সন্ধি
সন্ধি
হাসপাতাল থেকে ফিরে মায়ার আর কিছু ভালো লাগছিলো না। শুধুই সন্ধির চিন্তা মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছিল। কে জানে ছেলেটা পুরো সুস্থ হয়ে উঠবে কিনা। এখনও কলেজের পড়া শেষ হলো না আর এত বড় অসুখ বাঁধিয়ে বসে আছে। নার্সিংহোমে দিলে হয়তো আরো ভালো চিকিৎসা হত কিন্তু পয়সাটা তো অনেক বেশি লাগবে। মায়া ফ্রিজটা খুললো , না কিছুই নেই । এখন খেতে গেলে ওকে রান্না করতে হবে আর মায়ার শরীরটা ভাল লাগছিল না তাই ও কিছু না খেয়েই শুয়ে পড়ল।
মায়ার ওই একমাত্র ছেলে সন্ধীই সম্বল। সন্ধির বাবা সন্ধির পাঁচ বছর পূর্ণ হওয়ার আগেই মারা গেছেন নেশার কবলে পড়ে সন্ধির বাবা ছেলে আর বউ এর জন্য কিছুই রেখে যেতে পারেনি। মায়া অনেক কষ্ট করে একটা ছোট প্রাইভেট ফার্মে কাজ জোগাড় করেছিল ।
মাইনে খুব বেশি নয় তাও দুটো টিউশনির সাথে চাকরির মাইনেতে কষ্ট করে ওদের মা ছেলের চলে যায়। আর দেড় বছর পর সন্ধির কলেজ জীবন শেষ হত কিন্তু ওর এই অসুখটা ওদের জীবনটা এলোমেলো করে দিল। মায়া ব্লাড টেস্ট করার পর ভেবেছিলো সন্ধিকে অসুখের কথাটা পুরো জানাবে না কিন্তু সন্ধি কি করে ঠিক বুঝতে পেরেছিল । আসলে এই অসুখের চিকিৎসা খুবই ব্যয়সাপেক্ষ। যেটা করার ক্ষমতা মায়ার নেই। সাহায্য হয়তো চেষ্টা করলে কিছুটা পাবে কিন্তু তাতে হয়তো পুরো চিকিৎসা হবে না। সন্ধির হার্টে ব্লকেজ আছে। অপারেশন করা খুব জরুরি।
সেদিন মায়া অফিস বেরোনোর ব্যস্ততায় নিজের পার্স টা ভুলে গেল নিতে। বাসে উঠে ওর মনে পড়ল। তখন অনেকটা পথ চলে গেছে। কি আর করবে কিন্তু কন্টাকটার কে বোঝানো খুব মুশকিল। কন্টাকটার ভাড়া চাওয়ার আগেই ও বলে উঠলো
"দাদা আজ আমি পার্স আনতে ভুলে গেছি, কিছু মনে করবেন না আমার কাছে ভাড়া টা নেই"
"আরে দিদি ঐরকম কথা আমরা অনেকের কাছে রোজ শুনি,"
কন্টাকটার ব্যঙ্গ করে হাসলো।
পিছন থেকে এক ভদ্রলোক বলে উঠলেন
"মায়া আমি টাকা দিয়ে দিচ্ছি"
মায়া ঘুরে দেখে ওদের আগের পাড়ার শৈবাল দা। এখন বেশ একটু মুটিয়ে গেছে। তাই মায়ার চিনতে একটু মুশকিল হচ্ছিল।
"আরে শৈবাল দা কেমন আছো ? সত্যিই আমি না ব্যাগটা আজকে ভুলে গেছি আনতে।"
"আরে ঠিক আছে ,ভুল হতেই পারে"
কন্টাকটার এবার চুপ করে টাকাটা নিয়ে দুটো টিকিট দিল। নির্দিষ্ট স্টপেজ আসতেই মায়া শৈবালকে আবার ধন্যবাদ জানিয়ে নেমে গেল। এর মধ্যে শৈবাল ওর মোবাইল নম্বরটা নিয়ে নিয়েছিল। মায়ার আর নেওয়া হয়নি।
সেদিন অফিস থেকে ফিরে মায়া দেখে ওওর মোবাইলে দুটো মিস কল। নম্বর ওর চেনা নয়। ও আর রিংব্যাক করলো না। ফোনটা রেখে একটু ফ্রেশ হয়ে রান্নাঘরে ঢুকলো। আজ সকালে সন্ধি একটু চিকেন খেতে চেয়েছিল। সেটাই করার জন্য মিক্সি।টা অন করল। আবার ফোনটা বেজে উঠলো।
মায়া দেখল একটা অজানা নম্বর থেকে ফোন।
"হ্যালো কে বলছেন?"
"আমি শৈবাল বলছি, তোমাকে বলেছিলাম না ফোন করবো, কিছু মনে করলে না তো?"
"আরে না না কী মনে করবো, আমি এখনই বাড়ি ফিরলাম, ছেলের জন্য চিকেন বানাচ্ছি"
"শুধু ছেলেকেই খাওয়াবে নাকি, আমাদের জন্য তো বানাতে পারো"
মায়া বুঝল শৈবাল ঠাট্টা করে বলছে।
"হ্যাঁ বানাবো তো চলে আসুন খেতে হলে আমার বাড়িতে আসতে হবে"
সেদিন ওদের দু'জনের বেশ অনেকক্ষণ ফোনে কথা হয়। মায়া সন্ধির অসুখের কথা শৈবাল কে জানায়। সন্ধির বাবার কথাও কিছু হয়। আসলে মায়ার বিয়ে হয় বেশ কম বয়সে। আর মায়ার বিয়ে কোনরকম জাঁকজমক করে হয়নি। তাই শৈবাল দের বাড়ি মায়ার বিয়েতে আমন্ত্রিত ছিল না। তবে শৈবালের কিশোর বয়সের একটা আকর্ষণ বরাবরই মায়ার ওপর ছিল। কতবার ভেবেছে মায়াকে জানাবে। কিন্তু মায়াকে বলতে গিয়েও ও ফিরে এসেছে তার প্রথম কারণ মায়া কোনরকম আগ্রহ দেখায়নি আর দ্বিতীয় কারণ মায়ার বাবা পাড়ার মধ্যে একটু ডাকাবুকো টাইপের ছিলেন । একবার শৈবালের পাশের বাড়ির রঞ্জন এর সাথে খুব মারপিট হয় কারণ মায়ার দিদি লক্ষীকে স্কুল যাওয়ার পথে কোন একটা খারাপ কথা বলেছিল। এইসব নানা কারণে শৈবাল আর বলে উঠতে পারেনি আসলে শৈবাল খুব শান্ত ছেলে কোনরকম ঝগড়াঝাঁটি ওর পছন্দ নয় । আর একটা কথা খুব মানে সেটা হলো জোর করে কাউকে ভালোবাসা যায় না।
সেদিনের ফোনের পর শৈবাল মাঝেমাঝেই মায়াকে ফোন করে । শৈবাল জানিয়েছে ও বিয়ে করেনি। পরিবার ওর উপরেই নির্ভরশীল এখনও। বোনের বিয়ের জন্য অনেক চেষ্টা হলেও এখনও বোন অবিবাহিতা। সংসারে টাকা আনা ছড়ানোর আর কোনো গুরুত্ব নেই। এসব শুনে মায়ার খুব মন খারাপ হয়ে যায়। ভাবে এই পৃথিবীতে ভালো মানুষ রাই সবচেয়ে বেশি কষ্ট পায়।
সেদিন সন্ধির আর একটা ব্লাড টেস্টের রিপোর্ট আনতে যাওয়ার কথা ছিল। মায়া অফিস থেকে বেরিয়ে পার্কস্ট্রিট এল। তার আগে শৈবাল যখন ফোন করেছিল তখন শৈবালকে রিপোর্ট আনতে যাওয়ার কথা বলেছিল। রিপোর্ট নিয়ে রাস্তায় বেরিয়ে দেখে শৈবাল দাঁড়িয়ে।
"এত দেরী হল যে, গাড়িতে কোন প্রবলেম?
"না আসলে আজ অফিস থেকে বের হতেই একটু দেরী হয়ে গেলো , চলো কোথাও একটু চা খাই"
দুজনে একটা ছোট রেস্তুরায় ঢুকলো। প্রথমে দুজনে চাওমিন এর অর্ডার দিলো। হঠাৎ মায়ার নজরে পড়ে ওদের টেবিলের উল্টোদিকে সন্ধির বন্ধু পল্লব। প্রথমে ওর চোখাচোখি হতেই জিজ্ঞেস করল
"কিরে আজকে কোচিং যাসনি?"
পল্লব যেন একটু সংকোচ বোধ করল।
"না কাকিমা আজ আমার জন্মদিন ছিল তাই যাইনি এখন বন্ধুর সাথে খেতে এসেছি"
এবার পল্লব নিজের টেবিল থেকে উঠে মায়াদের টেবিলের কাছে এসে দাঁড়িয়ে সরাসরি জিজ্ঞেস করল
"এটা কে কাকিমা?"
মায়া একটু অবাক হলেও উত্তর দিল
"ইনি আমার বন্ধু শৈবাল মুখার্জী"
শৈবালের সাথে পল্লব হ্যান্ডসেক করলো ।তারপর আবার নিজের টেবিলে চলে গেল।
মায়ারাও বেশিক্ষণ বসলো না।
এর দিন সাতেক পর একদিন সন্ধি বাড়িতে ঢুকেই বিছানায় শুয়ে পড়ল। মায়ার সবসময়ই আতঙ্ক হয়তো শরীর আরো বেশি খারাপ হল
"কিরে সন্ধি শরীরটা কি খুব খারাপ লাগছে"
"না ঠিক আছে , মা একটা কথা তোমায় জিজ্ঞেস করবো"?
"হ্যাঁ বল কি কথা?"
"তোমার কি কোন বয়-ফ্রেন্ড আছে?"
"ছি ছি মাকে কি এভাবে বলতে হয়? আর বয়ফ্রেন্ড কেন বলছিস আমার বন্ধু তো থাকতেই পারে সেটা ছেলে হোক বা মেয়ে"
মায়া ঘর থেকে বেরিয়ে গেল। দেখলো সন্ধি পাশ ফিরে শুয়ে পড়ল। মায়া ভাবল এই ছেলের জন্য আমি জীবনের সব সুখ ,সব আনন্দ ,সব আশা ছেড়ে দিয়েছি কিন্তু আজ সন্ধি এটা কি বলল, তবে কি শৈবালের সাথে কথা বলে বা দেখা করে আমি খুব অন্যায় করছি? নিজের মনকে বার বার জিজ্ঞেস করল মায়া। রাতে শৈবালের ফোন ধরল না কিন্তু আবার এটাও ভাবল শৈবালের কোন দোষ নেই ওতো ওকে সাহায্য করার জন্য এগিয়ে এসেছে আর সাহায্য টা শুধু ওর জন্য নয় সবটাই সন্ধির জন্য।
আজ অফিস বেরোনোর মুখেই শৈবালের ফোন
"মায়া আমি বেশ কিছু টাকা জোগাড় করে ফেলেছি তুমি প্লিজ আর না করুণা সন্ধির অপারেশনটা করিয়ে নাও"
"কি বলছো শৈবাল এত টাকা আমি তোমার থেকে কিভাবে নেব?"
"আমি তোমাকে দিচ্ছি না ওটা আমি সন্ধিকে দেবো"
এবার বেশ কঠিন গলায় মায়া বলল
"সন্ধি যদি না নিতে চায়?"
"ঠিক নেবে তুমি অত চিন্তা কোরো না, ওটা আমার উপর ছেড়ে দাও"
মায়া বুঝল শৈবাল কে বোঝানো অত সোজা নয়। আবার এটাও ভাবল এই অপারেশনের টাকার জন্য ও আজ ছ মাস ধরে অপেক্ষা করে বসে আছে। মন তো বার বার বলছে টাকাটা নিয়ে অপারেশন করে নেওয়াটাই ঠিক। কিন্তু সন্ধি কি রাজি হবে?
পরদিন শৈবাল সোজা মায়ার বাড়িতে চলে এলো। সন্ধিও তখন বাড়িতেই ছিল। মায়া সারারাত ধরে ভেবে ঠিক করলো হ্যাঁ টাকাটা ও নেবে আর তার জন্য সন্ধি কে জিজ্ঞেস করার কোন দরকার নেই। সন্ধির এখন জীবন মরণ সমস্যা। সন্ধিকে ঘর থেকে ডাকলো
"সন্ধি একটু এই ঘরে আয় তো, তোর সাথে দেখা করতে তোর এক কাকু এসেছেন"
সন্ধি মুখটা বাড়িয়ে দেখল। একটু পরে গেঞ্জি টা চেঞ্জ করে শৈবালের কাছে এসে বসলো। শৈবাল সন্ধির সাথে অনেকক্ষণ গল্প করল। মায়া ভাবল কি বলবে সন্ধি কালকে শৈবালের সম্বন্ধে এত বাজে কথা বলছিল। সেদিন অনেকক্ষণ কথা বলার পর শৈবাল চলে গেল। রাতে সন্ধি মাকে বলল
"মা শৈবাল কাকু কে তুমি কিভাবে চেনো?"
"তোর শৈবাল কাকু আমার বাপের বাড়ির পাড়ায় থাকত। সেদিন আমি মানি ব্যাগটা নিয়ে যেতে ভুলে গিয়েছিলাম আর কনটাকটার বিশ্বাস করছিল না , তখনই দেখি শৈবাল আমার ভাড়াটা দিয়ে দিতে যাচ্ছিল , না নি
য়েও উপায় ছিল না কি করব বল?"
সন্ধি কপাল টা কুঁচকে জিজ্ঞেস করল
"ও শুধু এটাই তাহলে শৈবাল কাকু আমাদের বাড়িতে প্রায়ই যাওয়া-আসা করছে কেন?"
এবার মায়া একটু তিরিক্ষি মেজাজ এ উত্তর দিল
"তুই কি বলতে চাইছিস বলতো? "
সন্ধি ঠোঁটে একটু বিদ্রুপের হাসি এনে বললো
"আমি আর কি বলবো আর আমার কথা তুমি শুনবে ই বা কেন কারণ আমি এখনো রোজগার করতে পারি না তাই তোমার সব কিছুই আমাকে মেনে নিতে হবে"
মায়া এতোটাই কষ্ট পেল সন্ধির কথায় যে কোন কথা বলতে পারল না। শৈবাল কে নিয়ে মা ও ছেলের মধ্যে যে ঠান্ডা যুদ্ধ চলছিল সেটা এবার বেশ উষ্ণ হয়ে উঠলো।
মায়া অনেক চিন্তা করে ঠিক করলো যে শৈবাল কে সন্ধি র এই কথাগুলো বলেই দেবে কারণ যে ছেলের জন্য ও জীবনের সবকিছু বিসর্জন দিয়েছে তাকে মায়া আর কষ্ট দিতে পারবে না। ইচ্ছে করেই অফিসে যাওয়ার আগে আর শৈবালের ফোন ধরল না তিনবার বেজে বেজে ফোনটা থেমে গেল। অফিস থেকে বেরিয়ে শৈবাল কে ফোন করল। কিন্তু রিং হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে শৈবাল ফোনটা কেটে দিলো। মায়া ভাবল কোনোভাবে ও হয়তো কথাগুলো অনুমান করেছে। কিন্তু পরক্ষনেই ফোন কাটার কারণটা জানতে পারল শৈবাল ওর সামনে দাঁড়িয়ে। এইবার বেশ কপট রাগ দেখিয়ে বলল
"তুমি যে আসবে আমাকে জানাওনি কেন"?
শৈবাল কথার কোন উত্তর দিল না। দুজনে পাশাপাশি হাঁটতে আরম্ভ করলো। মায়া বুঝতে পারছিল শৈবালের একটা কিছু হয়েছে
"শৈবাল কি হয়েছে তোমার?"
এবার শৈবাল বলতে আরম্ভ করলো
"আজ সন্ধি আমায় ফোন করেছিল । ও বলল আমার টাকা নিয়ে ও কোন ভাবেই অপারেশন করতে চায়না । আরো একটা কথা বলল যেটা আমি কিছুতেই ভুলতে পারছি না মায়া"
মায়া এতক্ষণ চুপ করে শুনছিল বুকটা উঠাল পাতাল করলেও বেশ কঠিন গলায় জিজ্ঞেস করলো" কি এমন বলেছে যা তোমার এত খারাপ লেগেছে?"
সন্ধি বলল আমার টাকা নিতে ওর নাকি খুব ঘৃণা হয়"
এর উত্তরে মায়া আর কোন কথা বলে না। দুজনে বেশ কিছুক্ষন চুপ করেই হাঁটতে থাকে। নীরবতা ভাঙে মায়াই
"শৈবাল যদি আজই আমাদের শেষ দেখা হয় তুমি কি কিছু মনে করবে?"
শৈবাল চুপ করেই ছিল । মায়া ভাবল শৈবালের এখন কিছু বলার মত মনের অবস্থা হয়তো নেই তাই বলল
"আমি আজ বাড়ি যাই তোমাকে রাতে একবার ফোন করবো।"
শৈবাল এবার মায়া কে অবাক করে দিয়ে মায়ার হাতটা ধরে
"মায়া তোমাকে একটা অনুরোধ করতে পারি?"
"হ্যাঁ করো"
"দেখো আমি যে টাকাটা সন্ধি র অপারেশনের জন্য রেখেছি প্লিজ সেটা তুমি রেখে দাও । তেমন হলে সন্ধিকে জানতে দিও না যে ওটা আমি দিয়েছি কারণ অপারেশন টা খুব জরুরী । আর তোমার সন্ধি না থাকলে তুমি বাঁচতে পারবে না, তাই আর অমত করোনা প্লিজ টাকাটা তুমি নিয়ে নিও"
মায়া দেখল শৈবালের চোখ জলে চিকচিক করছে।
কিন্তু এখনই নিতে পারবেনা এটা জানিয়ে ও বাসে উঠে পড়ল।
বাড়িতে পৌছে দেখলো শৈবালের বন্ধু পল্লব এসেছে। দুজনে সন্ধির ঘরে বসে কথা বলছে। মায়া এখন সিদ্ধান্ত নিয়েই নিয়েছে ,সারা জীবনে এত কষ্ট পেয়েও যখন সন্ধিকে নিয়েই এতোটা জীবন কাটিয়ে দিয়েছে আর বাকি জীবনে ওর কোন সুখের প্রয়োজন নেই। শৈবালের সঙ্গে সম্পর্ক না রাখলে যদি সন্ধি ভালো থাকে তো সেটাই করবে"
এর দিন সাতেকের মধ্যেই সন্ধি আরো বেশি অসুস্থ হয়ে পড়ল । মায়া একবার ভেবেছিল শৈবাল কে ফোন করবে কিন্তু সন্ধির কথা ভেবে আর করলো না। সেদিন এতো শ্বাসকষ্ট হচ্ছিল যে সন্ধিকে আবার হসপিটালে ভর্তি করতেই হল। এবার কোনভাবে হয়তো শৈবাল জেনেছিল ।পরের দিন হাসপাতলে ঢোকার মুখে শৈবাল কে দেখলো মায়া। মুখটা বেশ থমথমে লাগছিল শৈবালের। এগিয়ে এসে মায়া কে বলল
"মায়া এখন আর সন্ধির উপর রাগ করে ওর জীবনটা নষ্ট করো না প্লিজ ,টাকাটা নিয়ে অপারেশনটা করিয়ে নাও কারণ ও এখন রুগী, ওর কথা মেনে তুমি গোঁ ধরে বসে থেকো না প্লিজ"
মায়া এই কথার কোন উত্তর দেয় না।
সন্ধি র অবস্থার আরো অবনতি হল। এবার শৈবাল কথা বললো ডাক্তারের সাথে। মায়া এখন আর খুব বেশি আপত্তি করে না। শৈবাল হাসপাতালে গেলেও কখনোই সন্ধির সাথে দেখা করে না। অপারেশন হয়ে গেল। ডাক্তারের মতে তিন মাসের মধ্যে সন্ধি বেশ কিছুটা সুস্থ হয়ে উঠবে। এখন মায়া ভাবে শৈবাল কে হয়তো ভগবানই তার কাছে পাঠিয়েছেন। কিন্তু সন্ধির ব্যবহারে ও এখনো খুব কষ্ট পায়। আবার ভাবে সন্ধি ছোট থেকেই ওকে একাই দেখেছে, বাবার কথা খুব বেশি মনে নেই। হয়তো ভেবেছে মা শুধু ওর একার। এই বয়সী ছেলেরা যতটা ম্যাচিওর হয়ে যায় এখনও সন্ধি তেমন নয়।
সন্ধি এখন বেশ অনেকটা সুস্থ। শৈবাল ফোনে খবর নেয় বাড়িতে কখনোই আসে না ,মায়া ও জানে তাই ওকে বাড়িতে আসার অনুরোধ জানায় না। সন্ধি জানতো না যে তার অপারেশনের টাকা শৈবাল দিয়েছে কিন্তু সেদিন পল্লবের কাছে শুনে আস্তে করে মাকে জিজ্ঞেস করল
"মা শৈবাল কাকু আর আসে না?"
মায়া খুব সংক্ষিপ্ত উত্তর দিল
"না"
"পল্লব বলছিল আমার অপারেশনের সময় শৈবাল কাকু হাসপাতালেই ছিল এটা কি সত্যি?"
মায়া এই কথার কোন উত্তর না দিয়ে রান্নাঘরে চলে গেল। সন্ধি কে ও আর কোন টেনশন দিতে চায় না। মায়া ঠিক করে নিয়েছে বাকি জীবনটা এভাবেই কেটে যাবে। কিন্তু সন্ধি ওকে বার বার জানতে চাওয়ায় একদিন বলেই দিলো যে সন্ধির অপারেশন এর সব খরচা শৈবাল করেছে। কিন্তু মায়াকে অবাক করে সন্ধি বলে
"মা বাবা থাকলে হয় তো আমার জন্য এটাই করতো, আমি কি একবার ফোন করে কথা বলতে পারি শৈবাল কাকুর সাথে?"
মায়া একটা অন্য উত্তর দিতে যাচ্ছিল কিন্তু সন্ধির শরীরের অবস্থা বিবেচনা করে বলল
"কেন আবার শৈবাল কাকু কে মনে পড়ল তোর?
সন্ধি মায়ের এই প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে বলল
"মা ডাক্তার বাবু কে জিজ্ঞেস করো তো আমি আবার কবে থেকে ক্লাসে যেতে পারব।"
সেদিন অফিস থেকে ফিরে মায়া খুব অবাক হয়ে গেল। দেখলো ঘরে বসে শৈবাল সন্ধির সাথে গল্প করছে। মায়া কোন কথা না বলে ঘরের বাইরে কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। তবে বেশিক্ষণ দাঁড়াতে হলো না। সন্ধি ওকে ঠিক দেখতে পেল।
"শৈবাল কাকু দেখো মা এসে গেছে, আমি এবার একটু ঘুমাব তোমরা গল্প করো"
মায়া অবাক হলেও ওর ব্যবহারে সেটা বোঝা গেল না।
"শৈবাল তুমি কখন এলে?"
"আরে সন্ধি দুপুরে ফোন করে ডাকলো, বলল ওর নাকি আমাকে দেখতে খুব ইচ্ছে করছে, তাই চলে এলাম"
মায়া কিন্তু ওকে ছাড়তে যাওয়ার সময় আর বাড়িতে আসতে বারণ করল। শৈবাল এটা আশাই করেছিল। তবু বলল
"মায়া সন্ধির অনেক পরিবর্তন হয়েছে,
ও এখন আমাকে চাইছে, তবে তুমি যদি আপত্তি করো আমি আর কোনোদিন আসব না সন্ধি অনুরোধ করলেও না"
এর উত্তরে মায়া কিছু বলতে যাবে সেই সময় দুজনকে অবাক করে দিয়ে সন্ধি পিছন থেকে বলে উঠলো
"মা আমি অনেক স্বার্থপর হয়ে গিয়েছিলাম, তুমি আমাকে সারা জীবনে কত কষ্ট করে বড় করেছ, তোমার সব সুখ তুমি আমাকে দিয়ে দিয়েছো তাও আমি শৈবাল কাকু কে নিয়ে তোমাকে কত খারাপ কথা বলেছি পারলে আমায় ক্ষমা করে দিও," সন্ধির চোখে জল।
মায়ার গলা কান্নায় বুজে আসে। সন্ধি আবার বলে
"আমিতো ছোট থেকে বাবার ভালোবাসা পাইনি, হয়তো বাবা বেঁচে থাকলে শৈবাল কাকুর মতোই টাকা জোগাড় করে আমাকে অসুখ থেকে বাঁচাতো, শৈবাল কাকুর কাছেও আমার ক্ষমা চাওয়ার কথা কিন্তু উনি আমাকে ক্ষমা নাও করতে পারেন" সন্ধি আর কথা বলতে পারছিল না মায়া ওকে ধরে বিছানায় শুইয়ে দিল।
"তোকে ছাড়া আমি বাঁচতে পারব না, তুই শৈবালের সাথে কথা বললে খুব কষ্ট পেতিস তাই আমি ওকে বাড়িতে আসতে বারণ করেছিলাম।" শৈবাল নির্বাক শ্রোতা হয়ে এতক্ষন মা আর ছেলের কথা শুনছিল। এবার বলল
"আমার জন্য তোমরা কষ্ট পেয়ো না আমি কথা দিচ্ছি আর এই বাড়িতে কোন দিন আসবো না"
এবার সন্ধি একটু উত্তেজিত হয়ে বলল
"শৈবাল কাকু তুমি আমার রক্তের সম্পর্কের কেউ নয় তাও তুমি আমার জন্য যা করেছ শুধু আমার বাবা থাকলেই করতেন, আমাদের সম্পর্কটা হৃদয়ের, রক্তের নাইবা হলো, তবু আমি তোমাকে আজ থেকে বাবা বলেই ডাকবো তোমার কি কোন আপত্তি আছে?"
শৈবাল মায়ার দিকে তাকিয়ে মাথাটা নিচু করে বলল
"আমি তো কবে থেকেই তোমাকে ছেলে বলেই মেনেছি, এখন মায়া যা বলবে সেটাই হবে"
এত শরীর খারাপ এও সন্ধির ঠোঁটে হাসি।
মায়া আবার ফিরে পেল তার জীবনের হারিয়ে যাওয়া আনন্দ। আর সন্ধি ফিরে পেল তার বাবাকে। রক্তের সম্পর্ককে হারিয়ে দিল ওদের হৃদয়ের সম্পর্ক।