Unlock solutions to your love life challenges, from choosing the right partner to navigating deception and loneliness, with the book "Lust Love & Liberation ". Click here to get your copy!
Unlock solutions to your love life challenges, from choosing the right partner to navigating deception and loneliness, with the book "Lust Love & Liberation ". Click here to get your copy!

Baiduryya Sarkar

Drama

2  

Baiduryya Sarkar

Drama

প্রেমের বাতিল গল্প

প্রেমের বাতিল গল্প

12 mins
899



জুন মাসের মাঝামাঝি এই সময়টা খুব বিরক্তিকর কাটে বিলাসের । তার অবসরকালীন জীবনের অন্যতম আকর্ষণ মায়াময় বিকেলটা । চক্ররেলের প্ল্যাটফর্মে হাঁটাহাটি করে সন্ধেয় কিছুটা গালগপ্পো তেলেভাজা সেরে বাড়ি ফেরে । কিন্তু এই বর্ষায় বেশীরভাগ বিকেল গৃহবন্দী কাটে। ছাতা মাথায় হাঁটা যায় বটে, কিন্তু ওদের সাথে দেখাসাক্ষাৎ না হলে আর কী লাভ ! সময়ের হুড়োহুড়ির চক্করে পড়ে বিলাস খানিকটা স্মার্ট হয়ে উঠলেও ওরা সেই ‘আকাশ এতো মেঘলা, যেয়ো নাতো একলা’র যুগেই পড়ে রয়েছে ।

বিলাসের কর্মজীবন ফুরিয়ে এই একটা মহা সমস্যা হয়েছে – আগের রাতে দেখা বিখ্যাত কোনও সিনেমার কথা কাউকে বলতে না পারলে পেটের ভাত যেন হজম হয় না । পুরনো শহরের স্যাঁতস্যাঁতে একটা বাড়ির দোতলায় বসে দিনের পর দিন বছরের পর বছর গোটা পৃথিবীর সিনেমা নিয়ে একলা মাতামাতি করেই বিলাস জীবনটা কাটিয়ে দিল ।

শুনতে আশ্চর্য লাগলেও হ্যাপি জানতো এটা নিজ্জস সত্যি । তাও লোকটা যে সিনেমা বানায় বা পত্রপত্রিকায় রিভিউ লেখে – সেসব কিছু নয় । হ্যাপি অবশ্য মানে, খারাপভাবে বললে যেটা দাঁড়ায় – বাজার চলতি পত্রিকায় রিভিউ লেখা বা রদ্দি সিনেমা বানানো লোকদের থেকে বিভিন্ন দেশের সিনেমা দেখার ব্যপারে বিলাসবাবু বেশ খানিকটা এগিয়ে ।

লোকটা যৌবনের প্রথমদিকে সিনে ক্লাবের মেম্বার ছিল কিন্তু ক্রমে বুঝেছিল, যে যতই বাতেলা ঝাড়ুক – আনকাট বিদেশি ফিল্মে দেখানো অনাবৃত শরীরের কারণেই সিংহভাগ দর্শক ভিড় করে । পরবর্তীতে ভিসিডি ক্যাসেট আর তারপর সিডি ডিভিডি, প্রতিটা ধাপ বিলাস বেশ নিষ্ঠার সঙ্গে ফলো করেছে। সেসব করতে গিয়ে সামাজিক বা পারিবারিকভাবে যে কর্নার হয়নি তা নয় । কিন্তু কিছু কেয়ার করেনি।

তখন আকাশবাণীতে চাকরি করা লোকের বেশ খাতির ছিল, তার ওপর ফিল্ম লাইনের কেচ্ছা । নারী সুরা ডিভোর্স – পরবর্তী বিয়ে এবং সেটাও না টেঁকা নিয়ে পাড়ায় বেশ গুঞ্জন থাকলেও সামনাসামনি কেউ ঘাঁটাতো না ওকে। লোকজন হয়তো ভেবে দেখেছিল – পাড়ায় পুজোয় চাঁদা বা অনুষ্ঠানে আর্টিস্ট আর মাঝেমধ্যে দু’পাত্তরের সুযোগ যখন পাওয়া যাচ্ছে... কী লাভ ফালতু কিচাইন করে । এটাও ঠিক তখন পাড়ায় দু’চারটে ছেলেছোকরা সমাজের রক্ষক হিসেবে টিকে ছিল ।


আজকাল যে কিছুই নেই – সেতো জানা কথাই । তবে অনেক কিছু পাল্টে গেলেও কিছু কিছু জিনিস যে রয়ে গেছে সেটা ক’দিন আগে সন্ধেতে আবিস্কার করেছিল বিলাসবাবু । পাশের বাড়ির রিন্টুর ছেলেটা যে বেশ লেখাপড়া শিখে দেশবিদেশের সিনেমাটিনেমা দেখতে শুরু করেছে এবং অনুরাগ কাশ্যপের সিনেমার অন্ধকার নিয়ে ওর সাথে রীতিমতো তর্ক জুড়েছে –মনটা বেশ খুশি হয়ে উঠেছিল বিলাসবাবুর ।


পাঁচমাথার মোড়ে ছোট ছোট গুমটি সিডির দোকানগুলোর মধ্যে নিতাইয়ের দোকানে দীর্ঘ কুড়ি বাইশ বছর ধরে যাতায়াত আছে বিলাসের। ছেলেটা ক্যাসেট থেকে শুরু করে সিডি ডিভিডি বেচে জীবন কাটিয়ে দিল। ইরান থেকে জাপান, গোদার থেকে হলিউড, ফেলিনি বার্গম্যান ঋত্বিক, আইজেন্সটাইন থেকে রে ... সারাজীবন এই করেই নিতাই গোঁফ পাকিয়ে ফেলেছে। বিলাস জানে এটা খানিকটা নেশার মতো, সেও কি কিছু পাওয়ার জন্যে সিনেমা দেখছে এতকাল ! নিতাইও তেমন – এই গোটা অঞ্চলের কিছু লোককে সামান্য পঞ্চাশ ষাট টাকার বিনিময়ে একেকটা মাস্টারপিস দেখার সুযোগ করে দিয়েছে । এখানেই হ্যাপিকে সিডির বাঞ্চ থেকে সিডি খুঁজতে দেখে বেশ অবাক হয়েছিল বিলাস ।


হ্যাপি অবশ্য নিতাইদার মুখে বিবরণ শুনে বিলাসবাবুকে চিনেছিল। ও জানতো বিলাসের সম্বন্ধে রটনাগুলো পল্লবিত হয়ে এখন পাড়ায় খানিকটা মিথের আকার নিয়েছে। সাধারণ বুদ্ধিতে হ্যাপি বুঝতে পারতো এসব গল্প শীতের দুপুরে উল বোনার আসরে তৈরী হওয়া রূপকথা । কারণ উনি কারোর গায়ে পড়ে ঘর গেরস্থালি ভাঙার গান গেয়েছেন – পাড়ায় এমন রেকর্ড নেই ।


দু’চারদিন কথাবার্তার পর হ্যাপি বুঝেছিল – এর’ম উঁচু রুচির একটা লোক চারটে প্যাঁচাপেঁচির সাথে কী কথাই বা বলবে ! হ্যাপির মনে হল – মধ্যবিত্ত বাঙালি বলেই লোকটা এরকম অবস্থায় রীতিমতো কোণঠাসা হয়ে পড়ে আছে। মোদ্দা কথা – কোথাও কোনও ইনপুট দিয়ে যেতে পারলো না ।

হ্যাপি বিলাসবাবুকে বলেছিল সে একটা আশ্চর্য সিনেমা বানানোর স্বপ্ন দেখে । অবশ্য কোনও প্লট ফর্ম বা সাবজেক্টের ধারণা ওর মাথায় নেই । তবে এটা জানে, ওর জীবন নিয়ে সিনেমা হলে তার নাম দেবে – ট্রাভেলিং সেলসম্যান । বহু বছর ধরে যার চলাফেরার পথ নিয়ে গবেষণা হয়ে চলেছে এবং চলবে । তাই ও ভেবে রেখেছে এ সিনেমার কোনও পূর্ব প্রস্তুতি নেই।

শুনে বিলাসবাবু হেসে বলেছিলেন – ছবি তোমার হবে না কেন ! জীবনের আলো আর ছায়া সেটাই তো সিনেমা...আর ক্যামেরা তো আমার ঘরেই আছে। স্ক্রিপ্ট প্লটের দরকার নেই... সবটাই অতর্কিতে । যে যার মতো করে কথা বলবে । আমি বলবো, তুমি বলবে, আমার পুরনো বন্ধুরা, তোমার নতুন বন্ধুরা । একটু থেমে চোখটা একটু নাচিয়েছিলেন বিলাসবাবু – তোমার সেই বান্ধবি, আমার হারিয়ে ফেলা সঙ্গিনীরা। সেদিন থেকে হ্যাপি ওনার ইয়ার বন্ধুর মতো হয়ে গেল।


সেদিন রাতে অনেক কথা হয়েছিল - মানুষ তো আর আলাদা কিছু নয়, ইম্প্রেশান মাত্র । সত্যিই তো, আলো আর আঁধার এই দু’টো নিয়েই জীবন। তবে বিলাসবাবু ইদানিং লক্ষ্য করছেন সবজায়গাতেই আলো যেন খানিকটা করে বেড়ে গেছে । শান্তশিষ্ট আঁধার খুঁজে পাওয়াই দায় । উন্নয়নের ধাক্কায় - গলি, তস্য গলি, গঙ্গার ঘাট, অপ্রচলিত পথঘাট, খালপাড়ে পর্যন্ত অনাবশ্যক আলো । বিলাসবাবু হ্যাপিকে বলেন, একটু আঁধার না পেলে মানুষ যন্ত্রণাগুলো জুড়োবে কী করে ! এখন তো আর লোডশেডিংও হয় না । হ্যাপি ভেবে দেখলো, শেষ লোডশেডিং হয়েছিল ন’বছর ছ’মাস তেরো দিন আগে । সেই আঁধারেই সোনালীকে প্রথম চুমু খাওয়া।


হ্যাপি বনগাঁইগাওয়ের লিচু বাগানে তার কৈশোরের প্রেমিকাকে শেষবারের জন্য দেখেছিল । অবিকল সোনালীর মতোই এক সদ্য যুবতী লিচু পাড়ছে, রাস্তার ধারে সেই লিচু বিক্রি হচ্ছে সস্তা দরে । তার আগে ওর সাথে কতবার দেখা হয়েছে – সেই ক্লাস ইলেভেনের ইংলিশ কোচিং ... সেবার সোনালীকে সরস্বতী পুজোর দিন দেখে হ্যাপি বলেছিল, আমাদের পাড়ার প্রতিমার বদলে তোকে নিয়ে গেলে ভালো হতো । অবোধ টিন এজের দংশনের দাগ সবাইকে বইতে হয় । কিন্তু ফেয়ার অ্যান্ড লাভলিতে সম্ভবত সেই বিজ্ঞাপনী জোর আছে যাতে সব দাগ ঢাকা পড়ে যায় । 

তাই সোনালীকে তার যাবতীয় মায়াবী উপস্থিতি নিয়ে হারিয়ে যেতে দেখেছিল হ্যাপি। ততদিনে অবশ্য হ্যাপি তার নিশ্চিত জীবন ছেড়ে ঝাঁপ দিয়েছে ঘোড়সওয়ারের জীবনে । বন্দর থেকে বন্দরে ভেসে বেরানোর জীবনে অনেক পণ্যরূপী নারীকে বিশেষ কোনও মুহূর্তে মায়াবী মনে হয়েছে হ্যাপির । আবার পরের দিন সকালে নতুন গন্তব্যের টানে শয্যাবিলাসের কথা ভুলেও গেছে । হ্যাপির মনে হয়েছিল মানুষের জীবনে বেশ খানিকটা ম্যাজিক । অনেকটা মায়া । সেগুলো সবাই দেখতে চায় না অথবা স্বীকার করতে চায় না ।


বিলাসবাবু ঠিকই বলে, আজকাল বাঙালি সব ব্যাপারেই ক্যাসুয়াল হয়ে গেছে । প্যাশনটাই নেই কোনও ব্যাপারে। পড়াশোনা করে না, খেলাধুলোয় পিছিয়ে পড়েছে, রাজনীতি বা ব্যবসার কথা বাদ দেওয়াই ভালো । এমনকি তেমন ভালো করে প্রেম করতেও পারে না, ঝরনা কলম দিয়ে পাতার পর পাতা প্রাণের মানুষকে চিঠি লিখতে ভুলে গেছে - খালি ফেসবুক করে । ফেসবুক বন্ধ হয়ে গেলে এতগুলো লোক যে কী করবে, কে জানে ! মোবাইল ক্যামেরার হুজ্জুতে আশপাশটা তাকিয়ে দেখার ধৈর্য পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেছে সবাই ।

কথাটা নিজেকে দিয়েই বুঝতে পারে হ্যাপি। সবসময় যেন একটা ছটফটানি বুকের মধ্যে । ঘুমিয়ে না পড়া পর্যন্ত সবসময় একটা ইন্সিক্যুরিটি।  


তবে হ্যাপি খানিকটা বিলাসবাবুর পেছনে লাগার ভঙ্গিতেই বলল, কেন ছেলেমেয়েরা যে এখন রাত জেগে ম্যাসেজ ভিডিও চ্যাট করে ... ব্যাপারটা তো ওই চিঠি লেখার মতোই । শুনে বিলাসবাবু হেসে বলেছিলেন, না ভায়া হল না ... চিঠি আসার অপেক্ষা তার যে মাধুর্য কিংবা মানুষের হাতের ছোঁয়া –পাবে কোথায় ! আমাদের সময় দূরদুরান্তের পেনফ্রেন্ডরা ছিল । তাদের সাথে চিঠির আদানপ্রদানের একটা সংস্কৃতি ছিল । হ্যাপি বলল, বলতে পারেন ফেসবুক সে কাজটা করছে । বিলাসবাবু বললেন, কিন্তু এ যেন বড় তাড়াহুড়োর ব্যাপার হে। কোনও অপেক্ষা নেই, সম্পর্ক ম্যাচুরিটির টাইমটা দিতেও কেউ রাজী নয়। শুনে হ্যাপি দুষ্টুমির হাসি হেসে বলেছিল, তা আপনার তেমন কোনও পেনফ্রেন্ড ছিল নাকি ? ম্যাচিওরড কিছু হয়েছিল ! ছিল মানে... এখনও লিখি । সে বলেছে একশোটা চিঠির পর সে আসবে । হেসে হ্যাপি বলেছিল, শ্রীকৃষ্ণ তো একশো নম্বরেরর পর শিশুপালের মুণ্ডচ্ছেদ করেছিলেন । আর আপনার একশো নম্বরে স্বয়ং রাধিকা আসবেন !

শুনে হাসতে হাসতে বিলাসবাবু বলেছিল, কারো কাছে টেক্সট অ্যাপিলিং, কারো কাছে সুর আবার কারো ছবি । মানুষের মুখে শুধুমাত্র শরীরের অ্যাপিল কথাটা শুনতে খুব জান্তব লাগে । হ্যাপি ভেবে দেখেছিল, সত্যিই তো ওর কাছে সোনালী নয় সোনালীর সাথে কাটানো মুহূর্তের স্মৃতিটাই সবথেকে উত্তেজক একটা ভাবনা। ওর চুপ করে থাকা মুখের দিকে তাকিয়ে, মাথা নাড়িয়ে বিলাসবাবু গেয়ে উঠেছিল – ‘আলগা করো খোপার বাঁধন / দিল ওহি মেরা ফাঁস গায়ি’ ।

সন্ধেয় পাড়ার আশপাশে একজন মাঝবয়েসী লোককে দেখতো হ্যাপি – খানিকটা অদ্ভুতদর্শন । উজ্জ্বল রঙের শেরওয়ানির মতো পাঞ্জাবি বা সিল্কের জামা, ধোপদুরস্ত সাদা প্যান্ট, পালিশ করা সাদা চটির সাথে তার চেহারা বা বয়স ঠিক মানানসই ছিল না । কিন্তু সন্ধেয় পাড়ার মোড়ে বা চায়ের দোকানে লোকটা সেজেগুজে এসে দাঁড়াতো। সবাই যে খুব সমাদর করতো তা নয় – বরং চিমটি কাটা কথাবার্তাই বেশি বলতো লোকে । শুনে কিন্তু সে নিজের খুশিতে ডগমগ হয়ে মিটিমিটি হাসতো । শোনা যেতো কোনও এক মধ্যবয়স্কা নারীর জন্য এত আয়োজন ।

আরেকজন ছিল, এর থেকেও বয়স্ক এবং বিয়ে করতে প্রবল ইচ্ছুক। তার ড্রেস – ঝুল পাঞ্জাবির সাথে ফরসা পায়জামা আর পায়ে কোলাপুরি । লোকেজনদের বলা নানারকম মেয়ের প্রসঙ্গ, বানিয়ে বলা সম্বন্ধ অবলীলায় বিশ্বাস করে লোকটা বেনারসির দরাদরি পর্যন্ত করে ফেলতো ।

এদের থেকেও দুর্দান্ত প্রেমিক ছিল সিন্টুকাকা – রীতিমতো সুপুরুষ, শিক্ষিত, সরকারি চাকরি সত্ত্বেও প্রায়শই নেশায় আচ্ছন্ন এবং বেশ্যাপাড়ায় পড়ে থাকা দুর্ভাগা মানুষ । কারণ তার কৈশোরের প্রেমিকা জীবনে আসেনি সামাজিক ষড়যন্ত্রে । 


হ্যাপি ছোট থেকে এরকম রঙদার লোকজনের সাথে বড় হয়েছে বলে, ভার্চুয়াল জগতের সাজানো সংসারে উৎসাহ পায় না বিশেষ । যেসব লোক সাধারণ মানুষের ভিড় থেকে আলাদা হয়ে বাঁচতে ভালবাসে, হ্যাপি তাদের প্রতি মনোযোগী । ও লক্ষ্য করে দেখেছে – কামনা ব্যাপারটা মানুষকে কখনো প্রবল উদাসীন করে তোলে আবার কখনো প্রবল ভোগী।


বিলাসের যৌবনে সকাল সন্ধে আশপাশের বাড়ি থেকে শাঁখের আওয়াজের সাথে কিশোরি মেয়ের গলা সাধার যে শব্দ ভেসে আসতো আজকাল আর সেসবের বালাই নেই । অথচ কারণে অকারণে প্রচুর অনুষ্ঠান হয় দিকে দিকে। বাড়ির কাছের মঞ্চে সেসব দু’একটা শুনতে গিয়ে পালাবার পথ পায়নি বিলাস। গান জিনিসটাকে যে এত কুৎসিত করে তোলা যায় – না দেখলে বিশ্বাস হতো না । এদের যারা মঞ্চে তুলেছে তারা নিশ্চিত বধির বলেই ধারণা হয়েছিল ওর।


এতদিন আকাশবাণীতে কাজ করে বিলাসের বিলাসের ধারণা হয়েছে – আগে মঞ্চ এতো সুলভ ছিল না । পাড়ার জলসায় হেমন্ত গাইতে এসে সবাইকে সম্মোহিত করে রাখতো । চারটে শিক্ষানবিশ ক্যালব্যাল করে সময় নষ্ট করতো না । এরকম এক অনুষ্ঠানে এসেছিল সিনেমায় সদ্য মুখ দেখানো আরতি । বিলাস তখন এলিজিবেল ব্যাচেলার । বিলাসের শিক্ষিত কথাবার্তা, আকাশবাণীর কানেকশান শুধু নয় – তার মুখে লেগে থাকা উদাসীনতার কারণেও আরতি যেন কীরকম দুর্বল হয়ে গেছিল । একসাথে ঘোরাঘুরি, ক্রমে সম্পর্ক এবং শারীরিক খেলাধুলার পরে নিতান্ত এলেবেলে লোকের মতো বিয়ে । বিয়ের কিছুদিনের মধ্যেই দুজন ভুল বুঝতে পেরেছিল। কেরিয়ারের খাতিরে আরতি সরে গেলেও বিলাস আর লোকসমাজে ফিরতে পারলো না । আশ্রয় নিল দেশবিদেশের সিনেমার আলোছায়ার কাছে এবং ক্রমশ বাস্তব থেকে বিযুক্ত হয়ে যেতে যেতে আত্মীয় বন্ধুদের উপরোধে বিয়ে করলো ওর সাথে একেবারেই বেমানান –এমন একটা মেয়ে অর্চনাকে ।


অর্চনা তখনকার আর পাঁচটা বাঙালি মেয়ের মতো ঘরের কাজ নিয়ে থাকতো এবং বিলাসকে সুখী রাখার যথাসাধ্য চেষ্টা করতো । যদিও বিলাস সে’সবে গা করতো না, আবার আপত্তিও করতো না । নীরব এবং উদাসীন বিলাস ওর অভিমান বুঝতে পারেনি বলেই হয়তো অর্চনা শরীরে বাসা বাঁধা ক্যান্সারের হাতে বিনা চিকিৎসায় আত্মসমর্পণ করেছিল । শেষের দিকটা বড় ভয়ঙ্কর ছিল বিলাসের কাছে । সারাদিনের পর ঘরে ফিরতে তার ভয় করতো, খানিকটা বিরক্তি লাগতো । পাশে মৃত্যু পথযাত্রী মানুষ থাকলে, সে বাঁচা যে কী দুর্বিষহ – উপলব্ধি করেছিল বিলাস। বছর খানেকের মধ্যেই অবশ্য বিলাসকে নিষ্কৃতি দিয়ে অর্চনা তার অল্পবয়সী জীবনের মায়া কাটিয়ে ফেললো । 


এই মেঘলা মাসটাকে অসম্ভব সুন্দর লাগে হ্যাপির । বৃষ্টির পর যে আলোটা দেখা যায় – সেটাই জীবনের সঠিক কালার টোন বলে মনে হয় ওর। ঠিক বলেছ, ভেজা সময়টা শরীর-মন-সেলুলয়েড সব জায়গায় একটা মায়া নিয়ে আসে ... বলতে বলতে বিলাস তার পুরনো ক্যামেরাটা বের করেছিল । হ্যাপির মনে হল – লোকটার সাথে ওর মিলেছে ভালো । বিলাস তখন মহা উৎসাহে ওকে ক্যামেরার খুঁটিনাটি বোঝাচ্ছে । কিন্তু হ্যাপির কোথায় যেন একটা অস্বস্তি লাগছে । একটা খেয়ালের কথা শুনে লোকটা যে সত্যিই এভাবে মেতে উঠবে সেটা ও বুঝতে পারেনি । তবে বিলাস বারবার বলছে ওর বন্ধুদের কথা, ছোটবেলার বান্ধবীর কথা । কিন্তু তারা কোথা থেকেই বা আসবে কিংবা ঠিক কী করবে সেটা নিয়ে বেশ সন্দেহ আছে হ্যাপির মনে । আরেকটা ব্যাপারেও বেশ অস্বস্তি আছে – খেয়ালের ঘোরে সেও তো নিজের বন্ধু বান্ধবীর কথা বলেছে। কিন্তু সবাই তো ব্যস্ত – এর’ম একটা ছেলেমানুষি ব্যাপারে কে আর আসবে ?

হ্যাপি মাঝে একটা অফিস ট্যুরে ব্যস্ত হয়ে পড়লেও বিলাসবাবু কিন্তু সময়মতো ম্যাসেজ করে সব আপডেট দিচ্ছিল। মাঝে একবার উত্তেজিত গলায় বিলাসবাবুর ফোন আসলো – নিতাইয়ের থেকে ডিভিডি কিনতে গিয়ে দু’টো সিনেমার মাষ্টার কপি পেয়ে চুপচাপ নিয়ে চলে এসেছেন । কথাটা শুনতে তেমন কিছু না হলেও নিতাইয়ের সিডি ব্যবসার নিরিখে ব্যাপারটা বেশ গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই মাষ্টার কপিগুলোই তার মূলধন ।

সপ্তাহ শেষে শনিবার বাড়ি ঢোকার আগেই নিতাইয়ের দোকানে পৌঁছে গেছিল হ্যাপি। কী আশ্চর্য ব্যাপার – এর আগে অনেক খুঁজে না পাওয়া ফারাদির ‘দ্য সেলসম্যান’র ডিভিডিটা পেয়ে গেল হ্যাপি । পুরো বাঞ্চটাই কাল্ট সিনেমায় ভর্তি । নিতাইদা বিরক্ত মুখে ওকে বলল, বেশী বাছাবাছি করো না... সব অরিজিনাল কপি । এগুলোর পর আমার থেকে কেউ কোনও ছবি আর পাবে না।

হ্যাপি শুনে খানিকটা চমকে উঠল । কেন ! জিজ্ঞেস করে হ্যাপি বুঝলো খুব বোকার মতো প্রশ্ন করে ফেলেছে । নিতাই খানিকটা রাগী গলায় বলে উঠল, এসব কেনার লোক আর নেই ... বোঝার মতো লোকজনেরা হারিয়ে গেছে। তোমাদের মতো দু’একজন ছাড়া কেউ আসে না এসব ছবির জন্য । ব্যবসা তুলে দেবো এবার...।

শুনে কেমন একটা মনখারাপ ভর করলো হ্যাপির মধ্যে । বুঝতে পারলো –সব পুরনো ছবি, পুরনো কথা, সম্পর্করা এভাবে ক্রমে হারিয়ে যাবে । আর সেইসবের সাথে যুক্ত নিতাইদার মতো, বিলাসবাবুর মতো, ওর মতো লোকজনেরা আশ্রয় নেবে ছবির দেশে।


রবিবার দুপুরে বৃষ্টি মাথায় করে বিলাসবাবুর বাড়ি পৌঁছে অদ্ভুত একটা পরিস্থিতির মধ্যে পড়ল হ্যাপি । ঘরের এক কোণে স্ট্যান্ডের ওপর ক্যামেরা বসানো, সেটা আপন মনে চলছে । একটা আরামকেদারায় হেলান দিয়ে চোখ বুজে শুয়ে আছে বিলাসবাবু, গায়ে বেশ জমকালো দেখতে একটা কাশ্মীরি শাল । আজ যেন বাড়িটাকে আরও শুনশান মনে হচ্ছে । কিন্তু আর সব চরিত্ররা কোথায় ? বিলাসবাবুর বন্ধুদের তো দেখা পাওয়া যাচ্ছে না । হ্যাপিও দু’চারজন বন্ধুকে আসার কথা বলেছিল কিন্তু তাদের উত্তরের ধরণ বিশেষ আশাব্যঞ্জক ছিল না ।

কিছুক্ষণ কেটে যাওয়ার পর চমক ভাঙলো হ্যাপির । বৃষ্টি থেমে একটা আশ্চর্য আলোয় ভরে উঠেছে চারপাশ । হ্যাপির মনে হচ্ছে সে যেন এখানে একটা স্বপ্নের মধ্যে আটকে গেছে । স্ট্যান্ড করা ক্যামেরাটায় চোখ দিয়ে একটা শিহরণ খেলে গেল হ্যাপির শরীরে । কোথাকার দৃশ্য দেখা যাচ্ছে ভিউফাইন্ডার দিয়ে ! লেন্স তো তাক করা আছে বারান্দার দিকে, সেদিকটা তো বেবাক ফাঁকা । হ্যাপি লক্ষ্য করলো পুরনো ছবিরা নড়াচড়া করছে, ধুতি পাঞ্জাবি পরা লোকজনেরা সব বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি করছে ঋত্বিকের ছবির চরিত্রের মতো । মহিলারাও লাজুক ভাবে হাসছে আর সুচিত্রার মতো করে যে চোখ ঘোরানোর চেষ্টা করছে – সেটা বোঝা যাচ্ছে। বিলাসবাবুর ছোকরা বয়সের ছবি চিনতে পারলো হ্যাপি – কাপ্তেন সেজে একটা স্মার্ট মেয়ের হাত ধরে রেললাইন দিয়ে হাঁটছে । মেয়েটার ভঙ্গি দেখে মনে হচ্ছে সে মৃদু স্বরে কোনও গান গাইছে ।

হঠাৎ দরজার কাছে পায়ের শব্দ পেয়ে চমকে উঠে তাকালো হ্যাপি । ছবির জগৎ থেকে যেন একজন নেমে এসেছে । মধ্যবয়স্কা এক নারী, তাঁতের শাড়ি, গোল্ড প্লেটেড চশমা, কাঁধে শান্তিনিকেতনের একটা ব্যাগ... কল্পনা করার মতো সৌন্দর্য । যেন কণিকা বন্দোপাধ্যায়ের মতো গ্রেসফুল চেহারা আর বলার ভঙ্গী। সবমিলিয়ে একটা ঘোর লাগা অবস্থায় বিলাসবাবুকে ডাকলো হ্যাপি । কিন্তু উনি সাড়া দেওয়ার মতো অবস্থায় তখন নেই। চমকে উঠল হ্যাপি । এতক্ষণ এই ক্যামেরা নিয়ে কী করছিল ও ! বিলাসবাবুর কাছে গিয়ে বুঝলো –ব্যাপারটা আর এখন খেলাচ্ছলে ছবি তোলার ব্যাপার নেই । এখন উনি ছবির ভেতর ঢোকার প্রক্রিয়ায় আছেন।

ভদ্রমহিলা ততক্ষণে স্লো মোশানে তার ব্যাগ থেকে বের করে একতাড়া পুরনো চিঠি টেবিলের ওপর নামিয়ে রাখলেন । তারপর দেখেশুনে খানিকটা ক্লান্ত ভঙ্গিতে বললেন, বড্ড দেরী হয়ে গেল আসতে । একটু থেমে বললেন, ও হয়তো এমনটাই চেয়েছিল – ফাইনালি আমি আসি এবং ও আমাকে রিফিউস করুক । মেল ইগো তো ... বড় সহজে কোনও পরাজয় মেনে নিতে পারে না।

লোকটা সিনেমাটা বুঝতো, কিন্তু এভাবে ক্লাইম্যাক্সে এসে যে একটা মোক্ষম প্যাঁচ দেবে – সেটা ধরতে পারেনি হ্যাপি । ওনার চিঠিপত্রের কথাটা নেহাত হাসিঠাট্টার ছলে হলেও সেটা যে এর’ম প্রবল সত্যি, কে আর ভেবেছিল !  

হ্যাপির মনে হল- বিলাসবাবুর বন্ধুবান্ধবী, জেগে থাকা শিহরণ কিংবা ছবির আলোছায়া সবটাই অতীতের স্মৃতি মাত্র।

বাতিল হয়ে যাওয়া সময়কে ধরে রাখাই ছিল ওনার উদ্দেশ্য । তাই ওর বন্ধু বান্ধবীর কল্পিত গল্পগুলোকে সত্যি বলে মনে হতো । পুরনো দিনের ছবি উনি দেখাতে চেয়েছিলেন, সেগুলো কীভাবে যেন তার এই ক্যামেরায় বন্দী হয়ে ছিল । কিন্তু মানুষটা যে এভাবে আত্মধ্বংসের দিকে একপা দু’পা করে এগোচ্ছে বুঝতে পারেনি হ্যাপি ।

  

হ্যাপি বুঝতে পারছিল না – এই বাড়ি থেকে বেরিয়ে কোথায় যাবে ? সেদিন যেন কার কাছে যেন শুনেছিল, সোনালী ডিভোর্স হয়ে ফিরে এসেছে বাপের বাড়িতে। একবার ওদের বাড়ির সেই বাইরের জানলাটা দিয়ে উঁকি মেরে আসবে, নাকি বিলাসবাবুর ছায়ার দেশটাকে ফলো করবে !


হ্যাপি আসলে খুঁজে নিয়ে আসতে চাইছিল তার জীবনের বাতিল গল্পটাকে । 


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama