সংশোধন
সংশোধন
তিন বাই সাত বিছানায় দীর্ঘদিন কুঁকড়ে শুয়ে থাকতে থাকতে কখন যে সাপ থেকে কেন্নো হয়ে গেছি, নিজেই বুঝে উঠতে পারিনি। আমার চরিত্রগত ফোঁসফোঁস শব্দগুলো গুটিসুটি মেরে কোণাকানচিতে নেতিয়ে পড়েছে। আধমরা সরীসৃপের মতো থেতলে গেছে শরীরের বহু অংশ। একটা মাঝবয়সী মহিলা আয়া হিসাবে
দিনে একবার করে ড্রেসিং করে দেয় আমার দেহগত ঘাগুলোকে। নইলে রাতের দিকে একবার যে ছোটোছেলে বিশু অফিস ফেরত এ ঘরে ঢুকে রুটিন মেনে আমার খবর নেবে, তার জন্য উপযুক্ত বাতাবরণ থাকে না। দুর্গন্ধে ঘরের ভেতরটা নাকি গুমট হয়ে থাকে। এসব আমার ছেলে বিশু বলে। ও অফিস যাওয়ার তাড়ার মধ্যেও তাই সকালে একবার করে উঁচুস্বরে মাঝবয়েসী আয়াকে বুঝিয়ে দিয়ে যায়, আমার ছোঁয়া সবকিছুকে প্রত্যহ ডেটল ওয়াশ করার কথা। আমি অবশ্য আজকাল কোনো গন্ধই পাই না। হয়তো একনাগাড়ে পচনশীল দেহটার সাথে একাত্ম হয়ে আছি বলে। কিন্তু একটা আজব রকমের দুর্গন্ধ মাঝেমধ্যে ক্ষনিক সময়ের জন্য আমার নাকে এসে ঠেঁকে। সেটা ঠিক ওষুধের ঝাঁজ বা দেহের ক্ষত কেন্দ্রিক গন্ধ নয়। একটু অন্যরকম তার অনুভূতি। সেই অনুভূতি সামান্য কিছু সময়ের জন্য আমার ঘ্রাণেন্দ্রিয় দিয়ে প্রবেশ করে আমার সমস্ত সত্ত্বাকে ধাক্কা দিয়ে জিজ্ঞেস করে যেন, 'টের পাচ্ছিস তোর মনের ঘাগুলোকে? আর কবে পাবি? দিনতো ফুরিয়ে এলো।'
আমি এসবের মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝে উঠতে পারিনা। আবার যেদিন এই অনুভূতিটা হয়, সেই দিনই রাতে স্বপ্ন দেখি একটা এলার্ম দেওয়া টেবিল ঘড়িকে। ঘড়ির কাটা জানান দেয় আমায়, বারোটা বাজতে পাঁচ মিনিট বাকি। আর সেই ঘড়ির দিকে চেয়ে আমার কেবলই মনে হয় যেন ঘড়িটার একাংশ দ্রুত ভেঙে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে বালির মতো মিশে যাচ্ছে পঞভূতে। আর ঘড়িটাও নিজের ওজন হারিয়ে ক্রমশ উপরের দিকে ভেসে আমার হাতের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে।
সেদিন সকালে উঠে আগের দিন রাতের ঘড়ির স্বপ্নের কথাটা ভাবছিলাম, মনে হচ্ছিল ঘড়িটা যেন খুব চেনা চেনা। এমন সময় মাঝবয়সী আয়াটার কিছু কথা কানে এলো। ও সম্ভবত পাশের ঘরে ফোনে কারো সাথে কথা বলছিল। শুনতে পেলাম 'যা ভুল করার তো করেই ফেলেছি রে। আজ আর তা বলে কি হবে? আমার ভুলেই তো আজ সম্পর্কগুলো সব এলোমেলো হয়ে গেল। দাদার যা অবস্থা দেখে এসেছি, এখন গিয়ে ক্ষমা না চাইলে, কদিন পর তো নিজেকেও আর ক্ষমা করতে পারব না। তাই ভাবছি, এরমধ্যে একদিন কাজে ছুটি নিয়ে যাবো।'
কথাগুলো শুনে আমার হঠাৎ আমার মৃত বাবার কথা মনে পড়ে গেল। একবার আমি স্কুলের স্পোর্টসে একটা ছেলেকে অন্যায়ভাবে ঠেলে ফেলে দিয়ে এগিয়েছিলাম বলে, আমায় বাবা বলেছিলেন 'দীপক, একটা কথা জানবি ন্যায় অন্যায়ের হিসাবটা ঠিক পৃথিবীর সূর্যকে প্রদক্ষিণ করার মতোই একটা অবিরাম প্রক্রিয়া। তা কারো চোখে পড়ল কি না পড়ল, আমরা আমাদের হিসাবে তা মেলাতে পারলাম কি না পারলাম ... এসবের উপর আদৌ নির্ভরশীল নয়। তাই জীবনে যখনই নিজের ভুল বুঝতে পারবি, আগে তার কাছে গিয়ে ক্ষমা চেয়ে নিবি। মনে রাখবি, সময় থাকতে থাকতেই ভুল স্বীকার করতে হয়, নইলে সময় হাতের নাগালের বাইরে চলে গেলে, হাজার মাথাকুটেও আর কোনোই লাভ হয় না।'
এসব মনে করতেই মনে পড়ে গেল, বাবা ওর
টেবিলে রাখা এলার্ম ঘড়িটাকে দেখিয়ে বলেছিলেন আমায় 'এই ঘড়ির কাটা যেমন থেমে থাকে না কারোর জন্য, তেমনি আমাদের জীবনও থেমে থাকে না কারোর কর্মসূচি অনুযায়ী। নিজের ছন্দে এগিয়ে চলতে থাকে ঠিক ভুলের অঙ্কের সাথে। অনেক পুরানো হিসাব দেরি হয়ে গেলে সংশোধন করতে পাতা উলটে খুঁজে পাওয়াটা কঠিন হয়ে পড়ে।'
এসব বলতে বলতে নিজেই চুপ করে যেতেন। আমি বুঝতাম, বাবা দিদিকে পড়াশুনা না করিয়ে বিয়ে দিয়ে খুব অনুতপ্ত হয়েছিলেন। দিদি মেধাবী ছিল, কিন্তু অকালে শ্বশুরবাড়ির অবহেলায় শেষ হয়ে গিয়েছিল। আর তখন থেকেই বাবার মনের মেরুদণ্ডটাকে আমি একটু একটু করে নুয়ে যেতে দেখেছিলাম।
আমিও বাবার শুরুর দিকের মতোই বা হয়তো বাবার চেয়েও কয়েক কাঠি আরো উপরে ছিলাম। একরোখা, দাম্ভিক। কোনো কাজ করার পর চিন্তাই করতাম না, ঠিক কি ভুল। একটা রুক্ষ দৃঢ়তা ভেতরের মনের বিচারকে দলিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়াত সর্বদা। তার বশবর্তী হয়ে নিজের স্ত্রীয়ের প্রতি সঠিকভাবে নজর দিনি ... বড়ছেলে মায়ের মতো ন্যায়ের পুজারি হওয়ায় আমার সাথে মতান্তর করত বলে পৈতৃক বাড়ি থেকে তাকে একরকম বেরিয়ে যেতে বাধ্য করেছিলাম ... ছোটো ছেলেকে আমার মনের মতো করে পেয়ে, তার অনেক ভুল সিদ্ধান্তে নিরন্তর স্বাচ্ছন্দ প্রকাশ করে গেছি ... নিজের কর্মজীবনেও অনেকের সাথে ছল চাতুরি করে উপরের পজিশনে উঠেছি ... আমার দ্বিতীয় সন্তান হওয়ার সময় মাসতুতো বৌদির সাথে অসংযত হয়ে .... উফফফ, আর চিন্তা করতে পারছি না আমি। আমার চিন্তাধারাগুলো কেন এভাবে দ্রুত আমাকে আমার অতীত জীবনের দিকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে গিয়ে একের পর এক ভ্রান্তিবিলাস ঘটাচ্ছে? আমার কর্দমাক্ত রিপুজাত কর্মগুলোকে ঘাটাঘাটি করছে। চেতনা সহসা যেন আমায় নাড়িয়ে ফিসফিস করে বলে উঠল, এক জীবনে এতোগুলো ভুলের পাহাড় কিকরে গড়েছিলাম আমি? তবে কি বাবার কথামতো এই ক্ষমাহীন কর্মের পাহাড়গুলোই আজ আমার শরীরের পচনজাত দুর্গন্ধের কারণ? নাকি এসমস্ত ভুলের মূলে আমার যে অস্বচ্ছ চরিত্র ও দূষিত মনের বিচার ছিল, তার থেকেই ভিন্নতর এক দুর্গন্ধ বের হচ্ছে। আর একাকী ঘরে বিছানার উপর শেষ সময়ের সুযোগের মতো লেপ্টে থাকতে থাকতে, আমি সেই দুর্গন্ধই মাঝেমধ্যে টের পাই ... ক্ষনিকের জন্য।
আর ওই স্বপ্নে দেখা ঘড়িটা কি বোঝাতে চায় আমায়? ... আমার আয়ুষ্কালের বারোটার ঘর আসন্ন? ... সময়টা দ্রুত আমার হাত থেকে বেরিয়ে যাচ্ছে পঞ্চভূতের আকর্ষণে? ... আমাকে ক্ষমা চাইতে হবে?
ভাবতেই তৎক্ষনাৎ যেন মনে হল আমার চারপাশের মৃত ও জীবিত মানুষগুলো দূরে দাঁড়িয়ে আমার দিকে চেয়ে একটা করে সুযোগ ছুঁড়ে দিচ্ছে তাচ্ছিল্যের সাথে। আর বলছে 'সময় থাকতে কটা অঙ্ক মুছে ঠিক করে নে। এরপর জীবন ঘড়িটা থেমে গেলে, আর বিবেক এলার্ম বাজালেও, শুধরানোর উপায় থাকবে না।'
আমি কিছুক্ষণের জন্য চেষ্টা করতে লাগলাম নিজের চারিত্রিক কাঠামোকে বদলে নরম হতে। কিন্তু কথায় বলে, সময় বহিয়া যায় নদীর স্রোতের প্রায়।
অত:পর হঠাৎই কানে ভেসে এলো ঘড়ির কাটার বারোটার ঘরে মিলিত হওয়ার শব্দ। আর সূচিছিদ্র অন্ধকার হাতড়ে আমার সংশোধনের প্রয়াসগুলো তখন বৃথা দাপাদাপি করতে থাকল মহাশূন্য মাঝারে।
(সমাপ্ত)