STORYMIRROR

Pritam Sen

Classics Thriller

4  

Pritam Sen

Classics Thriller

​১০১-এর ফাঁদ: শান্তিনিবাসের গোপন সংবিধান

​১০১-এর ফাঁদ: শান্তিনিবাসের গোপন সংবিধান

5 mins
0

কলকাতার বুকে এই বাড়িটা দাঁড়িয়ে আছে, যার বয়স প্রায় দেড়শো বছর। নাম তার 'শান্তিনিবাস' হলেও, এখানে শান্তির চেয়েও বেশি কঠোরতার রাজত্ব চলে। আর সেই রাজত্বের একমাত্র সম্রাট হলেন এর মালিক, প্রতুলচন্দ্র মুখোপাধ্যায়।

প্রতুলবাবুর জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য—তার ভাড়াটিয়াদের জীবনটাকে নিয়মের ইস্পাত-কঠিন ফ্রেমে বেঁধে রাখা। প্রতুলবাবু নিজে থাকেন দোতলায়, আর নিচে ও তিনতলায় ভাড়াটিয়ারা। তার চেহারায় একটা প্রাচীন আমলের দৃঢ়তা, কপালে সর্বদা একটা গভীর ভাঁজ, আর হাতে একটা জীর্ণ নোটবুক—যা কিনা 'শান্তিনিবাসের নিয়মাবলী'র একমাত্র দলিল।

ভাড়াটিয়ারা প্রতুলবাবুকে আড়ালে 'নিয়মবাবু' বলে ডাকে। কারণ, 'শান্তিনিবাস'-এ প্রবেশ করার অর্থ হলো শুধু একটি ঘর নয়, বরং ১০১টি অদ্ভুত, কখনও বা হাস্যকর নিয়মের জালে জড়িয়ে যাওয়া।

প্রথম অধ্যায়: নিয়মের জাল

নতুন ভাড়াটিয়া হিসেবে সেদিন প্রথম পা রাখল অয়ন, সদ্য চাকরি পাওয়া এক তরুণ আর্কিটেক্ট। সে ভেবেছিল, শহরের কেন্দ্রস্থলে এমন সস্তা ভাড়া আর কোথাও পাবে না। কিন্তু তার ধারণা পাল্টে গেল যেদিন প্রতুলবাবু তাকে নিয়মাবলির পাতাগুলো ধরিয়ে দিলেন।

> প্রতুলবাবু: "শোনো বাপু। এখানে থাকতে গেলে এই নিয়মগুলো মেনে চলতে হবে। এই হলো আমাদের পবিত্র সংবিধান। ভালো করে পড়ে সই করো।"

অয়ন পাতা উল্টাতে শুরু করল। প্রথম ১০টা নিয়ম ছিল সাধারণ—সময়মতো ভাড়া দেওয়া, দেওয়ালে পেরেক না মারা, রাত ১১টার পর জোরে গান না বাজানো। কিন্তু তার পরেই শুরু হলো আসল খেলা।

 * নিয়ম ১৪: রবিবারে বাড়ির সামনের বারান্দায় চটি খুলে রাখা নিষিদ্ধ। (কারণ, চটিগুলো নাকি আলস্যকে আমন্ত্রণ জানায়।)

 * নিয়ম ৩০: দুপুর ২:০৭ মিনিটের পর থেকে ৩:৫১ মিনিট পর্যন্ত হাঁচি দেওয়া চলবে না। (প্রতুলবাবুর নাকি এই সময়ে ঘুম আসে এবং হাঁচি নাকি স্বপ্নকে ভেঙে দেয়।)

 * নিয়ম ৪২: ফুলকপির রোস্ট ও ইলিশ মাছ ভাজার গন্ধ যেন রান্নাঘরের বাইরে না আসে। (অন্য ভাড়াটিয়ার জিভে জল আনা চলবে না।)

 * নিয়ম ৬৬: সিঁড়িতে ওঠার সময় প্রথম তিনটি ধাপে ডান পা, পরের দুটিতে বাম পা ব্যবহার করতে হবে। (নিয়মবাবু এর নাম দিয়েছেন 'সুশৃঙ্খল পদক্ষেপ'।)

অয়ন হাসবে না কাঁদবে বুঝতে পারল না। কিন্তু ঘরটা তার খুব দরকার ছিল। একপ্রকার বাধ্য হয়েই সে নিয়মগুলো মুখস্থ করার চেষ্টা করল এবং চুক্তিপত্রে সই করল।

দ্বিতীয় অধ্যায়: ১০১-এর রহস্য

অয়ন আসার পর প্রথম সপ্তাহটা বেশ ভালোই কাটল। সে যথাসাধ্য চেষ্টা করল নিয়মের গণ্ডির মধ্যে থাকতে। কিন্তু বাড়ির অন্য ভাড়াটিয়ারা—এক অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষিকা মিসেস সেন এবং এক গবেষক ডাক্তার সান্যাল—তার সাথে গোপনে যোগাযোগ করলেন।

> মিসেস সেন: (ফিসফিস করে) "সাবধান, বাবা। নিয়মবাবু নিজের নিয়মের প্রতি অন্ধ। আমরা তো মেনে নিতে নিতে ক্লান্ত।"

> ডাক্তার সান্যাল: "সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো—১০১ নম্বর নিয়মটা।"

> অয়ন: "১০১ নম্বর নিয়ম? কিন্তু এখানে তো ১০০টা নিয়ম লেখা আছে!"

ডাক্তার সান্যাল তার হাতের জীর্ণ নিয়মাবলিটা দেখালেন। সত্যিই, শেষ নিয়মটি লেখা আছে 'নিয়ম ১০০: সকল নিয়ম কঠোরভাবে পালন করতে হবে এবং প্রতুলবাবুর প্রতি পূর্ণ শ্রদ্ধা রাখতে হবে।'

কিন্তু নিয়মাবলির শেষ পাতায়, ম্লান কালিতে একটি নম্বর লেখা ছিল: ১০১। এর পাশে কোনো টেক্সট ছিল না, শুধু একটা ছোট প্রতীক—একটি ভাঙা চাবির ছবি।

> অয়ন: "এই ভাঙা চাবিটা কী?"

> মিসেস সেন: "কেউ জানে না। নিয়মবাবুও কখনো বলেন না। শুধু মাঝে মাঝে যখন তিনি খুব রেগে যান, তখন একা একা বিড়বিড় করেন—'১০১... কেউ মানলো না!'"

এরপর থেকে অয়নের মাথায় একটাই চিন্তা—কী এই ১০১ নম্বর নিয়ম?

একদিন, গভীর রাতে, অয়ন দেখল প্রতুলবাবু নিজের ঘরের বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন। বাইরে তখন ঝিরঝিরে বৃষ্টি। প্রতুলবাবুর চোখে কেমন যেন এক বিষাদের ছায়া। তিনি খুব সাবধানে তার নোটবুকটা খুললেন এবং ঠিক ১০১ নম্বরের পাশে নিজের হাতে কিছু একটা লিখলেন। পরক্ষণেই আবার সেটা মুছে ফেললেন।

অয়ন নিশ্চিত হলো—১০১ নম্বর নিয়মের সঙ্গে প্রতুলবাবুর কোনো ব্যক্তিগত রহস্য জড়িত।

তৃতীয় অধ্যায়: ভাঙা চাবির সন্ধানে

অয়ন তখন আর্কিটেকচার ছেড়ে এক নতুন গবেষণায় নামল—প্রতুলবাবুর ১০১ নম্বর নিয়ম।

সে প্রতুলবাবুর দৈনিক রুটিন লক্ষ্য করতে শুরু করল। নিয়মবাবু প্রতিদিন সন্ধ্যায় বাড়ির পেছনের বাগানটায় যান। সেই বাগান, যা সর্বদা তালাবদ্ধ থাকে এবং যার চাবি প্রতুলবাবুর কোমরে ঝোলে। আর নিয়ম ৯৯ বলে: 'গভীর সন্ধ্যায় বাগানের দিকে তাকানো কঠোরভাবে নিষিদ্ধ'।

একদিন সন্ধ্যায়, অয়ন নিয়ম ৯৯ ভাঙল। সে লুকিয়ে বাগানের দিকে তাকাল। সেখানে সে দেখল, একটি পুরনো, শ্যাওলা-পড়া বেঞ্চের পাশে প্রতুলবাবু হাঁটু গেড়ে বসে আছেন। তার হাতে সেই জীর্ণ নোটবুকটা।

প্রতুলবাবু বিড়বিড় করে বলছেন: "১০১... ১০১... আজকেও কেউ...।"

অয়ন সাহস করে বাগানের তালাবন্ধ দরজার কাছে গেল।

> অয়ন: "নিয়মবাবু, আমাকে ক্ষমা করবেন। কিন্তু আমি ১০১ নম্বর নিয়মটা জানতে চাই।"

প্রতুলবাবু থমকে গেলেন। তার চোখে হঠাৎ রাজ্যের হতাশা।

> প্রতুলবাবু: "তুমি? কেন জানতে চাও? জানলে তো তুমিও পালাবে!"

> অয়ন: "আমি পালাবো না। আমি একজন আর্কিটেক্ট। আমি বুঝতে পারি, কোনো কাঠামো তৈরির আগে তার নকশার কারণ জানা জরুরি। আপনার ১০১টা নিয়ম, আপনার জীবনকে নিয়ন্ত্রণ করেছে। কিন্তু ১০১ নম্বর নিয়মটা কী?"

প্রতুলবাবু দীর্ঘশ্বাস নিলেন। তারপর চাবি দিয়ে দরজাটা খুলে দিলেন।

> প্রতুলবাবু: "এসো।"

বাগানে প্রবেশ করে অয়ন দেখল—বেঞ্চটার নিচে মাটিতে একটা ছোট ফলক বসানো। তাতে শুধু লেখা: 'সুরমা'।

> প্রতুলবাবু: "এ হলো আমার স্ত্রী, সুরমা। আজ থেকে পঁচিশ বছর আগে, এই বাড়িতেই... এই বাগানেই সে মারা যায়।"

> অয়ন: "আমি দুঃখিত।"

প্রতুলবাবু নোটবুকটা খুললেন। ১০১ নম্বরের পাশে লেখা ছিল: "ভাড়াটিয়াকে হাসি-খুশি রাখো।"

অয়ন অবাক হলো। "কিন্তু আপনার নিয়মাবলির তো এর ঠিক উল্টো!"

প্রতুলবাবু বললেন, "সুরমা খুবই হাসিখুশি ছিল। সে বলত, এই বাড়িতে যেন সবসময় আনন্দের ঢেউ থাকে। সে চলে যাওয়ার পর, আমি আমার জীবনটাকে একটা নিয়মের বেড়াজালে বেঁধে ফেললাম। কারণ আমি ভয় পেতাম—যদি ভাড়াটিয়ারা খুব বেশি খুশি হয়, তারা যদি এই বাড়িকে খুব বেশি ভালোবাসে, তবে তারাও সুরমার মতো একদিন হঠাৎ চলে যাবে। তাই আমি কঠোর হলাম। আমি তাদের সুখ কেড়ে নিলাম, যাতে তারা এই বাড়ির মায়ায় না জড়ায়।"

তিনি চোখ মুছলেন। "আর ১০১ নম্বর নিয়ম? সেটা ছিল আমার কাছে সুরমার শেষ অনুরোধ। কিন্তু আমি নিজেই সেটা ভাঙি, কারণ আমি খুশি হতে ভয় পাই। প্রতিনিয়ত আমি চাই, কেউ না কেউ এসে বলুক—'নিয়মবাবু, আপনি খুব খারাপ!'"

> প্রতুলবাবু: "১০১ নম্বর নিয়মের রহস্য হলো—সেটি আমার মন। আমি চেয়েছিলাম কেউ অন্তত একবার আমাকে এই নিয়মের বিপরীতে যেতে বাধ্য করুক। কেউ একজন নিয়ম ভেঙে এসে বলুক—'জীবনটা শুধু নিয়মের জন্য নয়!'"

শেষ অধ্যায়: নতুন সকাল

অয়ন সেদিন রাতে বাড়ি ফিরে একটি চিঠি লিখল। তাতে কোনো অভিযোগ ছিল না, ছিল শুধু একটি প্রস্তাব।

পরের দিন সকালে প্রতুলবাবু দেখলেন, বাড়ির সামনে ঝুলছে একটি নতুন সাইনবোর্ড। তাতে লেখা:

> শান্তিনিবাস: নিয়ম শিথিল করা হয়েছে।

> আজ থেকে এই বাড়িতে 'নিয়ম ১০১' পালন করা হবে: 'সবাই হাসি-খুশি থাকবে এবং একে অপরের খোঁজ নেবে।'

প্রতুলবাবু চিঠিটা খুললেন। অয়ন লিখেছে:

> নিয়মবাবু, আমি জানি, আপনার হৃদয়টা নিয়মের চেয়ে অনেক বড়। আমরা ভাড়াটিয়ারা আপনার কঠোরতা দেখেছি, কিন্তু আপনার ভয়টা দেখিনি। এখন থেকে নিয়ম ৪২ অনুযায়ী আমরা সবাই মিলে রান্না করে এক সাথে খাবো। নিয়ম ৬৬ অনুযায়ী আমরা সিঁড়িতে ইচ্ছামত পা ফেলব—একবার বাঁ, একবার ডান, অথবা দুটোই একসাথে। কারণ জীবনটা আনন্দের জন্য, ভয়ের জন্য নয়।

প্রতুলবাবু হাসলেন। অনেক দিন পর প্রাণ খুলে হাসি। সে হাসিতে নেই কোনো কঠোরতা, আছে শুধুই এক নতুন শুরু। তিনি জীর্ণ নোটবুকটা বন্ধ করলেন। বুঝলেন, জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ নিয়ম হলো—মানুষের অনুভূতি, যার কোনো ১০০ বা ১০১টা সংখ্যা দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায় না।

আর সেই দিন থেকেই 'শান্তিনিবাস'-এর পরিবেশ বদলে গেল। নিয়মবাবু এখন মাঝে মাঝে ভাড়াটিয়াদের সঙ্গে বসে চা খান এবং তার জীবনের পুরোনো গল্প শোনান। কঠোর নিয়মবর্জিত এই বাড়িতে এখন সত্যিই 'শান্তিনিবাসের' আবহাওয়া।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics