STORYMIRROR

বৃষ্টিস্নাতা - bristisnata

Inspirational Thriller

4  

বৃষ্টিস্নাতা - bristisnata

Inspirational Thriller

বাস্তবের মহামায়া

বাস্তবের মহামায়া

10 mins
399


~ •কলমে #ছদ্মনামে 'বৃষ্টিস্নাতা' 🌧️


"হাওড়া জেলার মোহনপুর গ্রামের একাদশ শ্রেণির এক ছাত্রীকে বাজার থেকে বাড়ি ফেরার পথে ধর্ষণ করে গ্রামের জঙ্গলে ফেলে রেখে যান ধর্ষক। বিষয়টিকে ঘিরে চঞ্চল্য ছড়িয়ে পরেছে ইতিমধ্যেই। ধর্ষিতার বাড়ির লোক এই ঘটনার রায় চায়..."

বাকি খবর শেষ হওয়ার আগেই রিমোটের সুইচ টিপে খবরের চ্যানেল বদলে দেয় সায়ক।

"খবরের চ্যানেল খুললে রোজ রোজ এই একই খবর। কী অবস্থা! মেয়েদের রাস্তায় একা ছাড়াই যাবেনা...", সায়কের কণ্ঠে হতাশা ঝরে পরে। ডাইনিং টেবিলে বসে থাকা ওর মা উষাদেবী ভাতের শেষ অংশটা নাতনি মোমের সামনে ধরে চোখ বন্ধ করে বলে ওঠেন,"কে খাবে এটা? বাঘ খাবে? নাকি জিরাফ খেয়ে যাবে?"

"হালুম...", বলেই উষাদেবীর হাত থেকে ভাতটা মুখের মধ্যে নিয়ে মেয় চার বছরের মোম।উষাদেবী চোখ খুলে অবাক হওয়ার ভান করে বলে ওঠেন,"ওমা! বাঘ এসেছিলো নাকি? ভাতটা খেয়ে চলে গেলো..."

মোম খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে। ভাতের থালাটা টেবিলে রেখে ধুইয়ে দেয় মোমের মুখটা। মোম হাতের পুতুলটা নিয়ে লাফাতে লাফাতে গিয়ে বসে সায়কের কোলের কাছে, "মাম্মা কখন আসবে গো , বাবাই?"

"আর একটুখানি পরেই...", মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় সায়ক। মোম কাঁদো কাঁদো চোখে বাবার দিকে তাকিয়ে আধো আধো গলায় বলে ওঠে,"মা কে একটা ফোন করোনা। কখন আসবে?"

"মা তো এখন busy আছে বলো। তুমি একটু কার্টুন দেখো ততক্ষন...."

"তাহলে আমায় little singham চালিয়ে দাও....", ফর্সা গালে টোল ফেলা হাসি হেসে বলে ওঠে মোম।

"Okk,সোনা...",বলেই টিভির চ্যানেল পাল্টে বাচ্ছাদের কার্টুন চ্যানেল চালিয়ে দেয়। টিভির স্ক্রিনে ফুটে ওঠে অনেক দৃশ্য।

"বাবাই দেখো...", টিভিতে উজ্জ্বল হয়ে থাকা মহিলা পুলিশকর্মীর দিকে আঙুল দেখিয়ে উৎফুল্ল হয়ে ওঠে মোম,"আমার মাম্মার মতো। মাম্মাও তো পচা লোকেদের বকা দেয় বলো?"

"হ্যাঁ তো গো....", মোমের নরম গালদুটো টিপে দিয়ে উঠে আসে সায়ক। খাবার চেয়ারে বসে পরে উষাদেবীর উদ্দেশ্যে বলে ওঠে,"খাবে তো?"

"তোর বউ কখন আসবে?", উষাদেবীর গলা গম্ভীর। সায়ক ধীর গলায় বলে ওঠে,"খবরের চ্যানেল যেভাবে তোলপাড় হচ্ছে ঘটনাটা নিয়ে। রাত হবে হয়তো..."

"হুম...", গজগজ করতে করতে দুটো প্লেটে ভাত তরকারি বেড়ে দেন উষাদেবী,"ভাগ্যি করে বৌমা পেয়েছি বটে! ভেবেছিলাম ছেলের বিয়ে দিয়ে একটু শান্তিতে থাকবো। তা না! মাথার ওপর আরেক অশান্তি..."

"আহঃ! মা!", সামান্য বিরক্তি ঝরে পরে সায়কের কণ্ঠে,"সবাই ঘর দেখাশোনা করলে, বাইরেটা দেখবে কে?", ভাত মাখাতে মাখতে অল্প হেসে বলে সায়ক। উষাদেবী হতাশ কণ্ঠে বলে ওঠে,"হ্যাঁ সেই! বাইরের সেবায় করুক তোর বউ। আর ঘরে যে ছোট্ট মেয়েটা আছে। তার কথা ভাবতে হবেনা..."

"মা! কেন এমন করছো বলো? এই যে যে মেয়েটা আজ ধর্ষিত হলো, সেও তো কারোর একজনের মেয়ে নাকি? সেই মেয়েটার পরিবারও তো চাইছে যেন সেই দোষী শাস্তি পাক। শুধু নিজের মেয়ের কথা ভেবে স্বার্থপর হলে কি চলে?"

"আর যাদের শাস্তি দিতে ছুটছে তারা তোর মেয়েটার যদি কোনো ক্ষতি করে? তার দায়?"

"মা! এভাবে....", সায়কের বাকি কথা শেষ হওয়ার আগেই প্লেটের ভাত ফেলে রেখেই উঠে পরেন উষাদেবী,"বৌয়ের ভুলগুলোও দেখতে শেখ, বাবু...."


উষাদেবী উঠে চলে যান। সায়ক মাথায় হাত দিয়ে বসে থাকে চেয়ারেই।

"চলো মোম সোনা। এবার ঘুমু ঘুমু করে নি একটু...", মোমকে কোলে তুলে নিয়ে বলে ওঠেন উষাদেবী। সায়ক আড়চোখে তাকায় সেদিকে। মোম বায়না করে বলে ওঠে,"মাম্মা আসুক। আমি মাম্মার সাথেই ঘুমাবো..."

উষাদেবী আড়চোখে তাকান সায়কের দিকে। সায়ক বলে ওঠে,"মাম্মার আজ ফিরতে দেরী হবে, সোনা! তুমি ঠাম্মির কাছেই শুয়ে পড়ো আজ। ঠাম্মি গল্প শোনাবে..."

"শোনাবে তো ঠাম্মি গপ্পো?", আল্হাদি কণ্ঠে বলে ওঠে মোম। উষাদেবী ওকে কোলে নিয়ে বলেন,"হুম তো। শোনাবো..."

বলেই ঘরের দিকে চলে যান।


সায়ক একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে ঘরের সব গুছিয়ে নেয়। হাত ধুয়ে একবার বাড়িয়ে দরজার দিকে তাকায়। তারপর চলে যায় নিজের ঘরে।


ঘরের মধ্যে একটা অল্প নীল আলো জ্বলছে। বড়ো আলো আর জ্বালায়না সায়ক। বিছানাটা পরিপাটি করে গোছানো। কিন্তু ফাঁকা! কেউ নেই! কেমন একটা একাকিত্ব জড়িয়ে ধরে সায়ককে। গিয়ে বলে ব্যালকনিতে রাখা বেতের চেয়ারে। শরীরটা চেয়ারে এলিয়ে দিয়ে চোখেদুটো ধীরে ধীরে বন্ধ করে সায়ক। চোখের সামনে ভেসে উঠেছে পালকের মুখটা!


হ্যাঁ, পালক। ওর সহধর্মিনী। পালকের সাথে ওর বিয়েটা ঠিক হয় বাড়ি থেকেই। পালককে সায়ক প্রথম দেখেছিলো ছবিতে। উষাদেবী অনেক মেয়ের ছবি সামনে ফেলে বলেছিলেন, "বল দেখি বাবু। কোন মেয়েকে পছন্দ তোর...."

এতো ছবির ভিড়ে সায়ক তুলে নিয়েছিল নীল শাড়ির পালককে। ওর মুখের দীপ্ততা বড্ডো আকৃষ্ট করেছিল ওকে। উষাদেবী একগাল হেসে সেদিন বলেছিলেন,"জানতাম তোর একেই পছন্দ হবে। এর নাম হলো পালক। বাড়ি...."

কোনো কথা কানে আসেনি সায়কের। ও একদৃষ্টে তাকিয়েছিল এই যুবতীর দিকে।


ওবাড়ি থেকেও মতামত আসায় দেখা করে দুজনে। রবীন্দ্র সরবর। সায়ক অপেক্ষা করছিলো অনেক আগে থেকেই। দূর থেকে সাদা আর গোলাপি মাখা চুড়িদার পরে যখন দূর থেকে হেঁটে আসছিলো পালক, সেদিনই নিজের শরীরে বিদ্যুতের ঝলক অনুভব করে সায়ক। দেহের বর্ণ উজ্জ্বল কাঞ্চণবর্ণা। একরাশ কোঁচকানো চুল কোমর ছুঁয়েছে। মুখে একটা মিষ্টি হাসি। চোখেদুটো খঞ্জনা পাখির মতো চঞ্চলা হলেও বড্ডো তীক্ষ্ণ। সারা মুখে তার বুদ্ধিদীপ্ত মনোভাবের প্রকাশ মেলে। রঞ্জিত কোমল ওষ্ঠদ্বয় অল্প ফাঁক করে পালক জিজ্ঞেস করেছিল, "আপনিই সায়ক তো?"

কথার সুরে সায়কের মনে সেতার বেজে উঠেছিলো সেদিন। কথা শুরু সেদিন থেকেই। রবীন্দ্র সরোবরের ধার ধরে হেঁটে গিয়েছিল দুজনে। ভাড়ের চায়ে চুমুক দিয়ে সায়ক জিজ্ঞেস করেছিল, "তোমার ক্যারিয়ার নিয়ে এগোনার জন্য কী ইচ্ছে আছে?"

চকিতে মুখ তুলে তাকিয়েছিল পালক। কোনো জড়তা না রেখেই বলে উঠেছিলো,"পুলিশ হয়ে দেশের সেবা করার ইচ্ছে আছে। দোষীদের শাস্তি দেওয়ার ইচ্ছে। আপনার অসুবিধে নেই তো?"

"আছে বই কি!", সায়কের উত্তরে ভ্রূদুটো কুঁচকে গিয়েছিল পালকের। সায়ক হেসে বলে উঠেছিলো,"আপনি করে বললে তো অসুবিধে থাকবেই। এবার তুমি তে নামলে হয় না?"

উত্তরে হেসে উঠেছিলো পালকও, "বেশ! তবে তোমায় তুমি করেই বলবো..."


শুরু হয়েছিল ওদের মিষ্টি প্রেমের গল্প। মুঠোফোনের সীমানা পেরিয়ে দুধে-আলতায় পা ডুবিয়ে এবাড়িতে প্রবেশ করে পালক। ঘোর বর্ষায় বিয়ে হয় ওদের। বিয়ের পর প্রথম রাতে বৃষ্টির ঝমঝম শব্দকে ভেঙে পালক বলেছিলো,"আমার পাশে থাকবে তো তো, সায়ক? যেকোনো পরিস্থিতিতে...."


থেকে গেছে সায়ক। প্রথম চাকরিতে যোগ দেওয়ার খবর যেদিন এসেছিলো, সেদিন সবার বিরুদ্ধে গিয়েই পালকের পাশে দাঁড়ায় ও। তারপর কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। ওদের মধ্যে এসেছে ওদের ভালোবাসার চিন্হ মোম।


স্মৃতির সরণী বেয়ে অতীতে উড়ে যেতে যেতে চোখে ঘোর লেগে আসে সায়কের। কখন যে চোখেদুটো বুজে এসেছে খেয়ালও হয়নি ওর। সেতারের শব্দ টা ভেসে আসে, "তুমি এখানে?"

"হুম..", চোখ খুলে তাকায় সায়ক। সামনে পুলিশের পোশাক পরে দাঁড়িয়ে পালক। চকিতে উঠে পরে ও,"ওহ তুমি। বুঝতে পারিনি গো।"

"এই শিশিরে কেউ এভাবে বাইরে বসে থাকে? এসো ভিতরে এসো...", পালকের পিছন পিছন ভিতরে যায় সায়ক। রাপোশাক হাতে নিয়ে ওয়াশরুমে ঢুকতে ঢুকতে পালক বলে ওঠে,"লাইট off করে ঘুমিয়ে যেতে পারো..."


অল্প হাসে সায়ক। স্নান ঘরের গরম জল শরীরে লাগতেই অনেক শান্তি লাগে পালকের। উষ্ণ জল ছুঁয়ে যাচ্ছে ওর নারী দেহের প্রতিটা খাঁজকে। চোখ বন্ধ করলেই ভেসে উঠেছে সেই ধর্ষিত নারীদেহটা। নারী হয়ে জন্মানোই তবে ভুল? এই তো কদিন আগে ধুমধাম করে দুর্গাপুজো হয়ে গেলো । কী লাভ হলো এতে? একজন নারীকে মূর্তিরূপে পুজো করবো, আর ওপর নারীর রক্তমাংসের দেহের খাঁজে ললুপ দৃষ্টি ভরিয়ে দেবো। এরকম পুজো করার মানে কী!? পরক্ষনেই ভেসে ওঠে মোমের মুখটা। সেই কোন সকালে বেরিয়েছিল আজ পালক, আর এখন রাত দুটো বাজতে চললো। মেয়েটাকে সারাদিন দেখেনি পালক। ওকে কাছে পেলেই ছোট্ট হাতদুটো বাড়িয়ে ওকে জড়িয়ে ধরে মোম। কী স্নিগ্ধ সেই স্পর্শ!


রাতপোশাক পরে চুল মুছতে মুছতে বাইরে বেরোয় পালক। এদিক-ওদিক তাকায়। সায়ক কোথায় গেলো?!

"এই রাতে এতো চুল ভেজালে কেন আবার?", সায়কের কণ্ঠে পিছনে ফিরে তাকায় পালক। সায়ক একহাতে খাবারের প্লেট আর অন্যহাতে জলের গ্লাস নিয়ে ভিতরে ঢুকছে। পালক ধীর স্বরে বলে ওঠে,"এমনিই। সারাদিন যা গেলো!"

"সে আর জানিনা!? এখন খেয়ে নাও দেখি চট করে..."

"তুমি ঘুমিয়ে পরো। আমি কিছু mail চেক করে তারপর খাবো..."

"তবে তুমি mail চেক করো। আর আমি খাইয়ে দিচ্ছি..."

বলেই ভাত মাখিয়ে পালকের মুখের কাছে নিয়ে আসে সায়ক। পালক চুপ করে তাকিয়ে থাকে। সায়ক একটু ধমক দিয়ে বলে ওঠে, "খাও..."

পালক খেয়ে নেয় খাবারটা। সদ্য গরম করেই এনেছে সায়ক সবকিছু। ও ফোনটা হাতে নিয়ে mail গুলো দেখতে থাকে। সায়ক ওকে খাইয়ে দিতে থাকে। খাওয়া শেষে প্লেট রান্নাঘরে নিয়ে চলে যায় সায়ক। পালক মুখ ধুয়ে ফোনটা বন্ধ করে দেয়। মুখ ধুয়ে আসে। চোখটা বন্ধ করে অল্প। মাথায় গরম হাওয়ার অনুভূতিতে চোখ খুলে তাকায়।

"আরও আস্তে। নড়ছো কেন এতো?", সায়ক হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে যত্ন করে শুকিয়ে দিচ্ছে পালকের চুলটা। পালক বলেনা কিছু। চুপ করে বসে থাকে। সায়ক চুলগুলো শুকিয়ে দিয়ে চিরুনি এনে সুন্দর করে আঁচড়ে দেয় চুলটা।

"এবার ঠিক আছে।", পালকের সামনে বসে সায়ক।


পালক হঠাৎ জড়িয়ে ধরে সায়ককে। অবাধ অশ্রুধারা ওর দুগাল পেরিয়ে যায়। সায়ক বলেনা কিছু। চুপ করে ওর মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে থাকে। আসলে এই বাইরে থেকে মনে হওয়া কঠিন মানুষগুলো অনেকটা নারকেলের মতো। তারা বাইরে থেকে খুব কঠিন, দাম্ভীক, গম্ভীর একটা মানুষ।কিন্তু সেই কঠিন খোলোসের ভিতরেও তাদের নরম একটা মন আছে। আর অন্যায় , অবিচার নিয়ে যাদের কাজ, যাদের ভয়ে কেঁপে ওঠে সমাজের কীটশ্রেণীর মানুষেরা। সমাজের অন্ধকার দিকের আরও গভীরে যেতে যেতে তাদের কাঠিন্যের খোলোস আরও শক্ত হয়ে ওঠে, আর ভিতরের নরম মনটা সকলের অলক্ষ্যে আরও বেশি বেশি ক্ষতবিক্ষত হয়।


"কেন সায়ক কেন? আমাদের সমাজটা কেন এতটা নোংরা? ক্লাস ১১ এর মেয়েটা সদ্য মাধ্যমিক দিয়ে দুচোখে কতো স্বপ্ন এঁকেছিল। নিজের জীবন নিয়ে কতো স্বপ্ন ছিল তার। আর একটা মানুষ নিজের ক্ষনিকের আনন্দের জন্য সেই ফুটফুটে প্রাণ থেকে সব আনন্দ, স্বপ্ন কেড়ে নিলো। এতো কিছু করেও সে ঘুরে বেড়াচ্ছে নিজের মতো, আর কলঙ্কিত হলো এই দুচোখে স্বপ্ন আঁকা মেয়েটা! কেন সায়ক? কেন? বলতে পারো গো? কেন?"


পালক কাঁদছে। সায়ক চুপ করে জড়িয়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে ওর মাথায়। পালক শান্ত হয় ধীরে ধীরে। সায়ক ধীরকণ্ঠে বলে ওঠে,"এটাই যে সমাজের নিয়ম। পৃথিবী সৃষ্টির অদিকাল থেকেই সমাজ যে ভেঙে গেছে তিনটে ভাগে। একভাগ অসুরের মতো নিজেদের স্বার্থের কথা ভেবে শোষণ করে আসছে সাধারণ মানুষকে। একদল মানুষ অসুরদের দ্বারা শোষিত হয়ে যাচ্ছে। আর একদল মানুষ জেগে উঠেছে সেই অসুরদের নিধন করতে। তুমিও পারবে, পালক। মা দূর্গা যেমন পেরেছিল অসুরদের নিধন করতে, তুমিও পারবে...."

মাথা তুলে তাকায় পালক। সায়কের চোখে চোখ রেখে বলে, "আর আর একদল আছে গো। অসুরদের যারা নিধন করতে ব্যস্ত, তাদের শক্তি দেওয়ার জন্য যারা আছে। ঠিক যেমন আমার জন্য তুমি..."

সায়কের কপালে ঠোঁট ছোঁয়ায় পালক। আবারও জড়িয়ে ধরে ওকে, "আমি কি মোমের প্রতি , তোমার প্রতি, মায়ের প্রতি অন্যায় করছি?"

"কে বলেছে গো তোমায়!? তুমি তো আমাদের গর্ব গো..."

"এভাবেই থাকবে তো, সায়ক? আমার পাশে? তোমার মা দূর্গা যে তার ভোলানাথকে ছাড়া একদম অসহায়.."


...

"সব প্রমান এখন আমাদের হাতের মুঠোয়। এবার সময় এসেছে দোষীকে ধরার...", মিটিং রুম থেকে ভেসে আসে পালকের গম্ভীর, দৃঢ় কণ্ঠস্বর,"আমি আর কোনো দেরী চাইনা। শুধু একজন নাবালিকাকে ধর্ষণই না। ড্রাগ পাচারের সঙ্গেও জড়িত এই ধর্ষক, তাপস দাস। যা ইনফরমেশন আমরা পেয়েছি, তাতে কালকে খামারবাড়ি এলাকার বাজি কারখানাতেই বাজির সঙ্গেই ড্রাগ পাচার করার ফন্দি এঁটেছে ওরা। কাল সেখানেই রেইড করা হবে। আর তারপর থার্ড ডিগ্রি পড়লে সব নিজের মুখেই শিকার করবে।"

"Okk, ম্যাম..", সবাই সম্মতি দেয়।


..

"তুমি থাকবেনা, মাম্মা আজকেও?", মোম জড়িয়ে ধরে পালককে। আজ কালীপুজো। পাড়ার মাইকে বাজছে শ্যামা সংগীত। বাচ্ছারা আজ তুমুল ব্যস্ত। বাজি কিনতে হবে কিনা?! আর আজকেই সেই দোষীদের ধরার দিন।পালক বলে ওঠে,"আমি চেষ্টা করবো তো সোনা। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব আমি ফেরার চেষ্টা করবো..."

"প্রমিস?", বলেই নিজের ডান হাতটা বাড়ায় মোম। পালক ওর হাতে হাত রেখে বলে ওঠে,"পিঙ্কি প্রমিস..."

"আজ তো কালীপুজো। তুমি মা কালির মতোই সব অসুরদের আজ বধ করে আসবে। ঠিক আছে?", মোমের কথায় হেসে মাথা নাড়ায় পালক। বেরোনার আগে উষাদেবীকে প্রণাম করে পালক। পালকের মাথায় হাত রেখে বলেন,"আমার বাড়ির মেয়ে যে শুধু মা লক্ষ্মী না, মা কালীও, সেটা যেন আজ পুজোর দিনে আমি গর্ব করে বলতে পারি..."

"নিশ্চই পারবো গো...", হাসে পালক। দূর থেকে হাসে সায়কও। ও জানে, উষাদেবী যতই পালকের ওপর রেগে যান, পাড়ার লোকের কাছে পালকের গুণের কথাই বলে বেড়ান। পালক কোনো কাজে সফল হলে, সবথেকে খুশি যে মানুষটা হয়, সেটা উষাদেবী নিজেই।


বেরোনার আগে পালককে বলে,"আজ জিতে এসো। মা কালী যেমন নিধন করেছিলেন অসুরদের। ঠিক তেমনি আজ তোমায়ও এই সমাজের কীটদের আইনের হাতে তুলে দিয়ে হবে..."


..

"মাম্মা এখনও এলোনা, বাবাই? একবার ফোন করোনা গো। মাম্মা এলে তবে তো একসঙ্গে বাজি ফাটাবো...", সায়ককে ঠেলা দেয় মোম। সায়ক অল্প হাসার চেষ্টা করে বলে,"মাম্মা এক্ষুনি আসবে তো, সোনা..."

মুখে বললেও ভিতরে ভিতরে নিজেও উদ্বিগ্ন সায়ক। পালকের ফোন বন্ধ। কী অবস্থায় যে আছে ওরা। সেই খবর পাওয়ারও কোনো লক্ষন নেই!


"ঠাম্মি, তুমি আমায় কালীপুজোর গল্প বলবে?", মোম বসে উষাদেবীর পাশে। উষাদেবী নিজেও চিন্তিত। তাও মোমের মাথায় হাত রেখে বলতে শুরু করে,"দেবী মহামায়ার দশমহাবিদ্যা রূপের প্রথম রূপ হল কালী। আদ্যাশক্তি ভগবতীর কোষ থেকেই সৃষ্টি হন কালী। কোষ থেকে জন্ম বলে প্রথমে তাঁকে বলা হয় ‘দেবী কৌশিকী’। আর কৌশিকী রূপ ধারণের পর ভগবতীর গায়ের রঙ ঘন কালো হয়ে ওঠে আর এই রঙের কারণেই তাঁকে ‘কালী’ বলে সম্বোধন করা হয়। তাঁর মূর্তিতে দেখা যায় চারটি হাত যার মধ্যে এক হাতে খড়্গ , এক হাতে কাটা নরমুণ্ড, আর দুই হাতে দেখা যায় বরাভয় মুদ্রা ও আশীর্বাদ মুদ্রা। তাঁর গলায় নরমুণ্ডের মালা আর তাঁর হাতে ধরা নরমুণ্ডের রক্ত পান করে তাঁর বাহন শিয়াল। এলোকেশী দেবী কালী শিবের বুকের উপর দাঁড়িয়ে আছেন।শুম্ভ ও নিশুম্ভ নামের দুই অসুরকে পরাজিত করে দেবকুলকে রক্ষা করার জন্য আবির্ভূতা হন দেবী কালী..."


উষাদেবীর গল্পের মাঝেরই টিভির খবরের চ্যানেলে এ চলে আসে নতুন খবর।

"হাওড়ার মোহনপুর গ্রামের খামারবাড়ি এলাকার বাজি কারখানায় ধরা পরলো ড্রাগ পাচার কান্ড। সুত্রানুযায়ী, এই ড্রাগ পাচার কাণ্ডের শীর্ষে আছে তাপস দাস, যিনি এই গ্রামেই কিছুদিন আগে ঘটে যাওয়া ধর্ষণ কাণ্ডের সঙ্গে জড়িত...."


"পেরেছে, মোম। তোর মা পেরেছে....", আনন্দে লাফিয়ে ওঠে সায়ক। উষাদেবী মোমের মাথায় হাত রেখে বলে ওঠে,"তোর মাও পেরেছে রে। সমাজেরর অসুরদের শাস্তি দিতে পেরেছে..."

"সত্যিই?",মোমের মধ্যে আনন্দ খেলে যায়,"আমার মাম্মা তো সত্যিকারের মা কালী। যে অসুরদের বধ করে দেয়..."


বাড়ির ডোরবেলটা বেজে উঠেলো। সায়ক ছুটে গিয়ে দরজা খুলে দেয়। সামনে উজ্জ্বল, জয়ের হাসি নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে পালক। মোমও ছুটে এগিয়ে আসে। পালক বলে ওঠে, "এই না না। আগে আমি ফ্রেশ হয়ে আসি। ততক্ষন চট করে বাজিগুলো বের করে ফেলো।


পালক ফ্রেশ হয়ে একটা শাড়ি পরে চলে আসে। বাগানে শুরু হয় আলোকবাজির খেলা। ছোট্ট মোমের হাত ধরে পালক ফুলঝুরি জ্বালাতে শুরু করে। সারা বাগান আলো আর হাসিতে ভোরে ওঠে। আজ পালকের মনটা অনেকটা হালকা। কয়েকদিন ধরে চলা চাপটা আজ আর নেই। বাজি ফাটানো শেষ করে উষাদেবীর বারণ সত্ত্বেও ওনার সাথে রান্নায় সাহায্য করে পালক। একসাথে অনেকদিন পর আনন্দ করে খাওয়া দাওয়া সেরে নেয় সকলে।


"পালক, কী ভাবছো?", জিজ্ঞেস করে ওঠে সায়ক। রাত হয়ে গেছে অনেক। মোমকে দুজনে মিলে ঘুম পাড়িয়ে এসে দাঁড়িয়েছে ব্যালকনিতে। পালক একটা বড়ো শ্বাস নিয়ে বলে ওঠে,"খুব শান্তি লাগছে আজ। আমি পেরেছি গো...সমাজের অসুরদের শাস্তি দিতে..."

"আমি যে জানতাম তুমি পারবে।",পালককে জড়িয়ে ধরে সায়ক,"তুমি যে আমার সত্যিকারের মহামায়া। যেমন এই সংসারকে আগলে রেখেছো, ঠিক তেমনি আগলে রেখেছো নিজের সন্তানকে , আবার সেই তুমিই সমাজের অসুরদের বিনাশ গোটাচ্ছ। তুমি কে আমার গর্ব , আমাদের গর্ব। তুমিই যে বাস্তবের মহামায়া...."


                *সমাপ্ত*


Rate this content
Log in

Similar bengali poem from Inspirational