Unlock solutions to your love life challenges, from choosing the right partner to navigating deception and loneliness, with the book "Lust Love & Liberation ". Click here to get your copy!
Unlock solutions to your love life challenges, from choosing the right partner to navigating deception and loneliness, with the book "Lust Love & Liberation ". Click here to get your copy!

susmIta Saha

Inspirational

0.2  

susmIta Saha

Inspirational

জোড়া দেওয়া খাট

জোড়া দেওয়া খাট

7 mins
1.1K


সকাল ন'টা পয়তাল্লিশে সেকেন্ড পিরিয়ড শেষ হওয়ার ঘন্টা বাজার সঙ্গে সঙ্গে সুচেতা মনেমনে বলে ফেললো-"উফ্ বাঁচা গেলো"। আজ আর একটুও পড়াতে ইচ্ছে করছিলো না ওর। সবাই ভাবে শুধু ছাত্রছাত্রীদেরই বুঝি এরকম হয়...তারা ক্লাস শেষ হওয়ার ঘন্টা বাজার জন্য কান খাড়া করে থাকে, আসল ব্যাপারটা হল শিক্ষক শিক্ষিকাদেরও মাঝেমাঝেই পড়ানো থেকে ছুটি পেতে ইচ্ছে করে।

টানা প্রচণ্ড গরমের পর গতকাল রাতে বেশ খানিক্ষণ সময় ধরে ভারি বৃষ্টি হয়েছে। আজ সকাল থেকে প্রকৃতি অপরূপা। এখন অবশ্য বৃষ্টি নেই...এখন পৃথিবী অনেকটা "মান্না দে"র বিখ্যাত গানের মতো -"সবে যখন আকাশটাতে মেঘ করেছে, ঝড় ওঠেনি বাতাসটাতে ঘোর লেগেছে ...।" এমন দিনে অনেক মানুষের মনেই অনেক রকম ঘোর লাগে। সুচেতার অবশ্য ঠিক ঘোর লাগেনি...বরং বলা যেতে পারে গত দেড় দুবছর ও একটা ঘোরের মধ্যে ছিলো, হঠাৎ যেন সেই ঘোর কাটতে শুরু করেছে...এলোমেলো ঝোড়ো হাওয়া বইছে সুচেতার মনের মধ্যে... ঝড়টা উঠলো সেদিন বিকেলবেলা...সুচেতা যেদিন লেডিস হোস্টেলের লেটারবক্সে "পৌলমী চ্যাটার্জি"নাম লেখা বিদেশী খামটা দেখলো। সুচেতা সেদিন একাই স্কুলে গিয়েছিলো। গত তিনদিন ধরে পৌলমীর শরীরটা বিশেষ ভালো যাচ্ছিলো না বলে সীকলিভে ছিলো ও। তাছাড়াও স্কুলে নূতন প্রিন্সিপাল আসার পর থেকে উঁচু ক্লাসের শিক্ষিকাদের সাথে ম্যানেজমেন্টের কিছু না কিছু ঝামেলা লেগেই রয়েছে। সেজন্যও পৌলমীর মেজাজ ভালো নেই। সুচেতা প্রাইমারী ক্লাসে পড়ায়, মাত্র আটমাস হয়েছে ওর এই স্কুলে। অর্থাৎ চাকরী জীবনের "হানিমুন পিরিয়ড"এখনও চলছে। যার ফলে স্কুল রাজনীতিতে ওর অবস্থানটা এখন কিছুটা নিরাপদ। বিদ্রোহী শিক্ষিকারা ভাবেন-সুচেতার এখনও কনফার্মেশন হয়নি অতএব ওকে দলে টেনে বিপদে ফেলা ঠিক হবেনা। অন্যদিকে ম্যানেজমেন্টও জানে-এইসব নূতন টীচারদের পুরোনো দিদিমনিদের মতো "ঘাঘু"হয়ে উঠতে এখনও দেরি আছে...আরও বেশ কিছুদিন এরা "সেফ"।

