STORYMIRROR

শিপ্রা চক্রবর্তী

Inspirational Others

3  

শিপ্রা চক্রবর্তী

Inspirational Others

আলোর দিশারি

আলোর দিশারি

5 mins
248


রবি বাবু একটা বেসরকারী ব‍্যাঙ্কে ম‍্যানেজারের পদে চাকরি করেন। খুব গুরু....গম্ভীর প্রকৃতির একজন মানুষ, কথা কম বলেন, কাজের ক্ষেত্রে খুব ডেডিকেটেড। আর সময় সম্পর্কে খুব সচেতন। রবিবাবু প্রতিদিন ঠিক একই টাইমে ব‍্যাঙ্কে পৌছান। এর জন‍্য ব‍্যাঙ্কের বড় বাবুর কাছে রবিবাবুর খুব সুনাম, এবং সবাই রবি বাবুকে খুব সম্মান করেন। আর তাছাড়া ব‍্যাঙ্কের সমস্ত সহকর্মীরা রবিবাবুকে ভালোবাসেন এবং যথেষ্ট সম্মান করেন। যার যা.... অসুবিধা হয়েছে কাজের ক্ষেত্রে রবি বাবু তার দিকেই সাহায‍্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। রবিবাবু তার কাজের জায়গাটাকে নিজের আর একটা পরিবার মনে করেন।


কয়েকমাস আগে ব‍্যাঙ্কে নতুন জয়েন করেছে বিকাশ চট্টরাজ বলে একজন বছর সাতাশের ছেলে। খুব উগ্র সাজ পোষাক, কোনো ডিসিপ্লিন নেই, মুখের ভাষা প্রচন্ড বাজে, আর একদিনও ব‍্যাঙ্কে সঠিক সময়ে এসে পৌঁছায়নি!কোনো সময় জ্ঞান নেই, আর রোজ নতুন নতুন বাহানা দেরী করে আসার কারন হিসাবে।


রবি বাবু ছেলেটাকে লক্ষ‍্য করেছেন এই একমাস ধরে, ছেলেটা আর যাই হোক কাজে কোন রকম ভুল করেনা একেবারে পারফ‍েক্ট। তবে ছেলেটার স্বভাবের মধ‍্যে রবিবাবু কিছু রহস‍্যের সন্ধান পান! আসলে অভিজ্ঞ চোখ কিনা! মানুষ পরখ করতে জানেন। আর একটা বিষয় যেটা রবিবাবুর সন্দেহ কে.গাঢ় করেছে সেটা হলো প্রত‍্যেক সপ্তাহের শনিবার ছেলেটা বারোটার মধ‍্যে কাজ সেরে বেড়িয়ে যায়। এই নিয়ে ব‍্যাঙ্কের বাদবাকি সবাই অনেক কমপ্লেন করেছে। তাই রবিবাবু ঠিক করেছেন এই শনিবার কোনোমতেই বিকাশকে ছাড়বেননা তাড়াতাড়ি!


***************************************

----------------এই গোটা সপ্তাহ বিকাশের একই ভাবে চলে, এর মধ‍্যে নিয়মের কোন রকম পরিবর্তন ঘটেনি!!! আজ শনিবার! ঘড়ির কাটায় বারোটা বাজতে বাজতে বিকাশ নিজের ব‍্যাগটা কাঁধে ঝুলিয়ে হাতে একটা ফাইল নিয়ে রবিবাবুর কেবিনের দরজাটা ঠেলে বলল ম‍ে.আই. কাম.ইন. স‍্যার.

রবিবাবু গম্ভীর গলায় বললেন, ইয়েশ.কাম.. ইন..।

বিকাশ সটান কেবিনে ঢুকে কোন রকমের ভনিতা না. করে হাতের ফাইলটা টেবিলে রেখে বলল, স‍্যার. আমি এখন আসি!খুব দরকারি কাজ আছে!

-রবিবাবু বললেন, সে.... তো..... প্রত‍্যেক শনিবারে তোমার দরকারি কাজ থাকে!!!! তবে আজ এখন যেতে পারবেনা, একটা গুরুত্বপূর্ণ কাজ আছে তোমাকে করতে হবে এক্ষুনি!! কাজটা ডিলে করা যাবেনা!

বিকাশ নিজের অ‍্যাটিটিউড বজায় রেখে বলল, আমার পক্ষে এখন কোন....কাজ করা সম্ভব নয়!আমি চললাম। এই বলে, পিছন ঘুরে দরজার দিকে যেতে লাগল!!

