Gopa Ghosh

Inspirational

5.0  

Gopa Ghosh

Inspirational

সফলতা

সফলতা

8 mins
908


নামটা সার্থক হলেও ওর জীবনে ওই সার্থক নামক বস্তুটা কিছুতেই আসতে চায় না। এক এক সময় ও ভাবে যে সার্থক নামটা রাখাই ঠিক হয় নি ওর । বাবার কাছে শুনেছে মা নাকি এই নামটা রেখেছিল। মায়ের কথা ভাবলেই ওর মনটা এখনও খুব খারাপ হয়ে যায়। বলতে খারাপ লাগলেও মায়ের প্রতি ওর ঘৃণা ক্রমশ বেড়ে চলেছে। সত্যি মায়ের কি ওকে ছেড়ে যেতে একটুও কষ্ট হয় নি? নিজের সুখটাই তার কাছে সবচেয়ে বড়ো হয়েছিল। মা কাউকে ভালোবেসে চলে না গেলে হয়ত সার্থক এর বাবা আর বিয়েও করতো না। ও অবশ্য এত কথা শুধু বাবার কাছে শোনে নি , পিসি ওকে সব বলেছে। অল্প বয়েসে বিধবা হয়ে সাধনা বাপের বাড়িতেই কাটিয়ে দিলো প্রায় সারাটা জীবন। সার্থক এই পিসির কাছেই মানুষ। নতুন মা ওকে যে খুব একটা সহ্য করতে পারে না, সেটা ও জানে। তাতে খুব একটা কষ্ট পায় না সার্থক, ভাবে যে নিজের মা,সেই যদি ওকে ছেড়ে চলে যেতে পারে, অন্য কেউ তো এটা করতেই পারে। শুধু পিসির কিছু হলে সার্থক খুব উতলা হয়ে পড়ে। নতুন মা আর পিসির সাথে ঝগড়া ওদের পরিবারে নতুন কিছু নয়, পাশাপাশি বাড়ির সবাইও জানে।

সার্থক লক্ষ্য করেছে পিসির সব কাজে নতুন মা খুঁত ধরতে ব্যস্ত থাকে সবসময়। এটা আবার সাধনার একদম পছন্দ নয়, এই নিয়ে লেগে যায় ঝগড়া। সবচেয়ে আশচর্য লাগে সার্থকের, বাবা সবসময় নতুন মাকেই সমর্থন করে। কার দোষ বা কার কোনো দোষ ই নেই এসব দেখা প্রয়োজনই মনে করে না। সার্থক এর এটাই সবচেয়ে খারাপ লাগে। ওর আর কোনো ভাই বোন হয় নি, হলে হয়ত সার্থক আর পিসি এই বাড়িতে থাকতেই পারতো না।

সার্থক দু বার উচ্চ মাধ্যমিক দিয়ে যাহোক করে পাশ করেছে। এখন অনেক কষ্ট করে একটা অখ্যাত কলেজ এ ভর্তি হলেও ক্লাস খুব একটা করে না। আসলে বাড়ির অনেক কাজের দায়িত্ব সর্থকের কাঁধে। বাজার দোকান সব ওই করে। ঘরের কাজ পিসি শরীর খারাপের জন্য করতে না পারলে সেটাও ওর দায়িত্ব। এরপর নতুন মায়ের অনেক ফাই ফরমাস আছে, যা না করলে, বাবা এলেই নালিশ হবে সেটা সার্থক ভালো করেই জানে।

সেদিন বাজার থেকে ফিরেই সার্থক শুনলো আজ কিছু অতিথি আসবেন, তার জন্য ওকে নতুন মা একটা 500 টাকার নোট দিয়ে বলল মিষ্টি নিয়ে আসতে। বাজার থেকে ফিরে একটুও রেস্ট না নিয়ে আবার ছুটল মিষ্টি আনতে। রাস্তায় গিয়ে ভাবল আজ কারা ওদের বাড়িতে আসবে সেটা পিসি কে জিজ্ঞেস করা হলো না। মিষ্টি নিয়ে ফেরার সময় আর এক বিপত্তি হল সার্থকের। মিষ্টির দোকানের ফেরত টাকাটা রাস্তায় হারিয়ে ফেলল। সার্থক জানে বাড়িতে ফিরলে এই নতুন মা ওর থেকে হিসাব চাইবে। তাই আগে ও পিসির ঘরে গেল,

"পিসি আমাকে কিছু টাকা দিতে পারবে?"

"কেন কি হল? কত টাকা?"

"অত প্রশ্ন কোরো না তো ,"আগে টাকাটা দাও"

আবার বলল

"265 টাকা লাগবে, আমি মিষ্টি আনার সময় রাস্তায় হারিয়ে ফেলেছি"

পিসি লক্ষ্মীর ভার থেকে কিছু মোড়ানো টাকা বের করে আনল। সব মিলিয়ে যা হোক করে টাকাটা পূরণ হলো কিন্তু এই মোড়ানো টাকা নতুন মাকে দিতে গেলেই মা অনেক প্রশ্ন করবে, কিন্তু কিছু করার নেই, অবশেষে মাকে গিয়ে ওই টাকাটা সার্থক দিল।

টাকাটা হাতে নিয়েই ভ্রু কুঁচকে নতুন মা জিজ্ঞেস করল

"দোকান থেকে এত কুঁচকানো টাকা তুই নিলি কেন? বলার মুখ নেই যে এই টাকাটা বাজারে চালানো যাবে না"

সার্থক কোন কথা না বলে পিসির ঘরে চলে যায়।

একজন মানুষকে যদি অন্ধকার ঘরে রেখে দেওয়া হয় সে আস্তে আস্তে ওই অন্ধকার ঘরের সমস্ত জিনিসপত্র দেখতে পাবে, এমনটাই হয়েছে সার্থক এর জীবনে। এখন ওর কষ্টটা ঠিক কষ্টের এর মত লাগে না। কিছুটা গা সওয়া হয়ে গেছে। বার বার অপমানে মনটা পাথর হয়ে গেছে।তাই এখন অপমানটা অপমান এর মত লাগে না। কিছুক্ষণের মধ্যেই ও ঝেড়ে ফেলতে পারে।

"পিসি তুমি কি জানো আজ আমাদের বাড়িতে কারা আসবে?"

পিসির কয়েকদিন ধরেই খুব পায়ে ব্যথা তাই পায়ের তেল মালিশ করতে করতে বলল

"তোর নতুন মায়ের বাপের বাড়ি থেকে হয়তো কেউ আসবে, আমিও সঠিক জানিনা"

সার্থক আর কোন কথা না বলে একটা গল্পের বই নিয়ে খাটে বসে পড়ল। কিন্তু বেশিক্ষণ বসতে পারল না , পাশের ঘর থেকে নতুন মায়ের চিৎকারে ওকে উঠে যেতে হল। পিসি অসুস্থ তাই রান্নাঘরের অনেকটা দায়িত্বই স্বার্থক কে সামলাতে হচ্ছে। না হলে বাবা এলেই নালিশ।

সার্থক এই কয়েকদিন ধরে লক্ষ্য করছে নতুন মায়ের আচরণে বেশ কিছুটা পরিবর্তন হয়েছে,অন্তত তার প্রতি আচরণ বেশ অনেকটাই বদলেছে কারণটা ও কিছুতেই বুঝতে পারছে না। যে মানুষটা প্রতি কথায় ওকে অপমান করে আনন্দ পেত সে কিছুদিন ধরে ওর প্রত্যেক কথা সমর্থন করছে। আজ স্বার্থক পিসিকে ও এই কথা জানালো। পিসি ও লক্ষ্য করেছে। তবে পিসির মতে নতুন মা বিনা কারণে ব্যবহার পরিবর্তন করেনি। নিশ্চয়ই বড় কোনো কারণ আছে। তবে এতদিন পরে নতুন মায়ের মিষ্টি মিষ্টি কথা শুনতে সার্থকের বেশ ভালই লাগছে।

সার্থক এর ডাক নাম বাবু। সেদিন সকালে জলখাবার খাওয়ার পরেই নতুন মা সার্থক কে ঘরে ডাকলো।

"বাবু তুই একবার আমার সাথে আমার দাদার বাড়ি যেতে পারবি"?

"হ্যাঁ কখন যেতে হবে বলো?

"তুই ঘরে টিভি দেখ আমি বেরোনোর সময় তোকে ডেকে নেব"

নতুন মায়ের দাদার বাড়ি ঢাকুরিয়া। সেখানে বেশ কয়েকবার সার্থক গেছে বাবার সাথে।

বিকেল চারটের আগেই নতুন মায়ের সাথে সার্থক ঢাকুরিয়ার উদ্দেশ্যে বেরোলো।

পিসির কিন্তু মনটা ভাল লাগছিল না। একটা আশঙ্কা হচ্ছিল কিন্তু সেটা কাউকে বলতে পারছিল না।

রাত একটু বাড়তে সার্থক এর পিসি খুব ছটফট করতে লাগলো। কিন্তু সারা রাত কেটে গেলেও নতুন মা আর সার্থক ফিরল না। সার্থক এর বাবা কে কিছু বলতে গেলেও সে তা শুনলো না। বরং পিসির ওপর রাগ করে বলে উঠলো

"তোমার প্রবলেমটা কি বলতো? মা তার ছেলেকে নিয়ে গেছে তোমার অত চিন্তা করার দরকারটা কি?"

পিসি কিন্তু সারা রাত ঘুম এলো না। তবে শুতে যাবার সময় সার্থকের বাবা পিসির ঘরে এসে বলে গেল

"দিদি তুমি এত চিন্তা করোনা আজ সার্থকের শরীরটা ভালো লাগছিলো না তাই মাকে বলেছে একদিন থেকে যাওয়ার কথা, কাল ওরা চলে আসবে তুমি প্লিজ ঘুমিয়ে পড়ো"

পরের দিন নতুন মা ফিরল, কিন্তু সার্থক নয়। পিসি নাওয়া খাওয়া বন্ধ করে দিল সার্থকের চিন্তায়। নতুন মা ফিরে সবাইকে জানালো সার্থক ওর দাদাদের সাথে পুরি গেছে। নতুন মাই ওকে জোর করে পাঠিয়েছে কারণ সার্থক কোনদিন পুরি যায়নি।পিসির মনটা কিন্তু মান ছিল না। একবার ফোন করে স্বার্থর সাথে কথা বলতে চাইল। সেটা নতুন মা বেশ কায়দা করে এড়িয়ে গেল।

"কেন আবার ওকে বিরক্ত করবেন বেশ ঘুরে বেড়াচ্ছে সেটা কি সহ্য হচ্ছে না"?

পিসি এবার বেশ ভালো করেই বুঝতে পারে নতুন মা মিথ্যে কথা বলছে।

সেদিন পিসির কথা সত্যি প্রমাণিত হলো। সার্থক দুপুরেই ফিরে এল আর ওকে দেখে নতুন মা ভুত দেখার মত চমকে উঠে বললো

"কিরে তুই কি করে চলে এলি"?

সার্থক মাথা নিচু করে পিসির ঘরে ঢুকে খাটে বসে পরলো। পিসি অনেক কথাই জিজ্ঞেস করল কিন্তু সার্থকের থেকে একটাও উত্তর পেল না ।

এবারে সার্থক যেন একটু বেশী রকমের চুপচাপ হয়ে গেছে। পিসির সাথে ও খুব একটা কথা বলেনা। নিজের বই, টিভি আর পড়াশোনা নিয়েই সারাদিন কাটিয়ে দেয়। আবার সংসারের কাজকর্ম ও আগের থেকে এখন অনেক বেশি করে। সার্থক এই কয়েকদিন কোথায় ছিল এই নিয়ে আর কোন কথা হয়না ওদের পরিবারে। পিসি কিন্তু অনেক আগেই সিঁদুরে মেঘ দেখে ছিল।

সেদিন বাজার থেকে ফিরে সার্থক শোনে পিসি খুব জোরে ওদের কাজের মাসি রত্নাকে ডাকছে

"রত্না একটু এইদিকে আয় তো মা দেখতো নতুন বউয়ের কি হলো?"

"সার্থক ছুটে নতুন মায়ের ঘরে ঢোকে। নতুন মা মেঝের মধ্যে অজ্ঞান হয়ে পড়ে আছে। সার্থক মাকে পাঁজাকোলা করে তুলে বিছানায় শোয়ায়। পিসি গরম দুধ এনে সার্থক কে বলে চামচে করে মুখে দিতে। এর মধ্যে বাবাও এসে হাজির হয়।

হসপিটালে দেওয়ার মত অবস্থা হলেও বাবা চায় বাড়িতে রেখে চিকিৎসা করাতে। তাই হল। তবে ডাক্তারের সাথে কথা বলে সার্থক বুঝল নতুন মায়ের একটা কিডনি প্রায় নষ্টের মুখে। নতুন কিডনি না দিলে রোগীকে বাঁচানো খুব মুশকিল এটাও ডাক্তারবাবু জানিয়ে দিলেন। বাবা খুব ভেঙে পড়ল । পিসিও যথা সাধ্য নতুন মায়ের সেবা করতে লাগলো। কিন্তু রোগীর অবস্থা ক্রমশ খারাপের দিকেই এগুতে লাগলো। সার্থক পরের দিন বাবার মুখে শুনল কিডনি ট্রান্সফার না করলে নতুন মাকে বাঁচানোর অসম্ভব । কিন্তু কে দেবে কিডনি? বাবা আর পিসির পক্ষে দেওয়া সম্ভব নয়, বাকি রইল ও নিজে। অনেক চিন্তা করে বাবার ঘরে এসে বলল সার্থক

"বাবা তুমি আমার ব্লাড টেস্ট করাও নতুন মায়ের জন্য আমি নিজেই কিডনি দেব"

বাবা কোন কথা না বলে অপলক দৃষ্টিতে সর্থোকের দিকে চেয়ে রইল। দুচোখে জল। সেই সময় বাবার বুকের ভেতরের তুফান টা হয়তো অনেকেই দেখতে পেল না কিন্তু সার্থক উপলব্ধি করতে পারল

"বাবা নতুন মা আমাকে ছেলে বলে না মানলেও আমি মা বলেই মানি। আর আমার মায়ের জন্য আমি কিডনি দেব"

বাবার মুখে কোন কথা ফোটে না এখনো।

"তুমি আজি ডাক্তার বাবুর সাথে কথা বল "

এবার পিসির ঘরে গিয়ে ঢুকে সার্থক।

"পিসি তুমি অত চিন্তা করো না আমার জন্য আমি খুব ভালো আছি"

পিসি ওর মুখের দিকে অনেকক্ষণ তাকিয়ে থেকে জিজ্ঞেস করে

"একটা কথা বলবি বাবু?"

সার্থক কোন উত্তর না দিয়ে ইশারায় হ্যাঁ বলে

"তুই নতুন মায়ের সাথে গিয়ে দু দিন কোথায় ছিলিস?"

এবার সার্থক কপট রাগ দেখিয়ে বলে

"তোমাকে কি সবই জানতে হবে?"

কিন্তু পিসির কাছে ও সত্যি কথাটা বলেই ফেলল সেদিন।

"আমি তোমাকে বলতে চাইছিলাম না কারণ তুমি জানলে খুব কষ্ট পাবে তাও তুমি যখন এত করে বলছ তবে শোনো আমাকে নতুন মা বাপের বাড়িতে নিয়ে যায়নি। বাপের বাড়ি যাবার নাম করে উনার এক বোনের বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিল কারণ উনার বোনের মেয়ের একটা কিডনির প্রয়োজন ছিল এবং আমার রক্তের গ্রুপ মিলে গেলে হয়তো আমাকেই ওটা দিতে হতো , আর এটা বাবাও জানতো। ওদের অন্য।কোথাও থেকে ওটা মিলে যাওযায় আমি ফিরে আসি। একমাত্র তুমি ছাড়া এই পৃথিবীতে আমাকে আর কেউ ভালোবাসে না সেটা আমি খুব ভাল করেই জানি। তোমার কাছে আমি কোন কথা লুকোতে পারি না বা মিথ্যে কথা বলতে পারি না, তাই তুমি আজ এই কথাটা জানতে পারলে"কান্নায় পিসির গলা দিয়ে সর বেরচ্ছিল না তাও বলল

"তোকে নতুন মা আর তোর বাবা এত কষ্ট দিয়েছে তাও তুই ওর জন্য নিজের অঙ্গ টাও দিতে প্রস্তুত। সত্যি বাবু তোর জন্য আমার গর্ব হয়"

সার্থকের চোখ জলে চিকচিক করে উঠলো।

"পিসি আবার বলে উঠলো

"তোর বাবা সারা জীবন বলে এসেছে সার্থকের জীবনে কোন কিছু হবেনা। ও কোনদিন কোন কিছুতেই সফলতা পাবে না , কিন্তু ক'জন সফল মানুষ তোর মতো মাকে নিজের অঙ্গ দিয়ে বাঁচাতে প্রস্তুত হয়? এর চেয়ে সফল কাউকে আমি জীবনে দেখিনি। যে তোকে নিজের বোনের মেয়ের প্রাণ বাঁচানোর জন্য কিডনি দিতে বাধ্য করছিলো, তুই আজ তার জন্যেই নিজের অঙ্গ দিতে প্রস্তুত, ভগবান তোর সব দুঃখ বুঝিয়ে দেবে বাবু"

আর কান্না আর বাঁধ মানে না । সার্থক পিসির কাঁধে মাথা রেখে হাপুস নয়নে কাঁদতে থাকে।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational