিজ্ঞানের ছাত্র, তুমি যুক্তি মানো। আমাকে শুধু বলো যে আমি ভুল দেখছি, আমার মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে।"
"কী হয়েছে জমিদারবাবু?" সৌমিত্র উদ্বিগ্ন হয়ে প্রশ্ন করলেন।
রুদ্রপ্রতাপ মেঝের দিকে আঙুল তুললেন। "ওই পাতালঘর। আমি লোভ সামলাতে পারিনি। শুনেছিলাম ঠাকুরদাদা ওখানে সোনা লুকিয়ে রেখেছিলেন। আমি মিস্ত্রি না ডেকে নিজেই শাবল দিয়ে মেঝের সীল ভেঙেছিলাম। কিন্তু সোনা ছিল না সৌমিত্র, ছিল শুধু একটা মাটির কলসি, লাল কাপড়ে মোড়া। আমি... আমি কলসিটা ভেঙে ফেলেছি।"
"তারপর?"
"তারপর থেকেই ওটা ছাড়া পেয়েছে। ওটা পিশাচ, সৌমিত্র। কাঁচা মাংসের খিদে ওর। ও আমার রক্তবংশের সঙ্গে নিজেকে বেঁধে নিয়েছে। রোজ রাতে ও উপরে উঠে আসতে চায়। আমি ছাগল দিয়েছি, কিন্তু এখন আর তাতে হচ্ছে না। ও আমাকে ডাকছে।"
সৌমিত্রর শিরদাঁড়া দিয়ে একটা ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। যুক্তিবাদী মন এটাকে পাগলামি বলতে চাইল, কিন্তু ঘরের ভারী বাতাস আর কোণের ছায়াগুলো যেন অন্য কথা বলছিল। মনে হচ্ছিল, কেউ একজন এই ঘরেই আছে, যে নিঃশ্বাস নিচ্ছে না কিন্তু তাকিয়ে আছে।
"আমাদের পুলিশে খবর দেওয়া উচিত," সৌমিত্র বললেন।
"পুলিশ কি ছায়াকে গুলি করতে পারে?" রুদ্রপ্রতাপ আর্তনাদ করে উঠলেন। "আমি একজনকে খবর দিয়েছি। ভৈরব দাস। একজন কাপালিক তান্ত্রিক। তিনি আজই আসছেন। আমি চাই তুমি থাকো। একা থাকতে আমার ভয় করছে।"
পর্ব ৩: কাপালিকের আগমন
ভৈরব দাসকে দেখে কোনো অলৌকিক ক্ষমতার অধিকারী মনে হলো না। সাধারণ সুতির গেরুয়া বসন, কাঁধে একটা ঝোলা, কিন্তু চোখ দুটো অসম্ভব ধীর আর তীক্ষ্ণ।
ঘরে ঢুকেই তিনি নাকে গন্ধ শুঁকলেন। তারপর শান্ত গলায় বললেন, "বড্ড পুরোনো। আপনি এক ব্রহ্মপিশাচকে জাগিয়ে তুলেছেন বাবু। অপঘাতে মরা কোনো তান্ত্রিকের অতৃপ্ত আত্মা, যে নিষিদ্ধ বিদ্যায় হাত পাকিয়েছিল। এ বড় সাঙ্ঘাতিক জিনিস।"
"আপনি কি ওকে মারতে পারবেন?" রুদ্রপ্রতাপ তান্ত্রিকের পা জড়িয়ে ধরতে গেলেন।
"শক্তিকে মারা যায় না, তাকে শুধু বন্দি করা যায়।" ভৈরব দাস সৌমিত্রর দিকে তাকালেন। "মাস্টারমশাই, আপনার মন খুব শক্ত। আপনি ভয় পেলেও বিশ্বাস করছেন না, এটাই আপনার রক্ষা কবচ। আপনি শুধু এই প্রদীপটা ধরে রাখবেন। যা-ই দেখুন, যা-ই শুনুন, আলো নিভতে দেবেন না।"
পর্ব ৪: পাতালে অবতরণ
লাইব্রেরির একটা ভারী আলমারি সরাতেই নিচে নামার সিঁড়ি দেখা গেল। সিঁড়ি দিয়ে নামতেই তাপমাত্রা যেন দশ ডিগ্রি কমে গেল। পচা গন্ধটা এখানে অসহ্য।
পাতালঘরটা পাথরের তৈরি, স্যাঁতসেঁতে। মাঝখানে পড়ে আছে সেই ভাঙা মাটির কলসির টুকরো।
"গণ্ডির বাইরে যাবেন না," ভৈরব দাস মেঝের ধুলোয় আঙুল দিয়ে একটা বৃত্ত আঁকলেন। তারপর মাঝখানে বসে মন্ত্র উচ্চারণ শুরু করলেন। কোনো চিৎকার নয়, এক গভীর, নিচু স্বর যা সৌমিত্রর বুকের ভেতর কাঁপন ধরিয়ে দিল।
"ওং হ্রীং... ক্লিং... হুম..."
হঠাৎ ঘরের কোণের অন্ধকারটা যেন জ্যান্ত হয়ে উঠল। ওটা শুধু ছায়া নয়, ঘন কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলী।
সৌমিত্র প্রদীপটা উঁচিয়ে ধরলেন। তাঁর হাত কাঁপছে।
সেই অন্ধকার কোণ থেকে একটা শব্দ ভেসে এল। ভেজা পায়ে হাঁটার শব্দ। প্যাত... প্যাত... প্যাত... কিন্তু কেউ কোথাও নেই।
"মন শক্ত রাখুন!" ভৈরব দাসের হুকুম।
হঠাৎ সৌমিত্রর কানের কাছে, যেন তাঁর মস্তিষ্কের ভেতর কেউ ফিসফিস করে উঠল, "আলোটা দে... আলোটা আমাকে দে..."
সৌমিত্রর মনে হলো এক্ষুনি ল্যাম্পটা আছাড় মেরে ভেঙে ফেলি। তাঁর আঙুল আলগা হয়ে আসছিল। ঠিক তখনই ভৈরব দাস একমুঠো সর্ষে আগুনে ছুড়ে মারলেন। আগুনটা দপ করে নীল হয়ে জ্বলে উঠল।
ছায়াটা ছিটকে গেল। ওটা আর ধোঁয়া নয়, একটা অবয়ব নিচ্ছে। দুটো জ্বলন্ত চোখ আর কঙ্কালসার দেহ নিয়ে সেটা রুদ্রপ্রতাপের দিকে ধেয়ে গেল।
পর্ব ৫: শেষ বলিদান
"ও রক্ত চাইছে! রক্ত ছাড়া ও ফিরবে না!" ভৈরব চিৎকার করে উঠলেন। "রুদ্রপ্রতাপ, এ তোমার রক্তের সাথে বাঁধা। তোমাকেই এর শেষ করতে হবে!"
রুদ্রপ্রতাপ উঠে দাঁড়ালেন। তাঁর চোখের ভীতিটা কেটে গিয়ে এক অদ্ভুত শূন্যতা এসেছে। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন, মুক্তি পাওয়ার একটাই রাস্তা।
"আমাকে চাস? নে তবে!" রুদ্রপ্রতাপ পকেট থেকে একটা ছোট ছুরি বের করে নিজের হাতের তালু চিরে ফেললেন। ফিনকি দিয়ে রক্ত বের হলো। তিনি সেই রক্তাক্ত হাতটা সজোরে চেপে ধরলেন ভাঙা কলসির ওপর।
পিশাচটা একটা অমানবিক আর্তনাদ করে উঠল—যেন লোহায় লোহায় ঘষা খাওয়ার শব্দ। কালো ধোঁয়ার কুণ্ডলীটা ঘূর্ণিঝড়ের মতো পাক খেয়ে রুদ্রপ্রতাপের দিকে ধেয়ে এল এবং তাঁর ওই ক্ষতস্থান দিয়ে শরীরের ভেতর প্রবেশ করতে লাগল।
রুদ্রপ্রতাপ যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গিয়ে কলসির ওপর আছড়ে পড়লেন। ঘরটা নিস্তব্ধ হয়ে গেল।
পর্ব ৬: সকালের আলো
পরদিন সকালে সৌমিত্র আর ভৈরব দাস মিলে রুদ্রপ্রতাপকে ওপরে তুলে আনলেন।
জমিদার বেঁচে ছিলেন, কিন্তু তাঁর চৈতন্য ছিল না। তিনি শুধু শূন্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন। পিশাচ তার ক্ষুধা মিটিয়েছে, কিন্তু বিনিময়ে জমিদারের মনটা খেয়ে নিয়েছে। এখন তিনি শুধু একটা জ্যান্ত পুতুল।
ভৈরব দাস পাতালঘরের দরজা মোটা লোহার শিকল দিয়ে বন্ধ করে দিলেন এবং দরজার ওপর একটা তামার তাবিজ পেরেক দিয়ে পুঁতে দিলেন।
"ঋণ শোধ হয়েছে," তান্ত্রিক ভোরের আলোয় চোখ মুছতে মুছতে বললেন। "গ্রাম এখন নিরাপদ। কিন্তু মাস্টারমশাই, মনে রাখবেন—ক্ষুধা কখনো মরে না, সে শুধু অপেক্ষা করে। এই দরজা যেন আর কোনোদিন না খোলে।"
সৌমিত্র রায় এরপর আরও দশ বছর ওই গ্রামে মাস্টারি করেছিলেন। তিনি ছাত্রদের জ্যামিতি আর লজিক শেখাতেন। কিন্তু অমাবস্যার রাতে যখনই ওই পরিত্যক্ত জমিদারি বাড়ির পাশ দিয়ে যেতেন, তাঁর হাতের লণ্ঠনের আলোটা একটু বাড়িয়ে দিতেন। আর ভুলেও কখনো পেছনের ওই অন্ধকারের দিকে ফিরে তাকাতেন না।