রবিবাবু গম্ভীর গলায় বললেন এটা তোমার বাড়ি নয়, যে. যখন ইচ্ছে হবে.. আসবে আবার, যখন ইচ্ছে হবে.. চলে যাবে!!, এখানে একটা নিয়ম আছে, যেটা সবাই মেনটেন করে, তোমাকেও করতে হবে! না হলে আমি তোমাকে এই জব থেকে স‍্যাক করতে ব‍্যধ‍্য হব!

বিকাশ ঘুরে দাঁড়িয়ে রবিবাবুর চোখে চোখ রেখে বলে উঠল, স‍্যাক করে দিন আমার তাতে কিছু এসে যায় না!তবে আমাকে এখন যেতে হবেই! ওকে গুড.বাই.. বলে বিকাশ রবিবাবুর কেবিন ছেড়ে বেড়িয়ে গেল।

রবিবাবু বিকাশের চোখের দিকে তাকিয়ে লক্ষ‍্য করলেন একটা দৃঢ়তা, কোনরকমের অনুতাপ বা আফশোষ নেই। এই দৃঢ়তার পিছনের কারন খুঁজতে রবিবাবু বেড়িয়ে পড়লেন বিকাশের পিছন পিছন!


****************************************


বিকাশ বেড়িয়ে কিছুটা হেঁটে একটা দোকান থেকে বেশকিছু চকলেট, কেক কিনে একটা অটোতে উঠে পড়ল, দেখে মনে হল অটোর লোক এবং দোকানদার দুটোই বিকাশের চেনা লোক। রবিবাবু আর একটা অটো ধরে বিকাশের অটোকে ফলো করতে করতে এগিয়ে যেতে বললেন। প্রাই কুড়ি, পঁচিশ মিনিট পর অটোটা এসে দাঁড়ালো একটা বেশ পুরনো বাড়ির সামনে।বেশ বড় বাড়ি, আর বাড়ির সামনের গেটে বড় বড় করে লেখা আছে."দিশারি"। বিকাশ আর আটোচালক হাসতে হাসতে বাড়িটার ভিতরে ঢুকে পড়ল। রবিবাবুও কিছুক্ষন অপেক্ষা করে ধীরে ধীরে ভিতরের দিকে পা বাড়ালেন।

কিছুটা ভীতরে যাওয়ার পর রবিবাবু চোখের সামনে যা. দেখলেন তাতে চরম আশ্চর্য হলেন!!! বিকাশকে চারিদিক থেকে ঘিরে দাঁড়িয়ে আছে অনেক অনেক স্পেশাল চাইল্ড। বিকাশ ওদের হাতে চকলেট তুলে দিচ্ছে, ওদের কোলে তুলে আদর করছে, এবং ওদের সাথে দুষ্টুমি করছে। আর বাচ্ছাগুলো ওকে পেয়ে এত খুশি হয়েছে মনে হচ্ছে হাতে যেন. চাঁদ পেয়ে গেছে।


হঠাৎ রবিবাবু নিজের কাঁধে কারোর হাতের স্পর্শ পেলেন। পিছন ঘুরে দেখলেন একজন বৃদ্ধ লোক এবং তারপাশে একজন মাঝ বয়সি মহিলা হাসিমুখে দাঁড়িয়ে আছে।

বৃদ্ধ লোকটি জিজ্ঞাসা করলেন কাকে. চাই.

-রবিবাবু ওদের দিকে ঘুরে হাতজোড় করে নমস্কার করে বললেন, আমি রবি কিরন বাগচি। এই বিকাশকে অনুসরন করতে করতে এইখানে আসলাম। আচ্ছা! এটা কি. এই সব বাচ্ছা দের স্কুল?

বৃদ্ধ লোকটি হাসতে হাসত বলল না..... না...... এটা বিকাশের পৈত্রিক বাড়ি। ঐ.... নিজের উদ্যোগে এটাকে স্কুল করেছে, যাতে ওদের কিছু ভালো সময় উপহার দিতে পারে!!কিছু শিক্ষা দিতে পারে! জীবন পথে এগিয়ে যাওয়ার জন‍্য!!!। ঐ সব কিছু দায়িত্ব সহকারে পালন করে? আমারও নাতনি আছে বাচ্ছা গুলোর মধ‍্যে । আর পাশের মহিলাটিকে দেখিয়ে বললেন ওর একটা ছেলে। তা.. আপনার কেউ আছে নাকি? বৃদ্ধ একটা জোড়ে দীর্ঘনিঃশ্বাস ছাড়লেন।

রবিবাবু বললেন না.না..সেই রকম কিছু না.আমি তাহলে এখন আসি?

বৃদ্ধ লোকটি বলে উঠল বিকাশের সাথে দেখা করবেন না?

রবিবাবু বলল পরে দেখা করে নেব!

বৃদ্ধ লোকটি বলল আচ্ছা!

রবিবাবু ওনাদের নমস্কার জানিয়ে বেড়িয়ে পড়লেন ওখান থেকে।


***************************************

সোমবারের দিন সকাল সকাল রবিবাবু বিকাশকে ফোন করে বললেন, সময় মত ব‍্যাঙ্কে চলে আসতে। বিকাশ ফোনটা পেয়ে অবাক হলো কারন ও ভেবে নিয়েছিল ওর এই চাকরিটা আর নেই। আগেকার চাকরির মত এটাও গেল। বিকাশ নিজের প্রশংসা বা প্রচার কোনটাই চায়না যেটুকু করে মন থেকে করে তাই কোথাও কিছু জানায় না ফলে ওর চাকরি বেশিদিন কোথাও টেকে না। যাই হোক বিকাশ, বিকাশের সময় মত ব‍্যাঙ্কে ঢুকলো!

-বিকাশের ঢোকার সাথে সাথে সিকিউরিটি বলল, আপনি এসে গেছেন!রবিবাবু আপনাকে কেবিনে যেতে বলেছেন আসলেই।


বিকাশ আবার অবাক হলো কি..... ব‍্যাপার ডিশমিশ লেটার দেবেন নাকি!ধুর কিছুই তো. বুঝতে পারছিনা! বিকাশ ব‍্যাগটা নিজের ডেস্কে রেখে এগিয়ে গেল রবি বাবুর কেবিনের দিকে। বিকাশ দরজা ঠেলতে যাবে ঠিক তখনই রবিবাবু কেবিন থেকে বেড়িয়ে এলেন, এবং বিকাশের হাত ধরে বললেন, চলো।


বিকাশ কিছু বলার আগেই রবি বাবু বিকাশের হাত ধরে নিয়ে এসে সবার সামনে দাঁড় করালেন। সবাই অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে ওদের দিকে। কেউ ভাবছে আজ বিকাশের কাজের শেষ দিন!

আবার কেউ ভাবছে কি.. ব‍্যাপার?এমনকি বিকাশ নিজেও.ভাবছে যে.হচ্ছেটা কি.. ওর সাথে কিছুইতো বুঝতে পারছেনা!


সবার মনের ভাব বুঝতে পেরে রবিবাবু বলে উঠলেন, আজ আপনাদেরকে আমি একটাই কথা বলব, বিকাশের মত সহকর্মী পেয়ে আমি আজ নিজেকে ধন‍্য মনে করছি। আর বিকাশের এই সুন্দর মানসিকতাকে স‍্যালুট জানাচ্ছি। আমি আজ থেকে যতদিন বাঁচব ততদিন বিকাশের পাশে আছি সব দিক থেকে। বিকাশের পিঠ চাপড়ে রবিবাবু বলে ওঠলেন, ব্রেভো..... ইয়ং..... ম‍্যান..... ব্রেভো।


রবিবাবুর কথা শুনে এবং এই রকম আচরন দেখে সবাই অবাক হয়ে যায়! এমনকি. বিকাশ নিজেও! বিকাশ মনে মনে বলে ওঠে এর আবার কি. হলো? কাজের চাপে পাগল হয়ে গেল নাকি??


রবিবাবু সেইদিনের সমস্ত ঘটনা সবাই কে.. খুলে বললেন। সবাই সবকিছু শুনে বিকাশকে আরও উৎসাহিত করল এইভাবে এগিয়ে যাওয়ার জন‍্য!


রবিবাবু বলে উঠলেন, সামনের রবিবার আমরা সবাই যাবো একসাথে বিকাশের সঙ্গে। কি বিকাশ নিয়ে যাবে তো?


বিকাশ মুখে চওড়া হাসি এনে বলল নিশ্চয়ই নিয়ে যাব!

"মেঘের আড়ালে লুকিয়ে থাকা সূর্য

যেমন ছড়ায় ক্ষীন আলো,

সবার ভালো চাইলে পরে হবে

নিজের ভালো।

আলোর নীচে যেমন থাকে অন্ধকার,

তেমনি নিকষ কালো রত্রি পেরিয়ে

সূর্য ওঠে জীবনে বারবার।"




Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational