মুখের অনেকটা আঁচলে ঢাকা
মুখের অনেকটা আঁচলে ঢাকা
গ্রীলের বাইরে থেকে হাত বাড়িয়ে
দিয়েছে
পরিবারবন্ধু কাজলদি,
মাস মাইনের প্রাপ্যটুকু অসহায়
দুহাত বাড়িয়ে নিচ্ছে।
তার সঙ্গে এ বাড়ির দিদিভাইয়ের
হাত থেকে ব্যাগ ভর্তি সবজির
ভালোবাসা।
সাত সকালের আলো আর
দিনশেষের রাঙা মুকুল নীল
ক্যানভাসে ছবি আঁকা ভুলেই গেছে।
সারাটা মেঘ রোদ্দুর বৃষ্টির
আকাশ, মা বসুন্ধরার কানে কানে
ফিসফিস করে বলছে — বাঁচিয়ে
রাখো,বাঁচিয়ে রাখো,বাঁচিয়ে রাখো।
পৃথিবীর গান আকাশকে বলছে—
মনে রেখো, মনে রেখো বন্ধু।
কেউ কারও হাত ছুঁয়ে বলতে
পারছিনা-
ও দিদি, তুমি কবে থেকে আবার
আসবে গো?
সেই কাজলদি, নীলাকাশের সাড়ে
তেইশ বছর ধরে শুধু আদুরে
ডাক– ও কাজল পিসি,ও কাজল
পিসি,ও কাজলপিসি–
মাঝবয়সী শ্যামলা মুখের
অনেকটা ভয়ের আঁচলে
ঢাকা,চোখে যেন দু দুটো বিশ্বযুদ্ধের
আতঙ্ক!
মতিঝিলে জুজুলদির
বাড়িতে,ঘরের মেয়ে নাসিমার
জন্যে মাস মাইনের টাকা গোকুলে
মাস মাইনের টাকা গোকুলে
বাড়লেও,
তার হাতে পৌছচ্ছে না কিছুতেই।
যোগাযোগহীন মেয়েটার পক্ষে সেই
বামনগাছির ঝুপড়ি থেকে দমদম
আসা সম্ভব?
খেটে খাওয়া নারীশক্তি
নাসিমা আজ তাই ঘরে বসা, প্রায়
কোলকুঁজো চাচাকে নিয়ে
লঙ্গরখানার ডাল ভাত তরকারির
লাইনে,কঠোর সোস্যাল
ডিসট্যান্সিং মেনে একঠায়ে
দাঁড়িয়ে। নিঃস্ব মুঠি, বিবর্ণ মুখ।
মুখে সারাক্ষণ কিশোরকুমার লেগে
থাকা কেশ-শিল্পী বিশুদার অক্লান্ত
চিরুনি- ক়াঁচি,আমার চুলকে চেনে
আজ তিন দশক প্রায়,
ধ্বস্ত, বিবিক্ত সেই বিশুদা এখন
নিজেই মহাশূন্যতামাখা কর্মহীন।
অসহায় রাজকুমার, পাড়ার
ইস্ত্রিভাই,জেলা পূর্ণিয়া,উত্তর বিহার,
শুধু ফ্যালফ্যাল তাকিয়ে ক্রমশ
ব্যালেন্স ফুরিয়ে আসা
মুঠোফোনের দিকে;
যদি দেহাতের লাজুক ঘরণীর ভীরু
কন্ঠে ভেসে আসে — কব আয়োগে
জী?
ও কাজল পিসি,ও নাসিমা বন্ধু, ও
জুজুলদি,
ও নীলাকাশের মা–এসো, আমরা
যে যার ঘরের জানলা খুলে
বিসর্জনের ক্রোধী রঘুপতি হয়ে
চিৎকার করি — উচ্ছন্ন! উচ্ছন্ন যাও!
যাকে চোখে দেখা যায়না,সেই
অদৃশ্য মানতার চোখে চোখ রেখে
বলো– উচ্ছন্নে যাও,কুৎসিত
শত্রু– উচ্ছন্নে যাও।
জলে কুমীর,ডাঙায় বাঘ,
বাইরে মৃত্যুদূত, আর ঘরে বুকের
ওপর চেপে বসা কর্মহীন
ভবিষ্যতের লাগাতার দুঃস্বপ্ন!
একদিকে দাঁতে দাঁত চেপে লড়াকু
বিজ্ঞানী,ডাক্তার,নার্স, স্বাস্থ্যকর্মী,
সাংবাদিক, প্রশাসন, অন্যদিকে
দুশ্চিন্তার মহাসাগরে হাবুডুবু
তামাম পৃথিবীর অর্থনীতিবিদ।
বহুদূর থেকে বনের পাখির কান্নার
রুদ্ধসঙ্গীত শুনে
কানে তুলো গুঁজে দিচ্ছে ভয়ের
গর্তে সেঁধিয়ে যাওয়া, এই
সেদিনের দামামা বাজিয়ে কামান
দাগা সভ্যতা
গ্রীলের ওপারে টাকার জন্য হাত
পাতা — ও কাজল পিসির
শরীরীভাষায় সত্যিকারের ভয়।
দ্য হাংরি স্টোন আর ক্ষুধিত পাষাণ
সব ঝুট ঝুট হ্যায় বলে চিৎকার করতে
গিয়েও নিজেই নিজের মুখ ঢাকছে
এক টুকরো কালো কাপড়ে।
আকাশ বলছে, মাটি বলছে, ঋতু
বদলের পরমা প্রকৃতি বলছে-
মানুষ, তুমি মানবসভ্যতাকে
বাঁচাও, নয়তো গোলাপের দিকে
চেয়ে কে বলবে- সুন্দর!
প্রাণহীন চুনী কার দৃষ্টির বৃষ্টিপাতে
রাঙা হয়ে উঠবে?
ধৈর্য্য, তুমি আরও কতোটা
ধৈর্য্যশীল হতে পারো,
এখন তারই কঠিনতম পরীক্ষা।
দুঃস্বপ্ন, জাস্ট গেট আউট।
