তারে ভোলানো গেলো না
তারে ভোলানো গেলো না
আজকের লেট নাইট পার্টিটা বাড়িতে খুব ভালোভাবে সাকসেসফুল হয়েছে বলতে হবে। আসলে এটাই ওদের মানে... চিরদীপ আর রুচিরার বাড়িতে প্রথম লেট নাইট পার্টি। এর আগে খুচরো দুই একটা নাবালক ইভনিং পার্টি হয়েছে... একেবারে নিরামিষ নাবালক পার্টি সেসব। চা - কফি - কোল্ড ড্রিঙ্কসে সীমাবদ্ধ ছিলো। এইপ্রথম সাবালক লেট নাইট পার্টি হলো বাড়িতে... মানে রঙিন মদির পানীয়ের গ্লাসে আর আমন্ত্রিত অতিথিদের শরীরী হিল্লোলে ঝড় উঠলো ট্রান্স মিউজিকের ডিজেতে। তবে রুচিরার এসব পোষায় না... ওর ধাতে নেই এইসব জগঝম্প ব্যাপারস্যাপার... লেট নাইট পার্টি মদ্যপান ইত্যাদি। ঐজন্য এতোদিন হোটেলেই হয়েছে এমন সব পার্টি। রুচিরার মত না থাকাতে। অবশ্য চিরদীপ চিরকালই এমন হুল্লোড়বাজ। একদম পারফেক্ট মিসম্যাচ... সেটা এতোদিনে বোঝে রুচিরা। তবে আজকের পার্টির সাফল্যে চিরদীপ ভীষণ খুশি। সবাই চলে যাবার পরে থেকে থেকেই বেসুরো গলায় গাইছে চিরদীপ, "পহেলা পহেলা প্যায়ার... হুঁ হুঁ হুঁ... পহেলা পহেলা প্যায়ার...!" রুচিরা হলে হালকা গোছগাছ সারছিলো। রুচিরাকে জড়িয়ে ধরে কাঁধে মুখ ডুবিয়ে দিল চিরদীপ। রুচিরা কেন যেন অতোও খুশি হতে পারছে না! এমনকি খুশির অভিনয়টাও ঠিকমতো করতে পারছে না আজ। আসলে এর কোনোটাই রুচিরার রুচিতে পোষায় না, তবুও করে যেতে হয় সংসারের যাঁতাকলে পড়ে। আজকের দিনটা রুচিরাকে বড্ড উথালপাথাল করে তুলেছে। আজ রুচিরার অরিন্দমকে মনে পড়ছে বড্ড।
বিছানায় চিরদীপের পাশে চিৎ হয়ে শুয়ে নির্ঘুম রাত কাটাচ্ছে রুচিরা। একবার পাশ ফিরে চিরদীপকে দেখলো। অঘোরে ঘুমাচ্ছে ছ'ফুট দু'ইঞ্চির চিরদীপ। রাত প্রায় তিনটে... অ্যালকোহলের প্রভাবের ঘুম। সহজে ভাঙবে না। চিরদীপের দিকে পেছন ঘুরে শুলো রুচিরা। মন এলোমেলো ঘুরপাক খাচ্ছে, "আমি কি সুখী হয়েছি? চিরদীপের সাথে বিয়েতে কি আমি আদৌ সুখ পেয়েছি? যদি হ্যাঁ হয় তবে এভাবে হঠাৎ হঠাৎ অরিন্দমকে মনে পড়ে যায় কেন? মন ভারি হলেই আজকাল অরিন্দম রুচিরার মনের ঘরের চৌকাঠের বাইরে থেকে উঁকি দেয়। আর আজকের কথাটা তো আরো আলাদা মাত্রার। চিরদীপ অকাতরে ঘুমোচ্ছে... রীতিমতো নাক ডাকিয়ে। রুচিরা হাতটা আড়াআড়ি করে নিজের মাথায় রেখে চোখ বুজলো।
অরিন্দম যেদিন কলকাতা ছেড়ে গেলো সেই দিনটার কথা এতোদিন পরে বড্ড মনে পড়ছে। আটবছরের একটা সম্পর্ককে কেমন করে ছিঁড়ে ফেলেছিলো রুচিরা। রাগ নয়, ঝগড়া নয়, কিছুই ছিলো না সেই দিনটায়, তবুও ভেঙে খানখান হয়ে গেলো সম্পর্কটা। অরিন্দম চলে যাচ্ছে উত্তরবঙ্গে... নতুন চাকরিতে জয়েন করতে। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের চাকরি... সরকারি চাকরি। অরিন্দমের পরিবারের জন্য খুব দরকারি ছিলো চাকরিটা। বয়স বাড়ছিলো। তাই অরিন্দম কোনো ঝুঁকি নিতে চায়নি। চলে গেলো জঙ্গলে... নির্বান্ধব জঙ্গলে চাকরি করতে চলে গেলো। রুচিরার নিষেধ বা বাধা কোনোটাই শোনেনি শুধু নিরুপায় অরিন্দম। একটা ভদ্রস্থ চাকরিই যদি না পায় তবে কী হবে ইউনিভার্সিটির পিএইচডি ডিগ্রি? ওতো শুধু একটুকরো কাগজ। রুচিরা সে কথা বুঝতে চায়নি। কলকাতা শহরে থেকে সুখের কোনো চাকরি যে এতোদিনেও পায়নি অরিন্দম, সেই কথাটাই তো রুচিরা কিছুতেই বুঝতে চাইলো না। আর সেই দিনই সিদ্ধান্ত নিলো রুচিরা, কিছুতেই আর দীর্ঘায়িত করবে না সম্পর্কটাকে। রুচিরা কোনোমতেই ঐ বনে-জঙ্গলে গিয়ে পড়ে থাকতে পারবে না অরিন্দমের সঙ্গে। খুব হিসেবি হয়ে উঠলো রুচিরার ভালোবাসা।
তারপর রুচিরার বাড়ি থেকে বিত্তবান - ক্ষমতাবান সব পাত্রের অনুসন্ধান চললো। অবশেষে ব্রেক আপের তিনমাসের মধ্যেই রুচিরার বিয়ের ঠিক হয়ে গেলো... চিরদীপের সঙ্গে। সুপুরুষ অর্থশালী চিরদীপ। ব্যবসায়ী... বড়োমাপের বাড়ি, বড়োমাপের গাড়ি... সবই বড়োমাপের... এমনকি লোভটাও বড়োমাপের। আরো আরো অর্থের লোভ। ব্যবসা বাড়ানোর লোভ। চিরদীপ ব্যবসা বাড়িয়ে এবারে উত্তরবঙ্গে টিম্বার মার্চেন্ট হতে চাইছে। কাঠের... জঙ্গলকাটা কাঠের ব্যবসা। সেই আনন্দের সেলিব্রেশনেই আজকের এই লেট নাইট পার্টি। মোটামুটিভাবে সবই ফিক্স হয়ে গেছে। কিন্তু বাদ সাধছে ওখানকার কোন এক ফরেস্ট রেঞ্জার অফিসার... চূড়ান্ত সৎ বলতে যা বোঝায় আরকি! তবে একটাই সুখের খবর এনেছে বাবলু... মানে ওদের উত্তরবঙ্গের ইনফর্মার। ওখানকার ধুলো মাটি গাছ পাতার সব খবর বাবলুর নখদর্পণে। ঐ ফরেস্ট অফিসারের নাম অরিন্দম মিত্র। বাবলু পার্টির একফাঁকে নীচু গলায় চিরদীপকে বলছিলো, "ঐ লোকটার সাথে দিদির প্রেম ছিলো। আট বছরের।" চিরদীপ কেমন একটা আদিম উল্লাসধ্বনি করে উঠলো। রুচিরার সারা শরীর কেঁপে উঠলো। বাবলু বলছিলো, "দিদিকে একটু বলার দরকার ছিলো তো কথাটা!" চিরদীপ জিভ দিয়ে চুকচুক আওয়াজ করে, "আবার দিদি কেন? আমিই তো আছি! আমি যা বলবো দিদি তাই করবে, কোনো চিন্তা নেই। পতির পুণ্যে সতীর পুণ্য, বুঝলে বাবলু! আমার অবশ্য সতীর পুণ্যে পতির পুণ্য! তোমার দিদিই আমার সৌভাগ্যের চাবিকাঠি!" স্বভাবসিদ্ধ হা-হা হাসিতে ফেটে পড়ে চিরদীপ। পতি - সতী - পতি - সতী - পুণ্য... শব্দগুলো এমএসসি ফার্স্ট ক্লাস রুচিশীলা রুচিরার অস্তিত্বের মধ্যে সুনামির মতো আছড়ে পড়ে। হাসতে হাসতেই চিরদীপ বলে, "কী উপকার যে হলো আমার!" রুচিরা এমনিতেই এই জীবনযাত্রা পছন্দ করে না। তার মধ্যে এই কাজ কী করে করবে রুচিরা? ভেতরটা ওর ডুকরে উঠলো।
******
ফরেস্ট বাংলোর গেটে গাড়িটা এসে থামলো, মিটিং শুরু হয়ে গিয়েছে। বাংলোর বেয়ারা আর কুককে ডিনারের নির্দেশ দিতে দিতে রুচিরা শুনতে পায় চিরদীপের গলা, "আমার ব্যবসার এই বাড়বাড়ন্ত সবই আমার স্ত্রী ভাগ্যে। আমার স্ত্রীরই বিশেষ ইচ্ছে এবার টিম্বার ইণ্ডাস্ট্রিতেও আমাদের কোম্পানির এন্ট্রি হোক... তা ঐজন্যইতো গিন্নির ইচ্ছেয় কর্ম!" চিরদীপের হাসিটাকে কেমন যেন অশ্লীল ব্যাঙ্গের মতো মনে হয় রুচিরার। চোখ ভিজে যায় রুচিরার, তবুও চোখে আরেকবার কাজল বুলিয়ে গাঢ় নীল শিফনে নিজেকে মুড়ে আয়নার সামনে দাঁড়ায় রুচিরা। আবার ওর অরিন্দমকে মনে পড়ে যায়। গাঢ় নীল অরিন্দমের খুব পছন্দের। এরকমই একদিন ওদের বাড়িতে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে অরিন্দম রুচিরার ঠোঁটের উষ্ণতায় নিজেকে ডুবিয়ে দিয়েছিলো। রুচিরার চোখের পাতা দুটো আবার কেঁপে উঠলো। চিরদীপের গলা আবার, "আপনি তো আমার স্ত্রীর সহপাঠী ছিলেন, তাই না? তেমনইতো শুনেছিলাম।" অরিন্দম বেশ জোরালো অথচ ভদ্র ভঙ্গীতে উত্তর দেয়, "হ্যাঁ, ঠিকই শুনেছেন। তবে আজই আমি রিলিজ নিয়েছি। আমার ট্রান্সফার হয়ে গেছে আর্জেন্ট অর্ডারে। এই যে মিস্টার দিলীপ ভার্মা... ইনি আজ থেকে এখানকার ফরেস্ট রেঞ্জার। পরিচয় করিয়ে দিলাম। এবারে তাহলে আমি আসি মিস্টার বাসু। আপনার স্ত্রী মানে রুচিকে বলে দেবেন আবার পরে একদিন দেখা হবে। পৃথিবীটা গোল আর খুব ছোট্ট। ঠিক দেখা হয়ে যায়। চলি... নমস্কার।" ভারি বুটের আওয়াজ মিলিয়ে গেলো দূরে। তারপর গাড়িটার ফিরে যাওয়ার আওয়াজ। বাংলোর বসার ঘরে তখন মিস্টার দিলীপ ভার্মার সাথে চিরদীপের আড্ডা জমে উঠেছে।
রুচিরা হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। ওকে আর অরিন্দমের দুর্বলতার সুযোগ নিতে হয়নি বলে। এভাবে সারা জীবনে অনেকবার কারণে অকারণে অরিন্দমকে মনে পড়েছে রুচিরার। আসলে চিরদীপরাইতো কিছুতেই মন থেকে রুচিরাদের তাদের প্রাক্তন অরিন্দমদের ভুলতে দেয় না। বারবার শুধু মনে করিয়ে দেয়! রুচিরার দুগাল বেয়ে মেঘনা যমুনা... টিভিতে পুরোনো দিনের "লালকুঠি" সিনেমার গানটা চলছে তখনই, "তারে ভোলানো গেলো না কিছুতেই...!"