SUKANYA SAHA

Romance

0  

SUKANYA SAHA

Romance

টাইট্রেশান

টাইট্রেশান

5 mins
1.0K


কেমিস্ট্রি প্র্যাক্টিকালের বেল পড়লেই একটু বেশী মাত্রায় চঞ্চল হয়ে ওঠে লালিমা আজকাল । বুকের মধ্যেকার লাব ডুব শব্দটা যেন দ্রুত হতে থাকে । আর পালস বিট ও বেড়ে যায় বেশ কয়েক গুণ ।অথচ এরকম তো তার কখনও হয় না ; শান্ত শিষ্ট নিরীহ গোবেচারা মেয়ে হিসেবেই ক্লাস ইলেভেনের সায়েন্স সেকশানে সে পরিচিত। তার এমন চিত্ত চাঞ্চল্য !

কেমিস্ট্রি লালিমার প্রিয় সাবজেক্ট । আর স্কুলের মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় জায়গা কেমিস্ট্রি ল্যাব ।নানা রিএজেন্ট, অ্যাসিড্‌ ,ক্ষার এসব নিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা সময় কাটানো তার প্রিয়তম নেশা । সেই লালিমার কি যে হচ্ছে আজকাল , একদম মন নেই প্র্যাক্টিকালে । আর দু মাস ও নেই ক্লাস ইলেভেনের ফাইনাল একজাম , অথচ গত দু সপ্তাহ ধরে একটা সিম্পল টাইট্রেশান সে কমপ্লিট করতে পারছে না ।

আজ তার ল্যাবে ঢুকতেই পা সরছে না । প্রিয় বন্ধু অনুষ দুবার ডেকে গেল তাকে , সে আসছি আসছি করে বসেই রইল ক্লাস রুমে । অনুষ আর সে খুব ছোটো থেকেই বন্ধু । কো এড স্কুলে পড়েছে 

বলে সে এমনিতে ছেলেদের সঙ্গে বেশ ফ্রি । আর অনুষের সঙ্গে সব কথা শেয়ার না করলে তো তার পেটের ভাতই হজম হয় না ; সেই অনুষকেও এই ব্যাপারটা সে বলতে পারে নি ।অথচ অন্য সব ব্যাপারে অনুষ ও লালিমা হরিহর আত্মা । এমনকি তাদের দুই পরিবারের মধ্যেও সম্পর্ক যথেষ্ট ভালো । যদিও অনুষরা মারোয়াড়ী আর লালিমারা বাঙ্গালী , মানে উত্তর কলকাতার খাস ঘটি, তবুও এই দুই পরিবারের সখ্যতা দেখার মতো ।আর এই পারিবারিক সখ্যতার সূত্রপাত লালিমা অনুষের বন্ধুত্ব থেকেই ।


শেষ পর্যন্ত সব দ্বিধা দ্বন্দ্ব কাটিয়ে উঠে ল্যাবের পথে পা বাড়াল লালিমা । মন শক্ত করল ,আজ টাইট্রেশানটা তাকে কমপ্লিট করতেই হবে । ল্যাবে পৌঁছে সে দেখল কৌশিক স্যর এসে গিয়েছেন, খুব সপ্রতিভ ভাবে আজকের প্র্যাক্টিক্যালের জন্য লেকচার দিচ্ছেন রাজেশ , দিয়াশা, অনিকেতদের । সেই চোখ, সেই ভুরূ , ব্যাকব্রাশ করা চুল, আজ হালকা ব্লু কালারের একটা শার্ট পড়েছেন স্যর । এই স্কুলে সদ্য সদ্য জয়েন করা কেমিস্ট্রির টীচার কৌশিক ভদ্র , উচুঁ ক্লাসের মেয়েদের হার্টথ্রব ; সে শুধু তিনি অসম্ভব হ্যান্ডসাম সে জন্যই নয়, ভদ্রলোকের সেন্স অফ হিউমার অসাধারণ । ওনার ক্লাস করার জন্য তো মেয়েদের মধ্যে হুড়োহুড়ি পড়ে যায় ... এই জানিস স্যর না আজ আমার দিকে তাকিয়ে একটু হেসেছেন, এইসব টিফিন বেলার আলোচনার বিষয় ।লালিমা কোনদিনই পাত্তা দিত না এসব ।সে বুঁদ হয়ে থাকত নানা রিএজেন্ট, অ্যাসিড্‌ ,ক্ষারের জগতে । কিন্তু কৌশিক স্যর যেন একটু বেশি মাত্রায় উৎসাহী ছিলেন লালিমা সমন্ধে , কেমিস্ট্রী প্র্যাক্টিক্যালে বুঁদ হয়ে থাকা এই মেয়েটি প্রথম থেকেই তার চোখে পড়ে ; নিজের অনার্স লেভেলের স্পেশাল নোটসও তিনি দিয়েছিলেন লালিমাকে , তখনও লালিমা বুঝতে পারে নি কিছুই...


সেদিন বিকেলে ছুটির সময়, আকাশে মেঘ করেছে খুব ... শেষ পিরিয়ড কেমিস্ট্রী প্র্যাক্টিকাল ; ক্লাস শেষ হওয়ার আগেই কৌশিক স্যার একটা চিরকুট গুঁজে দিলেন লালিমার হাতে ... চিরকুট খুলে লালিমা দেখল স্যার লিখছেন , ছুটির পরে অপেক্ষা কোরো ল্যাবেই ... স্পেশাল ক্লাস নেবো । কিছু স্পেশাল নোটস দেব তোমায় । আগের বারে স্যারের নোটসগুলো পেয়ে সত্যিই উপকৃত হয়েছিল লালিমা ।

তাই ছুটির সময় অনুষকে বলল , তুই বাড়ি চলে যা , আমার একটা কাজ আছে , ঘণ্টা খানেক পর ফিরব ।অবাক চোখে অনুষ বলল." কি কাজ ? আগে বলিস নি তো!"

" আগে জানলে তো বলব ! এই মাত্র তো জানলাম" ... ঝাঁঝিয়ে উঠল লালিমা ;

" কিন্তু বৃষ্টি আসছে যে খুব" ... করুণ গলায় বলল অনুষ । 

"আমার ব্যাগে ছাতা আছে" ... কথা কটা ছুঁড়ে দিয়ে ব্যাগ পিঠে নিয়ে ল্যাবের দিকে দৌড়ায় লালিমা । 

ল্যাবে একটা মৃদু আলো জ্বলছিল , আর সেই আলোর নীচে বসে কৌশিক স্যার একটা খাতার ওপর ঝুঁকে পড়ে কিসব লিখছিলেন ...

লালিমা টেবিলের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই খাতা থেকে মুখ না তুলেই স্যার বললেন , "এসো ... স্যারের গলার আওয়াজে এমন কিছু ছিল যে লালিমা নিঃশব্দে বসে পড়ল স্যারের পাশে ।সেই প্রথম কৌশিক স্যারকে এত কাছ থেকে দেখল লালিমা , একমাথা ব্যাক ব্রাশ করা চুল, ফর্সা রং , দুটি অসম্ভব উজ্জ্বল ঝকঝকে বুদ্ধিদীপ্ত দুটি চোখ , চোখে রিমলেস চশমা ... একটা হালকা ল্যাভেন্ডার ডিওডেরান্টের গন্ধ ভাসছে স্যারের চারপাশে ।

"বেশ কয়েকদিন ধরে দেখছি একটা সিস্পল টাইট্রেশান তুমি কমপ্লিট করতে পারছ না ... কেন লালিমা ?" 

" হোয়াটস ইওর প্রবলেম ?" আমি তো শুনেছি তুমি ক্লাস ইলেভেনে কেমিস্ট্রিতে টপ স্কোরার ..." আর তাছাড়া কেমিস্ট্রি তোমার খুব ভালো লাগার সাবজেক্টও ... তাই নয় কি ? অ্যাম আই রাইট ?

কোনো কথা বলতে পারে না লালিমা ... শুধু মাথা নাড়ে নীরবে । তার বুকের মধ্যে তখন সেই লাব- ডুব ,লাব -ডুব, যেন হৃৎপিণ্ডটা ফেটে বেরিয়ে যাবে এক্ষুনি ।

"এই খাতাটা রাখ , একটা ছোটো নোটবুক লালিমাকে দেন কৌশিক স্যার ।এতে বেশ কিছু ভালো নোটস আছে , সবই আমার গ্র্যাজুয়েশান লেভেলের , তুমি কেমিস্ট্রি নিয়ে পড়লে তোমার কাজে লাগবে পরবর্তী জীবনে ... আর সঠিক ভাবে টাইট্রেশান করার কিছু পদ্ধতিও লেখা আছে এখানে ; দেখে নিও ...

হাত বাড়িয়ে খাতাটা নেওয়ার সময় স্যারের গায়ে হাত ঠেকে যায় লালিমার ... একি! জ্বরে যে স্যারের গা পুড়ে যাচ্ছে ...

অস্ফুটে সে খালি বলতে পারে ... "আপনার তো খুব জ্বর , গা পুড়ে যাচ্ছে 

ততক্ষনে নিজের মুখের ওপর স্যারের গরম নিঃশ্বাস অনুভব করে সে ... চুম্বনোদ্যত দুটি ঠোঁট মিশে যায় গভীর আশ্লেষে ...

লালিমাকে পাগলের মতো আদর করতে করতে কৌশিক স্যার খালি বলতে থাকেন , তুমি বোঝো না লালিমা , সব মেয়েরা যখন পাগলের মতো আমায় চায় , তখন আমি শুধু তোমার প্রত্যাশায় বসে থাকি ? তুমি বোঝো না কেন তোমায় স্পেশাল ক্লাস নিতে ডাকি ? স্পেশাল নোটস দিই ?

জ্বরে পুড়ে যাওয়া কৌশিক স্যারের মাথাটা নিজের বুকের মাঝখানে চেপে লালিমা বলতে থাকে... সব বুঝি ... কিন্তু ... আর আদরে ভিজে যেতে থাকে ক্রমশঃ...

সেদিন তুমুল ঝড় বৃষ্টিতে বাড়ি ফেরার সময় পুরো ভিজে যায় লালিমা ... ধুম জ্বর আসে , প্রায় দিন পনেরো স্কুল কামাই হয় ...

একদিন অনুষ নিয়মিত এসেছে তাদের বাড়ি , সব সাবজেক্টের নোটসগুলো দিয়ে তাকে সাহায্যও করেছে ... পরীক্ষার আর বেশিদিন বাকি নেই ; কিন্তু সেই বিকেলের কথাটা লালিমা কাউকে বলতে পারেনি , না অনুষকেও নয় । তবে অনুষের মনের গভীরেও কিছু ব্যথা সেদিনের পর থেকেই তাকে কুরে কুরে খাচ্ছে । আকাশ কালো করে প্রচন্ড ঝড় বৃষ্টি আসছিল দেখে অনুষ লালিমাকে ডাকতে কেমেস্ট্রি ল্যাবের দিকে যায়। দরজা ভেজানো দেখে দরজার ফাঁক দিয়ে উঁকি মেরে দেখে লালিমা আর কৌশিক স্যর ... আর দাঁড়িয়ে থাকতে পারে নি অনুষ। ওই ঝড় বৃষ্টির মধ্যেই স্কুল থেকে বেরিয়ে পড়ে । সে দিনের পরে তার কেবলি মনে হচ্ছে সে মানুষ চিনতে এত ভুল করেছিল!!

স্কুলে এসে লালিমা জানতে পারে কৌশিক স্যার চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন, স্টেটসে পোস্ট ডক্টরেট রিসার্চ করার অফার পেয়েছেন , সেখানেই চলে গেছেন ...

 

আজ অনেকদিন বাদে আবার কেমিস্ট্রী ল্যাবে ঢুকেছে লালিমা । টাইট্রেশানের সব সরঞ্জাম সাজিয়েছে আবার , সামনে স্যারের দেওয়া খাতাটা খোলা ।বুরেট থেকে বিন্দু বিন্দু অ্যাসিড পড়ছে বিকারের গা বেয়ে ... বিকেলের আকাশে তখন গোধুলি , আকাশ জুড়ে কমলা রঙের খেলা ...


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance