Sanghamitra Roychowdhury

Romance

0.8  

Sanghamitra Roychowdhury

Romance

তোমায় ছোঁয়ার অজুহাতে

তোমায় ছোঁয়ার অজুহাতে

4 mins
560


২০১৯-এর শেষ রবিবার। মনটা হু হু করে উঠলো শাল্মলীর। রবিবারের সকালের আনন্দবাজার, খোলা পড়ে চোখের সামনে। অথচ একসময় ওদের মারামারি হওয়ার উপক্রম হোতো। কে আগে কাগজ পড়বে? আজ কাগজ পড়ে আছে অবহেলায়। শাল্মলীর মন নেই তাতে। চোখের সামনে দিয়ে অগণিত মুহূর্তরা সারবন্দী হয়ে মার্চ পাস্ট করছে। লেফট‌-রাইট, লেফট-রাইট, লেফট-রাইট, লেফট... হ্যাঁ, লেফট। মানে বামপন্থী রাজনীতি করতো শতানীক। ছাত্র রাজনীতি। কলেজের জিএস। পেছনে সর্বক্ষণ একটা ছোটখাটো চলমান জনতার ভিড়। ওরা শতানীকের বন্ধুবাহিনী, তা না বলে ফলোয়ার বললে বোধহয় বেশী ভালো শোনাবে। শাল্মলী একবছরের জুনিয়র। শতানীকের পরের ব্যাচ। শতানীকের মধ্যে যেন চুম্বক সাঁটা আছে। মেয়েরা হুড়মুড় করে ছোটে ওর কাছেপিঠে ঘেঁষে থাকতে, ঠিক যেমন পতঙ্গদল উড়ে যায় তীব্র আলোর উৎসের দিকে। তবে শাল্মলী সেই দলে ছিলো না। একদিন উল্টো ব্যাপার ঘটে গেলো। আলো ছুটলো পতঙ্গের দিকে। পতঙ্গ আকৃষ্ট হোলো শেষমেশ। কলেজের অ্যানুয়াল ফাংশন উপলক্ষ্য হোলো। দু'জনেই ভালো গায়, লেখে, সুর করে। শতানীক আর শাল্মলীর প্রেমপর্ব শুরু হোলো। উদ্দাম ঝর্ণার মতো আছড়ে পড়া প্রেম।

ফাইনাল পরীক্ষা তখন দরজায় কড়া নাড়ছে। সবাই হতবাক হয়ে একদিন দেখলো, শতানীকের হিরোহণ্ডা বাইকের পেছন থেকে শাল্মলী নামছে। এই পর্যন্ত চোখ সওয়া ছিলো পাবলিকের। পরের অংশে এসে সজোরে ধাক্কা খেলো জনগণ, শাল্মলীর মাথার মাঝ মধ্যিখানে সিঁথি জুড়ে ডগমগ করছে টকটকে লাল টাটকা সিঁদুর। ব্যাপারখানা ওরা নিজেরাই ব্যাখ্যা করলো, শাল্মলীর বাড়ী থেকে অতি গোপনে পাত্র দেখা হচ্ছিলো শাল্মলীর জন্য। অমন টেবিল পিটিয়ে, গিটার বাজিয়ে হাঁ হাঁ করে চিৎকার করে গান গাওয়া বাউণ্ডুলে ছেলে শতানীকের সাথে শাল্মলীর বাড়ী থেকে মরে গেলেও বিয়ে দেবে না। এতোটা বাড়াবাড়ি সহ্য করার মতো ছেলে আবার শতানীক নয়। সাম্যে বিশ্বাসী শতানীক। তাই কোনো ঝুঁকি না নিয়ে শাল্মলীকে বিয়ে করে নিয়েছে। সেদিনই সকালে, শ্যামনগরে মন্দিরে গিয়ে। এখন সমস্যাটা হচ্ছে, শাল্মলী তো এক কাপড়ে বাড়ী ছেড়েছে। এদিকে শতানীককেও বাড়ীতে ঢুকতে দেয় নি, শাল্মলীকে নিয়ে। অগত্যা বন্ধুদের শরণাপন্ন। তবে শতানীকের বন্ধুবাহিনী মোটেই নিরাশ করে নি ওদের। দু'জনেই বন্ধু। এটুকু তো করতেই হবে। ঠিক হয়ে গেলো ভাড়াবাড়ি, দরকারী জিনিসপত্রের ব্যবস্থা হোলো, এমনকি বন্ধুরা বইখাতা নোটস সব দিয়ে পরীক্ষা পর্যন্ত উদ্ধার করে দিলো।

পরীক্ষার পরে শতানীক শুরু করলো গান গাওয়া, রেকর্ড করা ইত্যাদির খোঁজ খবর। টুকটাক স্টেজ প্রোগ্রাম, কলেজে কলেজে ফেস্ট ফাংশন... চালিয়ে নিচ্ছে যাহোক করে। তবে এই তালে শতানীক নিজে গান লেখা বা গিটার নিয়ে বসে সুর করার সময় পাচ্ছে না। পুরোনো লিড সিঙ্গারদের পপুলার হিট গান গাইছে, মানে গাইতে বাধ্য হচ্ছে। এর মধ্যেই শাল্মলীর পরীক্ষাও শেষ। শাল্মলীও গাইতো, তবে অতটা নিয়মিত নয়। কিন্তু শাল্মলীর গলা ভীষণ ভালো। কয়েকটা কম্পোজিশনও করেছিলো ফার্স্ট ইয়ার, সেকেন্ড ইয়ারে। আসলে ঐ সময়েই শতানীক ধেয়ে এসেছিলো শাল্মলীর দিকে। শাল্মলীর আবার প্রথাগত শিক্ষাও আছে গানে, তবে ও আবার ততটা প্রফেশনাল নয়। একটু ইন্ট্রোভার্ট। বাড়ীতেই গুনগুন করা আর খাতাভর্তি কম্পোজিশন নোটেশন করতেই ব্যস্ত। কয়েকটা ট্যুইশন করে, ব্যাস্। শতানীক অনেক বোঝাতে চেষ্টা করেছে শাল্মলীকে। দু'জনে একসাথে প্রোগ্রাম করার ব্যাপারে। রাজী হয় নি শাল্মলী। আসলে ওর মন পড়ে রয়েছে নতুন গান তৈরীর দিকে। কিন্তু শতানীক বুঝছে, সেই সময় ওদের তখন নেই। খেয়ে পরে বাঁচলে তবে না গান।


তারপর এই নিয়েই ঝগড়া হতে শুরু হোলো। প্রথম প্রথম দু'জনেই অ্যাডজাস্ট করে মিটমাট করে নিতো। পরে একসময় যত দিন গড়াতে লাগলো, তত তিক্ততাও বাড়তে লাগলো পাল্লা দিয়ে। কিছুদিন বন্ধু বান্ধবেরা মধ্যস্থতা করে পরিস্থিতি সামলেছে। তারপর যখন শতানীক যখন প্রায় প্রত্যেক প্রোগ্রাম সেরেই বেহেড মাতাল হয়ে ঘরে ফিরতে লাগলো, তখন আর শাল্মলীর সহ্য হোলো না। একটা ছেলে, চালচুলোহীন অবস্থায় যার হাত ধরে ঘরবাড়ী পরিবার পরিজন সব ছেড়েছে, তার এই অধঃপতন মানতেই পারলো না শাল্মলী। আলাদা হওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেললো শাল্মলী। নিজের বাপের বাড়ীতে ফিরে গেলো। শতানীকও বাধা দেয় নি। বাধা দিলেও শাল্মলী শুনতো না। বিনা বাধাতেই তারপর ডিভোর্সও হয়ে গেলো। এখন দু'জনেই যে যার নিজের বাড়ীতে। বন্ধু বান্ধব তো সবাই কমন, ওদের মুখে মুখেই সব খবরাখবর পায়।


মাঝে বেশ কয়েকটা বছর পার। শাল্মলীর টুকটাক নাম হয়েছে কম্পোজার হিসেবে। শতানীক মুম্বাই গেছে এই পর্যন্ত খবর পেয়েছিলো শাল্মলী। তার পরের খবর জানে না কেউই। এমনকি শতানীকের ফোন নাম্বারটাও নাকি ইনভ্যালিড বলে শোনায়। বন্ধুদের মুখেই শুনেছে শাল্মলী। সেদিন একটা মাঝারি মাপের বিজ্ঞাপনে চোখ আটকেছিলো শাল্মলীর। একটা বাংলা সিনেমা, প্রোডিউসার ডিরেক্টর সব মুম্বাই ইণ্ডাস্ট্রি‌ থেকে. মিউজিক ডিরেক্ট করছে শতানীক। প্রথমে বিশ্বাস হয় নি শাল্মলীর। তারপরে শেষপর্যন্ত সিনেমাটা দেখে তবে বিশ্বাস হোলো। প্রথম ব্রেক শতানীকের, এতো বড়। অথচ শাল্মলী আজ শতানীকের সঙ্গে নেই, শতানীকের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ে অভিনন্দন জানানোর জন্য। শনিবার সিনেমাটা দেখে আসার পর থেকে শাল্মলীর চোখ ঝাপসা। ওদের প্রথম বিবাহবার্ষিকীতে শাল্মলী লিখেছিলো গানটা। সুরও করেছিলো দু'জনে মিলে বসে। ঐ গানটা অবিকল রেখেছে, এমনকি টাইটেল কার্ডে লিরিসিস্ট হিসেবেও শাল্মলীর নাম রেখেছে। তার চেয়েও বড়ো খবর শনিবার বাড়ীতে ফিরে একটা চেক পেয়েছে, ক্যুরিয়রে এসেছে। সম্মান দক্ষিণা।


শাল্মলীর গাল ভিজে যাচ্ছে গরম জলে। শাল্মলীর শরীরের প্রত্যেক অণু-পরমাণু গাইছে....

"রাতবাতিটা নিভিয়ে দিই রাত গভীর হলে,

শুধু তোমায় ছোঁয়ার অজুহাতে।

ইচ্ছে করেই ছ্যাঁকা খাই জল ছিটিয়ে তেলে,

শুধু তোমায় ছোঁয়ার অজুহাতে।

শীতের রাতে কম্বলটা পায়ের নীচে ফেলি ঠেলে,

শুধু তোমায় ছোঁয়ার অজুহাতে।

ছাতার বাইরে বেরিয়ে গিয়ে হাপুস ভিজি বৃষ্টি জলে,

শুধু তোমায় ছোঁয়ার অজুহাতে।

একটা শ্বাস বাড়তি চাই বোজা চোখে মরণকালে,

শুধু তোমায় ছোঁয়ার অজুহাতে।

শুধু তোমায় ছোঁয়ার অজুহাতে।।"


নাহ্, আর সময় নষ্ট করবে না শাল্মলী। নতুন বছর অনেক আশার আলো নিয়ে আসুক। ২০২০... টোয়েন্টি টোয়েন্টির প্রথম রবিবারের টিকিটটার বুকিং কনফার্ম করে দিলো শাল্মলী। হাওড়া-মুম্বাই গীতাঞ্জলি এক্সপ্রেস। ও হ্যাঁ, সঙ্গে ওদের দুই বন্ধুও যাবে। ডিভোর্স হয়ে গিয়েছিলো, এখন স্বামী স্ত্রী হিসেবে থাকতে হলে রেজিস্ট্রিটা আবার করে নিতে হবে তো। তো বন্ধুরাও সাক্ষী। ক্যুরিয়রের খামে লেখা সেণ্ডারের ফোন নম্বর। যোগাযোগ করেছে ওদের বন্ধুবাহিনী। গোছগাছও হয়ে গেছে। শুধু একটা কাজ বাকী। একটা "গীতাঞ্জলি" কিনতে হবে। ওদের শেষ ঝগড়াটার দিনে হাতাহাতি টানাটানিতে ছিঁড়েছিলো "গীতাঞ্জলি"টা। খুব বাজে ব্যাপার হয়েছিলো। ছিঃ ছিঃ, কত অপরিণত ছিলো দু'জনেই। ট্রেন রাইট টাইমেই ছাড়বে আশা। আর নতুন বছরে শাল্মলী শতানীকের জন্য অনেক শুভেচ্ছা। ভালোবাসার এমনি অনেক অনেক অজুহাত থাক।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance