তিস্তা
তিস্তা
কলেজের প্রথম দিন কলেজে পা দিয়েই অদ্ভুত একটা অনুভূতি কাজ করল তিস্তার মনে। সেই ছোট্ট থেকে অনবরত মনে হত “একদিন আমিও কলেজ যাব, আমিও বড় হব”। আজ সেই এতদিনকার ইচ্ছে পূরণ হতে চলেছে তিস্তার। বড় হবার মুহূর্তটা মনের খাতায় যত্ন করে তুলে রাখছে তিস্তা। ডানদিকে একটা কদম গাছের তলায় দাঁড়ালো ও। কদম ফুলের গন্ধ মেখে আকাশের দিকে চেয়ে দেখল আকাশ পুরো নীল। এক দু টুকরো সাদা মেঘ খেলে বেড়াচ্ছে সেই আকাশে। হাসলো তিস্তা। কে জানে ওর নিজের ভবিষ্যৎটাও এরম ভ্রূকুটিহীন নীল আকাশের মত হবে কিনা!
চারতলা বিল্ডিংটার তিনতলায় নিজের ক্লাসরুমে ঢুকল তিস্তা। অচেনা মুখের সারি, সবার চোখে মুখেই ঔৎসুক্য যেমন রয়েছে, তেমন-ই রয়েছে এক বিরাট অজানা সাগরে ডুব দেবার তীব্র আকাঙ্খা। কিছু বন্ধুবান্ধবের মুখে শুনেছে এখানে র্যাগিং তেমন হয় না। তা একদিক থেকে ভালো বটে। সেসব হলে ওদের এই ঔৎসুক্য, কৌতূহলের সাথে একটা ভয়ও কাজ করত।
প্রথম ক্লাস হবার পর-ই উঁচু ক্লাসের কিছু দাদা দিদির উপস্থিতি বেশ উদ্বেগ বাড়ালো ওদের। “ইন্ট্রো দে”, “কবিতা বল”, “হেনা কর”, “তেনা কর”, এইসব আদেশসমূহ অনেকে মজার ছলে নিলেও বেশ কিছু ছাত্র-ছাত্রী একটু একটু ভয় পেতে শুরু করেছে। যদিও দাদা, দিদিরা সস্নেহে ঘোষণা করল “না, না, ভয় পাবার কারণ নেই কোনো”।
প্রথম দিনের অভিজ্ঞতার ডালি পূর্ণ করে বাড়ি ফিরল তিস্তা। বেশ মনে ধরেছে ওর কলেজটাকে। পরদিনও দাদা দিদিরা এল। যারা টুকটাক ভয় পাচ্ছিল তারাও যেন ক্রমশ একটু একটু করে সরগড় হচ্ছে। তিস্তার নতুন বন্ধু, শর্মিলা তিস্তাকে ডেকে একজন হাই পাওয়ারের চশমা পরা ছেলেকে দেখিয়ে বলল
- তিস্তা, ওই দাদাটাকে দ্যাখ, কেমন যেন ক্যাবলা ক্যাবলা। বাকি সবাই কি হ্যান্ডু, কাকে ছেড়ে কাকে দেখব বুঝতে পারছি না। তার মধ্যে দাঁড়কাকের মত ওই দাদাটা কি করছে!
- এই, এরম বলতে নেই।
ফিসফিসিয়ে উত্তর দিল তিস্তা।
কলেজ জীবনের প্রথম তিনটি মাস নতুন ছন্দে বেশ ভালোই কাটলো তিস্তার, কিন্তু এবার সেই ছন্দে একটু হলেও তাল কাটবার সম্ভাবনা। সামনে যে ইন্টারনাল এক্সাম! যদিও পরীক্ষা দিতে খুব যে ভয় পায় তিস্তা তা ঠিক নয়। স্কুলে ক্লাসে বরাবর ফার্স্ট হয়ে এসেছে, ভয় পাবেই বা কেন! তবুও সামনের সপ্তাহতেই এক্সাম। একটু বুক দুরুদুরু ভাব তো থাকেই।
আজ একটু আগেই কলেজ পৌঁছে গেছে তিস্তা। নোটিসবোর্ডে পরীক্ষার রুটিন দিয়েছে। মোবাইল বার করে ছবি তুলে নিল তিস্তা। মোবাইলটা পার্সে ঢুকিয়ে ওখান থেকে বেরিয়ে আসবে, কলেজের দ্বিতীয় দিনে যে হাই পাওয়ারের চশমা পরা দাদাকে দেখিয়ে শর্মিলা দাঁড়কাক বলেছিল, সেই দাদার সাথে দেখা। ভুরুটা কুঁচকিয়ে, চোখ পিটপিট করে ছেলেটি তিস্তাকে তুতলিয়ে জিজ্ঞেস করল
- রু-উটিন দিয়েছে? তা-আই না?
তিস্তা মাথা নেড়ে সম্মতি জানালো।
- আ-আমার ব্যাগটা এ-একটু ধরবে?
হাত বাড়িয়ে ছেলেটির ব্যাগটা ধরল তিস্তা। ছেলেটি খাতা পেন বার করে রুটিন লিখছে দেখে তিস্তা জিজ্ঞেস করল
- ছবি তুলে নিতে পারো তো।
- আ-আমি চেষ্টা করেছি। ঝা-আপসা হয়ে যায়।
রুটিন লেখা হয়ে গেলে ব্যাগটা দাদার হাতে দিয়ে ওখান থেকে বেরিয়ে এল তিস্তা। সাড়ে নটায় একটা ক্লাস আছে। তাড়াহুড়োর দরকার নেই। আস্তে আস্তে ক্লাসের দিকে এগোতে যাবে ও, হটাৎ কানে এল পেছনে ওই দাদাটির কোনো বন্ধু দাদাটিকে বলছে
- এই তোতলা, কিরে কি ব্যাপার রে?
- কি-ই রে?
- মেয়ে পটিয়েছিস দেখলাম।
- ক-ওই না তো। ও-ওকে তো ব্যাগটা এ-একটু ধরতে ব-ওলেছিলাম খালি।
- ব্যাগটা ধরতে বলেছিলাম খালি। হুমম? ডুবে ডুবে ভালোই জল খাচ্ছ। বুঝিনা ভেবেছ?
- স-অত্যি বলছি আমি।
- ক্লাসে চ আজ।
পেছন ঘুরে একবার তাকালো তিস্তা। তারপর আবার সামনে ক্লাসের দিকে হাঁটা লাগাল।
- তু-উমি কিছু মনে করোনি তো? ও-ওরা এরম মজা করে আ-আমার সাথে। কি-ইছু মনে কোরোনা, কে-এমন!
পেছন ফিরে তিস্তা উত্তর দিল
- না, দাদা। কিছু মনে করিনি।
- ধ-অন্যবাদ।
মিষ্টি হেসে মাথা নাড়ালো তিস্তা।
- তো-ওমার নামটা?
- তিস্তা
হ্যান্ডশেক করার জন্য হাত বাড়ালো তিস্তা।
- তোমার নাম?
- স্ব-অর্নাভ
স্বর্ণাভ থার্ড ইয়ারে পড়ে। পড়াশুনা ছাড়া অন্য কোনো কিছুতেই তেমন মন নেই ওর। ক্লাসেও প্রথম-ই হয়ে এসেছে আজীবন। কিন্তু ওই আর কি! চোখে হাই পাওয়ারের চশমা, তারপর তোতলা বলে সিনিয়র থেকে জুনিয়র কেউ খ্যাপাতে ছাড়ে না। যদিও শিক্ষক, শিক্ষিকাদের বেশ পছন্দের পাত্র স্বর্ণাভ।
এদিকে তিস্তাও প্রথম হতে শুরু করল ক্লাসে। ক্রমশ সেও শিক্ষক শিক্ষিকাদের পছন্দের পাত্রী হতে শুরু করল। তিস্তাকে কিছু এক্সট্রা নোটস নেওয়ার জন্য স্বর্ণাভর কাছে যেতেই অনুরোধ করত শিক্ষক-শিক্ষিকারা। স্বর্ণাভ আর তিস্তার পরিচয় ক্রমশ বাড়তে থাকল সেই ভিত্তিতেই। এমনিতে স্বর্ণাভর দিকে কেউ পা-ও মাড়ায় না। সেও তিস্তাকে নানান কাজে সাহায্য করতে পেরে বেশ খুশি-ই হচ্ছে। এখন তো বাচ্ছা বাচ্ছা ছেলেমেয়েগুলোও স্বর্ণাভকে “তোতলাদা” বলে ডাকে। কই! তিস্তা তো ডাকেনি কোনোদিনও। বরং “স্বর্ণাভদা” বলে ডেকেই যথেষ্ট সম্মান দেয়। এটাই তো কতটা পাওয়া স্বর্ণাভর কাছে। তিস্তা পড়াশুনায় ভাল, কিন্তু স্বর্ণাভদার সাথে কথাবার্তা বলে তিস্তা বুঝতে পারল স্বর্ণাভদা শুধু ভালোই নয়, একজন এক্সট্রা অর্ডিনারি স্টুডেন্টও বটে। প্রত্যেকটি বিষয়ে কি গভীর জ্ঞান। পরীক্ষার আগে তো বটেই, এমনকি অন্য সময়েও স্বর্ণাভর অফ পিরিয়ডে নানান বিষয় বুঝতে স্বর্ণাভর কাছে গিয়ে সটান হাজির হতে থাকল তিস্তা। দুজনই এই কারণে যথেষ্টভাবেই বন্ধুবান্ধবদের কাছে মজার পাত্র হয়ে উঠল বটে, তবে তাতে দুজনের কেউই পাত্তা দিত না। স্বর্ণাভ যেমন বুঝল সেও সম্মান পাবার যোগ্য, তেমন তিস্তাও এক জ্ঞানসাগরে ডুব দিতে পারল স্বর্ণাভর সন্যিধ্যে আসতে পেরে।
সময় এগিয়ে চলল। স্বর্ণাভ ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে চাকরি করবে এখন। যদিও ওর ইচ্ছে ছিল আরো পড়াশুনা করবার, হাইয়ার স্টাডি করবার, কিন্তু নিজের পরিবারের অর্থনৈতিক অবস্থা স্বর্ণাভকে সেই সুযোগ দিল কই! অগত্যা একটা ভালো দেখে চাকরিতে জয়েন করল ও। তিস্তা কিন্তু তার স্বর্ণাভদার থেকে এখনো নানান বিষয়ে সাহায্য চায়। স্বর্ণাভও বিনা চাহিদায় উৎসাহ সহকারে তিস্তাকে সাহায্য করে।
একদিন একটি বিষয় তিস্তা কিছুতেই বুঝতে পারছে না। স্বর্ণাভ বলল
- ফো-ওনে ঠিক হবে না। কো-ওথাও মিট করি চ-অলো।
- কফি হাউস?
- হু-উমম। শ-অনিবার স-অন্ধেবেলা?
- বেশ।
কফিহাউসে দেখা করল দুজন। তিস্তাকে দেখে একগাল হাসি হাসল স্বর্ণাভ।
- ভা-আলো আছো?
- হুমম, তোমার খবর বলো।
- চ-ওলে যাচ্ছে।
তিস্তা দেখল অফিস কাছাড়ি করেও তেমন পরিবর্তন আসেনি স্বর্ণাভর জীবনে। সেই হাই পাওয়ার চশমা, কথা বলার আগে ভ্রু কুঁচকে চোখ পিটপিট করা, খোঁচা খোঁচা দাড়ি, ঢলঢলে জামা প্যান্ট। সব একই আছে।
- অফিসেও একই ভাবে সবাই তোমার খিল্লি করে নাকি?
চোখটা একটু ঝাপসা হল স্বর্ণাভর।
- স-ওয়ে গেছে। তু-উমিই একমা-আত্র যে কিনা ভা-আলো ভাবে কথা বল।
- শোনো, পয়সা তো ইনকাম করছ। এভাবে থাকো কেন?
- কি-ই করবো তবে?
- এসব চশমা পরা চলবে না, কনট্যাক্ট লেন্স পরতে হবে। দাড়ি কেটে আসবে নেক্সট দিন থেকে। টি-শার্ট পরবে। এটা ফার্স্ট স্টেপ। তারপর স্ট্যামারিং থেরাপির জন্য কোথাও একটা খোঁজখবর নিয়ে ভর্তি হতে হবে।
- এ-এত পারব না আ-আমি। বে-এশ ভালোই তো আছি। তু-উমি পড়াটা বোঝো তো-ও এখন।
-সে তো বুঝতেই এসেছি। বুঝবো। তবে আমি যেগুলো বললাম সেগুলো না করলে আজ-ই তোমার সাথে শেষ কথা।
তিস্তার কথা মত স্বর্ণাভ কিন্তু নিজেকে ক্রমশ স্মার্ট করে তুলতে থাকে। ওরা এখন মাঝে মাঝেই কফি হাউসে দেখা করে। কখনো সত্যিই তিস্তার পড়া বোঝার ব্যাপার থাকে, আবার কখনো বা নিছক আড্ডা মারার জন্য। না, তথাকথিত বয়ফ্রেন্ড, গার্লফ্রেন্ডের মত প্রেম ওরা করে না। কিন্তু ওদের মধ্যেও একটা অন্যরকম প্রেম আছে, একটা অন্যরকম ভালোবাসা আছে। স্বর্ণাভ নিজের উচ্চশিক্ষার সুপ্ত ইচ্ছেকে তিলে তিলে তিস্তার মনে সঞ্চারিত করে। এতেই যেন স্বর্ণাভর আনন্দ, স্বর্ণাভর সাফল্য। তিস্তা মাস্টার্স করবে, ডক্টরেট করবে, আর স্বর্ণাভ দূরে দাঁড়িয়ে সেই আনন্দ উপভোগ করবে। ওদিকে তিস্তা নিজের মনের মতন করে স্বর্ণাভকে সাজিয়ে নেবার উদ্যমে মেতেছে। আর অদ্ভুতভাবে দুজনেই সফল হতে থাকল ক্রমশ একে অন্যকে সাজিয়ে তুলবার উদ্যোগে।
প্রায় একবছর কেটে গেল। তিস্তা চেন্নাইয়ে মাস্টার্স করতে যাচ্ছে। স্বর্ণাভ এয়ারপোর্টে সি-অফ করতে এসছে। জিন্স, টিশার্ট পরিহিত এই স্বর্ণাভকে আগের স্বর্ণাভর সাথে কেউ মেলাতেই পারবে না।
তিস্তা একবার স্বর্ণাভর হাতটা ধরে বলল
- এলাম। দু বছরের ব্যাপার তো। দেখতে দেখতে কেটে যাবে।
- এসো। শুভেচ্ছা রইল।
ক্ষনিকের নীরবতা যেন অনেকটা কথা বলে উঠল হঠাৎ করেই। কারোর-ই কারোকে ছাড়তে ইচ্ছে করছে না। দুজনেই দুজনের দিকে ঝাপসা দৃষ্টিতে স্মিত হেসে তাকিয়ে রয়েছে। তিস্তার কলেজের প্রথম দিনের মত আজও আকাশখানা নীল ক্যানভাস যেন। নীরবতা ভাঙলো তিস্তা।
- আসি, কেমন। সাবধানে থেকো। খুব শিগগিরই দেখা হবে আবার।