সোমার ডাইরি
সোমার ডাইরি


আমি সোমা, গৃহবধূ, মহানগরীর ব্যস্ত জীবনে দ্রুত গতিতে ছুটে চলেছি আমিও । তবু দিনের শেষে মনে পরে যায় আমার অতীত । আপাত শান্ত স্কুল জীবনে ও এমন কিছু ঘটনা ছিলো যা আজ ও মনে পড়লে আমার বুক কেঁপে ওঠে, রাতের ঘুম কেড়ে নেয়। আমার মনে একই সাথে বসবাস করে চলেছে আমার অতীত ও বর্তমান । আমি ঠিক গুছিয়ে কথা বলতে পারি না, তাই লিখে রাখতে চাই কিছু ঘটনা,
আমি সোমা, বাবা মায়ের একমাত্র মেয়ে, পোড়াশোনা, নাচ, গান, ছবি আঁকা এই নিয়ে ই ব্যস্ত থাকতাম আমি। খুব কম কথা বলি,সবার সঙ্গে মিশতে পারি না । এই সোমাটা কেই সবাই চেনে । কিন্তু স্কুলে আমার কিছু বন্ধু ছিলো । আমার বাকি বন্ধুরা ও ঠিক আমারি মতো ছিলো । কিন্তু একসঙ্গে থাকলে আমরা পাল্টে যেতাম সম্পুর্ণ । আমাদের মধ্যে ছিলো না কোনো প্রতিযোগিতা, একসঙ্গে টিফিন খাওয়া, একসঙ্গে সাইকেল করে স্কুলে যাওয়া, কোনো কারণ ছাড়া হেসে উঠা আর তার সঙ্গে মারামারি খুনসুটি ও চলতো সমান তালে ।
আমাদের সময় মাধ্যমিকের পর কিছুদিন ছুটি থাকত, তারপর আবার নতুন ক্লাস শুরু হতো । ঘটনাটি ঘটেছিলো ঠিক সেই সময়েই ।
আমি, রেশমি, মধুমিতা থাকতাম একই পাড়ায় । আমাদের বাড়ির পাশেই খোয়াই নদী । মধুমিতাদের বাড়িতে সেদিন আমাদের সব বন্ধুদের নিমন্ত্রণ ছিলো । অনেক কিছু রান্না হয়েছিলো । প্রচুর খাওয়া দাওয়া গল্পে, খুব মজা করেছিলাম সেদিন ।লিনা, শিবানী, অনিন্দিতা, সুনন্দিতা, কৃষ্ণা, সুপর্ণা, সবাই এসেছিলো। ওদের তারপর নদী দেখার বায়না করলো । সবাই মিলে নদী দেখতে বেরোলাম ।
ওরা খুব খুশী ছিলো । আমি রেশমি, মধুমিতা হাটতে বেরোতাম তবে খুব একটা দূরে যেতাম না । কিন্তু সেদিন সবাই মিলে গল্প করতে করতে অনেকটা দূরে কখন চলে এসেছিলাম, একদমই তা খেয়াল করিনি । কি সুন্দর নদী, অপূর্ব প্রাকৃতিক দৃশ্যে আমরা বিভোর হয়ে ছিলাম । আমাদের ঠিক পাশে যে কখন কাটা তারের বেড়া চলে এসে উপস্থিত হয়েছে , আর তার কি গুরুত্বপূর
্ণ ভূমিকা সে খেয়াল একদম ই করিনি । একটা দিক একটু নীচু পেয়ে একে অপরের সাহায্যে চলে গেলাম বেড়ার ও পাড়ে ।
মুহূর্তে বন্দুক হাতে কতোগুলো লোক ছুটে এসে আমাদের ঘিরে ফেললো! কোথায় ছিলো এরা লুকিয়ে!!!! আর পোশাক গুলো তো আমাদের একদমই অচেনা!!! মধুমিতা হাত দুটো মাথার উপরে তুলে সোজা হয়ে দাড়িয়ে পড়লো । তা দেখে বাকিরাও একই ভাবে হাত তুলে দাড়িয়ে পোরলো । আমি শুধু ভয়ঙ্কর ভাবে কেদে উঠলাম । আমার সঙ্গে বাকি মেয়েরাও সুর মেলালো ।
ওদের এক ধমকে কান্না থামলো আমাদের । ।
ওদের মধ্যে একজন বন্দুক মাটিতে রেখে সামনে এগিয়ে এসে আমাদের বুঝিয়ে বলার পর পুরো ব্যাপারটা বুঝেছিলাম।
আমরা নাকি দেশের সীমানা ছাড়িয়ে পৌছেঁ গেছিলাম বিদেশের মাটিতে । আর পাসপোর্ট, ভিসা, উপযুক্ত কাগজ ছিলোনা আমাদের কাছে, তাই আমরা অপরাধী । কতোটা বিপদে পড়ে গেছিলাম বুঝলাম তখন! খুব ভালো ভাবে বুঝিয়ে আমাদের ছেড়ে দিলেন । আর কোনোদিন যেনো অসতর্ক না হই তা বলেছিলেন । একছুটে পালিয়ে এলাম সেখান থেকে ।যেমন হটাত উদয় হয়েছিলেন ঠিক তেমনি হওয়ায় যেনো মিলিয়ে গেলেন ওনারা ।
কিন্তু এবার যে উঁচু তারকাঁটা বেড়া পেরোতে হবে, সবাই পেরে গেলো, কিন্তু আটকে গেলাম একমাত্র আমি!! সুপর্ণা ফিরে এলো, কি করে জানি না আমাকে কোলে তুলে নিয়ে ওপারে পৌছে গেলো । সবাই একে একে বাড়ি ফিরে গেলাম ।
তখন ছোটো ছিলাম, বুঝতে পারিনি কতোটা ভয়ঙ্কর সেই ঘটনা । একটা ভুলে শেষ হয়ে যেতে পারতো আমাদের জীবন ও । চেহারা গুলো মনে নেই, তবে সেই বন্দুকধারী দাদাদের আজ রাখী পূর্ণিমার দিনে প্রণাম জানাই । তোমরা আমাদের নতুন জীবন দিয়েছিলে। যেখানে অসহায় মানুষের দুর্বলতার সুযোগ নিচ্ছে একশ্রেণীর মানুষ, সেই একই সমাজে তোমরা আছো বলেই এখনো প্রতিদিন সূর্য নিয়ে আসে নতুন সকাল!!!
আমরা তোমাদের ভুলিনি ।
যেখানেই থাকো ভালো থেকো, ।