Unlock solutions to your love life challenges, from choosing the right partner to navigating deception and loneliness, with the book "Lust Love & Liberation ". Click here to get your copy!
Unlock solutions to your love life challenges, from choosing the right partner to navigating deception and loneliness, with the book "Lust Love & Liberation ". Click here to get your copy!

Sanghamitra Roychowdhury

Drama Tragedy Classics

4.6  

Sanghamitra Roychowdhury

Drama Tragedy Classics

রক্তের টানে

রক্তের টানে

14 mins
2.0K


আমার দিদির বিয়ে হয়েছে বছর দশেক। জামাইবাবু খুব পণ্ডিত ব্যক্তি। সরকারি কলেজের অধ্যাপক। ভাষা ও সাহিত্য পড়ান বোধহয়। আমার অতটা জ্ঞানগম্যি নেই। লেখাপড়ায় চিরকালের অগা আমি। আমার মাথায় মুগুর বা হাতুড়ি দিয়ে পেটালেও দু-এক লাইনের একটা ছড়াও আমার শৈশবের স্মৃতি থেকে বেরিয়ে আসতে পারবে না। আমার নিরেট মাথার জটিল গোলোকধাঁধাঁয় লেখাপড়া বিষয়ক বস্তু বেমালুম পথ হারিয়ে ফেলে। যেহেতু আমাদের দেশের সরকারি ইস্কুলে একবার ক্লাস ওয়ানে ভর্তি হয়ে যেতে পারলে ক্লাস এইট পর্যন্ত আপনাআপনিই উঠে যেতে পারা যায়, সেই হেতু আমিও দিব্যি পেছনে কোনো ঠেকনা ছাড়াই উঠে গিয়েছিলাম। নইলে বোধহয় স্বয়ং সরকার বাহাদুরেরও ক্ষমতা ছিলো না আমাকে পাশ করায় বা ফেল করায়। এইটা অবশ্য আমার দিদির কথা। আমার থেকে দশ বছরের বড়ো দিদি বলতো, "ফেল করতেও একটা যোগ্যতা লাগে। কিছু লিখে আসতে হয় পরীক্ষায়। ভুল লিখলে তবেই পরীক্ষক নম্বর কেটেকুটে ফেল করান। আর তুই? তুই তো সাদা খাতা জমা দিয়ে আসিস। কিছু লিখলে তবে না ঠিক বা ভুলের প্রশ্ন!" দিদির কথা শুনে আমি মাথা নীচু করে পায়ের বুড়ো আঙুল মেঝেতে ঘষি, ঠিকই তো বলছে, একটা অক্ষরও বানিয়ে বা বাড়িয়ে বলছে না তো। আমি কিছু মনে করে লিখতেই পারি না। কিন্তু তাই বলে আমি পড়ি না তেমন নয় কিন্তু। দু'বেলা মন দিয়েই পড়ি। পড়তে যে খুব খারাপ লাগে তেমনও নয়। তবু ঐ যে! পরীক্ষার সময় আমার কিচ্ছু মনে পড়ে না। একটা, দুটো, তিনটে... করে সবগুলো ঘন্টা বেজে যায়। সময় পার হয়ে যায়। একসময় দিদিমণি এসে আমার খাতা ফেরত নিয়ে নেন। সবাইয়ের শেষে। অন্যদের খাতা নেবার সময় দিদিমণি বারবার আমার দিকে তাকান... যেন ঐ দু-পাঁচ মিনিট সময়েই আমি তিন ঘন্টায় লেখার সব কিছু লিখে ফেলতে পারবো। অবশেষে দিদিমণি আমার সামনে এসে হতাশাব্যঞ্জক ভাবে দুদিকে মাথা নেড়ে আমার সামনে থেকে তিন ঘন্টায় শুধুমাত্র আমার নাম লেখা খাতাটি ফেরত নিতে নিতে বিড়বিড় করেন, "ওই দিদির এই বোন!" হ্যাঁ, ঠিক তাই। আমার দিদিও এই ইস্কুলেই পড়েছে। সব ক্লাসে ফার্স্ট। কখনো সেকেন্ড হয়নি।


দিদি আমার থেকে অনেকটাই বড়ো তো... সবদিকে। কী বয়সে, কী লেখাপড়ায় ও যোগ্যতায়। তাই দিদি অনেক লেখাপড়াও করেছিলো। কলকাতার কলেজে বিশ্ববিদ্যালয়ে। আমি ছাই অতশত জানি না বুঝি না। সকলের মুখে মুখে যা শুনি সেই মতোই বলি। কলকাতায় পড়বার সময় দিদি হস্টেলে থাকতো। ছুটিছাটায় আমাদের বর্ধমানের গ্রামের বাড়িতে আসতো। তখন অবশ্য আমি যথেষ্টই ছোট ছিলাম। দিদির বন্ধুরাও আসতো দিদির সাথে। সেবার দিদির অনেকজন বন্ধু এসেছিলো আমাদের বাড়িতে। তারমধ্যে আমার জামাইবাবুও ছিলেন। তখন অবশ্য তিনি দিদির সহপাঠী। বাকিদের সঙ্গে দিদির কথাবার্তার ধরণ আর তাঁর সঙ্গে কথাবার্তার ধরণ দেখেই আমার একটু অন্যরকম মনে হয়েছিলো। তবে আমি মুখ ফুটে কাউকে কিছু বলবো, তাও আবার দিদির নামে? তেমন সাহস আমার ছিলো না। তারপর দিদি আবার কলকাতায় ফিরে গেলো বন্ধুদের সঙ্গে। সরকারি বদান্যতায় তখন আমিও ক্লাস এইট শেষ করেছি। তবে ক্লাস নাইনের গণ্ডীতে এসে আমি আটকে গেলাম। তিন বছরেও সেই আটক থেকে মুক্তির সুরাহা হলো না দেখে বাবা মা আমার বিড়ম্বনা আর মোটেই বাড়াতে চাইলেন না। বই খাতাপত্র কোনোক্রমে দিদির ঘরের কোণ বরাবর তাকস্থ করে মহা উৎসাহে আমি মায়ের সাথে গৃহকর্মে নিপুণা হয়ে ওঠার তালিম নিতে শুরু করে দিলাম। সেবার দিদি ফিরলো বাড়ীতে বেশ অনেকদিন পরে। একটু যেন বেশিই গম্ভীর। ফিরেই একচোট বকাবকি করলো মা বাবাকে, তারপর আমাকে, "অন্ততপক্ষে উচ্চ মাধ্যমিকটা পর্যন্ত তো পড়া উচিৎ ছিলো!" হয়তো উচিৎ ছিলো। অতকিছু ভাববার ক্ষমতা আমার ছিলো না। আমার ভালো মন্দের ভাবনার জন্য তো দিদি বাবা মা রয়েছেন।


আমি আবার ঘোড়াড্ডিম কী ভাববো? ভাবতে ভাবতে আমি দিদির জন্য আদা-চা আর চিঁড়ে-বাদাম ভাজা করে নিয়ে আসতে আসতেই শুনতে পেলাম দিদির সঙ্গে বাবা মায়ের তুমুল তর্কাতর্কি। বড্ড অপ্রস্তুত হলাম আমি। আমার জন্য বাড়ীতে আজ কী অশান্তি! এতোদিন পরে দিদি এসেছে। তাও বাবা মা দিদির সঙ্গে অশান্তি করছেন... তাও আবার আমাকে ঘিরে। রান্নাঘরের দিকে ফিরে যেতে গিয়ে আমি থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম বাবার চিৎকারে, "হ্যাঁ হ্যাঁ, যাও। যাও বিয়ে করে নিজের মতো নিজে থাকো গিয়ে। আমাদেরকে আর নিজের মুখ দেখাতে এসো না। তোমার কোনো মান-সম্মান বোধ নেই? তুমি জানো, তোমার বিয়ের কথা পাড়তে ওদের বাড়ীতে গিয়ে কত অপমানিত হয়েছি আমি? আমরা ব্রাহ্মণ নই বলে পুত্রবধূর মর্যাদা তুমি ওবাড়িতে পাবে না, একথা ওনারা স্পষ্ট জানিয়ে দিয়েছেন।" বাবার কথার উত্তরে দিদি আর কিছু বলেনি। শুধু কাঁদতে কাঁদতে এক কাপড়ে বেরিয়ে গিয়েছিলো বাড়ী ছেড়ে, একঢোঁক জল পর্যন্ত না খেয়ে। আমি "দিদি দিদি" করে ছুটে গিয়েছিলাম খানিকটা দিদির পিছন পিছন। দিদি দাঁড়িয়ে পড়েছিলো। তারপর আমার মাথায় হাত বুলিয়ে বলেছিলো, "বাবা মা'কে দেখে রাখিস। আর কোনো দরকার হলে আমাকে জানাস।" বলেই ব্যাগ থেকে বার করে আমার হাতে একটা কাগজের টুকরো গুঁজে দিয়েছিলো। তাতে একটা ঠিকানা লেখা। দিদির যেখানে থাকার কথা হয়তো। অত বুঝিনি আমি। তারপর আর এক মুহূর্তও দাঁড়ায়নি দিদি। প্রায় ছুটতে ছুটতে চলে গিয়েছিলো।


দিদি ওভাবে চলে যাবার পরে আমাদের বাড়ীতে আর দিদির নামও উচ্চারণ হতো না। বাবা মাও খুব মুষড়ে পড়েছিলেন। এভাবেই দশটা দীর্ঘ বছর পার হয়ে গিয়েছিলো। তারপর বাড়ীতে আমার বিয়ের জন্য দেখাশোনা শুরু হলো। সব পাত্রপক্ষেরই ঐ একই কথা, "আজকালকার দিনে উচ্চ মাধ্যমিকটাও পাশ নয়!" বাবা মায়ের কোনো যুক্তি খাটেনি, গৃহকর্মে নিপুণা হলেই আজকালকার বাজারে বিয়ের গেরোয় বাঁধা পড়া যায় না। চলতি বছরের গোড়ায় আমি দিদিকে একটা চিঠি লিখেছিলাম। দিদির ছোট্ট কাগজের টুকরোয় লিখে দিয়ে যাওয়া ঠিকানা দেখে। দিদিও উত্তর দিয়েছিলো, তবে আমার কথা মতো পাড়ায় দিদির বন্ধু পদ্মদির ঠিকানায়। তবে তাতে সবটাই কুশল বিনিময় আর কথার কথা। তার বেশি কিছু নয়। আর দেখা করার কথা তো হয়ইনি। তারপর আবার নিস্তরঙ্গ জীবন।


সময় বয়ে গেছে আমাদের গ্রামের কোল দিয়ে বয়ে চলা দামোদর নদের জলের মতো। দামোদর নদ বড় খামখেয়ালিপনায় চলে। বুকে কখনো কষ্টেসৃষ্টে হাঁটুজল, আবার কখনো গলা জলে থৈ মেলে না। শীতে গ্রীষ্মে শীর্ণকায় রুগ্ন বালকের মতো দামোদর, কোনোক্রমে তার খাতে সামান্য জলরেখায় শুধু বেঁচে থাকার আভাস মাত্র। আর সেই দামোদরই বর্ষায় বীভৎস দামাল, সদ্য যৌবনপ্রাপ্ত উদ্ধত তরুণের মতো, তর্জনে-গর্জনে সব ভেঙেচুরে ধুয়েমুছে দেওয়ার ক্ষমতা প্রকাশের হুঙ্কার। তখন দু'পাড়ের অগণিত গ্রামবাসী বুকে হাত ছুঁইয়ে কেবলমাত্র প্রার্থণা করা ছাড়া আর কিচ্ছু করতে পারে না। এবারে দামোদরের খামখেয়ালি স্বভাব বিপদসীমা অতিক্রম করলো। ভরা ভাদ্রের বর্ষণমুখর এক কালো রাতে দামোদর ফুলেফেঁপে ফুঁসে উঠলো। কয়েকঘন্টায় দামোদরের পাড়ে ঘেঁষা আমাদের শান্ত শীতল ছায়া সুনিবিড় বর্ধিষ্ণু গ্রামখানি ধুয়েমুছে সাফ। ঘরবাড়ি, পোষ্য প্রাণীসমেত মানুষজন, সব যে কোথায় তলিয়ে গেলো, তা রাতের মুষলধারায় বৃষ্টিস্নাত ঝাপসা অন্ধকারে কেউ ঠাহর করে উঠতে পারলো না। মাথার ভেতরে কুয়াশার মধ্যে মিশে থাকা ফিনফিনে শিশিরের সরের মতো অনুভূতি নিয়ে আমার জ্ঞান যখন ফিরলো, আবছা আবছা মনে পড়লো... বাবা মা গোয়ালঘরে ঢুকে লন্ঠন হাতে বাঁধা গোরু বাছুর ছাগল মোষগুলির দড়ি খুলছিলেন। মা চেঁচিয়ে আমাকে বলেছিলেন, "খুকু, ঠাকুরঘর থেকে গোপালকে বুকে করে বেরিয়ে আয়। ঘর পড়ে যাচ্ছে..."! ঘুটঘুটে অন্ধকার। দূরে দূরে মানুষের ভয়ার্ত আর্তনাদ ভেঙে চুরচুর হয়ে যাচ্ছে পাগলা বৃষ্টির ক্রুদ্ধ দমকে। আমি গোপালকে বুকে করে দাওয়ায় নামতেই বিকট আওয়াজ, গোয়ালঘর হুড়মুড় করে ভেঙে ভেসে চলে যাচ্ছে সব সমেত... গোরু বাছুর মোষ ছাগল বাবা মা... সব সমেত। চিৎকার করেছিলাম কিনা তা আমার মনে পড়ছে না। শুধু মনে পড়ছে... কেউ আমাকে পিছন থেকে প্রবল জোরে ধাক্কা মারলো। তারপর আমি লাট খেতে খেতে উল্টেপাল্টে হাবুডুবু খেতে খেতে গিয়ে আটকে গেলাম কোথাও একটা। তারপর কী হয়েছিলো আর মনে পড়েনি। দিদি আমার পাশে বসে বসে মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছে দেখলাম। অচেনা একটা জায়গা। পাশাপাশি সরু সরু খাটে অনেক মানুষ শোয়ানো। আমার সাদামাটা নিরেট বুদ্ধিতেও বুঝলাম, সেটা হাসপাতাল, সিনেমায় অমন দেখেছিলাম একবার। দিদির গাল বেয়ে নামা জলের ধারা শুকিয়ে একটা অমসৃণ দাগ রেখে গেছে দিদির হনুওঠা গালে। ম্লান হাসতে চাইলাম, পারলাম না। দিদিকে দেখে কোথা থেকে কীকরে যেন ভাদুরে দামোদরের সব জল আমার চোখে এসে জমেই গড়াতে শুরু করলো। দিদিও কাঁদে, আমিও কাঁদি।


আটদিন হবে মনে হয়। কী জানি, দিন তারিখের সব হিসেব গুলিয়ে গিয়েছিলো। দিদি খবরের কাগজে আমাদের গ্রাম ভেসে যাওয়ার কথা পড়ে ছুটে এসেছিলো। রক্তের টানে। বাবা মায়ের পচাগলা মৃতদেহ শনাক্ত হয়েছিলো, দিদিই করেছিলো। পুলিশ দিদির হাতেই মৃতদেহ তুলে দিয়েছিলো। তখনো আমার খোঁজ পায়নি দিদি। পাগলের মতো খুঁজে চলেছিলো। নিশ্চিহ্ন হয়ে যাওয়া একটা জনপদের বেঁচেবর্তে যাওয়া হতভাগ্য মানুষগুলির মধ্যে আমিও একজন হয়ে সরকারি উদ্ধারকারী দলের সাহায্যে হাসপাতালে এসে পৌঁছেছিলাম, অচৈতন্য অবস্থায়। দিদি বাবা মায়ের সৎকার করেছিলো, আরতো কেউ ছিলো না, পুলিশ আর সরকারি ডিজ্যাস্টার ম্যানেজমেন্টের লোকজন ছাড়া। আমি একটু সুস্থ হতে শুনেছিলাম দিদির মুখেই। আমার গলার কাছটায় কী একটা দলা পাকিয়ে উঠেছিলো। কিছুতেই আমি বলতে পারিনি যে দিদি বাড়ি ছেড়ে গিয়ে বাবা মায়ের অমতে বিয়ে করার তিনদিনের মাথায় বাবা মা দিদির শ্রাদ্ধশান্তি করে নিয়েছিলেন... "আমাদের বড়ো মেয়ে টুকু আমাদের কাছে মৃত, এই কথা বলে।" এই কথাটা দিদি কোথাও থেকে কোনোভাবে জেনেছিলো কিনা আমি জানি না। তবে আমি বলিনি দিদিকে কিচ্ছু, এমনকি চিঠিতেও না।


আমি একটু সুস্থ হয়ে উঠে দাঁড়াতেই দিদি আমাকে সঙ্গে নিয়ে নিজের কলকাতার বাড়িতে এলো। নিজের বাড়ি বলা ভুল। ভাড়া বাড়ি। পুরোনো আমলের বাড়ি। নীচের তলায় সামনের দিকে আরো দুই-একটা আলাদা পরিবার থাকে মনে হয়। দিদি বলেনি। আমিও জিজ্ঞাসা করিনি। সাহস হয়নি। দিদি কত শিক্ষিত। জামাইবাবু আরো শিক্ষিত। আমার বোকা বোকা প্রশ্ন শুনলে ওরা হয়তো খারাপ ভাববে। আমি চুপচাপ চারধারটা দু'চোখ মেলে জরিপ করি। দিদির বাড়ির আশেপাশে ঘেঁষাঘেঁষি আরো কয়েকটা স্যাঁতসেঁতে বাড়ি আছে। আমাদের গ্রামের মতো খোলামেলা নয়। আমি আগে কখনো কলকাতা দেখিনি। আমার কেমন দমবন্ধ লাগে। কিন্তু দিদি তো এতো বছর আছে এখানেই। দিদি সেদিন আমার লম্বা চুলগুলো ভালো করে বেঁধে দিতে দিতে বলেছিলো, "আমার একটা চাকরি খুব দরকার, বুঝলি খুকু? তোর জন্য।" আমি বুঝতে পারিনি দিদি কী বলতে চায়। বা কেন বলছে। দিদির ভাড়াবাড়ির ছাদে দাঁড়ালে পাশের দুটো একতলা বাড়ির ন্যাড়া ছাদের মাথা টপকে খানিক দূরে অলস অজগরের মতো পড়ে থাকা রাস্তাটা দেখা যায়। দিনভর গিজগিজে ভিড়। মানুষ আর গাড়ির। রাত বাড়লে মাঝেমধ্যে ছিটকে আসা আলো জ্বেলে হুশ-হাশ করে দু-চারটে গাড়ি যাতায়াত করে। তবে সেটা ঐ হাতে গোনা, ধর্তব্যের মধ্যে নয়। এই রাতটুকুই একটু কম খারাপ লাগে আমার। তবে দিদিকে বলি না, বুঝতেই দিই না যে কলকাতায় আমার ভালো লাগছে না। দিদি কষ্ট পায় যদি।


জামাইবাবু খুব বিদ্বান, পণ্ডিত মানুষ তো! সরকারি কলেজে পড়ান। তাঁর সামনে আমি জড়সড় হয়েই থাকি। তবে জামাইবাবু আমাকে অনেক কিছু বলেন।কত ভারি ভারি কথা। সেসব আমি আগে কখনো শুনিনি। বোবা দৃষ্টি মেলে শুনে যাই দুর্বোধ্য কথাগুলো। একদিন খেতে বসে জামাইবাবু বলেন, "খুকু, গীতা পড়েছো? শুনেছো গীতার নাম?" আমি দু'দিকে মাথা নাড়ি। তবে আমি নিজেও জানি এই মাথা নাড়ায় কেউ বুঝবেই না আমি কী বলতে চাই। দিদি আমার পাতে আরেকখানা রুটি দিয়ে হাতায় করে জামাইবাবুর পাতে খানিকটা তরকারি তুলে দিচ্ছিলো। দিদির চোয়াল শক্ত। চোখে রাগ। আমি বুঝলাম যে আমাকে নিয়ে ঠাট্টাটা দিদির বোধহয় পছন্দ নয়। তবে জামাইবাবু থামেননি। বলেই চলেছেন, "গীতায় অনেক কথা লেখা আছে। আসলে সেসব জীবনদর্শন।" হাঁড়িকাঠে গলা রাখা পশুর মতো আমি তাকিয়ে আছি। করুণা ভিক্ষা করছিলাম আমি, দিদিও চুপচাপ দাঁড়িয়ে, জামাইবাবু বলছেন, 

"কা তব কান্তা কস্তে পুত্র সংসারোহয়মতীববিচিত্রঃ

কস‍্যঃ ত্বং বা কুতঃ আয়াতঃ তত্ত্বং চিন্তয় তদিদং ভাতঃ..."! শব্দগুলো আমার মাথায় হাতুড়ির মতো পড়ছিলো... দমাদ্দম, দমাদ্দম, দমাদ্দম! জামাইবাবু আবার শুরু করলেন, "এসব কথার মানে কী জানো খুকু? এর মানে হলো... কে কার পুত্র ? কেইবা কার মাতা? কে কার প্রিয় ? আর কেইবা কার পিতা? এই সংসারে কেইবা কার স্ত্রী? আসলে এই সম্পূর্ণ বিশ্বসংসারের কিছুই তোমার নয়! এমনকি তোমার এই দেহটাও তোমার নয়! মানুষ তার দেহকে আত্মা থেকে আলাদা ভাবে বলেই 'আমার দেহ' 'আমার শরীর' 'আমার সংসার' 'আমার সব' বলে মনে করে। নিজের বলে দাবি করে। আসলে এই 'আমার' আর 'আমি-আমি'র মধ্যেই বিস্তর ফারাক আছে। শরীর আর আত্মায় বিস্তর ব‍্যবধান। আত্মা তো বিনষ্ট হয় না। আত্মা শুধু অবস্থিতি সন্ধান করে শরীরের খাঁচায়। আসলে আত্মা নিরাকার। জলের মতো। যে পাত্রে রাখবে সেই পাত্রের আকার ধারণ করবে।" জামাইবাবুর কথাগুলো আমার কানে ভীমরুলের ঝাঁকের মতো বিনবিন করে ঘুরপাক খাচ্ছে। আমার শরীরটা কেমন করে উঠলো। মাথাটা ঘুরে গেলো। কপালে ঘাম জমছিলো। শরীরটা বাতাস চাইছিলো।


দিদি আমার হাত ধরে নিয়ে গিয়ে চোখে মুখে জলের ঝাপটা দিয়ে দিলো। তারপর ওদের কোণের দিকের ছোট ঘরটার বিছানায় আমাকে শুইয়ে দিলো। আমি আসার পর থেকে দিদিও এঘরেই আমার কাছেই শোয়। আমাকে বুকের কাছে জড়িয়ে নিয়ে। সেই ছোটবেলাকার মতো। আমি শুয়ে শুয়ে কতকিছু ভাবছিলাম, এলোমেলো, যেমন ভাবি আমি। কোনো আগা-মাথা নেই, ল্যাজা-মুড়ো নেই। দিদি ঘরের আলোটা নিভিয়ে দিয়ে গিয়েছিলো। এখনো বোধহয় কাজকর্ম কিছু বাকি আছে। ঘুম জড়িয়ে আসছিলো চোখে। হঠাৎ কাঁচের জিনিস ভাঙার আওয়াজে ঘুম উড়ে গেলো। কী হলো? বোঝবার জন্য দমবন্ধ করে বিছানায় বসে রইলাম। দিদির গলা পেলাম, চাপা হিসহিসে। আমার কেমন ভয় করে উঠলো। দিদির কিছু হয়নি তো? বাবা মায়ের মুখ আর দিদির মুখ কেমন তালগোল পাকিয়ে উঠতে লাগলো আমার চোখে। ভয়ে ভয়ে সন্তর্পণে পা টিপে টিপে এগোলাম।ওদিকের বড়ো ঘরটায় আলো জ্বলছে, বন্ধ দরজার ফাঁক দিয়ে সরু রেখার মতো আলো ঠিকরে বেরোচ্ছে। দরজার সামনে কালো মতো কিছু একটা। আমার হাত পা কাঁপতে লাগলো। গলা শুকিয়ে গেলো। এগিয়ে গেলাম। দিদি বসে আছে মাথায় দু'হাত দিয়ে অসহায়ভাবে। পাশে গিয়ে দিদির কাঁধে হাত ছোঁয়াতেই দিদি তাকালো আমার দিকে। যেন কিছুই হয়নি এমনভাবে বললো, "চল, ঘুমোতে চল।" আমার হাত ধরে দিদি ছোট ঘরে ফিরে এলো। তারপর দরজাটায় ছিটকিনি তুলে আমার পাশে শুতে শুতে বললো, "আমার একটা চাকরি খুব দরকার, বুঝলি খুকু? তোর জন্য।" দিদির কথা আমি ঠিক পরিষ্কার বুঝতে পারি না। জামাইবাবুর কথা তো আরোই কিছুই বুঝি না। কত বড়ো মানুষ উনি! আমি দিদির দিকে কাত হয়ে দিদিকে আঁকড়ে ধরে রইলাম। দিদি ছাড়া তো আমার আর কেউ নেই। কিছু নেই। আমাদের দামোদর পাড়ের বাড়িটাই তো নেই। দিদি আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছিলো। আমি ধীরেধীরে ঘুমিয়ে পড়লাম।

পুজো এসে গেছে মনে হয়। আকাশে কী সুন্দর ধবধবে সাদা পেঁজা তুলোর মতো মেঘ। যখন এমন মেঘ হয়, তখন দামোদরের দু'পাড়, নয়নজোলার খালপাড়, রায় দীঘির পাড় কাশফুলে কাশফুলে সাদা হয়ে যায়। কাশবন বুড়ো মানুষের শনের নুড়ি সাদা চুলের মতো হালকা হাওয়ায় মাথা দোলায়।


কলকাতায় সেসব নেই। বুকটা হুহু করে উঠলো। দিদি বলেছিলো পরেরদিন ভোরে মহালয়া। তাই হবে হয়তো। দিদি কি আর ভুল বলবে? খুব গরম পড়েছে। ভ্যাপসা গরম। গ্রামে তো এইসময় পাতলা কাঁথা গায়ে দিতে হয়। কলকাতায় তো এখনো কোনো গা শিরশিরানি ঠাণ্ডার লেশটুকুও নেই। আমার ঘুম আসছিলো না। দিদির ছেলেপুলে নেই তো, তাই হয়তো এমন মনমরা থাকে সবসময়। দিদি বারান্দার টিমটিমে আলোয় বসে একগাদা পুরোনো জামাকাপড় সেলাই করছিলো। আমার তো কোনো বাড়তি পোশাকও ছিলো না। তাই হয়তো আমার জন্য সেলাই করছে। দিদি মুখ তুলে দেখলোও না। নিজের কাজে ডুবে আছে। আমি ছাদে উঠে গেলাম। দিদির বাড়ির এই ছাদটুকু, আর দিদির স্নেহের পরশটুকু ছাড়া আর কিছুই ভালো লাগে না। ছাদে এসে আলসেয় হাত রেখে চুপ করে দাঁড়িয়ে ছিলাম। অনেকক্ষণ ধরে। ছাদে বেশ ঠাণ্ডা একটা আমেজ। দূরে শুয়ে থাকা প্রকাণ্ড অজগরের মস্ত রাস্তাটার দিকে তাকিয়ে রইলাম। ভালো লাগছিলো দিদির কাছে আছি বলে, আর কান্না পাচ্ছিলো বাবা মায়ের জন্য। কতদিন হয়ে গেলো! পেছনে এসে মনেহয় দিদি দাঁড়ালো। কাঁধে হাতের স্পর্শ। কিন্তু দিদির হাত তো এটা নয়! আমি প্রাণপণে চিৎকার করে উঠলাম। আর সেই অপরিচিত স্পর্শের হাতটায় সর্বশক্তি প্রয়োগ করে কামড়ে ধরলাম। তারপর কী থেকে কী হলো কে জানে? একটা আঁক করে চাপা চিৎকার। তারপর ধমাস করে পতনের আওয়াজ। আমি বুঝতে পারলাম না কী হলো! দিদি আমার মাথাটা নিজের বুকে চেপে ধরলো। ফোঁপাতে ফোঁপাতে বললো, "তুই আমার আমানত খুকু। বাবা মায়ের রেখে যাওয়া আমানত। তোকে রক্ষা করতে না পারলে আমার কৃতকর্মের প্রায়শ্চিত্ত হবে না।"


দিদি আমাকে নিয়ে এসে ছোট ঘরে শুইয়ে দিয়ে বারান্দায় গিয়ে চিৎকার শুরু করলো, "বাবলু, গদাই শিগগিরই এসো।" বাবলু গদাই দিদির বাড়ির নীচের তলায় থাকে। ছুটে আসতেই দিদি কী যেন বললো ওদের। তারপর সবাই দুদ্দাড় করে সিঁড়ি দিয়ে নীচে নেমে গেলো। আমি ভয়ে কাঠ হয়ে শুয়ে রইলাম। সকাল হতে কত দেরি আর? দূরে কোথাও রেডিওতে মহালয়া শুরু হয়েছে, এই সুরটা আমার চেনা। সেই গায়ে কাঁটা দেওয়া কথাগুলো। অনেকক্ষণ ধরে শুনছি, "... যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেণ সংস্থিতা, যা দেবী..."! আস্তে আস্তে মহালয়ার কথাগুলো আমার মাথার কোষে কোষে চারিয়ে যেতে লাগলো, "... যা দেবী সর্বভূতেষু শক্তিরূপেণ সংস্থিতা... যা দেবী..."! আমাদের গ্রামের একচালা দুর্গার মুখটা আস্তে আস্তে দিদির মুখ হয়ে গেলো। আর দুর্গার পায়ের কাছে পড়ে থাকা মহিষাসুরের মুখটা আমার অনেক বিদ্বান পণ্ডিত জামাইবাবুর মুখ হয়ে গেলো। আমি বিছানায় বসে বসে ডাকলাম আস্তে আস্তে, "দিদি, দিদিইইই..."! দিদি ছুটে এলো। দিদির পেছনে পুলিশ। আমি দেওয়ালে ঠেসান দিয়ে বসে ঘাড় বেঁকিয়ে শুনলাম সব। দিদি বলছে, "আমার মানসিক ভারসাম্যহীন বোন। দামোদরের বিধ্বংসী বন্যায় বাবা মাকে চোখের সামনে ভেসে যেতে দেখার পর থেকে ওর আর জ্ঞান বুদ্ধি কাজ করে না।" পুলিশটা মাথার টুপিটা হাতে নিয়ে আফশোষের গলায় বলে, "ওহ্, সরি সরি... ঠিক আছে। আপনি আমাদের দেখান আপনার স্বামীর ঘরটা।" দিদি আঁচলে চোখ মুছে কথা বলতে বলতে ঘর ছেড়ে বারান্দায় বেরিয়ে গেলো, "ইদানিং আমার স্বামীর মদ্যপান বড্ড বেড়ে গিয়েছিলো। এই দেখুন না, রোজ রোজ বোতল ভাঙা, গ্লাস ভাঙা, অশান্তি। কালকেও অশান্তির পরে আমি রাগ করে বোনকে নিয়ে শুয়ে পড়েছিলাম। তারপর মহালয়া শুনবো বলে ভোরে উঠে দেখি এই কাণ্ড। নেশার ঘোরেই ছাদ থেকে ঝাঁপ দিয়ে নীচের বাঁধানো উঠোনে পড়েছে, নাকি টাল সামলাতে না পেরে পড়েছে, তা তো আর আমি দেখিনি। আর ঐ উঠোনটা বাড়ির পেছন দিকে। ওদিকটা বন্ধই থাকে। কেউ থাকে না। আওয়াজ পেলেও কেউ হয়তো খেয়াল করেনি। আমি রেডিও নিতে ওঘরে না গেলে তো আমিও টের পেতাম না যে উনি ঘরে নেই। কী অশান্তিতে পড়লাম বলুন তো!" দিদির কথাগুলো আস্তে আস্তে মিলিয়ে গেলো। পুলিশদের সঙ্গে নীচে নেমে গেছে বোধহয়।

আমার খুব শীত করে উঠলো। আমি কাত হয়ে শুয়ে পড়লাম। যে আমার কোনোদিন সময়মতো কিচ্ছু মনে পড়ে না, সেই আমার মনে পড়লো... গতকাল রাতে আমি দিদিকে বসে সেলাই করতে দেখে ছাদে গেলাম। তখন জামাইবাবু নিজের ঘরের দরজার মুখোমুখি বসে গ্লাসে করে রঙিন তরল কিছু খাচ্ছিলেন। আমি ওদিকে দ্বিতীয়বার তাকাইনি। ছাদে এসে আলসেয় হাত রেখে রাস্তার দিকে তাকিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলাম। তখনই কাঁধের অচেনা স্পর্শ আমার নাইটির গলার ভেতর দিয়ে সাপের মতো কিলবিল করে গুঁড়ি মেরে আমার স্তনের উপরে ঘুরে বেড়াতে লাগলো। আমি প্রাণপণে চিৎকার করলাম। হাতটা কামড়ে ধরলাম। আমার বিদ্বান পণ্ডিত জামাইবাবু আমার কামড় থেকে হাত ছাড়িয়ে আমার মাথাটা জোর করে তুলে ধরে আমার দুই ঠোঁট কামড়ে ধরলেন। আমি ছাড়াতে পারলাম না। গোঁ গোঁ করতে লাগলাম। তারপর নিস্তেজ হয়ে পড়ে যাওয়ার মুহূর্তে দেখলাম আমার দিদি দু'হাতে জোর করে ধাক্কা দিয়ে আমার জামাইবাবুকে ঠেলে ফেলে দিলো। নেশাগ্রস্ত লোক বোধহয় শুধুমাত্র কুকর্ম করতে গায়ের জোর পায়। নইলে দিদি একলা...? আমার বুদ্ধি, আমার স্মৃতি সব কাজ করছে আজ। দিদি নিজেও বোধহয় মুক্তি চাইছিলো ঐ আসুরিক প্রবৃত্তির মানুষটার হাত থেকে। দিদি কখনো আমাকে কিছু বলেনি। কিন্তু আমি দেখেছি দিদির পিঠে, কোমরে, ঘাড়ে রক্ত জমাট বাঁধা কালশিটে দাগ।


ওগুলো দিদির ভালোবেসে বিয়ে করে বাড়ি ছেড়ে চলে এসে গড়ে তোলা নিজস্ব দাম্পত্যের পরস্ব উপহার ছিলো। আমার চোখদুটো ঝাপসা হয়ে উঠলো পুলিশের গাড়ির ফিরে যাওয়ার আওয়াজে। পুলিশ ডেডবডিটা নীচের উঠোন থেকে তুলে নিয়ে চলে গেছে। দিদি ওপরে এসে আমার ঠোঁটের দু'পাশে জামাইবাবুর কামড়ের ক্ষতে ওষুধ লাগাতে লাগাতে বললো, "আমার একটা চাকরি খুব দরকার, বুঝলি খুকু? তোর জন্য।" আমি কিছু বলতে পারি না। চুপ করে থাকি বোবার মতো। শক্তিরূপিণী দিদির বুকে মাথা রেখে শুধু কাঁদতে থাকি... কাঁদতেই থাকি।"



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama