উত্তর পশ্চিমের বেঞ্চটা
উত্তর পশ্চিমের বেঞ্চটা
সূর্যাস্তের রক্তিম আভা গায়ে মেখে সারাদিন পরিশ্রমের পর ক্লান্ত শহর, পাখিদের বাসায় ফেরার কলতান শুনতে শুনতে একটু জিরিয়ে নিচ্ছে তখন। সেই শহরের-ই এক ফুটপাথ ধরে বয়সের ভারে কিছুটা হলেও ন্যুব্জ সত্তর-উর্দ্ধ এক দম্পতি হাঁটছেন। কাঁপা কাঁপা হাতে শক্ত করে লাঠি ধরে চলেছেন বৃদ্ধ। ঠিক তেমনভাবে শক্ত করে বৃদ্ধের অপর হাত ধরে আছেন ওনার স্ত্রী। একটা মন্দিরে পুরোহিত মশাই মন্ত্র পড়ছেন। নমস্কার করলেন ওনারা। এই লাঠি, মন্ত্রচারণ, এগুলোই বৃদ্ধ দম্পতির বেঁচে থাকার শক্তি, বেঁচে থাকার ভরসা আজ।
ডাক্তার দেখিয়ে ফিরছেন ওনারা। বেশ কিছু দামী ওষুধের দরকার। চলার ফাঁকে ফাঁকে খানিক বিশ্রামের অবকাশে মধ্যবিত্ত দম্পতির আলোচনায় উঠে আসছে সংসারের অন্য খাতে খরচ কমিয়ে ওষুধের খরচ বাঁচানোর কথা। পশ্চিম আকাশের পড়ন্ত সূর্যের আলো ওনাদের পিঠে তখন আল্পনা আঁকতে ব্যস্ত। আর সামনে ওনাদের দীর্ঘায়িত ছায়া মিলেমিশে একাকার হয়ে রাস্তায় শুয়ে শুয়ে যেন জীবনের কতটা পথ ওনারা একসাথে চলেছেন তারই পরিমাপে ব্যস্ত।
- একটু তাড়াতাড়ি হাঁটবে গো? কালও সিরিয়ালটা দেখা হয়নি। আজও যদি মিস হয়! রাহুল টুম্পার বিয়েটা হয়ে যাচ্ছে আসলে। ওটা দেখতাম।
বৃদ্ধ প্যান্টের পকেট হাতড়িয়ে দেখল কিছু খুচরো দশ কুড়ি টাকার নোট পকেটে রয়েছে।
- চলো রিকশা করে ফিরি।
কয়েক মুহূর্ত ভাবল বৃদ্ধা।
- থাক! কাল সকালে তো তেমন কাজ নেই। রাত এগারোটায় আবার দেখায়। তখন দেখে নেব। চলো এখন। হাঁটতে খুব ভালোই লাগছে।
স্বামীর হাত শক্ত করে ধরলেন উনি। মুখের স্মিত হাসিতে রিকশা ভাড়া বাঁচানোর সিদ্ধান্ত প্রতিফলিত হচ্ছে।
চৌমাথার পার্কটায় শিশুর দল খেলাধুলা করছে। তাদের দুরন্ত চাঞ্চল্যর পাশ দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে দম্পতি থামলেন একটু।
- চলো, একটু বসবে বেঞ্চটায়?
- চলো।
- কি সুন্দর খেলছে দেখো বাচ্ছারা।
- ওদের রঙ্গিন, চনমনে এই জীবনের রস কিছুটা উপভোগ করে নিজেরাও চনমনে থাকাটাই তো এখন আমাদের বেঁচে থাকার মূল উপাদেয়। চলো বসি কিছুক্ষণ বেঞ্চিটায়।
তাদের বড় আপন এই বেঞ্চিটা, বড্ড আপন। তখনও এখানে পার্ক হয়নি। ছোট শিশুদের আনাগোনার চাইতে তরুণ যুবকদের ভিড় বেশি হত। পাশের পু-ঝিকঝিক ট্রেনের শব্দকে হার মানিয়ে “আউউউউট” আর “গোওওওওল” এর গগনভেদী চিৎকারে উচ্ছাসের বহিঃপ্রকাশ ঘটত। এরকম কাঠের ডিজাইনার বেঞ্চ তখন ছিল না। বরং মরচে ধরা, রং ওঠা স্টিলের বেঞ্চেই বসলে মনে হত কোন এক রাজসিংহাসনে বসার সুযোগ পাওয়া গেছে যেন।
বয়সের ভারে ন্যুব্জ আমাদের এই বৃদ্ধ তখন বছর পঁচিশের তরতাজা যুবক, ফুটবল খেলতে আসত মাঠটায়। আর বাড়ি ফেরার সময় কৃষ্ণচূড়া গাছটার তলায় অপেক্ষারত এক তরুণীকে দিয়ে যেত একটুকরো চিরকুট, হয়তো প্রেমপত্র। বেশ কিছুদিন চিরকুটেই কথা হল তাদের, কৃষ্ণচূড়া গাছকে সাক্ষী রেখে। নানান অছিলায় সেই তরুনীও ঠিক বাড়ি থেকে সন্ধ্যেবেলা বেড়িয়ে পরে কৃষ্ণচূড়া গাছটার তলায় রোজ অপেক্ষা করত। একদিন বেশ ঝোড়ো হওয়া বইছে। তরুণী অপেক্ষা করে আছে তার প্রাপ্য চিরকুটের জন্য। কৃষ্ণচূড়া গাছের ফুল, পাতা ঝরে পরছে তরুণীর গায়ে। রাত হয়ে আসছে, তবুও সেই যুবক সাইকেল চালিয়ে খেলার মাঠ থেকে ফিরছে না তো! আর অপেক্ষা করল না তরুণী। চৌমাথার খেলার মাঠে হাজির হল সে। মাঠের উত্তর-পশ্চিম দিকের একটা বেঞ্চে সেই যুবক বসে আছে তখন। একটু দূরের চায়ের দোকান থেকে আসা আবছা আলোয় বোঝা যাচ্ছে ঝুঁকে পরে কি একটা যেন করছে সেই যুবক। পাশে দুজন অফিস ফেরত ভদ্রলোক, ভদ্রমহিলা বসে গল্প করছে নিজেরা। তরুণী কাছে গেল যুবকের। ফুটবল খেলতে গিয়ে চোট লেগেছে, বা পা-টা ফুলে ঢোল। যুবকের কাঁধে হাত রাখে তরুণী। নরম হাতের স্পর্শ পেয়ে যুবক চোখ তুলে তাকায়। অপলক দৃষ্টিতে দুজন দুজনের দিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষন। চাহনির স্নিগ্ধতা নিমেষে যুবকের ব্যাথা ভুলিয়ে দেয়।
- কাকু, একটু সরে বসবেন?
পাশে বসা ভদ্রলোক, ভদ্রমহিলাকে অনুরোধ করে তরুণী। তারপর যুবকের পাশে বসে তার হাতটা শক্ত করে ধরে।
- খুব ব্যাথা করছে?
- তোমার ছোঁয়া পেয়ে ব্যাথা এখন শত যোজন দূরে।
মিষ্টি শীতল বাতাস বইছে, কাছেই কোথাও বৃষ্টি হয়েছে হয়ত। যুবকের কাঁধে মাথা হেলিয়ে দেয় তরুণী।
তারপর থেকে রোজ সন্ধ্যাবেলায় খেলা শেষে উত্তর পশ্চিমের এই বেঞ্চটাতে বসেই তারা দুজনে রংবেরঙের গল্প করত। সাত পাকে বাঁধাও পড়ল দুজনে বছর পাঁচেক পর। সাংসারিক জীবনে নানান কাজের মাঝে ক্ষনিকের অবকাশ পেলে এই বেঞ্চই হয়ে উঠত তাদের গল্প করার প্রিয় জায়গা। প্রাতঃভ্রমণ কিংবা সান্ধ্যভ্রমনের শেষেও কিছু সময়ের জন্য এই বেঞ্চে বসা চাই-ই চাই। সুখ, দুঃখ, আনন্দ, যন্ত্রণা, এরূপ কত গল্পের সাক্ষী উত্তর-পশ্চিমের এই বেঞ্চটা।
আস্তে আস্তে মাঠের আশপাশে বড় বড় বাড়ি ফ্ল্যাট তৈরি হতে শুরু করল। তারপর একদিন মাঠটাকেও সুন্দর করে সাজিয়ে গুছিয়ে পার্ক বানানো হল। নীরব সাক্ষী হয়ে সব দেখেছে উত্তর পশ্চিমের বেঞ্চটা। কিন্তু এতকিছুর পরেও বেঞ্চটা কিন্তু সবথেকে ভালোবাসে এক দম্পতিকে। কোন এক অজ্ঞাত জাদুবলে তাই হয়তো যখন-ই সেই দম্পতি আসে তখনই তাদের সংসারের সব গল্প ভাগ করে নেবার জন্য বেঞ্চটা নিজেকে ফাঁকা করে রাখে। এখন দম্পতির চুলে একটু আধটু পাক ধরেছে। প্রেমালাপের থেকে দায়িত্ব, কর্তব্য নিয়ে আলোচনাই বেশি হয়। মন দিয়ে সেসব শুনে গল্পের ভান্ডার পূরণ করে উত্তর পশ্চিমের বেঞ্চটা। এমন গল্প শুনতে শুনতেই কোথায় যেন সে শুনেছে বাস্তুমতে ঘরের উত্তর পশ্চিম দিকে জিনিসপত্র রাখলে মানসিক দিক থেকে নাকি সেই ঘরের লোকজন খুব সুখী হয়। তাই বোধহয় এত দায়িত্ব, কর্তব্যের ঝড়-ঝাপটা সামলেও দম্পতি এত খুশি মনে এই বেঞ্চটায় বসে গল্প করে। এই বেঞ্চ তো তাদেরও খুব প্রিয়, তাদের আরেকটা ঘরের মত। পাক ধরা চুল কখন যে আস্তে আস্তে আরো সাদা হতে শুরু করল সময়ের স্রোতে ভেসে তার আর হিসেব রাখা হয়নি কারোর। এখন আর ইচ্ছে করলেই আগের মত যখন তখন চলে আসতে পারে না দম্পতি। মাঝেমধ্যে কখনো কোথাও বেরোলে কেবল তখন-ই হয়ত এসে বসেন বেঞ্চটায় ওনারা। ঠিক যেমন আজ এসেছেন ডাক্তার দেখিয়ে ফেরার সময়।
- এই শোনো
- কি গো?
- বড্ড জল-আইসক্রিম খেতে ইচ্ছে করছে। কিনে দেবে? ওই পাঁচ টাকা না দশ টাকার আইসক্রিমগুলো গো।
- তোমার তো সুগার।
- হুমম। তাতে কি? তুমি কিনে খাও। আমি তোমার থেকে নিয়ে একটু টেস্ট করে নেব।
- তথাস্তু। অরেঞ্জ নেব কিন্তু।
- না। ম্যাংগো।
- না, না, অরেঞ্জ।
- বাদ দাও, কুলফি নাও।
দুজনেই দুজনের দিকে তাকিয়ে শিশুসুলভভাবে খিলখিলিয়ে হেসে ওঠেন। হয়তো সবার অলক্ষ্যে উত্তর-পশ্চিমের বেঞ্চটাও মুচকি হাসে বৃদ্ধ দম্পতির কান্ড-কারখানা দেখে।
মিনিট পাঁচেক পর দুজন স্বল্প বয়সী তরুণ তরুণী বেঞ্চের কাছটায় এসে মৃদু স্বরে বৃদ্ধকে অনুরোধ করে “একটু সরে বসবেন জেঠু?” দম্পতির মনে পরে বছর পঞ্চাশ আগে কোনো এক মিষ্টি শীতল হাওয়ার রাতে ঠিক এরকম ভাবেই মধ্যবয়স্ক এক দম্পতিকে সরে বসতে অনুরোধ করেছিলেন বৃদ্ধা। জীবনের রিলে রেসের ব্যাটন হয়তো এভাবেই এক হাত থেকে অন্য হাতে চলে যায় কালের নিয়মে।
তরুণী তরুণের কাঁধে মাথা হেলিয়ে দেয়। তরুণীর কপালে চুম্বন আঁকে তরুণ। বৃদ্ধ দম্পতি হাসে। তাদেরও প্রথম চুম্বনের সাক্ষী তো এই উত্তর পশ্চিমের বেঞ্চটাই। বৃদ্ধের হাতের উপর হাত রেখে বৃদ্ধাও বৃদ্ধের কাঁধে আস্তে করে মাথাটা হেলিয়ে দেয়। আর উত্তর পশ্চিমের বেঞ্চটা! সে তো দুই প্রজন্মের প্রেমের সব রং গায়ে মেখে চুপচাপ গল্প শুনছে তখন।