Unlock solutions to your love life challenges, from choosing the right partner to navigating deception and loneliness, with the book "Lust Love & Liberation ". Click here to get your copy!
Unlock solutions to your love life challenges, from choosing the right partner to navigating deception and loneliness, with the book "Lust Love & Liberation ". Click here to get your copy!

Runa Bandyopadhyay

Classics

2  

Runa Bandyopadhyay

Classics

কর্ণকুন্তীকথা

কর্ণকুন্তীকথা

10 mins
882



বৃষ্টিবিভোর ঠিকানা খোঁজে পাঞ্চালী নামে সে মেঘে


উদোম বৃষ্টিতে ভিজছে উঠোনে পড়ে থাকা হুইল চেয়ারটা। পাঞ্চালীর দৃষ্টিগ্রাহ্যতার সীমায়। জানলার গরাদে মুখ। ফোঁটা ফোঁটা বৃষ্টিবিন্দুর ছিটে চোখের পাতায়। অঝোর বিষাদ। বিষণ্ণতার কূল নেই। কিনারাও। মনের মধ্যে প্রশ্নের ঠেউ, কোথা থেকে উড়ে এসে জুড়ে বসল ছেলেটা? 


-অ বউমণি, ঝুড়ি লিবে নাকি?


সদর দরজা থেকে দুলে বউয়ের হাঁক ভেসে আসে। কিন্তু ঝুড়িউলির বউমণি তখন রান্নাঘরে হাতাখুন্তি নিয়ে হাতাহাতিতে ব্যস্ত। কর্ণের জন্মদিনে হাঁপ ফেলার সময় নেই। এখন কিনা দুলে বউয়ের হাজিরা পড়ল! হাঁড়ি থেকে পায়েসের চাল তুলে টিপে দেখে নিতে নিতে ঝাঁঝিয়ে ওঠে পৃথা –


-মরণ! ঝুড়ি বেচার আর সময় পেল না। যা তো পাঞ্চালী, দুলে বউকে বলে আয় পরে আসতে। 


আমি তখন বেশ ছোটো। একদিন সন্ধের ঠিক মুখটায় মা ফিরে এল মামার বাড়ি থেকে। বৃষ্টিতে চারিদিক থইথই। উঠোনে একহাঁটু কাদা। সদর দরজার উঁচু চৌকাঠ না ডিঙিয়ে মাকে ঘুরে যেতে হল খিড়কির দরজায়। তবু উঠোনের কাদায় আটকে গেল হুইল চেয়ার। বাবা নতুন রোয়াক থেকে নেমে এসে কোলে করে তুলে নিয়ে গেলেন ছেলেটাকে। 


ছেলেটা আসার পর থেকেই মায়ের কোল ছাড়া আমি। ছুটির দুপুরে বাবাযখন খবরের কাগজের এলোমেলো পাতা ওল্টাতো, তখন কতবার প্রশ্ন করেছি,

- ছেলেটা কে বাবা?

- তোর ভাই 

- কিন্তু আমি তো মায়ের একমাত্র মেয়ে


বাবা কাগজ থেকে চোখ তুলে কেমন একটা চোখে চেয়ে থাকতেন আমার মুখে। সে দৃষ্টিতে বিষণ্ণতা না মেদুরতা ঠিক ঠাহর করতে পারতুম না। তারপর নিস্তব্ধতা ভেঙে একসময় বলে উঠতেন,

-বড় হ, আপনিই বুঝবি


কত বছর হলে বড় হওয়া যায়? ষোল পেরিয়ে আমি সতেরোয় পা দিলুম। হিসেবটা পেয়েছিলুম ওবাড়ির কণকজ্যাঠাইমার কাছে। কর্ণ আজ বিশ বছরে পা দিল। ওর বয়সটা প্রতিবছরই বেশ ঘটা করে জানান দেয়। প্রদীপের আলো, ধানদূর্বোর আশীর্বাদ, পায়েসের সুগন্ধ।


তখন আমি বেশ ছোটো। বাড়ির একমাত্র মেয়ে, বাবা মায়ের কোলের কাছে বিছানা। মাঝরাত্তিরে হঠাৎ ঘুম ভেঙে গেল। বাবামায়ের হিসহিস শব্দে গা টা ছমছম করে উঠল,

- রাত্তিরে আর ঢঙ কোরো না তো পৃথা, এসো বলছি

- না, আমার ইচ্ছে নেই

- ইচ্ছেটাও কি সূর্য সঙ্গে নিয়ে গেছে?

- ইচ্ছেটা আমার ব্যক্তিগত আর সূর্য যা নিয়ে গেছে তা ছিল আমাদের দুজনের।  


শব্দধাঁধা আমার বন্ধ চোখের অন্ধকারে খুটখুট খুটখুট। সারা রাত। ইচ্ছে অনিচ্ছের টানাপোড়েনে আজকাল হাঁপ ধরে আসে। 

-------  


টুকরো আকাশ খোঁজে পৃথা নামে সে মেয়ে


বাবা কি আমার সুখের হিসেব কষেছিলেন নাকি খুশির? সুখের সংজ্ঞা তো একরকম নয়। প্রত্যেক মানুষের কাছেই সে তার নিজস্ব সংজ্ঞায়। বাবা কি জানতেন না সূর্যর স্মৃতিটুকু নিয়েই বেঁচে থাকতে পারে তাঁর মেয়ে। নাকি নিজের সম্পত্তির বিলিব্যবস্থার সঙ্গে সঙ্গে আত্মজার বিলিব্যবস্থাও জরুরি মনে করেছিলেন? যতবার জিজ্ঞেস করেছি আমার বিয়ের জন্য এত অস্থির হচ্ছ কেন, ততবারই রোগজর্জর বিছানা থেকে উত্তর এসেছে,


-তোর ভালোর জন্যই করছি রে মা। আমি চোখ বুঁজলেই তোকে তাড়াবার জন্য জ্ঞাতিগুষ্ঠি উঠেপড়ে লাগবে।

-কেন তাড়াবে কেন?

-তবে কি কুমারী মায়ের সন্তানকে বুকে করে আশ্রয় দেবে ভেবেছিস নাকি?

-আমি ওদের আশ্রয় চাইতে যাবোই বা কেন? আমি তো তোমার এই বাড়িতেই থাকতে পারি।


শীর্ণ হাতটা মাথায় আলতো রেখে বলেছিলেন,

-এ সংসারের চলন বুঝতে এখনো অনেক অলিগলি পেরোতে হবে রে মা। 


অলিগলি ধরে অনেকটা পথ। হয়তো সে কানাগলি। তবু আজও কর্ণের চোখে তাকালেই বুকের মধ্যে দ্রিম দ্রিম। 


মনে আছে তোমার সূর্য? তুমি শেষ যেবার পার্টির ডাকে কলকাতা গেলে, যাবার আগে বলেছিলে, 

-পথে যেতে যত অলিগলি পার হবি তার হয়তো অনেকটাই কানাগলি। তবু মনে রাখিস, অন্ধগলির শেষে মিললেও মিলতে পারে টুকরো আকাশ।


কোথায় সেই আকাশ সূর্য? কতদিনে পেরোনো যায় অন্ধগলি? পরিমলের সঙ্গে এতটা পথ। সে পথে পাঞ্চালী। আমার মেয়েকে দেখেছো সূর্য? মেঘের মত বিষণ্ণ চলন। মায়াবী গ্রীবায় ঝুলে থাকে মাটি ভেজা ভেজা স্পর্শ। অথচ চোখের কোণে চিলতে বিষ। কর্ণের চোখদুটো ঠিক তোমার মতো, উজ্জ্বল একঝাঁক পায়রা। এলিয়ে থাকা পা দুটোর দিকে চেয়ে থাকে যখন, হাতের আঙুলগুলো তিরতির করে কাঁপে। মুঠোর মধ্যে জড়ো হয়ে ওঠে একরাশ অভিমান।

---


বিবর্ণ কুয়াশায় একা জাগে কর্ণ নামে সে ছেলে

পাঞ্চালী তোমার চোখে ওটা কি? বিন্দু বিন্দু ঘৃণা না করুণা? আয়নায় নিজেকে কখনো দেখেছ পাঞ্চালী? তোমার বৃষ্টিবিভোর চোখ দুটোয় কেমন বনান্তরের আভাষ। তুমি তো জানলে না, তোমার সঙ্গেই আমার সারা দিনের রোদ্দুরযাপন; তোমার সঙ্গেই আমার সারা রাতের স্বপ্নছুট। তুমি তো জানলে না, তোমার সঙ্গে এই বসবাসে আমার বুকের মধ্যে দেয়াল ভাঙার আওয়াজ ওঠে। কেউ তো কখনো কান পাতলো না। 


-ওষুধটা খেয়ে নে বাবা

-ভালো লাগছে না মা 

-লক্ষ্মী ছেলে, খেয়ে নে 

-তুমি এখনো রোজ রোজ আমাকে ওষুধ খাওয়াও কেন বলতো? তুমি কি ভাবছো ওষুধ খেলে আমি উঠে দাঁড়াব?


পৃথার আঙুলগুলো তিরতির কাঁপে। ঠোঁটের রমণীয়তায় নদীমুখো নৈঃশব্দ্য। চোখের কিনার ঘেঁষে নোনাজল। হুইল চেয়ারের হাতলে ওষুধটা রেখে পালিয়ে যায় পৃথা। 


তোমাকে নিজের চোখে দেখার সৌভাগ্য আমার হয়নি সূর্য। কিন্তু মানুষকি শুধু তার নিজের চোখেই অন্যকে দেখে? ঘুমপাড়ানি গানের মাঝে মা যখন পঙ্‌ক্তিহারা হত, তখন তার ঠোঁটের সীমান্তে ভাঙা ভাঙা নিবিড়ে তোমাকে দেখেছি। তেতে ওঠা দুপুরে মা যখন আমায় হাতপাখার বাতাস করতে করতে থেমে যেত, তখন তার শূন্যদৃষ্টির অকপট নির্জনে তোমাকে দেখেছি। 


কিন্তু ঈর্ষার কোনো পাত্রাপাত্র ভেদ থাকে না সূর্য। যখনই চোখের সামনে ভেসে ওঠে তোমার কাল্পনিক সুস্থ সবল খেলোয়াড় মূর্তিটা তখনই আমি টাল খেয়ে যাই। মনে হয় তুমি ইচ্ছে করে পালিয়েছিলে।


জানো সূর্য, মা সেদিন খুব দুঃখ পেয়েছিল। যদিও আকাশখোঁজা বোকা মেয়েটা কেবলই নিজের দুঃখগুলো সিন্দুকে চাবি দিয়ে রাখতে চায়। হাসির ছটায় দিগন্ত পর্যন্ত ভাসিয়ে দিলেও আত্মজের চোখকে কি ফাঁকি দেওয়া যায়? বলো?


ওহ! তোমাকে তো বলাই হল না দুঃখের ইতিবৃত্তটা। মা আমার মুখে সূর্য শুনতে কিছুতেই রাজি নয়। কিন্তু তোমাকে কীকরে বাবা বলি বলতো? তুমি তো যাওয়ার আগে জেনে যাওনি তোমার ভ্রূণবৃত্তান্ত।  

---


সপ্তদশী শিহরনে পাঞ্চালী নামে সে মেয়ে


কলেজ থেকে ফিরতেই হাক্লান্ত পাঞ্চালী।

-উফ, এ গাঁয়ের রাস্তাগুলো কবে যে একটু ভালো হবে! 


জানলার কাছে দাঁড়িয়ে শাড়ির আঁচল দিয়ে ঘাড় মুছতে মুছতে হঠাৎই পাঞ্চালীর হাত থেমে যায়। মসৃণ ঘাড়ের ওপর আছড়ে পড়ছে একটা দৃষ্টি। পরুষ নয়, কেমন যেন মেদুর এক স্পর্শ। কে? সামনে পিছনে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখে পাঞ্চালী। কেউ নেই। সপ্তদশী শরীর জুড়ে গোপন শিহরন। আমিময় চৈতন্যের ঘরে কীসের যেন উঁকিঝুঁকি। অস্থিরতায় পায় তাকে। পায়ে পায়ে ঘর থেকে বেরিয়ে আসে পাঞ্চালী,

-কে তবে?


অনির্ণেয় বোধের কিনারে ঝোড়ো বাতাসের ঝাপট। নিজেকে উল্টেপাল্টে অকারণনদী হতে থাকে পাঞ্চালী। কোথাও কি দেয়াল ভাঙার শব্দ হচ্ছে? আঁচলের প্রান্তরেখায় গোধূলির বিম্বিত আলো। কে তবে? প্রশ্নের কিনার ধরে অপেক্ষমাণ এক অনির্দিষ্ট বন্দিশ। 


নতুন রকে পা দিয়েই স্থির হয়ে গেল পাঞ্চালী। তখনও জানলার দিকে চেয়ে চুপ করে বসে আছে কর্ণ। হুইল চেয়ারে লতিয়ে থাকা পায়ে বিকেলের নরম আলো। চেয়ারের পাশে ছড়িয়ে থাকা সুঠাম হাতের আঙুলে তিরতিরে কাঁপন। নিরলঙ্কার চোখের তারায় ঘন ছায়া। অল্পফাঁক হয়ে থাকা ঠোঁটে অদ্ভুত নিমজ্জন।  


-পাঞ্চালীইই...


রান্নাঘর থেকে মায়ের অস্থির ডাক আসে। কিন্তু কি যেন বোবায় ধরেছে পাঞ্চালীকে। সাবান আর গামছাটা নিয়ে তাড়াতাড়ি কলতলার দিকে রওনা দেয় সে। দরজা বন্ধ করে একটু একটু করে নিজেকে আবরণমুক্ত করতে গিয়ে কীসের যেন ঘোর লাগে। পোশাকী আবরণের নিচে পিছনে ফেলে আসা গোধূলির ছোঁয়া। স্তনবৃন্তে আলতো হাত রাখে পাঞ্চালী। নিমগ্ন অস্তরাগ। 


-পাঞ্চালীইই... 


ঘোর ভেঙে যায় মায়ের উপুরঝুপুর ডাকে। মাথার ওপর আকাশের ছাদ আর এক চিলতে দরজা নিয়ে কলতলা যাকে রুখতে পারেনা।

-উফ্‌, হাঁকটাকে একটু হাঁফ ফেলতেও দেয় না মা। হাজিরা না দেওয়া অবধি ডেকেই যাবে, ডেকেই যাবে। 


তাড়াতাড়ি কয়েক মগ জল ঢালে খোলা গায়ে। ঠান্ডা জলের ছোঁয়ায় শিউরে ওঠে সমস্ত শরীর। বালতি থেকে অঞ্জলি ভরে জল নিয়ে চোখে মুখে ছেটাতে গিয়ে আবারও থমকে যায় পাঞ্চালী, 

-ও কি? কার চোখ? 


জলের মধ্যে যেন আবছা ছায়া। টলটল করছে। চমকে চোখ তোলে ওপরদিকে। খোলা আকাশে কেবল ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘেদের গা ঘেঁষাঘেঁষি আর তারই কোল জুড়ে একমুঠো আবিরের নেশা। 

---


অরন্ধনে আরব্ধ পৃথা নামে সে মেয়ে


কলেজে পা দিয়ে অবধি সাপের পাঁচ পা দেখেছে মেয়ে। এত যে ডাকছি কোনো গ্রাহ্যি আছে!হালুয়ার সুজিটা কড়ায় লাল করে ভাজতে ভাজতে পৃথা। কপালে লেপটে থাকা চুলে জড়িয়ে গেছে বিন্দু বিন্দু ক্লান্তি।  

-ডাকছ কেন? 


মেয়ের দিকে ব্যস্ত চোখ তুলে তাকিয়ে হঠাৎ কথা হারায় পৃথা। গোলাপী তাঁতের শাড়ি বুকের ধার ঘেঁষে পাড় ভেঙেছে সবজে রঙে। ভেজা চোখের পাতায় ভাসামেঘ। ঠোঁটের কোণে কূলহারানো নেশা। তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে অনেকগুলো বছর পিছনে ফেলে আসা পৃথা। অবাক চোখে তিরতির কাঁপন নামে। 


অধৈর্য্য পাঞ্চালী আবার প্রশ্নে ভাষে,

-ডাকছ কেন বলবে তো?


চমক ভেঙে সম্বিতে ফেরে পৃথা,

-সময় হল? কলেজ থেকে ফিরে কোন রাজ্যের কাজ থাকে শুনি? কখন থেকে ডেকেই যাচ্ছি, সাড়া দেবার নাম নেই?

-ডাকছ কেন বলবে তো?

-কর্ণকে হালুয়াটা দিয়ে এসে নিজেও খেয়ে আমায় উদ্ধার করো

 আমার এখন খেতে- ইচ্ছে নেই

-না খেয়ে খেয়ে তো তাল পাতার সেপাই হয়েছো। শরীর ভাঙলে আর বর জুটবে না, সে খেয়াল আছে?

-না জুটুক গে

-তেজেরও বলিহারি! বাপসোহাগী মেয়ে বলে কি বাপের ঘাড়ে বসেই জীবনটা কাটাবে ভেবেছ?


কয়েকটা মুহূর্ত চুপ করে থাকে পাঞ্চালী। মনে মনে একটা হিসেব কষেনেয়। মায়ের রাগ পঞ্চমে উঠলে সম্বোধনে তুমি আসে। সুতরাং এই মুহূর্তে তর্কে না গিয়ে নিজের হালুয়ার বাটিটা টেনে নেওয়াই ভালো বোধ করে।  


কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ঝেঁঝেঁ ওঠে পৃথা 

-নিজে গিলতে বসে গেলে? ভাইটাকে দিয়ে আসতে বললুম যে?

-তুমি যাও, আমার খিদে পেয়েছে এখন


মেয়েকে খেতে বসতে দেখে পৃথা আবার 

-তবু ভালো। বিয়ের কথায় মেয়ের সুবুদ্ধি হল


মায়ের কথা শুনে ঝটিতি একবার মায়ের মুখে দৃষ্টি ফেরায় পাঞ্চালী। চাপা গর্ব পাতলা ঠোঁটের আশেপাশে।  


পৃথা মনে মনে ভাবে ইস, ঢঙ দেখে আর বাঁচিনে। আমাদের যেন সতেরো কোনোদিন ছিল না? এই বলছে খিদে নেই। আবার পরক্ষণেই এত খিদে পেয়ে গেল যে ভাইকে খেতে দিতে যাবারও সময় নেই!


মেয়ের উল্টোপাল্টা ভাবের রকম দেখে পৃথার অবাক ভাবটা কাটতে চায় না। ব্যাপারটার অবোধ সুবোধ তালের হদিশ খুঁজে মরে। নতুন রকে বইয়ের পাতায় চোখ রেখে বসে থাকা কর্ণকে দেখে আবারও চমক খায় পৃথা। খুব নিমগ্ন চোখ বইয়ের পাতায়। কিন্তু একটা অক্ষরও যে পড়ছে না সেটা এত স্পষ্ট যেকাছে না গিয়েও টের পাওয়া যাচ্ছে। 


ধীরে ধীরে পাশে গিয়ে দাঁড়ায় পৃথা। কিন্তু কর্ণ বই থেকে চোখ তুলে তাকায় না। মা কে দেখলেই ছড়ানো পাদুটোতে যে মৃদু কম্পন ওঠে, সেখানেও আজ নিবিড় স্তব্ধতা। পৃথার মনে হাজারো প্রশ্নের ভিড়, কী হল ছেলের? বইয়ের পাতায় নজর করে দেখে পৃথা। বার্নাড শ’র পিগম্যালিয়ান। নামটা দেখেই বিবশতা নামে। কি যেন সেই সিনেমাটার নাম? ‘মাই ফেয়ার লেডি’ কি? কোন যুগান্তরের গল্পকথা যেন। সেই সেবার কলকাতায় যাওয়া, মেট্রোতে সিনেমা। 


একসময় সূর্য কানের কাছে মুখ এনে বলেছিল, 

-কখনো পিগম্যালিয়ান যদি হাতে পাস পড়ে নিস।


সব আজ স্বপ্ন মনে হয়। নাকি সত্যিই স্বপ্ন? সেদিনও এসব ঘটেনি, আমি কেবল কল্পনাই করেছিলাম? 


একটা বেসুরো দীর্ঘশ্বাসে চোখ তুলে তাকায় কর্ণ। চেয়ারের পাশে মা। হাতে ধরা বাটি। সূর্য পাটে নেমেছে এই কিছুক্ষণ। মায়ের আঁচলে আবছা সন্ধ্যার আভাষ। মেদুর চোখে আলসে বিবশতা। খুব আলতো স্বরে ডাকে কর্ণ,

-মা

-উঁ

-কিছু বলবে?


ছেলের প্রশ্নে সুদূর অতীত থেকে ফিরে আসে পৃথা। কিন্তু স্বরযন্ত্র বিদ্রোহ করে। হালুয়ার বাটিটা নিঃশব্দে কর্ণকে দিয়ে আনমনে ফিরে যায় রান্নাঘরে। 

---


নিঃসঙ্গতার আর এক নাম কর্ণ


তোমার ওই আলতো দীর্ঘশ্বাসে অনেকটা তুমি জড়ানো থাকো। তুমিঅমন করে পালিয়ে গেলে কেন মা? তুমি তো জানো না তোমার রেখে যাওয়া দীর্ঘশ্বাসে জড়িয়ে থাকে পিছনের কিছু বাতাস; যেখানে মুখ ডোবালেই পিছুফেরা ইতিহাস। তবু কি আশ্চর্যভাবে ওই লোকটা তোমার স্বামী! পরিমল। 


জানো মা, বড় অদ্ভুত লাগে মানুষটাকে। চারপাশের এই পৃথিবী থেকে অনেকটাই যেন পৃথক। কারো সামনে কখনো আমার কাছ ঘেঁষে না। আমাকে অবহেলার ভাবটা স্পষ্ট করে তোলে সমস্ত শরীর দিয়ে। অথচ কাছাকাছি যখন কেউ নেই তখন সে আমার কাছে আসে। তোমরা যখন বাড়ি থাকো না, সেইসব মুহূর্তগুলো সে আমাকে দেয়। হুইল চেয়ারের পিছনে দাঁড়িয়ে আমার চুলে বিলি কেটে দিতে দিতে কথা বলে,


-আজ কোন বইটা পড়লে কর্ণ?

-ক্রাইম এন্ড পানিশমেন্ট

-ডস্টয়ভোস্কি ভালো লাগে?

-হুঁ, তবে বাট্রান্ড রাসেল পড়তে বেশি ভালো লাগে

-তুমি ফিলজফিতে এম এ টা করতে পারতে

-পারতাম। কিন্তু স্যার বললেন বাড়িতে বসে ফিলজফির থেকে ইংলিশেই সুবিধে হবে। তাই...

-তোমাকে বাংলা পড়তে দেখি না একদম। ভালো লাগে না?

-রবীন্দ্রনাথ ভালো লাগে

-বই পাও?

-স্যার কিছু কিছু এনে দেন


পরদিন থেকেই লাইব্রেরির রবীন্দ্ররচনাবলী আসতে শুরু করল। একদিনের কথা খুব মনে পড়ে। শীতের দুপুর। তোমরা দুজনে ছাতে গেলে। আর সেই সময় পরিমল এল আমার কাছে। হুইল চেয়ারের হাতলটা ধরে একেবারে সামনে এসে হঠাৎ প্রশ্নটা,

-সারাদিন তোমার খুব একা লাগে, তাই না?


একদম হঠাৎ। প্রশ্নটা শুনে খুব চমকে উঠেছিলাম। খুব পরিচিত প্রশ্ন। তবু ওর চোখের দিকে তাকিয়ে গাটা কেমন শিরশির করে উঠল। নিঝুম চোখে একরাশ নৈঃশব্দ্য উঁকি দিচ্ছে। কী ছিল ওই নৈঃশব্দ্যের ভেতর? ওর চোখে চোখ রেখে সেই প্রথম আমি কথা হারিয়ে ফেলেছিলাম। খুব অসাবধানে দেখে ফেলেছিলাম ওর নিঃসঙ্গতা। একটা পুরো পরিবারের কর্তা হয়েও কী প্রচণ্ড কর্তৃত্বহীনতা। নিঃসঙ্গ অভিমানটুকু যেন আমার সঙ্গে ভাগ করে নিতে চায়।


জানো পাঞ্চালী, সেদিন বিকেলে শেষের কবিতা পড়তে পড়তে হঠাৎ দেখি আকাশটা কালবোশেখির মেঘে সেজে উঠছে। তোমাকে খুব দেখতে ইচ্ছে করছিল, জানো। তুমি কখন কলেজ থেকে ফিরবে সেই আশায় অনেকক্ষণ। প্রচণ্ড ঝড়ের সীমায় তোমাকে অসীম করে দেখতে ইচ্ছে করছিল। তোমার কপালে লেপ্টে থাকা চুলগুলো নিয়ে ঝড়ের এলোমেলো খেলা দেখার দুরন্ত বাসনা নিয়ে আমি অপেক্ষা করছিলাম।


কিন্তু দেখা হল না। তুমি ফেরার আগেই ঝড় উঠল। কালোমেঘের ওপর গজগজ করতে করতে মা এসে আমাকে ঘরে তুলে দিল। সেই বিকেলে কী ভীষণ অন্ধকার ছিল ঘরটা। একটু আলো একটু আকাশ দেখার জন্য আমি হুইল চেয়ারটাকে ঠেলে ঠেলে জানলার কাছে নিয়ে গেলাম। পাগলামিতে মেতে ওঠা আকাশটাকে উঁকি দিয়ে দেখতে চাইছিলাম। 


কিন্তু, কিন্তু পৃথাটা কী ভীষণ হিংসুটে। কিছুতেই আমাকে আকাশ দেখতে দিল না। একটু একটু জলের ঝাট আসতেই দালান থেকে ছুটে এসে জানলাটা বন্ধ করে দিল। আমার দিকে ফিরেও তাকাল না। আপন মনেই গজরাতে গজরাতে এ ঘর ও ঘর করতে লাগল।


জানো পাঞ্চালী, সেই মুহূর্তে কেন যেন মা কে খুব দূরের মানুষ মনে হচ্ছিল। তুমি তখনও বাড়ি ফেরোনি বলে মা অশান্ত হয়ে উঠেছিল। আমি বুঝতে পারছিলাম। অথচ গলার কাছে কি যেন এক কষ্ট দানা বাঁধছিল। অভিমানটা ঠিক কার ওপর ভেবে পাচ্ছিলাম না।    

---


ভাবের ঘরে পাঞ্চালী নামে সে মেয়ে


-এই পাঞ্চালী, কী এত ভাবছিস? 

-কিছু না

- পিকেবির ক্লাসে তোকে কখনো এমন অন্যমনস্ক দেখিনি। কি ব্যাপার বলতো!


কোমল স্বরের কোণ ঘেঁষে ধারালো ঝাঁঝ –

-বললাম তো কিছু হয়নি। তুই একটু চুপ করবি অর্জুন


অর্জুনেরও সতেরোর মন। অভিমান ঘনিয়ে আসে। চুপ করে পাঞ্চালীর পাশে পাশে হাঁটতে থাকে। কিছুক্ষণ পর খুব অস্পষ্ট গলায় পাঞ্চালীর স্বর শোনা যায় –

-ঘৃণা থেকে প্রেম ঠিক কতটা দূরে বলতে পারিস?


মৃদু হাওয়ার টানে ভেসে আসে কথাগুলো। টানটান ছিলা থেকে বেরোনো তিরের মত বিঁধে যায় অর্জুনের বুকে। তবে কি পাঞ্চালী শেষপর্যন্ত... 


-জানিস অর্জুন, চারটে মানুষ চারটে দেয়াল। কোথাও যেন কোনো যোগসূত্র নেই। আমাদের বাড়িটা এমন অদ্ভুত!

-তোর ওই সূতপুত্রকে ঘিরেই বোধহয় মানুষগুলো ঘুরপাক খাচ্ছে। 

-আসলে কি মনে হয় জানিস, কর্ণ নয়, ওর এলানো পা টাই দায়ী 

-কিন্তু আমার মনে হয় ওই এলানো পা টাই মানুষগুলোকে একত্রে ঠাঁই দিয়েছে

মুখ ঘুরিয়ে খুব অদ্ভুত চোখে তাকায় পাঞ্চালী। বহুদিনের একত্র চলাচল তাদের। তবু এমন একটা দৃষ্টির সামনে দাঁড়িয়ে অর্জুনের বুকের ওঠাপড়া স্তব্ধ হয়ে আসে। পাঞ্চালীর হাতটা টেনে নেয় নিজের হাতের মধ্যে

-আমাকে বলবি না তোর কী হয়েছে? 

আস্তে আস্তে নিজের হাতটা ছাড়িয়ে নিয়ে মুখটা নিচু করে হাঁটতে থাকে পাঞ্চালী।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Classics