Unlock solutions to your love life challenges, from choosing the right partner to navigating deception and loneliness, with the book "Lust Love & Liberation ". Click here to get your copy!
Unlock solutions to your love life challenges, from choosing the right partner to navigating deception and loneliness, with the book "Lust Love & Liberation ". Click here to get your copy!

Manik Goswami

Classics Thriller

4  

Manik Goswami

Classics Thriller

ভূতের লিপ্সা

ভূতের লিপ্সা

7 mins
4


ভূতের লিপ্সা

মানিক চন্দ্র গোস্বামী


শ্রাবন মাসের শেষের দিকে মাসির বিয়েতে মামাবাড়ি গেছি মায়ের সাথে। আমার ছোটবেলার কথাই বলছি। অজ পাড়াগাঁয়ে মামার বাড়ি। কাঁচা মাটির রাস্তা। গরমকালে সাইকেলে চড়ে গেলেও ধুলো ওড়ে। এখন তো ঘোর বর্ষা। জলে কাদায় রাস্তার বেহাল অবস্থা। তার ওপর গরুর গাড়ির চাকার চাপে মাঝে মাঝেই গর্ত তৈরী হয়েছে রাস্তায়। বর্ষার জল ভরে গিয়ে গর্তগুলো ঠিক বোঝাও যায় না, আচমকা পড়ে গিয়ে হাত পা ভাঙার বড় বড় ফাঁদ তৈরী হয়ে রয়েছে। সে যাই হোক, মাসির বিয়েতে আসবো না, তা কি হয়। স্কুলের পড়াশোনার পাঠ কিছুদিনের জন্য শিকেয় তুলে এসে গেছি মামার বাড়ি। প্রথমে ট্রেনে করে, পরে ট্রেন থেকে নেমে বাসে করে যেখানে এসে নামলাম সেখান থেকে মামা বাড়ি যাওয়ার জন্য এই চার কিলোমিটার রাস্তার কাদা পার করতে হয় হেঁটে যেতে হবে নয়তো গরুর গাড়ি। একটা গরুর গাড়ি অবশ্য ভাড়া পাওয়া গেল। উঁচু নিচু, কাদা ভর্তি রাস্তার দুলুনি খেতে খেতে, দুপাশে বর্ষার জলে ডুবে যাওয়া ধান ক্ষেতগুলি দেখতে দেখতে, মাটির ঘরের খড়ের চালের ওপর শুয়ে থাকা লাউ, কুমড়ো দেখতে দেখতে অবশেষে এসে পোঁছালাম মামার বাড়ি। এতটা রাস্তা এসেছি, কষ্ট, ক্লান্তি তো হয়েছে বেশ, তবুও বাড়িতে ঢোকার সাথে সাথে সব কষ্ট উধাও। প্রাথমিক আদর আপ্যায়ন পর্ব শেষে মেতে উঠলাম মামাতো ভাই বোনেদের সাথে খেলাধুলায়।

সারাদিনের ক্লান্তির জন্যই বোধহয়, রাতের খাওয়া দাওয়া সারা হতেই ঘুমিয়ে পড়েছি অঘোরে।

হঠাৎ ধাক্কা খেয়ে ঘুম ভেঙে যেতেই দেখি মামাতো ভাই রীতিমতো ধাক্কাধাক্কি করে আমাকে জাগিয়ে দিয়েছে। দু হাতে চোখ ডলতে ডলতে ডেকে তোলার কারণ টা জানতে চাইলাম। সে বললো, 'ঘুমোচ্ছিস কি, ওঠ, শিগ্গির চল পাশের পাল বাড়িতে। ননী গোপাল কাকুকে ভূতে ধরেছে। ওঝা কাকুও এসে গেছে, ঝাড়ফুঁক চলছে, গিয়ে দেখে আসি চল'। 

এক দৌড়ে দুজনে চলে গেলাম পাশের বাড়ি। বেশ ভিড় হয়ে গিয়েছে। লোকজন গোল করে ঘিরে দাঁড়িয়ে দেখছে। মাঝখানে একজন মাঝ বয়সী লোক বসে আছে। উস্কো খুস্কো, অবিন্যস্ত, বিধ্বস্ত চেহারা। দেখলেই বোঝা যাচ্ছে তার শরীরের ওপর দিয়ে বেশ ঝড় বয়ে গিয়েছে। বড় বড় চোখ মেলে এদিক ওদিক দেখছে আর মাঝে মাঝে মাথা নাড়াচ্ছে। চেহারার মধ্যে একটা অস্থিরতা, অপ্রকৃতিস্থতা দেখতে পাওয়া যাচ্ছে। এই লোকটাই ননী গোপাল কাকু। একেই নাকি ভূতে ধরেছে। তার পাশে কালো মতো দেখতে বড় চেহারার একজন লোক, মাথায় ঝাঁকড়া ঝাঁকড়া বড় বড় চুল, লাল লাল চোখ, আলখাল্লার মতো একটা পোশাক পড়ে অনর্গল মন্ত্র বলে চলেছে। মাঝে মাঝে একমুঠো ধুলো নিয়ে মন্ত্র পড়ে ননী পাল কাকুর দিকে ছুড়ে মারছে। এই লোকটি ওঝা কাকু , ভূত ছাড়ানোর প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।

লোক মুখে শুনে বুঝতে পারলাম ননী গোপাল কাকু, সন্ধ্যে নাগাদ, ওই চার কিলোমিটার দূরের গ্রামীণ শহরের হাটে গেছিলেন। পেশায় তিনি কুমোর। মাটির হাঁড়ি, কলসি, গ্লাস, প্রদীপ ইত্যাদি তৈরী করেন বাড়িতে পেতে রাখা কাঠের চাকা ঘুরিয়ে। হাটের থেকে কিছু প্রয়োজনও জিনিস, সব্জিপাতি, আর একটা বড় ইলিশ মাছ কিনে সাইকেলে করে বাড়ি ফিরছিলেন। জিনিসপত্র সাইকেলের ক্যারিয়ারে বেঁধে নিয়ে, ইলিশ মাছটাকে দড়ি দিয়ে বেঁধে সাইকেলের হ্যান্ডেলে ঝুলিয়ে নিয়ে আসছিলেন। এই চার কিলোমিটার রাস্তা আসার সময় পথের মধ্যে একটা জায়গায় একটা শ্মশানের পাশ দিয়ে আসতে হয়। শ্মশানের কাজে জলের সুবিধার জন্য পাশের নদী থেকে খাল কেটে জলের ব্যবস্থা করা হয়েছে। আসার সময় রাস্তা থেকে একটু নেমে গিয়ে খাল পার হয়েই আসতে হয়। পাশে একটা ভাঙাচোরা পুল আছে। সেটা দিয়ে আসতে গেলে অনেকটা ঘুরে আসতে হয়। সন্ধ্যে হয়ে গিয়েছে, তাড়াতাড়ি বাড়ি ফিরতে হবে। তাই, এই খালের রাস্তা ধরেই আসা। গরমকালে অবশ্য খালটাতে জল একদমই থাকেনা বললেই হয়। কিন্তু এখন বর্ষার সময়, একটু হলেও জল তো রয়েছে।

ননী কাকু সাইকেল থেকে নেমে হেঁটে খাল পার হওয়ার সময়েই নাকি তাকে ভূতে ধরেছে। হঠাৎ তার শরীরটা খুব ভারী ভারী মনে হতে থাকে। হাঁটা চলার ইচ্ছেটাই কমে যেতে থাকে। কোনো রকমে বাড়ি পৌঁছে তার স্ত্রীকে বলেন যে তার শরীরটা খুব খারাপ লাগছে। স্ত্রীকে বলতে থাকেন কখন থেকে তার শরীর খারাপ লাগতে থাকে। বলতে বলতেই কাকু অজ্ঞান হয়ে যান। কাকিমা ভয় পেয়ে চিৎকার করে ওঠেন। লোকজনকে ডাকতে থাকেন। চোখে মুখে জলের ঝাপ্টা দিয়ে কাকুর জ্ঞান ফেরানো হয়। কিন্তু তার অপ্রকৃতিস্থ, অস্বাভাবিক অবস্থা দেখে প্রতিবেশীরাই ওঝাকে ডেকে আনে। ওঝা আসার পর থেকেই কাকুর ওপর ভর করে থাকা ভূত ছাড়ানোর প্রক্রিয়া চালু হয়ে গেছে।

হাতের মুঠোয় ধুলো নিয়ে মন্ত্র পড়ে কাকুর গায়ে বেশ কয়েকবার ছুড়ে মারার পরেও কোনো কাজ হচ্ছে বলে মনে হলো না। ওঝা কাকু নানারকম ভাবে ভূত ছাড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন, কিন্তু কিছুতেই কিছু হচ্ছে না। এরপর ওঝা কাকু কিছু পাটকাঠি আর কিছু সরষে দানা জোগাড় করে আনতে বললেন। একগোছা পাটকাঠি এসে পৌঁছতেই ওঝা কাকু কিছু পাটকাঠি তে আগুন লাগিয়ে একটা অগ্নিকুন্ড তৈরী করলেন। একটা পাত্রে কিছু সরষে দানা নিয়ে সেটাকে গরম করে মন্ত্র পাঠ করতে করতে ননী কাকুর গায়ে ছুঁড়ে মারতেই কাকু নাঁকি নাঁকি স্বরে চিৎকার করে বলতে লাগলেন, 'ওরে, মারিস না, মারিস ন। ব্যথা লাগছে'। ওঝা কাকু আরো জোরে চিৎকার করে জিজ্ঞাসা করলেন, 'কে তুই, তোর পরিচয় দিয়ে এই শরীর ছেড়ে চলে যা। না গেলে তোকে আরো সরষে পোড়ার মার খেতেই হবে'। কোনো কাজ হলো না। ননী কাকু মাথা দোলাতে থাকলেন। অবশেষে আর একবার মন্ত্রপূতঃ সরষে পোড়ার মার খেয়ে সে বলতে লাগলো, তার নাম গীতা রানী চৌধুরী। অতবড় টাটকা ইলিশ মাছ দেখে তার মাছ খাবার খুব লোভ হয়েছে। মাছ খাবার ইচ্ছাতেই সে ননী গোপালের কাঁধে চেপে এ বাড়িতে এসেছে। এক টুকরো ইলিশ মাছ ভাজা খেয়েই সে নাকি চলে যাবে।

ভিড়ের মধ্যে একটা গুঞ্জন উঠলো। লোকেরা বলাবলি করতে লাগলো, 'ওঃ, গীতা রানী চৌধুরী তো চৌধুরী পাড়ার সেই বৌটা। শ্বশুর বাড়িতে কিছু একটা ঝামেলা হওয়াতে গত বছর পুজোর আগেই সে গায়ে কেরোসিন তেল ঢেলে আগুন লাগিয়ে আত্মহত্যা করেছিল। সে কেস তো এখনও সদর আদালতে চলছে'।

ওঝার পরামর্শ মতো ননী কাকুর স্ত্রী ইলিশ মাছটা কেটে তার একটা টুকরো ভালো করে ভেজে প্লেটে করে দিয়ে গেলো। ওঝা কাকু মাছ ভাজার প্লেটটা ননী কাকুর সামনে নিয়ে যেতেই সে এক থাবা দিয়ে মাছটাকে প্লেট থেকে তুলে নিয়েই একরকম গোগ্রাসেই সেটি খেয়ে নিলো। কাঁটা বেছে খাওয়ার কোনো ব্যাপারই ছিল না। আমি বড় বড় চোখ করে অবাক হয়ে কাঁটা সমেত মাছ ভাজা খাওয়ার ব্যাপারটা এই প্রথম দেখলাম। আমরা সাধারণ মানুষেরা মাছের কাঁটা বেছেই তো খাই। কাঁটা সমেত মাছ আবার খাওয়া যায় নাকি। তাই ব্যাপারটা একটু অস্বাভাবিকই লাগলো। মাছ খাওয়া হয়ে গেলে ওঝা কাকু তাকে বললো, 'মাছ খাওয়া তো হলো, এবার যা'। 'যাচ্ছি বাপু, যাচ্ছি। অত তাড়া কিসের। একটু বিশ্রাম করেই যাচ্ছি'।

-'বিশ্রাম? কিসের বিশ্রাম'?

-'খাওয়া দাওয়া করেছি, একটু বিশ্রাম নেবো না?

-'তার মানে তোর যাবার ইচ্ছে নেই। যাবি না, তাই তো। তাহলে এই নে', বলে ওঝা কাকু আবার সরষে দানা গরম করে ছুঁড়ে মারলো। ননী কাকু চিৎকার করে উঠলো,'মারছিস কেন রে, যাবো তো বলছি'।

-'তাহলে যা, চলে যা বলছি, না হলে আরো মার খাবি'। কথাটি বলেই ওঝা কাকু আবার গরম সরষে ছোঁড়ার উদ্যোগ করতেই ননী কাকু নাঁকি সুরে বলে উঠলেন,'যাচ্ছি, যাচ্ছি, আর মারিস না'।

-'তুই যে যাচ্ছিস তার প্রমান তো তোকে দিতে হবে। এমনি এমনি কিভাবে বুঝতে পারবো তুই সত্যিই গেছিস কিনা'। এই কথা বলেই ওঝা কাকু ননী কাকুর স্ত্রীকে বললো একটা পিতলের কলসি জল ভর্তি করে নিয়ে আসতে। জল ভরা কলসি এসে যেতেই হাতে সরষে পোড়া নিয়ে ওঝা কাকু বলতে লাগলেন,'এই জলভরা কলসিটা মুখে করে নিয়ে ঐখানে ওই জবা গাছটার নিচে রেখে দিয়ে চলে যা'।

-'না,না, আমি পারবো না। অতবড় ভারী জিনিসটা নিয়ে আমি যেতে পারবো না। আমার সব দাঁত গুলো ভেঙে পড়ে যাবে। অন্য কোনো হালকা কাজ আমায় করতে দে, আমি করে দেবো'।

-'পারবি না, আচ্ছা বেশ। তাহলে ওই যে বেল গাছটা দেখতে পাচ্ছিস, ওই গাছের একটা ডাল ভেঙে দিয়ে চলে যা'।

-'ওরে বাবা, ভাঙতে আমি পারবো না। ওই গাছের ডালগুলো অনেক শক্ত। আমি ভাঙতে পারবো না। তার চেয়ে আমি ওই গাছের পাতাগুলো নাড়িয়ে দিয়ে চলে যাচ্ছি'।

-'আচ্ছা, ঠিক আছে। তুই তাই কর। গাছের পাতাগুলোকেই নাড়িয়ে দিয়ে যা। তবু তুই যা'। কথাগুলি বলেই ওঝা কাকু দাঁড়িয়ে থাকা লোকদের বললো,'আপনারা ওদিক থেকে একটু সরে যান। গাছের দিকে যাবার রাস্তাটা একটু ফাঁকা করে দিন যাতে গীতা রানী চলে যেতে পারে'।

লোকেরা সরে গিয়ে বেলগাছের দিকে যাবার রাস্তাটা একটু ফাঁকা করে দেবার প্রায় সাথে সাথেই বেলগাছটার ওপর দিয়ে যেন ঝড় বয়ে গেলো। ঝড়ের দাপটে বেল গাছের পাতাগুলো কাঁপতে থাকলো। কিছু পাতা ঝরে পড়ে গেলো। অথচ, আশেপাশের অন্যান্য গাছগুলোতে ঝড় কেন, কোনোরকম হাওয়ার লক্ষণই দেখতে পাওয়া গেলো না। একটা পাতাও নড়লো না। আর সেই সাথেই ননী কাকু সজোরে মাটির ওপর আছড়ে পরেই অজ্ঞান হয়ে গেলেন। চোখে মুখে জল ছিটিয়ে জ্ঞান ফিরতেই ননী কাকু স্বাভাবিক মানুষ। তার শরীরের ওপর দিয়ে যে এতবড়ো ঝড় বয়ে গেছে বোঝার উপায় নেই। চারদিক একবার দেখে নিয়ে কাকু জিজ্ঞাসা করলেন, 'আমার বাড়িতে এত লোকের ভিড় কেন ? কি হয়েছে? আমি একটু ক্লান্ত ছিলাম বলে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম'।

মাসির বিয়ে শেষে কলকাতায় ফিরেও আমার মনের মাঝে ঘুরপাক খাচ্ছে সেদিনের রাতে নিজের চোখে দেখা সেই ঘটনাটা। ভূত কি তাহলে সত্যিই আছে? আর কিছু খাওয়ার ইচ্ছে হলে সুযোগ বুঝেই কি লোকের ঘাড়ে চেপে বসে? 

            xxxx



Rate this content
Log in

Similar bengali poem from Classics