উত্তাপ
উত্তাপ
"বৌদিমণি, আপনার বাচ্চাদুটোর পড়াশুনার পুরানো বইখাতাগুলো আমায় দেবেন?" কাজে লাগার আগের কথাবার্তাগুলোর মধ্যে অনিমার কাছে এই প্রশ্নটাও ছিল সবরীর। প্রথমদিকে অনিমা ভেবেছিল নিজের ছেলেমেয়ের জন্য চাইছে বোধ হয়। কিন্তু শেষ হওয়া খাতাগুলো দিয়ে কি করবে? তারপর মনে মনে ভেবেছিল, দারিদ্রের সংসারে সবই সহায় হয়। হয়তো বেঁচে দেবে। শুনেছিল, সবরীর বর নাকি সকালের দিকে ভ্যান নিয়ে বেরোয়। কয়েকটা বাটখারা আর দাঁড়িপাল্লা থাকে সেই ভ্যানে। সেখানে স্বল্পদরে সস্তা হয় বইখাতার জ্ঞান আর খবরের কাগজের কড়কড়ে পাতাগুলো। বাসি আর শেষ হওয়া জিনিস বরাবরিই সংসারে জঞ্জাল। তাই সবাইকেই বিক্রি করে দিতে হয়। কিন্তু এখনকার ভার্চুয়াল দুনিয়ার দাপটে, কটা বাড়িতেই বা খবরের কাগজ পৌঁছায়? সকালের চায়ের সাথে তো স্মার্টফোনই স্ক্রল হতে থাকে হাতে হাতে। তাই হয়তো সবরী বরের একটু সহায়তা হবে ভেবে, ওর কাজের কটা বাড়িকে ধরে রাখতে চায়। খবরের কাগজ না এলেও, অন্তত বাচ্চা থাকলে বইখাতাপত্তরতো হবেই। যা পায়, তাই তুলবে।
"আহা, ওই দুটো পাতাও ফেলনি খোকাবাবু। এখানে রাখো। আমি নিয়ে নেব।" বছরের শেষে নতুন ক্লাসের শুরুর আগে চলছে ঝাড়পোঁছের পালা। সবরী অনিমার সাত বছরের ছেলেটাকে সামলাতে সামলাতে গোটা ছেঁড়া সব কাগজগুলোকেই তাতের শাড়ির ছেঁড়া পাড়ের শক্ত দড়ি দিয়ে বেঁধে নিচ্ছে।
অনিমা বারান্দা থেকে দেখল, সিড়ির ঘরের বাইরে ল্যান্ডিং এর তলায় এরকম আরও বেশ কয়েকটা কাগজের ডাঁই রয়েছে। এতোগুলোকে একা নেবে কিকরে সবরী? নিশ্চয় ওর বর ভ্যান নিয়ে আসবে।
এমন সময় সোসাইটির চ্যায়ারম্যানকে দেখে নিচে নামল অনিমা।
"এবার ভাবছি, চ্যারিটিটা একটু বড় করে করবো।" চ্যায়ারম্যান অতনু ব্যানার্জির স্ট্যাটাস ঝলকানো প্রসঙ্গ।
"একটু প্রচার টোচারও করুন। আমরা যে সোসাল ওয়ার্ক করছি, তা অন্য সোসাইটিও দেখুক।" অনিমার নিজেকে তুলে ধরার প্রয়াস।
আরও কিছু কথাবার্তার পর সিড়ি দিয়ে ওঠার সময় অনিমা দেখল সবরীর বর এসেছে। দুজনে মিলে হাতে হাতে সামলে নিচ্ছে কাগজের ডাঁইগুলোকে।
"ফাইনাল পরীক্ষাটা আবার এই শীতে চালু হওয়ায়, কতজনের উপকার হচ্ছে রে সবরী।" সবরীর বরের খুশিতে গদগদ উত্তর।
"তা যা বলেছো।" সবরীর সম্মতি।
"আজ ডিমের দোকানও অনেকগুলো পুরানো কাগজের ট্রে দিয়েছে আমায়। দেরি করিস না, আজ ব্রিজের নিচের দিকটায় যাবো।"
*************************************
বিকালের দিকে সোসাইটির চ্যারিটেবল প্রোগ্রাম ছিল টাউন হলে। বেশ সমারোহ করে দরিদ্রদের মধ্যে অণু পরমাণু সুখ বিলানো হল করতালিমুখর বৃহৎ আয়োজনের মধ্য দিয়ে। আজকালকার দিনে মানুষ মানুষকে বিনা স্বার্থে সূচাগ্র সুখও ভিক্ষা দেয় না। দেশের বিশেষ দিনে দশের জন্য কাজে নামে না। পরিবর্তে প্রতিষ্ঠা, খ্যাতি, ঝকঝকে ছবির পোস্ট ... কিছু তো চাই।
সেসব র্পব সেরে ২৩শে জানুয়ারির ছুটির দিনে মাল্টিপ্লেক্সে মুভি দেখে, রেস্টুরেন্টে খেয়ে গাড়ি করে ফিরছিল অনিমা। সাথে ছিল অনিমার ছেলে রিকু আর বর মৃদুল। গাড়িটা ব্রিজের নিচে ডানদিকে বাঁক ঘুরতেই, বাইরের দৃশ্যটা প্রথম নজরে এলো রিকুর। ও অবাক স্বরে চিল্লিয়ে বলে উঠল "মা দেখো, সবরী মাসি কি যেন করছে ওখানে!"
অনিমা গাড়ির কাঁচ নামিয়ে দেখে থমকে গেল। আর গাড়িটাকে রাস্তার একপাশে দাঁড় করাল মৃদুল। অত:পর অবাক তিনজোড়া চোখ এগিয়ে গেল সবরী আর ওর বরকে ঘিরে থাকা অপরিচ্ছন্ন ছেলেমেয়েগুলোর দিকে। অনিমা দেখল সবরীর বর কিছু কিছু করে কাগজ একত্র করছে। আর সবরী সেগুলোতে অগ্নিসংযোগ করছে। শীতে কুকড়ে যাওয়া কটা মুখ ভাগ ভাগ হয়ে বসছে কয়েকটা ক্ষুদ্র যজ্ঞকুন্ডের উত্তাপকে ঘিরে। ওদের কালো অপরিষ্কার হাতদুটোকে বের করে সেই আগুনে সেঁকে নিচ্ছে উত্তাপ।
সবরী সেই কাজের সুখে ডুবতে ডুবতে হঠাৎই খেয়াল করে অনিমাদের। ওদের প্রশ্নাতুর চোখগুলোকে দেখে এগিয়ে এসে বিনীতভাবে বলে "এক শীতের ঠান্ডায় কম্বল ছিল না। এক টুকরো মোটা কাপড় ছিল না পেটেরটাকে পেঁচিয়ে রাখার জন্য। সেদিন একটু উত্তাপের জন্য ধরে রাখতে পারিনি আমার বাছাটাকে। বড়ি দেওয়া ডাক্তারবাবু বলেছিলেন নিমুনিয়া না কি হয়েছিল যেন ছেলেটার। তাই আজ আমার বর সারাদিন রিক্সা টানলেও সকালের সময়টাকে তুলে রাখে সেই উত্তাপ খোঁজার তাগিদে। কম্বল দূরস্থিত এই বাচ্চাগুলোকে জামাকাপড় দেওয়ার ক্ষমতাও যে নেই আমাদের। তাই এই টুকু জোগাড়ই আমাদের সাধ্যের সাধ। এই জোগানে অন্যকেউ তো পাচ্ছে নিজেকে শীতের কাঁপুনি থেকে বাঁচানোর উত্তাপ।" বলেই উচ্ছ্বসিত কণ্ঠে বলে উঠল সবরী "দেখো বৌদিমণি, কি সুন্দর হাসিমুখে ওরা আগুন পোহাচ্ছে।"
সবরীর অঙ্গুলিসংকেত অনুসরণ করে অনিমা দেখল হাসিমুখে ছোটো দুই ভাই বোন কুড়িয়ে নিচ্ছে সেই আগুনের উত্তাপ। অনিমার অনুভূতি যেন নীরবে জানান দিল, এই উত্তাপ পরোপকারে পাওয়া প্রচারহীন ভালোবাসার উত্তাপ ... একটা শীতের রাত থেকে বাঁচার উত্তাপ ... নির্ভেজাল সুখপ্রাপ্তির উত্তাপ।
(সমাপ্ত)