যদি এমন হোত তবে কেমন হোত তুমি
যদি এমন হোত তবে কেমন হোত তুমি
দোল পর্যন্ত এবার মোটামুটি ঠান্ডাই ছিলো। কিন্তু চৈত্র মাসটার শেষের দিকে একেবারে চাঁদি ফাটানো গরম।
বৈশাখ পড়লো কিন্তু আকাশ কালো করে কালবৈশাখী আর হয়না। দু একদিন বিকেলের দিকে মেঘ ঘনাতে দেখে প্রাণে পুলক জাগলেও শেষ অবধি সেই মেঘ বৃষ্টি ঝড়াতে পারল না। ঝড়ও উঠলো না।
সন্ধ্যায় এক পুরানো বন্ধু বাড়িতে এসেছে,দোতলার বারান্দায় বসে একসঙ্গে বসে চা খাচ্ছিয়ার কালবৈশাখী না হওয়ার জন্য হা-হুতাশ করছি। এমন সময় হঠাৎ মায়ের প্রবেশ এবং মন্তব্য, একটু বৃষ্টি হলে ভালোই হয়। কিন্তু ঝড় চাইনা বাপু। গতবারের কথা মনে নেই? ঝড়ের চোটে বিদ্যুৎ তার ছিঁড়ে সে কি অবস্থা হয়েছিল! আড়াই দিন কারেন্ট ছিলো না,পাম্প চালাতে না পারায় জলের জন্য বাড়িতে সে কি হাহাকার, কথাটা বলেই মা একটু হেসে উঠলেন।
যাইহোক, সন্ধ্যায় না হোক কালবৈশাখী দেখা দিলেন বেশ রাতের দিকে। প্রথমে তুমুল ঝড়, তারপর মুষলধারে বৃষ্টি।সেই সঙ্গে ঘন ঘন বাজ। রাত এগারোটা নাগাদ আলোটা দপদপ করলো কিছুক্ষণ তারপরই অন্ধকার। সারারাত আর কারেন্ট এলো না। অন্ধকারের মধ্যেই কানে এলো মায়ের গজগজানি, ঝড় দেখার সাধ মিটলো তো..? তোমাদের আর কি। ফ্রিজে ভর্তি মাছ মাংস দুধ, এখন সব পচে নষ্ট হবে।
মায়ের গজগজানি শুনতে শুনতেই কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছি বুঝতেই পারিনি।
দেরীতে শুলেও খুব সকালেই ঘুমটা ভেঙে গেলো। দু চোখ রগড়াতে রগড়াতে বারান্দায় এসে দাড়াতেই দেখি রাস্তার মোড়ে বেশ কয়েকজনের জটলা। কাল রাতে মুষলধারে বৃষ্টি হওয়ায় প্রতিবারের মতো এবারেও গোটা পাড়া প্রায় জলমগ্ন। জটলা দেখে কৌতূহলবশত আমিও ট্রাউসার টা হাটু পর্যন্ত মুড়িয়ে রাস্তার মোড়ে গেলাম। গিয়ে দেখি প্রায় সবাই নির্বাক দর্শকের ভূমিকায় স্থির দৃষ্টিতে পাড়ার বিদ্যুতের খুঁটিটার দিকে তাকিয়ে আছে।
গতকাল রাতে ঝড় হওয়ায় মেইন খুঁটি থেকে বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে রয়েছে আর এক ব্যক্তি উপরে উঠে কিছু করার চেষ্টা করছেন। এত সকালে বিদ্যুতের দফতরে লোক এসেছে দেখে কম অবাক আমিও হইনি। কিন্তু তা বলে নীচ থেকে সেই ব্যক্তিকে দেখে সবাই নির্বাক মূর্তি হয়ে আছে কেনো বুঝতে পারলাম না। কিছুক্ষণ পর আমি প্রায় ভূত দেখার মতো চমকে উঠলাম যখন সেই ব্যক্তি উপর থেকে মই বেয়ে নীচে নেমে এলেন,
-আরে! ইনি তো আমাদের বিধায়ক জয়দীপ দত্ত। আমাদের পাশের পাড়াতেই থাকেন। আমার মুখের চেহারা দেখে বিধায়ক মৃদু হেসে বললেন, এত অবাক হওয়ার কিছু নেই, ছাত্রজীবনে আমি ইলেক্ট্রিক ইঞ্জিনিয়ারিং নিয়ে পড়েছি। সকলের মুখে তখন শুধুই নিশ্চুপ হাসি। বিধায়ক বললেন, সকালে হাঁটতে বেরিয়েছিলাম, এখানে দেখি বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে রয়েছে। বিদ্যুৎ দফতরের লোক আসার আগে হয়তো আপনাদের অনেক সমস্যা হতে পারে তাই নিজেই উঠে পড়লাম খুঁটির মাথায়। যাই হোক এখন আর কোন অসুবিধে নেই।
বিষয়টি দেখে আমার তো বেশ ভালো লাগছিলো, এও কি সম্ভব, সত্যি!
এর আগে তো ২৪ ঘন্টা পার না হলে বিদ্যুৎ আসার কোন সম্ভাবনাই থাকতো না।
এক হাঁটু জল ভেঙে বাড়ি ফিরে এলাম। স্নান খাওয়া সেড়ে কলেজের জন্য বাড়ি থেকে বের হবো, এমন সময় দেখি- ওমা! রাস্তার জল গেল কোথায়..? এতো তাড়াতাড়ি জল তো সরার কথা নয়। যা জল জমেছে তা তো অন্তত তিনদিনের আগে সরবার নয়। এর রহস্য উদঘাটন হোলো যখন আমি গলিপথ থেকে জাতীয় সড়কে ওঠার কালভার্টে পৌছলাম। দেখি কালভার্টের নীচে সবাই জল সরানোর কাজ করছে। তার মধ্যেই রয়েছেন স্বয়ং আমাদের কাউন্সিলর বিশ্বাস বাবু এবং চেয়ারম্যান দত্ত সাহেব। সত্যিই এই দৃশ্য আমার কাছে অভাবনীয়। ওনারাও বাকিদের মতই জল সরাচ্ছেন হাতে হাতে কাজ করছেন। ওনারা যে আমাদের কথা এতো ভাবেন তা সত্যিই জানা ছিলো না।
এমন সব ব্যতিক্রমী দৃশ্য দেখতে দেখতে আমার কলেজ পৌছতে হয়ে গেলো দেরী।
ক্লাস চলাকালীন 'মে আই কাম ইন' বলে ক্লাসে ঢুকতেই পেছন দিকে কয়েকটি নতুন মুখ চোখে পড়লো। আমার সহপাঠী দেবশ্রীর পাশে গিয়ে বসে ওকে জিজ্ঞেস করলাম,
-এই পেছনদিকে প্রায় চল্লিশোর্ধ্ব ব্যক্তিটি কে রে? আমাদের সঙ্গে নতুন ক্লাস করছে বলে মনে হচ্ছে।
কথা গুলো বলেই মুচকি হাসলাম।
দেবশ্রী আমার দিকে গম্ভীরভাবে তাকিয়ে বললো,
-তুই ওই ভদ্রলোককে চিনিস না?
ঘাড় ঘুরিয়ে আর এক ঝলক দেখেই বললাম,
-কেমন চেনা চেনা লাগছে।
কনুই দিয়ে খোঁচা দিয়ে দেবশ্রী বলল,
-তুই কি সত্যিই ওনাকে চিনতে পারছিস না?
মাথা নাড়িয়ে না জানালাম।
-আরে স্টুপিড, ইনি আমাদের শিক্ষামন্ত্রী।
-মানে? শিক্ষামন্ত্রী মৃন্ময় চক্রবর্তী?
-হু
-কিন্তু উনি এখানে কেন?
এবার থেকে উনি সমস্ত স্কুল কলেজে নিজে গিয়ে শিক্ষাব্যবস্থা খতিয়ে দেখবেন। তাই আজ আমাদের কলেজে এসেছেন।
-ও.....ও
ক্লাস শেষে শিক্ষামন্ত্রী এগিয়ে এসে সকলের সঙ্গে করমর্দন করলেন, আর বললেন শিক্ষাবিষয়ক কোন অসুবিধা হকে টোল ফ্রি নম্বরে জানাতে।
বলেই মৃদু হেসে চলে গেলেন।
আমি মন্ত্রীর চলে যাওয়া পথের দিকে একমনে চেয়ে রইলাম, আর ভাবলাম সত্যিই আমি স্বপ্ন দেখছি না তো? সামাজিক ব্যবস্থা কি এমনটাও হয়...?