সুক্ষ্মশরীর।
সুক্ষ্মশরীর।
মাত্র পঞ্চাশভাগ লোক দিয়ে অফিসটা চলছে।এদিকে বসের রিপোর্ট পজিটিভ।পুরো লোডটাই এখন ব্রতীনের ঘাড়ে।দশটা থেকে দুটো নিয়ম মেনেই অফিস চালাতে হচ্ছে,কজের চাপ অত্যাধিক,মাথা ঠিক রাখাই মুস্কিল।এমনিতেই বুকের ডানদিকটায় থেকে থেকে চিনচিন করে একটা ব্যাথা টের পাচ্ছে সকাল থেকেই...অস্বস্তিটা বাড়তে থাকে বেলার দিকে....একটু আগেই জুনিয়রকে অফিসের গাড়িটাতেই বেরিয়ে পড়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে....খানিকটা রাস্তা এগোতেই,ব্যাথাটা তীব্র হতে থাকে,বুকটা বাহাতে চেপে,দাঁতে দাঁত চিপে ,সহ্য করতে থাকে ব্রতীন.....পুরো শরীরটা ঝিমিয়ে পড়তে থাকে,ব্যাথা যন্ত্রনা সব বোধ হারিয়ে যেতে থাকেনৌ...পেছনের সীটে এলিয়ে পড়ে ধীরেধীরে....
সম্বিৎ ফেরে পাড়ার গলির মুখে এসে।ব্রতীন আবিস্কার করে নিজেকে....ঠিক যেখানে গাড়িটা রোজ নামিয়ে দিয়ে যায়....এক পা দুপা করে এগোতে থাকে বাড়ির দিকে। অদ্ভুত বিষয় ব্যাথাটা এখন আর নেই,অস্বস্তিটাও নেই আর,বরঞ্চ শরীরটা একদম ফুরফুরে চনমনে লাগছে মনে হয়।এ্যাপার্টমেন্টের সামনে এসে,খোলা গেট দিয়েই ভিতরে ঢুকে পড়ে,বাহাদুর দাড়িয়ে ছিলো গেটের পাশেই,তবে কি কারনে যেন আজ সেলাম ঠোকে নি।ব্রতীনের মনে হয় ..হয়তঃ খেয়াল করেনি...গ্রাউন্ড ফ্লোর থেকে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গিয়ে তিনতলার দত্তবাবুকে নেমে আসতে দেখে....এবার সত্যিই অবাক হয় ব্রতীন..কথা না বললে যার ঘুম হয় না,সেও কিনা পাশ কাটিয়ে নেমে গেলো.....একতলায় ওর ফ্ল্যাট......বেল বাটনে চাপ দেয় ব্রতীন.....বেলের আওয়াজ শুনতে পায় না,বারবার বেল বাজাতে থাকে.....বেশ ঘাবড়ে যায় মনে মনে,গ্রীলের দরজাটায় ঝোলানো তালাটা শব্দ করে নাড়তে থাকে বারবার.......তনিমা,তনিমা ....দরজা খোলো .....কখন থেকে ডেকে যাচ্ছি.......তনিমাআআ।
প্রায় দশ মিনিট হয়ে গেছে এতক্ষনে।আর একটা বিষয় ভীষণ অবাক করে.....এতক্ষন ধরে ডাকাডাকি,চিৎকার চলছে অথচ অতিউৎসুক পড়শীদের কোনো উঁকিঝুঁকি নেই.....
ফ্ল্যাটের ভিতরেই ল্যান্ডফোনটার বেজে ওঠার আওয়াজ কানে আসে........
ব্রতীন স্পষ্ট বুঝতে পারে.........মানুর মা (ওদের কুক কাম কেয়ারটেকার) ফোনটা ওঠায়.......কেমন একটা হাঁউমাঁউ আওয়াজ শোনা যায় ঘরের ভিতর থেকে....ব্রতীনের উৎকন্ঠা বেড়েই চলে....চিৎকার করে বলে.......মানুর মা দরজাটা খোলো না.......কখন থেকে ডেকেই যাচ্ছি..সবাই কি একসাথে কালা হয়ে গেলে...?
দরজাটা খুলে যায়,তনিমা ঘরোয়া শাড়ি পরে কোনোরকমে হাওয়াইচটি পায়ে গলিয়ে দরজার বাইরে আসে,পেছন পেছন আসে ব্রতীনের বছর চব্বিশের ছেলে বাবাই......ব্রতীন খেয়াল করে তনিমার মুখটা ভীষন থমথমে....ভয়ংকর দুশ্চিন্তা আর উদ্বেগের মেঘ ওর মুখমন্ডলে.........তনিমা আর বাবাই ব্রতীনকে প্রায় ধাক্কা দিয়েই দ্রুত সিড়ির দিকে যায়,নীচে নামতে থাকে....ব্রতীন বোঝে ওরাও ওকে খেয়াল করে নি.......
দরজাটা তখনও আধখোলা।একটা পাল্লা শুধু খোলা।মানুর মা সেখানে দাঁড়িয়ে তনিমাদের নেমে যাওয়া সিড়ির দিকে তাকিয়ে আছে....পাশের ফ্ল্যাটের দরজা খোলার আওয়াজ পেতেই,ব্রতীন দেখে সেনগিন্নী বেরিয়ে এসেছেন,ইশারায় মানুর মাকে জিজ্ঞাসা করছে কি যেন!
বিরক্ত হয় ব্রতীন....মানুর মাকে একরকম ধাক্কা দিয়েই সোজা ড্রয়িংরুমে ঢুকে যায়।মানুর মা একবার ফিরে তাকায় ভিতর দিকে,মুখে কিছু বলে না!......ব্রতীন জুতোজোড়া খোলে,বাথরুমের দিকে বলতে বলতে যায়......মানুর মা,চা বানাও এককাপ......
বাথরুম থেকে বেরিয়ে,ড্রয়িংরুমের সোফার উপর শরীরটা ছেড়ে বসে...রান্নাঘরের দরজার দিকে তাকিয়ে বলে......চা তৈরী হোলো.......?মানুর মা....তনিমা আর বাবাই কোথায় গেলো বলোতো.....মানুর মা রান্নাঘরের দরজা দিয়ে খালি হাতেই বেরিয়ে আসে...ব্রতীনের পাশ দিয়েই বাবাইএর ঘরের দিকে চলে যায়.....এবারে ভয় পেয়ে যায় ব্রতীন.......তাহলে কি মানুর মা ওকে দেখতে পাচ্ছে না?ওর কথাও কি শুনতে পাচ্ছে না?....তনিমা আর বাবাই,দত্তবাবু আর বাহাদুর...কেউ ওকে দেখতে পায় নি?......স্বপ্ন নয়তো?.... তাড়াতাড়ি উঠে টেলিফোনটার কাছে যায়.....নম্বর প্যাডে ডায়াল করতে থাকে তনিমা আর বাবাই এর নম্বর.....দশ মিনিট একনাগাড়ে চেষ্টা করে হাঁপিয়ে ওঠে ব্রতীন......পায়চারি করতে থাকে ড্রয়িংরুমের মেঝেতেই..... কলিং বেলটা বেজে ওঠে আবার...ব্রতীন খোলার আগেই ,মানুর মা দৌড়ে গিয়ে দরজা খোলে.....ব্রতীনের বড় শালা ও ভায়রাভাই কে ঘরের ভিতর ঢুকে আসতে দেখে........
.. এদের তো এখন আসবার কথা নয়,..... নিশ্চয়ই কারো কিছু একটা বিপদ ঘটেছে!!......তনিমা,বাবাই ও নিজে সবাইতো ঠিকই আছে.....তাহলে কে?ভীষন চিন্তিত হয়ে পড়ে ব্রতীন।
সামনের ডিভানের উপর ওরা দুজনে এসে বসে।মানুর মা হন্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে দাড়ায়........সব ঠিক আছে তো দাদাবাবু?ব্রতীনের শালা তরুন মাথা নাড়ায়,বলে ,"জানি না,তনিমা আর বাবাই হাসপাতালে গেছে.....এখনো খবর পাওয়া যায় নি ঠিকঠাক।.....কার কি হয়েছে তরুন?..প্রশ্নটা করতে গিয়েও,ঢোঁক গিলে ফেলে ব্রতীন।এতক্ষনে পরিস্কার হয়ে গেছে যে,ওরাও ব্রতীনকে দেখতে পাচ্ছে না!!
ক্লান্ত ব্রতীন বিরক্ত হয়ে,সোজা নিজেদের বেডরুমে চলে যায়,বিছানায় টানটান হয়ে শুয়ে পড়ে।মনে মনে ভাবে,আগে তনিমা আর বাবাই ফিরুক ,তারপর যা হয় দেখা যাবে।চোখ লেগে আসে ব্রতীনের.....
ঘন্টা তিনেক পর একটা চেঁচামেচি তে ঘুম ভেঙে যায় ব্রতীনের.....স্পষ্ট শুনতে পায়,উচ্চস্বরে কান্নার আওয়াজ,,গলাটা ভীষন চেনা,,,,,,,,এ আমার কি হোলো গো,কেন তুমি আমায় ফেলে চলে গেলে?"......শিউড়ে ওঠে ব্রতীন......এটা তো তনিমার গলা.......তাহলে কি??
খাট থেকে লাফ দিয়ে নেমে ব্রতীন ড্রয়িংরুমে আসে..ড্রয়িংরুমে তখন ভর্তি লোক.....সবাই কেমন যেন শোকস্তব্ধ....তনিমার বোন তনিমাকে ধরে রেখেছে শক্ত করে,কিছুতেই থামানো যাচ্ছে না ওর কান্নাকে....বাবাই,বাবাই.........অজান্তেই ডেকে ফেলে ব্রতীন........বাবাই কে কোথাও দেখতে না পেয়ে সবকটা ঘরে তন্নতন্ন করে খোঁজে ব্রতীন......আশঙ্কায় উদ্বেল হয়ে ওঠে........তবে কি 'বাবাই' ?.....না বাবাইকে তো ও নিজেই সিড়ি দিয়ে নামতে দেখেছে......বাবাইএর কিছু হ ওয়ার কথা নয়........নিজেকেই স্বান্তনা দেয় ব্রতীন।
তনিমার ঠিক সামনে গিয়ে,ওর মুখটা তুলে ধরতে চেষ্টা করে,হাত বাড়িয়ে চোখের জল মুছিয়ে দিয়ে.....কি হয়েছে তনি?কাঁদছো কেন?.....কার কি হয়েছে আমাকে বলো প্লীজ.......তনিমা আরো জোরে কেঁদে ওঠে,কোনো আবেশ ওর আবেগ বাড়িয়ে দিতে থাকে.....একটা চেনা পরশ ওর শরীরে অনুভব করে বারবার.......তনিমা জ্ঞান হারায়।
নীচে থেকে একটা এ্যাম্বুলেন্সের সাইরেনের শব্দ কানে আসে।দত্তবাবু বলে ওঠেন....'এসে গেছে'......সবার সাথে ব্রতীন ও নীচে যায়।বড় গেটটা খুলে এ্যাম্বুলেন্সটা ভিতরে আসে,,,,,,,,,,গাড়িটা থামতেই বা সামনের বাদিকের দরজা খুলে নেমে আসে বাবাই আর ব্রতীনের পুরোনো বন্ধু অনিমেষ!!........এ্যাম্বুলেন্সের পিছনের দরজা খুলে,স্ট্রেচার সমেত সাদাকাপড়ে ঢাকা দেওয়া একটা দেহ নামানো হয়।.............ব্রতীন এগিয়ে যায় শবদেহের দিকে,চেষ্টা করে এক ঝটকায় মুখের দিকের কাপড়টা সরিয়ে দিতে......পারেনা কিছুতেই.....উন্মাদের মতন হাত নাড়তে থাকে বারবার........অনিমেষ এগিয়ে আসে চোখ মুছতে মুছতে,খুব যত্ন করে মুখের কাপড়টা সরাতেই....এক লাফে অনেকটা পিছিয়ে যায় ব্রতীন...এ কি দেখছি? ভিতরটা মুচড়ে ঠেলে কান্না আসতে চায়...ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে ব্রতীন...
.... দুহাতে চোখ কচলে বারবার দেখতে থাকে শবদেহের মুখটার দিকে......নিজের চোখকেই বিশ্বাস হয় না ওর..বারবার মনে হয় .......ঘুমের মধ্যে আছে ও ..আর এটা একটা বড় দুঃস্বপ্ন! কিন্তু কিছুতেই স্বপ্নটা থেকে বেরোতে পারে না ....শত চেষ্টাতেও..!
শরীরটাকে বাইরে খাটের উপর রাখা হয়....মালা ,চন্দন,ধূপকাঠি,অগুরুর গন্ধে ম ম পুরোদেহটা।ব্রতীন কাছে যায় ধীরপায়ে,ভয় আর সংকোচ নিয়ে ছুঁয়ে দেখে দেহটা.....বুকের উপর অনিমার রাখা হাত দুখানা ধরে জোরে নাড়িয়ে দিতে চায়....চিৎকার করে বল.....তনিমা ,তাকিয়ে দেখো ....,আমি বেঁচে আছিইইই....!
অনেক কষ্টেও দেহটার ভিতরে আর ঢুকতে পারে নি ব্রতীন।চিৎ হয়ে শুয়ে নানান কসরৎ করেও কিছু ফল মেলে নি.....একসময়ে হাপিয়ে উঠে...খাটটার একপাশে বসে পড়ে ব্রতীন....চোখ তুলে চারিদিকে তাকিয়ে লক্ষ্য করে,অনেক পরিচিত লোক.... কিন্তু কারো দৃষ্টিতে সে ধরা পড়ছে না,কেউ তাঁর কথাও শুনতে পাচ্ছে না!!
কিছুক্ষণ বাদে খাটটাকে একটা মিনি ট্রাকে তুলে দেওয়া হয়,কয়েকজনের সাথে ব্রতীন ও চড়ে বসে তাতে।তরুন দেহটাকে ছুয়ে বসে......এবারে একটা বাধা লক্ষ্য করে ব্রতীন.........কিছুতেই দেহটার কাছে যেতে পারছে না,হাত দুয়েক দুর থেকেই একটা অদৃশ্য দেওয়াল যেন বাধা হয়ে দাড়াচ্ছে......ব্রতীনের বহুদিনের একটা জিজ্ঞাসার উত্তর মেলে.......তাঁর মানে এইজন্যেই শবদেহকে ছুঁয়ে থাকে কেউ না কেউ....
শ্মশানে অল্প ভীড় থাকায় ,লাইন মিলতে একটু দেরী হয়,একজন পুরুত মশাই আসেন...বডটাকে স্নান করিয়ে,মন্ত্র পড়া শুরু হয়......মন্ত্র গুলো সংস্কৃত শব্দ বটে,তবে বাঙালিপুরুতের হাতে উচ্চারনের দফারফা হলেও.....বুঝতে অসুবিধা হয় না.....গুগুল ট্রান্সশ্লেশনের মত সব শব্দের মানেই কম্পাঙ্ক হয়ে যেন সোজা ব্রতীনের মগজে বাজতে থাকে........ছাত্রজীবনে নাস্তিক্যবাদের অনুগামী ব্রতীনের বরাবর কৌতুহল ছিলো....মরাকে মন্ত্র শুনিয়ে কি লাভ?যার নাক,কান,বুদ্ধি কোনোটাই সতেজ নেই......তাকে মন্ত্র শোনানো কুসংস্কার ছাড়া আবার কি!
আজ উত্তরটা খুঁজে পায় ব্রতীন......শুনতে পায় ঠাকুর মশাইএর মুখ থেকে বেরিয়ে আসা মন্ত্র.........হে অমৃতের সন্তান,হে অনন্ত শুন্য, তোমার এবারের যাত্রা শেষ,ধরিত্রী,আকাশ,বায়ু ,তেজ,জল নির্মিত এ দেহ থেকে তোমার নিস্কৃতি হয়েছে,দেবতার সাক্ষীতে তুমি পরবর্তী মধুযাত্রার প্রস্তুতি নও......
ব্রতীনের ভয় অনেকটা কেটে গেছে এতক্ষনে।সত্যকে মেনে নিতে শুরু করেছে ভিতর থেকে.... দেহটা চুল্লীর কাছে নিয়ে যাওয়া হয়....সবাই চন্দন কাঠের টুকরো দিতে দিতে ধ্বনি দেয় বলোহরি হরিবোল...ব্রতীনের নাভির নীচ থেকে কিছু একটা দলা পাকিয়ে উঠে আসতে চায়,ভিতর থেকে মনে হয় কোনো কিছু একটা উপড়ে বাইরে আসতে চায়।ব্যাথায়,যনৃত্রনায়,ভয়ে ককিয়ে ওঠে ব্রতীন........দেহটা চুল্লীর ভিতর চলে যেতেই....ব্রতীনের নাভির কাছ থেকে কিছু একটা উপড়ে বাইরে চলে যায়..ব্রতীন ও অনেকটা হালকা হয়ে যায়....বুঝতে পারে জীবনের সব চেয়ে বড় সঙ্গী,সব চাইতে বড় মায়ার থেকে মুক্তি পেয়েছে ও.....ওর দেহটা আর নেই......
সবার সাথে শ্মশান থেকে বাড়ি ফেরে ব্রতীন.....বাবাই ও তনিমার পোষাক পাল্টে গেছে ততক্ষনে.......ব্রতীন ঘরে ঢুকে আবার শোবার ঘরেই যায়....একটা কুছ পরোয়া নেই ভাব এখন ওর...দেহটা যাওয়ার পর থেকেই কষ্টের বোধগুলো কেমন হাওয়া হয়ে গেছে.........শুয়ে দু হাত ছড়িয়ে দেয় আবার.....
..তিনদিন কেটে যায়।বাবাই তনিমা তরুন ও ওদের পরিচিত পুরোহিত মশাই সকাল সকাল গঙ্গার ঘাটে পৌঁছয়।ব্রতীন ও যায় ওদের সাথে।পুরোহিত মশাই কলাপাতায় পিন্ড সাজিয়ে ,সামনে দুটো আসন পেতে দেন।তনিমা ও বাবাই এর আঙুলে কুশের তৈরী আংটি পড়িয়ে ওঁ বিষ্ণূ,ওঁ বিষ্ণু ,ওঁ বিষ্ণু মন্ত্রে জল ছিটিয়ে দিয়ে,মন্ত্রচ্চারণ শুরু করেন.........
“ওঁ দেবতাভ্যঃ পিতৃভ্যশ্চ মহাদোগিভ্য এব চ। নমঃ স্বধায়ৈ স্বাহায়ৈ নিত্যমেব তবস্থিতি”,,,,মন্ত্রপাঠ ও পিন্ডে জলদান চলতে থাকে........সব মন্ত্রের মানে সেদিনের মত ই ব্রতীনের ভিতরে প্রচন্ড কম্পাঙ্ক তৈরী....ব্রতীন পরিস্কার বুঝতে পারে....ওর শরীরটা আরো হালকা ও স্বচ্ছ হয়ে যাচ্ছে.... প্রতিটা মন্ত্রপূতঃ পিন্ডদানের সাথে সাথে ,সুক্ষ্ম অবয়ব থেকে কালো রঙের ধোয়াশার মতন কিছু একটা বেরিয়ে যেতে পারে.........কি হচ্ছে এসব? প্রশ্নটা জাগতেই,স্বচ্ছ দেহের ভ্রূ যুগলের মধ্যে একটা তীব্র অনুভূতি জাগে.......নিঃশব্দ শব্দে কেউ যেন বলে দেয়,পার্থিব জীবনের জমে থাকা বাসনার জড় স্তরের ক্ষয় হচ্ছে রে।.....ভালো,মন্দ ,পিছুটানের বোধগুলোর সাড়া মিলছে না...দুঃখ,সুখের অনুভুতি র পাড়ে দাঁড়িয়ে
ব্রতীন শুধুই উপলব্ধি করে.....নামহীন গোত্রহীন নিজেকে,শুধু একটা সুক্ষ্ম অস্বিত্বকে।
ইতিমধ্যেই চতুর্থীর কাজ শেষ।গঙ্গায় পিন্ড ভাসিয়ে দিয়েছে বাবাই।...স্নান করে বস্ত্র বদলে আবার সবাই গাড়িতে চড়ে বসে.......ব্রতীন ও যেতে চায়.....আবার ভাবনা হয়.....কি লাভ গিয়ে?
দোটানা বাড়তে থাকে..ব্রতীনের শরীরটাও বড্ড হালকা হয়ে গেছে আজ,অনেক কষ্ট হয় শরীরটাকে কেন্দ্রীভূত করে গাড়িতে উঠতে......কিছু একটা অদৃশ্য সুক্ষ্মটানে,সব দোটানা কাটিয়ে আবার বাড়িতে ফিরতে চায় ব্রতীন......
এ্যাপার্টমেন্টের দরজার সামনে গাড়িটা থামে।সবার সাথে ব্রতীন ও নামে।পা দুটো কিছুতেই চলতে চায় না,শরীরটাও পুরো তুলোর মতন,ব্রতীন বোঝে মাধ্যাকর্ষণ ও কাজ করছে না আর.....মনের জোর এক করে সিড়ি দিয়ে উঠতে থাকে......দরজার কাছে পৌছতে সময় লাগে অনেকটাই.......দরজা দিয়ে প্রবেশ করতে যেতেই বাধা পায় ব্রতীন......অদৃশ্য স্বচ্ছ দেওয়াল আটকে দেয় ওকে,হতবাক ব্রতীনের মনে প্রশ্ন জাগতেই,আবার কালের মাঝখানের কম্পনটা জেগে ওঠে ,অনুভুতির বোধ জানিয়ে দেয়.....আর তোমার এখানে থাকার অনুমতি নেই........
.......ভিতরটা খাঁ খাঁ করে ওঠে ওর...... "এত সাধের নিজের বাড়িতেই ব্রাত্য আমি.".... মুহুর্তে ই অনুভতি জানিয়ে দেয়..ওগুলো ফেলে আসা পাঞ্চভৌতিক জগতের সম্পদ ..,তুমি এখন ওসব থেকে ভিন্ন!
চেতনার ডাকে সাড়া দিয়ে নেমে আসে ব্রতীন....পাড়ার মোড়ের বটগাছটার কথা মনে পড়তেই...খুব ইচ্ছা করে
বটগাছ নীচের বাঁধানো চাতালটায় একবার বসতে।...এবারে একটা চমৎকার ঘটে....ইচ্ছা হ ওয়া মাত্র নিমেষে নিজেকে আবিস্কার করে চাতালটার সামনে,চাতালটায় গিয়ে বসে ব্রতীন.......ছোটোবেলা থেকে ঘটে যাওয়া ঘটনাগুলো খুব দ্রুত ব্রতীনের সামনে ভাসতে থাকে........কতক্ষন কেটেছে খেয়াল নেই,হুঁশ ফিরতেই ব্রতীন টের পায় ,রাত বেড়েছে,চারপাশটা শুনশান.......কি করবে ,কোথায় যাবে কিছুই বুঝতে পারে না।হঠাৎ ফিসফিসানির আওয়াজে বটগাছটার দিকে তাকাতেই দেখতে পায়,ওর মতন ই কতগুলো অশরীরি শরীর বটগাছটার আড়াআড়ি শাখাটার উপর বসে আছে।
একজন দুজন করে নেমে আসে ওরা.....ব্রতীনকে ঘিরে দাড়ায়.......ব্রতীন খেয়াল করে লোকগুলোর চোখেমুখে বেশ একটা উগ্রতার চিন্হ ফূটে উঠেছে.... তাছাড়া ওদের অবয়ব গুলোও ঠিক পরিস্কার নয়.....ধূসর আর অনেকটাই স্পষ্ট.......ভালো লাগেনা ওর.....পরিস্কার বুঝতে পারে,..... ব্রতীনের উপস্থিতি ওদের পছন্দ নয়।
কিছু বলবার আগেই ব্রতীন উঠে পড়ে চাতালটার থেকে।
একজন ওকে ধরতে হাত বাড়াতেই বিপত্তি ঘটে...ব্রতীনের সুক্ষ্ম শরীর ঘিরে নিমেষেই একটা শক্তিবলয় তৈরী হয়...লোকটা এক ঝটকায় পিছনে পড়ে যায়.....বাকি অবয়বগুলোও নিমেষে শুন্যে মিলিয়ে যায়।
ব্রতীন সামনের পাকা রাস্তা ধরে এগোতে থাকে।হাঁটতে হাঁটতে ই মনে পড়ে কিছুদুরে থাকা লাইব্রেরীর কথা..জীবনের একাকী সময়ে এই জায়গাটাই ছিলো,ওর সময় কাটাবার অন্যতম জায়গা...ম্যাজিক আবার ঘটে,ব্রতীন নিজেকে খুঁজে পায়....লাইব্রেরীর ষ্টাডিরুমে।
আরো নয়দিন কাটে।এর মধ্যে একটা একাদশী আর একটা পূর্ণিমা তিথি পরে......ঐ দুই দিন ব্রতীনের শরীরটায় একটা মজবুতি ফেরে....ইচ্ছা হয় একবার বাবাই আর তনিমাকে দেখবার....গভীর রাতে ইচ্ছামাত্র পৌঁছেও যায় বাড়িতে.....অবাক বিষয় ....ঐ দিনগুলোতে কোনো বাধা পায়নি ঘরে ঢুকতে......ঘরে ঢুকে তনিমার মাথার কাছে বসেও থাকে খানিকক্ষন......তনিমাকে দেহটা ছুঁয়ে দেখতে চায়....অনেকটা মনঃসংযোগ করতেই,তনিমাকে ছুঁতে পারে আবার,বাবাই এর ঘরে গিয়ে,ঘুমন্ত বাবাইএর মাথায় হাত বুলিয়ে দেয় কিছুক্ষন.....বাবাই হঠাৎ উঠে বসে বিছানায়,উঠেই তনিমার ঘরে যায়......তনিমাকে ঘুম থেকে ডেকে বলে..মা মা. জানো.....বাবাকে স্বপ্নে দেখলাম।বাবা আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিলো......ব্রতীন বুঝতে পারে ও আবার দূর্বল হচ্ছে,দমবন্ধ হ ওয়া অনুভতিটাও বাড়তে থাকে...কষ্ট হয় খুব......বেরিয়ে আসে বাড়িটা থেকে.....খোলা হাওয়াতে আসতেই আবারো হালকা লাগে অনেকটাই... আবার পৌঁছে যায় লাইব্রেরীর ষ্টাডিরুমে....
এয়োদশ দিন।কুলীন কায়স্থ ,গৌতম গোত্রের ব্রতীনের আজ পার্থিব শ্রাদ্ধানুষ্ঠান।আজ সকাল থেকেই ব্রতীন বাড়িতে.......গত রাত থেকেই একটা অমোঘ টান চলছিলো বাড়িতে ফেরার ....সাত সকালেই ঘরে ফিরেছে ব্রতীন......বাড়িতে ঢুকতেই বাবাই কে দেখতে পায়..সাদা গেঞ্জি ,সাদাধুতি,মুন্ডিত মস্তক,চোখে গত মাসে নতুন বানিয়ে আনা সোনালী ফ্রেমের চশমা,কাধের দু ধার দিয়ে ঝুলে থাকা সাদা বস্ত্রে.......মনে হচ্ছে যেন পুরানপুরুষ,কোন তপোবনের আশ্রমিক ব্রহ্মচারী.....ওকে দুচোখ ভরে দেখতেই থাকে ব্রতীন..!
ভিতরটা হু হু করে ওঠে....মনে হয় ইস্ বাবাই যদি ওকে একবার দেখতে পেত....!
শ্রাদ্ধের ক্রিয়াকর্ম শুরু হয়.....ঘন্টা তিনেক সময় লাগে..ব্রতীন শ্রাদ্ধমন্ডপে ওর ছবিটার সামনে গিয়ে বসে...কোনো একটা আবেশ ওকে বসিয়ে রাখে ঠায়।প্রতিবার তিলদান,জলদানের সাথে সাথে হাত বাড়িয়ে সেটা গ্রহন করতে থাকে......প্রতিবার অনুভব হয় ওর শরীরটা আরো সংকুচিত হয়ে আসছে....প্রতিটি মন্ত্রচ্চারন ওকে যেন ছোটো করে দিচ্ছে.....ওর শরীরটা থেকে অতি সুক্ষ্ম একটা আবরন খসে পড়ছে......শ্রাদ্ধকর্ম শেষ হয়।অন্য দিকে তখনও গীতাপাঠ চলছে,ব্রতীনের শ্রবনে আসে ...পাঠক বলছেন...............
ন জায়তে ম্রিয়তে বা কদাচিন্
নায়ং ভূত্বা ভবিতা বা ন ভূয়ঃ।
অজো নিত্যঃ শাশ্বতোহয়ং পুরাণো
ন হন্যতে হন্যমানে শরীরে।।২০।।
অর্থাৎ আত্মার কখনও জন্ম হয় না বা মৃত্যু হয় না, অথবা পুনঃ পুনঃ তাঁর উৎপত্তি বা বৃদ্ধি হয় না। তিনি জন্মরহিতশাশ্বত, নিত্য এবং পুরাতন হলেও চিরনবীন। শরীর নষ্ট হলেও আত্মা কখনও বিনষ্ট হয় না।
অদ্ভুত একটা আনন্দ আসে ব্রতীনের চেতনায়।আজ বুঝতে পারে,সত্যিই তো মৃত্যু সত্যি হলে,ওর অনুভব হচ্ছে কেমন করে....সব বুঝতে পারছে ...সব শুনতে পাচ্ছে..শুধূ ...পার্থিব শরীরটা না থাকায় ....ইন্দ্রিয়ের বোধগুলো ওকে ছুঁতে পারছে না.......নাস্তিক ব্রতীনের মনে হয়.......ইশ্ অকারনে কত তর্ক করেছি.....মনগড়া ধারনায় কতকিছু বলেছি...পুরো জীবনটা....পার্থিব বিনাশশীল বস্তুর পিছনে ব্যায় করেছি......যে ইশ্বর..যার বিনাশ সম্ভব নয় সেই অমৃত যা একের পর এক লীলাস্বাদনের জন্য পার্থিব শরীরে জন্ম মৃত্যুর চক্রে প্রবেশ করে .......তাকে জানতেই চেষ্টা করেনি কোনোদিন।
ব্রতীনের সুক্ষ্ম শরীরবোধটাও আর বোধ হয় না,নিজেকে মনে একটু বিস্তৃত একটা বিন্দু...যার মধ্যে থেকে সমানে কম্পন তৈরী হচ্ছে.........নিমেষে বাড়িটা থেকে বেরিয়ে আসে ব্রতীন.......না কোনোরকম মানসিক দ্বিধাদ্বন্দ আর নেই,,,,বরঞ্চ জন্মেছে নতুন বোধ.....জানতেই হবে এ রহস্যকে........তীব্র ইচ্ছার কম্পন ব্রতীনকে পৌঁছে দেয়,জগতের সীমানার বাইরে ....এক অজানা লোকে.....(ক্রমশ:)
ব্রতীন নামটাই এখন অতীত......নাম থেকে অনামীর জগতে শুধুমাত্র একটা অস্তিত্ব........স্বচ্ছ দেহটা আরো স্বচ্ছ হয়েছে মনে হয়.....কপালের বিন্দুটাকে ঘিরে চক্রাকারে ঘিরে থাকা একটা অস্তিত্বের চাদর শুধু অনুভুত হয়.....
তীব্র উর্ধাকর্ষন পেঁজা তুলোর মতন ভাসিয়ে নিয়ে যেতে থাকে ওকে.......বায়ুমন্ডলের সীমানা ছাড়িয়ে ভেসে যেতে থাকে অনামী অস্বিত্ব নিয়ে.....প্রায় বিচার শুন্য এক অলীক অনুভব......শুধু মাঝেমাঝে জাগে এক তীব্র ইচ্ছা..জীবন ও মরনের সীমানা ছাড়িয়ে....জেগে থাকা সেই চরম অস্তিত্বকে জানবার ইচ্ছা হয় বারেবারে।