যাইহোক সুচেতা এমনিতেই বড় শান্ত, একচোরা নিরীহ ধরণের মানুষ। কোনোদিনই ও কারুর জন্য বিশেষ বিপজ্জনক হয়ে উঠবে -এমন সম্ভাবনা দেখা যায়না । খুব ছোটোবেলায় বাবাকে হারিয়ে ছিলো সুচেতা। ও তখন ক্লাস থ্রীতে পড়তো। ওর নিজের খুব স্পষ্ট মনে নেই, পরে মায়ের কাছে শুনেছে -বাবা যেদিন খাটে শুয়ে শেষবারের মতো চলে গেলো বাড়ি থেকে, ছোট্ট সুচেতা সেদিন হাত নেড়ে "টা টা "ও বলেছিলো বাবাকে। আর সেদিনই সন্ধ্যাবেলা জ্বর এসেছিল সুচেতার। প্রায় মাস দেড়েক সময় লেগেছিল ওর সুস্থ হতে। ও কিন্তু কাঁদতো না। আশ্চর্যর ব্যাপার হল "বকবকম পায়রা" বলে পরিচিত ছিল যে বাচ্চা মেয়েটি, সে একেবারে কথা বন্ধ করে দিয়েছিলো সেই দিন থেকে। সুচেতার শুধু মনে পড়ে-প্রায় দুমাস কামাই করার পরে ও যেদিন প্রথম স্কুলে গেলো, সেদিন ঠিক দুঃখ নয়...ভয়ও নয়, ভীষণ লজ্জা করছিলো বাবা না থাকার জন্য। শিশু বয়সে সঠিক বোঝেনি, তবু বারবার মনে হতো "ওর মাথার ওপরে কোনো ছাদ নেই, ছাতা নেই...সবাই যেন কিরকম কৃপাদৃষ্টিতে তাকায় ওর দিকে "।

ছোট্ট সুচেতার মনে হতো -মায়েরও যেন বড় লজ্জা করছে সবসময়, মা কিরকম কুঁকড়ে গিয়েছে। ওদের আগলে রাখার, রক্ষা করার কেউ নেই। সেই তখন থেকেই ওরা মা-মেয়ে একে অপরের হাত ধরে একলা বাঁচার লড়াই শিখতে শুরু করলো। মা পাড়ার একটা প্রাইমারী স্কুলে পড়াতেন। বাবার দিকে প্রায় কেউই ছিলো না। মামাবাড়ি যে খুব দূরে তা নয়। সেখানে বৃদ্ধা দিদা আর তিন মামামামীর ছেলেপুলে নিয়ে অভাব অনটনের সংসার। বিপদে আপদে মামারাই সবার আগে ছুটে আসেন ঠিকই কিন্তু তার থেকে বেশি কিছু করা তাদের পক্ষেও সম্ভব নয়। এভাবে কেটে গেলো বেশ কয়েকটা বছর। সুচেতা তখন ক্লাস ইলেভেনে পড়ে। ওকে আরও একটু একলা করে দেওয়ার ইচ্ছে হল ওর ভবিতব্যের। ক্যানসার ধরা পরার মাত্র দুমাসের মধ্যে মা চলে গেলো...প্রায় বিনা চিকিৎসায়। এবারও সুচেতা কাঁদেনি, শুধু আরও একটু বেশি চুপচাপ হয়ে গেল ও। যেন কথা বলা প্রায় ভুলেই যাচ্ছে ...। দিদা এসে সঙ্গে থাকতে চেয়েছিলেন। সুচেতা রাজি হয়নি। কি হবে সন্তান-হারানো বৃদ্ধাটিকে শেষ বয়সে নাড়াচাড়া করিয়ে ? প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে দিদাকে হারালে আবার তো সেই একাই থাকতে হবে ওকে। সুচেতা যেন বুঝে গিয়েছিলো "একাকীত্বই ওর নিয়তি"।

কলেজের কাছে একটা লেডিস হোস্টেলে নিজের থাকার ব্যবস্থা করে নিয়েছিল সদ্য কৈশোর পেরোনো একলা মেয়েটি। ট্যুইশনি ও মামাদের আর্থিক সহায়তায়। হায়ার সেকেন্ডারি পাশ করে গ্র্যাজুয়েশন এই হোস্টেলে থেকেই। সেকেন্ড ইয়ারের মাঝামাঝি সময়ে এই হোস্টেলেই আলাপ পৌলমীর সাথে। অবশ্য আলাপ বললে একটু ভুল হবে। বলা যেতে পারে-"পৌলমীর নজরে পড়ে সুচেতা"। খুব পুরোনো উপমা হলেও পৌলমীকে দেখলেই "দমকা ঝোড়ো হাওয়া"র কথা মনে আসে। বিশ্ববিদ্যালয়ের নামী ছাত্রী ছিল পৌলমী। পরিবারের অবস্থাও বেশ স্বচ্ছল এবং কাছেই বাড়ি। শুধু জীবনের তথাকথিত স্বাভাবিক সাধারণ নিয়মগুলো মানতে চায়না পৌলমী...মানতে পারেনা। ও যেন সময়ের থেকে কিছুটা এগোনো...উদ্দাম। কেমিস্ট্রি নিয়ে এম এস সি পাশ করার সাথেসাথে শুধুমাত্র বাড়ির নিরাপত্তায় নিশ্চিন্ত জীবন চায়না বলেই মেয়েটি একটি স্কুলের উঁচু ক্লাসে বিজ্ঞান পড়ানোর কাজ নিয়ে এই লেডিস হোস্টেলে চলে এসেছে। ভবিষ্যতে আরও অনেক কিছু করতে চায় পৌলমী। শুধু সবার আগে বাড়ি থেকে বেরোনো দরকার।

পৌলমীর মেয়ে বন্ধু নেই বললেই চলে। ছেলেবন্ধুদের সাহচর্যেই ও বেশি স্বচ্ছন্দ ও স্বাভাবিক বোধ করে।সারাদিন স্কুলে পড়ানো, বিকেলে সায়েন্স কলেজের কয়েকজন বন্ধু মিলে একটি বিজ্ঞানভিত্তিক ম্যাগাজিন প্রকাশের কাজ ও নিজের ভবিষ্যৎ গবেষণার লেখাপড়া নিয়ে কেটে যায় পৌলমীর। দিনের শেষে যখন ক্লান্তদেহে ফিরে আসে হোস্টেলে তখন ওর অবচেতন মন কামনা করে এক স্নেহমমতা মাখানো লাবণ্যময়ী নারীর সান্নিধ্য। ঠিক যেন পুরুষদের মতো। এইরকমই কোনো এক সন্ধ্যায় হোস্টেলের ডাইনিংরুমে পৌলমীর দৃষ্টি চলে যায় সুচেতার দিকে। স্নিগ্ধ, শান্ত, মায়াবী চোখের মেয়েটি কোণের দিকের টেবিলে একলা বসে রাতের খাওয়া সারছিলো...। উঠে গিয়ে আলাপ জমাতে দেরি করেনি পৌলমী। সুচেতার গভীর একাকীত্ববোধ, শৈশব থেকে জমে ওঠা নিরাপত্তাহীনতার বরফ গলাতে কিছুটা সময় যে লাগেনি তা নয়। কিন্তু পৌলমী যে সত্যিই দমকা ঝোড়ো হাওয়া। মাত্র দুমাসের মধ্যে ও সুতপাকে রাজি করিয়ে নিয়ে এসেছিলো ডরমিটরি থেকে নিজের টুইন শেয়ারিং রুমে রুমমেট হিসেবে।

ততদিনে সুচেতাও পৌলমীর মধ্যে খুঁজে পেয়েছে তার নিরাপত্তাবোধ। সেই ক্লিশে হয়ে যাওয়া কথাগুলোই ফিরে ফিরে আসে...। সুচেতা ঠিক লতার মতো জড়িয়ে ধরে, আঁকড়ে থাকে পৌলমীকে। পৌলমীও উদ্দাম দিনের শেষে নোঙ্গর খুঁজে পায় সুচেতার স্নিগ্ধ ব্যক্তিত্বের ছায়ায়। সুচেতার আজকাল খুব সুন্দর করে সাজতে ইচ্ছে করে...শুধুমাত্র পৌলমী দেখবে বলেই। ওদের হোস্টেলের ঘরের খাট দুটো এখন আর ঘরের দু কোণায় নেই। ওরা সে দুটিকে জোড়া দিয়ে নিয়েছে। অনেক রাত পর্যন্ত জেগে দুই বান্ধবী দুজনের বুকে মুখ গুঁজে মনের সব ভার লাঘব করে । দেখতে দেখতে গ্র্যাজুয়েশন শেষ করেছে সুচেতা। ইতিহাস নিয়ে পড়াশোনা করেছে সে। এরপরে পোস্টগ্র্যাজুয়েশন বা বি এড পড়ার আগে নিজেকে অর্থনৈতিক দিক থেকে আরেকটু গুছিয়ে নেওয়া প্রয়োজন। আজকাল অবশ্য ওর সব চিন্তা ভাগ করে নেওয়ার জন্য পৌলমী সবসময়ই সাহায্যের হাত বাড়িয়ে পাশে থাকে। তারই চেষ্টায় এবং তদ্বিরে একই স্কুলে প্রাইমারী ক্লাসে পড়ানোর কাজটা পেয়েছে সুচেতা।

মনেমনে বড় কৃতজ্ঞ বোধ করে ও পৌলমীর প্রতি। পৌলমী অবশ্য সেসব কথা একবারের জন্যও উচ্চারণ করতে দেয়না। বাবা মাকে হারানোর এতগুলো বছর পরে পৌলমীকে পেয়ে সুচেতার মনটা একটু শান্ত হয়েছে। বড় শান্তি পেয়েছিল ও এই সম্পর্কটার মধ্যে। কিন্তু হঠাৎ সেখানে ঝড় উঠেছে। ঝড়টা উঠলো সেদিন বিকেলে হোস্টেলের লেটারবক্সে পৌলমীর নাম লেখা বিদেশী খামটা দেখে। চিঠিটা সুচেতাই হতে করে পৌঁছে দিয়েছিল পৌলমীর কাছে... গত সাতদিনে পৌলমী চিঠিটার বিষয়ে একটা কথাও বলেনি। কিন্তু হোস্টেলের অন্যান্য মেয়েদের কাছ থেকে সুচেতা জানতে পেরেছে- "বিদেশের নামী বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণার সুযোগ পেয়েছে পৌলমী, সে চলে যাচ্ছে কলকাতা ছেড়ে, দেশ ছেড়ে এবং সুচেতাকে ছেড়ে...। কিছুতেই আজ পড়ানোতে মন বসাতে পারছেনা সুচেতা। থার্ড পিরিয়ডটা ছিল ফ্রী পিরিয়ড। একলা বসে সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে সেটাও শেষ হয়ে গেল। বেল বাজার সঙ্গে সঙ্গে নিজের ক্লাসরুমের দরজায় গিয়ে দাঁড়ালো সুচেতা। ওর ক্লাসের সব বাচ্চারা গিয়েছে গেমস্ পিরিয়ডে খেলার মাঠে। সেখান থেকে ফিরলে তাদের নিয়ে যেতে হবে পাশের ক্লাসরুমে একটি ভিডিও শো দেখাতে।

আজকাল এইধরণের ব্যবস্থা বাচ্চারা খুব উপভোগ করে। সুচেতার সেকশনে একটি বাচ্চার জন্মগত ত্রুটির কারণে একটি পা অপর পা থেকে অনেকটা ছোট। ভালোভাবে হাঁটতে পারেনা ছেলেটি, ওকে বিশেষ রকমের জুতো পড়তে হয়। তার জন্যই ক্লাসরুমের দরজায় এসে দাঁড়ায় সুচেতা। হঠাৎ দেখতে পায় স্কুলের লম্বা করিডোরে জল থাকার জন্য ভীষণ জোরে হোঁচট খেয়ে পড়ে গেলো পেছিয়ে পরা একলা শিশুটি।

কি যে হলো সুচেতার...ও স্থির হয়ে দরজায় দাঁড়িয়েই রইলো মূর্তির মতো। এগিয়ে গিয়ে একটুও সাহায্য করলো না বাচ্চাটিকে। বরং দেখতে থাকলো ক্লাসের অন্য বাচ্চাদের অর্থাৎ বন্ধুদের আচরণ। প্রথমে মনে হলো-আচ্ছা, এখানকার ছোটরা কি একেবারে বড়দের মতো হয়ে গিয়েছে ? কেউ তো এগিয়ে গিয়ে সাহায্য করছেনা বন্ধুকে ...আজকাল ছোটরাও কেউ কারুর জন্য একটুও বিচলিত হয় না ? না, তা নয় । ওই তো একটি ছোট বাচ্চা পেছিয়ে গিয়ে বন্ধুর হাত ধরে তুলে দাঁড় করালো... বড়দের জীবনেও কিন্তু এখনও অন্তত একজন মানুষকে ঠিকই পাওয়া যায় হাত ধরার জন্য...।

সুচেতার মনে পড়ে গেলো পৌলমীর সাথে বন্ধুত্বের প্রথম দিনটার কথা । সাহায্যের হাত তো বাড়িয়ে দিয়েছিলো পৌলমীই ...। কিন্তু বিকৃত অঙ্গের শিশুটির পায়ে বেশ চোট লেগেছে। বন্ধু হাত ধরে তুলে দাঁড় করানো সত্বেও সে কিছুতেই হাঁটতে পারছে না। আর ধৈর্য রাখতে পারছে না অন্য বাচ্চাটি ...দৌড়ে গিয়ে আগে না পৌঁছলে ফার্স্ট বেঞ্চে জায়গা পাওয়া যাবেনা যে ... বন্ধুর হাত ধরে তুলে দাঁড় করালো যে সে আর কত ত্যাগ স্বীকার করতে পারে ? কতই বা মহৎ হওয়া যায় ? পেছিয়ে পরার ভয়ে এবং ফার্স্ট বেঞ্চে জায়গা দখলের জন্য বন্ধুর হাত ছেড়ে দৌড়ে এগিয়ে গেলো সে ও ... "ঠিক বড়দের মতো"-এটাই তো স্বাভাবিক ।

ছোটদের মধ্যে বড়দের জীবনের ছবি দেখতে দেখতে সুচেতা সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো "আজ বিকেলে হোস্টেলে ফিরেই জোড়া দেওয়া খাটদুটোকে ঘরের দুই কোণায় সরিয়ে দেবে ও " তুমি অন্য কারো সঙ্গে বেঁধো ঘর..."


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational