স্মৃতির পাতায় শরৎ যেথায় (শারদ সংখ্যা)
স্মৃতির পাতায় শরৎ যেথায় (শারদ সংখ্যা)
প্রকৃতি আবারও যেন উঠছে মেতে
সেই চেনা পরিচিত এক ছন্দে,
বাঙালি মন আবারও হচ্ছে মাতোয়ারা,
বাতাসে মিশে থাকা সেই প্রাণ ভোলানো গন্ধে।
চারিপাশে ছড়িয়ে থাকা সূর্যোদয়ের
স্বর্ণাভ রোদের কোমল স্পর্শ লাগে শরীরে,
অনুভূত হয় কিছুর আয়োজন চলছে,
প্রকৃতির সকল সৌন্দর্য ঘিরে।
কান পেতে শুনি আগমনীর বার্তা,
মা যে আসছেন, হতে সময় নেই আর,
সেই কারণেই এত ব্যস্ততা, মনের এই বাকুলতা,
চারিপাশ ঘিরে সময় এসেছে সাজাবার।
দুঃসময়ের মাঝে এবারেও মা আসছেন,
এইটুকুই মোদের ভরসা, অপেক্ষা নয় বহুদূর,
নয়ন দুটি মেলে দেখি, আকাশে বাতাসে যেন
আজ ডানা মেলেছে আগমনী সুর।
মনে পরে যায় ছেলেবেলার কিছু স্মৃতি,
যা আজও অন্তরের আকাশে ভাসমান,
হৃদয়ের আয়নায় প্রতিফলিত হয় ছেলেবেলার ছবিগুলি,
আমার গ্রামের জমিদার বাড়ির সেই দূর্গা দালান।
এরকম সময় থেকেই যেখানে
শুরু হতো গড়া, মা দুর্গার চিন্ময়ী রূপ,
মনে পরে, এক ছুটে একলা যেতাম চলে,
ক্লান্ত দুপুর তখন একা, চারিপাশ নিশ্চুপ।
অবাক চোখে তাকিয়ে দেখতাম
প্রতিমা গড়ার কাজ, বিকেল হলে ফিরতাম বাড়ি,
একটি বছর অপেক্ষা শেষে, জীর্ণ কাঠামোয়
প্রথমেই জুড়তো খড় আর দড়ি।
দিন এগোতে থাকতো, খড়ের কাঠামোর ওপর
শিল্পীর হাতের জাদুতে মাটির প্রলেপ লাগতো ধীরে ধীরে,
কোন মায়াবলে ওই বাঁশের কাঠামো-টি
পূর্ণাঙ্গ মূর্তি হয়ে যেত, দেখতাম বিস্ময় আর কৌতুহল ভরে।
শরৎ মানেই নীল আকাশ সমুদ্রে বয়ে চলা
বড় ছোট টুকরো টুকরো সাদা মেঘের ভেলা,
শরৎ মানেই নদীর ধারে, মাঠের কোণে,
বাতাসের সুরে, ছন্দে কাশ ফুলের দোলা।
শরৎ মানেই বাড়ির উঠনে কিংবা কুয়াশা ভেজা ঘাসে
ছড়িয়ে থাকা মনমুগ্ধকর শিউলি ফুলের গন্ধ,
ছেলেবেলার সেই দিনগুলিকে ফিরে পেতে চাই,
সেই ইচ্ছেদের স্বপ্নগুলোর দরজা আজ বন্ধ।
স্মৃতিতে আঙিনায় জড়ো হয় সেইসব বিকেলগুলো,
বন্ধুরা মিলে ছুটে যেতাম সবুজ-সাদায় মোড়া কাশবনে,
কত গল্প, কত লুকোচুরি, কত খেলাধুলা, অন্তরাত্মা আজ
বারে বারে একটিবার ঘুড়ে আসতে চায় সেইখানে।
মনে হতো, শিশিরে ভেজা ঘাসের সাথে
ঝরে পড়া শিউলিগুলি মনের কথা বলে,
এখনো যখন ভোরের আবছা আলোয়
পথ পানে চাই, নয়ন দুটি শুধুই শিউলি খুঁজে চলে।
এই ভাবেই কেটে যেত বেশ কয়েকটা দিন,
অবশেষে আসত সেই বহু প্রতীক্ষিত ভোর,
যার জন্য সবাই অপেক্ষা করে থাকতাম,
আর স্কুল ছুটির দিন গুনতাম গোটা একটা বছর।
মহালয়া- যাকে ঘিরে থাকা কিছু ঘটনা
আজও স্মৃতির পাতায় সুস্পষ্ট, রঙিন,
সেই রকমই কিছু মুহূর্তের স্রোতে দিতে চাই আরেকবার ডুব,
জানি তা অসম্ভব, দুর্লভ, সময়ের গ্রাসে তারা আজ বিলীন।
মায়ের ডাক শুনে উঠে পরতাম সেই ভোরে,
রেডিও-তে শুনতে হবে যে “মহিষাসুরমর্দিনী”,
দূর হতে ভেসে আসে মন্ত্রমুগ্ধকর সকল গান,
সাথে চন্ডীপাঠে "বিরূপাক্ষ "- এর সেই শিহরণ জাগানো ধ্বনি।
কিছু তা ঘুম জড়ানো চোখে, হালকা শীতে
কাঁথায় মুড়ে, বাবা মায়ের পাশে থাকত
াম আমি শুয়ে,
“যা দেবী সর্বভূতেষু” কিংবা "জাগো তুমি জাগো"
শুনতে শুনতে জানিনা কখন আবার পড়তাম ঘুমিয়ে।
আজও ব্যস্তময় জীবনে সেই ভোর আসে,
আগমন বার্তা বাজে, ভোরের আঁধার যায় সরে,
ছেলেবেলার সেই আনন্দঘন মুহূর্তগুলি আজ ঝাপসা,
চোখ খোলার আগেই চারিপাশ প্রভাতী আলোয় যায় ভরে।
মহালয়ার দিন সকালে তাড়াতাড়ি স্নান সেরে,
ছুটে চলে যেতাম জমিদার বাড়ির সেই দূর্গা দালানে,
সেদিন যে মায়ের মাটির মূর্তিতে চক্ষুদান হবে,
অদ্ভুত এক তৃপ্তি, পুলক জেগে থাকতো হৃদয়াঙ্গনে।
আজ মন বারে বারে সেখানেই উড়ে যেতে চায়, কিন্তু উপায় কী?,
সেই দূর্গা দালানে ছুটে যাওয়ার সুযোগ যে নেই আর,
চোখ দুটি বুজলে, আজও ভেসে ওঠে মায়ের মুখখানি,
ত্রিনয়ন আঁকার পর যখন অপার বিস্ময়ে দেখাতাম প্রথমবার।
পঞ্চমীর দিনে জমিদার বাড়ির ঢাকির দল
আসত মাঠ পেরিয়ে, নদী পেরিয়ে, নৌকা চড়ে,
দূর হতে ভেসে আসা ঢাকের শব্দ শুনে
আমাদের ঘুম ভাঙতো মহাপঞ্চমীর ভোরে।
পঞ্চমীর ভোরে আজও উঠে পড়ি,
যেন সেই ঢাকের সুর আজও কানে বেজে ওঠে,
বেরিয়ে পড়ি রাস্তায়, কিন্তু কোথায় ঢাকি?,
কোথায় তার ঢাক? অকারণেই চলি হেঁটে।
ষষ্ঠী থেকে দশমী, গ্রামের সবাই মিলে শত দুঃখের মাঝেও,
এই পাঁচটা দিন দুর্গোৎসব নিয়েই থাকতো মেতে,
অষ্টমীতে নতুন জামা পড়ে, আমরা গ্রামের সব
ছোটোরা মিলে জমিদার বাড়ি যেতাম ভোগ খেতে।
ষষ্ঠীর কলা বৌ স্নান থেকে শুরু করে,
অষ্টমীতে অঞ্জলি, সন্ধি পূজা, নবমীতে পাঁঠা বলি,
চারটে দিন মহানন্দে কাটানোর পর আসত দশমী,
বিদায়ী সুর বাজিয়ে মা যেন বলতেন "এবার আমি চলি"।
সিঁদুর খেলার শেষে, ঢাকের তালে নেচে নেচে,
গ্রামের সকলের সাথে দূর্গা প্রতিমা চলতো নিরঞ্জনের পথে,
চারিদিকে সূর্যাস্তের রক্তিম আভা, মাঠের মধ্যে দিয়ে
কাশ বন পেরিয়ে মায়ের বিসর্জন হতো মাঝ নদীতে।
কাশ ফুলের আলতো স্পর্শ আর লাগেনা প্রানে,
শিউলির মিষ্টি গন্ধও আজ উধাও, এসব যেন বহু দূরে,
যখন পুরনো মুহূর্তগুলি আমায় জড়িয়ে ধরে,
মন-প্রাণ যেন কেঁদে ওঠে, গা ভাসাই স্মৃতির সুরে সুরে।
মহামারীর প্রকোপ মাঝেই আরও একটা শরতের আগমন,
আরও একবার মহালয়ার ভোরের স্মৃতি রোমন্থন, হাতে আর মাত্র কটা দিন,
চারিপাশে থিম পুজোর বড়ো, দামী প্যান্ডেলের ভিড়ে,
জমিদার বাড়ির দূর্গা দালানের সেই পুজো এখন হয়তো প্রাণহীন।
শারদোৎসব ১৪২৭ প্ৰায় দোর গোড়ায়, আবারও মা আসছেন,
অনেক আশা, আকাঙ্খা, অনেক ভালোবাসা নিয়ে,
সকল হিংসা, বিবাদ, মহামারীর আতঙ্কের অবসান ঘটিয়ে,
আমাদের সমাজ, জীবনটাকে শান্তির আলোয় দেবেন ভরিয়ে।
সকল অশুভ শক্তির বিনাশ করবেন মা,
তিনি যে অসুর বিনাশিনী, দুর্গতিনাশিনী,
জাগো মা, জাগো দূর্গা, জাগো বলপ্রদায়িনী,
জাগো তুমি জাগো, জাগো দশপ্রহরণধারিণী।
আজ সবাইকে জানাই আগাম শুভেচ্ছা, অভিনন্দন,
হে মা দুর্গা, তোমার জন্য রইলো সাদর আমন্ত্রণ,
দেখতে দেখতে একটা বছর পেরিয়ে গেলো,
সময় এসেছে মাগো, আবার হবে তোমার অকাল বোধন।