সমুদ্র গড়ের জমিদার বাড়ি
সমুদ্র গড়ের জমিদার বাড়ি


পটাই যখন আমার বাড়ি এসে বলে গেল যে আজ বিকেলে ওদের বাড়ি যেতে তখন আমার ভীষণ আনন্দ হলো। ওদের বাড়ি বিকেল বেলা যাওয়ার ডাক পাওয়া মানেই অরণ্যদাদু এসেছে নিশ্চই। নাহলে তো বিকেলে ও সাঁতার এর ক্লাসে যায়।আর অরণ্যদাদু আসা মানেই অনেক অনেক গল্প শোনা যাবে। এখন আমাদের স্কুলে শীতের ছুটি চলছে, তাই পড়াশোনার চাপ কম। আমি হলাম অনিরুদ্ধ। সজনে,পটাই আর পুহুল হলো আমার সব থেকে প্রিয় বন্ধু। আমরা চারজনে একই স্কুলে পড়ি ভট্টনগর কুলোকামিনী বিদ্যালয়ে। অরণ্যদাদু হলেন পটাই এর দাদু। তিনি চাকরি করতেন ফরেস্ট রেঞ্জার এর । বছর দুয়েক হলো অবসর নিয়েছেন। এখন সুন্দরবনে থাকেন। সেখানকার পরিবেশ আর মানুষদের উন্নতির জন্য কোন একটা সংস্থার সাথে কাজ করছেন।ফরেস্ট রেঞ্জার ছিলেন বলেই আমরা নাম দিয়েছি অরণ্য দাদু। অনেকদিন পর একটা দারুন গল্প শুনতে পাবো এই আশায় দুপুরের খাওয়া দাওয়া শেষ করেই ছুটলাম পটাই দের বাড়ি।
অরণ্যদাদু বেশ দীর্ঘকায় । অনেকদিন পর দেখছি বলে নাকি জানি না , কিন্তু দাদু কে এখন বেশ ফর্সা লাগছে। চশমার ফ্রেমটা মনে হলো নতুন। পটাই জিজ্ঞেস করলো আজ কি গল্প শোনাবে দাদু?, দাদু বললেন, আজ যেটা শোনাবো সেটা আমার জীবনের একটা ভীষণ আশ্চর্য ঘটনা। শোন তাহলেই বুঝবি।
তখন আমি ফরেস্ট রেঞ্জারের চাকরীতে সদ্য সদ্য ঢুকেছি। দু-মাস কাজ করার পর বেশ কিছুদিনের ছুটি পাওয়া গেল। আমার বন্ধু বিমল থাকে সমুদ্রগড়ে। সে অনেকবার আমায় তাদের বাড়ি যেতে বলেছিল। তাই ছুটি পেয়ে প্রথমে ওদের বাড়িতেই কিছুদিন কাটাবো ঠিক করলাম। সমুদ্রগড় কাটোয়া লাইনের এক বর্ধিষ্ণু জনপদ । হাওড়া থেকে ট্রেনেই যাওয়া যায় । স্টেশন থেকে ওদের বাড়ি পৌঁছতে কোনো অসুবিধা হয় নি। আমি লোহার দরজা ঠেলে ভিতরে ঢুকলাম। সামনেই বাড়ির উঠোন। উঠোনে একটা চেয়ারে বসে বিমল একটা বই পড়ছে দেখলাম। আমার পায়ের আওয়াজে আমায় দেখে সে উঠে এসে আমায় জড়িয়ে ধরলো।বেশ একটা কোলাকুলির পর আমরা ভিতরে ঢুকলাম। দুপুরে জম্পেশ খাওয়া দাওয়া হলো । সে যাকে বলে দারুন খাওয়া আর রান্নাও সেরকম ই ভালো। বিমল এর বউ অর্চনার রান্নার হাত বেশ ভালো। আমি খুব প্রশংসা করাতে সে ভীষণ লজ্জা পেয়ে গেল। দুপুরে ঘুমিয়ে নেওয়ার পর দুই বন্ধুতে বিকেলবেলা বেড়াতে বেরোলাম। ফেরার সময় একটা বাড়ির দিকে চোখ পড়লো। বাড়িটা অনেক বড়ো ,আর ভাঙাচোৱা,তারপর হরেক গাছগাছালি সেটাকে যেন আড়াল করে আছে। আমার হঠাৎ যেন দারুন ইচ্ছে হলো বাড়িটায় ঢুকি। বিমল কে সেটা বলতেই ও এমন ভাবে আমার দিকে তাকালো যেন আমি যেন উন্মাদ । তারপর বাড়িটার দিকে তাকিয়ে বলল না ওই বাড়িটায় আমরা কেউ যাই না । আমি ঐ আধো ঘনায়মান অন্ধকারেও স্পষ্ট বুঝতে পারলাম বিমলের চোখে মুখে একটা ভয়ের আস্তরণ এসে পড়ছে। সন্ধ্যে বেলা মুড়ি খেতে খেতে বিমল আমায় ওই বাড়িটার কথা বললো , ওই যে বাড়িটা দেখছিস ওটাকে আমি আমার ছোটবেলা থেকেই ওইরকমই দেখেছি। আমার ছোটবেলা থেকেই বাড়িটা ফাঁকা, ভাঙাচোৱা কেউ থাকে না। শুনেছি এই বাড়িটা অনেকদিন আগে এক জমিদার এর ছিল তারপর থেকে বংশানুক্রমে তারাই থেকে আসছিলেন। কিন্তু কোনো অদ্ভুত কারণে সেই জমিদার পরিবার এখানে থাকতে পারে নি ।একদিন সকালে দেখা যায় আচমকাই পুরো বাড়ি খালি। জমিদার এর বংশের সবাই রাত্রে লুকিয়ে লুকিয়ে পালিয়ে গেছিলেন। তারপর থেকে অনেকেই ওই বাড়িতে থাকার চেষ্টা করেছে কিন্তু ভয়ে পালিয়ে গেছে। রাতে নাকি শব্দ হয়, কান্নার মতো কেমন একটা আওয়াজ শোনা যায়। আর দম আটকে আসে। ওটাকে একটা স্কুল বাড়ি করা হবে ঠিক হয়েছিল কিন্তু তাও হলো না, সবাই দারুন ভয় পায় বাড়িটাকে ।
আমি চুপ করে শুনছিলাম সবটা। বললাম তুই কখনো যাস নি তাহলে? বিমল বললো নাহ, ও বাড়ি ভালো না। সেদিন তাড়াতাড়ি খেয়ে শুয়ে পড়া গেল। পরদিন বিকেলে আমরা মাছ ধরতে গেলাম কাছের একটা ঝিলে।সারা বিকেলের চেষ্টায় চারটে মাঝারি মাপের রুই মাছ ধরলাম দুজনে।যখন বাড়ির কাছে এসেছি তখন একটা লোক কে দেখলাম আমাদের দিকেই আসছে। সে বিমলের সামনে এসে বললো স্যার আমার বাড়িতে এখুনি একবার যেতে হবে আমার ছেলেটা মারপিট করেছে স্কুলে আর তাই যার সাথে মারপিট হয়েছে তারা এসে খুব ঝগড়া করছে।একবার চলুন স্যার। দাদু গল্প থামিয়ে হঠাৎ হেসে বললেন শোন, বলতে ভুলে গেছি বিমল এখানে একটা স্কুলে পড়ায়। এসে পর্যন্ত দেখেছি শিক্ষক বলে বিমলের কথা এখানে বেশ মান্য করে লোক। বিমল আমার দিকে তাকাল, আমি বিমল কে বললাম যে যা তুই, এই মাছের থলিটা নিয়ে যা বাড়িতে নামিয়ে দিস । আমি একটু আশেপাশে ঘুরে বেড়াই।বিমল একটুক্ষণ ভেবে বললো ,আচ্ছা ঘোর বেশি দেরি করিস না। আমি একটু পরেই আসছি ,তারপর সে লোকটার সাথে হাঁটা দিল। আমার ভিতরে যেন অন্য কেউ জেগে উঠেছে তখন। বিমল চোখের আড়াল হয়ে যেতেই আমি সোজা ওই বাড়িটার কাছে গিয়ে উপস্থিত হলাম। তখন সূর্য ডুবে গেছে । রাঙা আলোর একটা ক্ষীণ আভা তখন ও আকাশের পশ্চিম কোণ আলো করে আছে। কিন্তু বেশিক্ষন থাকবে না। শীতের সন্ধে হনহন করে হাঁটা লাগিয়েছে ওই দূরের মাঠের ওপাশের দিগন্ত রেখা আবছা হয়ে এসেছে এক্ষুনি ঝপ করে অন্ধকার হয়ে আসবে । এই আলো আঁধারীতে বাড়িটা দেখে ভিতরটা কেমন যেন ঠান্ডা হয়ে এলো। যেন আমার সামনে কোনো প্রাচীন,ভয়ানক হিংস্র জন্তু নিদ্রিত অবস্থায় বহুদিন থেকে রয়েছে।কিন্তু হঠাৎই যেন জেগে উঠবে । বাড়িটা নিঝুম হয়ে দাঁড়িয়ে আছে।নানারকম বুনো আগাছার জঙ্গল বাড়িটাকে চাদরের মতো জড়িয়ে নিয়েছে। ঝোপঝাড় থেকে ঝিঁঝির কোরাস শুনতে পাচ্ছি। বাড়িটা যেন দু হাত বাড়িয়ে টেনে নিল আমায় । সামনেই একটা বারান্দা মতো জায়গা তার ওপর অজস্র ইঁট ধুলো চুন বালি সুড়কি পরে স্তূপ হয়ে আছে এখানে ওখানে। আমার ভিতর টা হিম হয়ে এলো আতঙ্কে যেন আমার বিরুদ্ধে কেউ কোনো চক্রান্ত করছে এখুনি আমার কোনো একটা বিপদ ঘটবে ।বাড়ির ভিতরটা খুব ঠান্ডা , আমি ঠকঠক করে কাঁপছি সে ঠান্ডায়। একটু খানি দাঁড়িয়ে আমি ভেবে নিলাম যে কি করবো তারপর সাহস সঞ্চয় করে এগিয়ে গিয়ে সামনের যে ঘরটা ছিল তার দরজাটা খুললাম। সন্ধ্যে নেমে এসেছে তখন। আমার কাছে টর্চটা ছিল, কিন্তু সেটাকে কিছুতেই জ্বালাতে পারলাম না। অন্ধকারে কিছুই দেখতে পাচ্ছি না । আমার তখন পাগলের মতো অবস্থা। টালুমালু করে চারদিক চাইলাম।ভাবলাম ফিরে যাই বরং,দরজা দিয়ে বাইরে বেরোতে গিয়ে দেখি আর বেরোতে পারছি না। অদৃশ্য কিছু যেন আমার পথ আটকে দাঁড়িয়ে আছে। অনেক বার চেষ্টা করলাম কিছুতেই বাইরে যেতে পারলাম না। আমার গলা বুক শুকিয়ে গেছে। হঠাৎ আমার মনে হলো গায়ত্রী মন্ত্র জপ করি। কেন মনে হলো জানি না। কেউ যেন বলে দিল , কিন্তু জপ করা শুরু করলাম। আস্তে আস্তে বুকের মধ্যের চাপ ভাবটা কমে গেল।এবার দরজা দিয়ে বাইরে যাওয়ার চেষ্টা করে দেখলাম, বাহ ! এবার ঠিক বেড়িয়ে যেতে পারলাম। কিন্তু বাইরে বেড়িয়েই আমার ভিতর টা কেঁপে উঠলো সব ঘরের দরজায় অনেক গুলো মানুষ দাঁড়িয়ে আছে।অন্ধকারে তাদের মুখ বুঝতে পারছি না।কিন্তু তারা দাঁড়িয়ে যে আমায় লক্ষ করছে তা বুঝতে পারলাম।তাদের তীব্র দৃষ্টি আমার সমস্ত কিছু মেপে নিচ্ছে । এসময় আমায় টর্চ টা জ্বলে উঠলো। টর্চের আলোয় দেখি না পুরো ফাঁকা কেউ কোথাও নেই। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলতে যাচ্ছিলাম।কিন্তু একটা সন্ধেহ হওয়াতে টর্চ টা নিভিয়ে দেখি যে সর্বনাশ , যাবে সব কালো কালো মূর্তি সব জায়গায় ।সবাই আছে সবাই তাকিয়ে আছে আমার দিকে।অন্ধকারেও তাদের দৃষ্টির তীব্রতা বুঝতে পারছিলাম। তারা আমায় চায়। ওপরে দোতলাতেও অনেক মূর্তি চোখে চোখে পড়েছে তখন।কালো কালো প্রেতের দল যেন নরকের কোন কবর থেকে উঠে এসেছে হত্যার লোভে।আমি রুদ্ধশ্বাসে একটা চিৎকার করে ছুটে বেড়িয়ে গেলাম দরজা দিয়ে বাইরে।সঙ্গে সঙ্গে অনেকগুলো পায়ের শব্দ আমার পেছনে শুনতে পেলাম।তারা আসছে।তারা আমায় শেষ না করে ছাড়বে না।দাদু এই পর্যন্ত বলে জল খেলেন অনেকটা। আমরা চারজনই তখন একদম গা ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে আছি। পটাই বললো তারপর কি হলো। দাদু যেন বাইরে দিকে তাকিয়ে সেইদিনের ঘটনা ভাবছিলেন।পটাই এর ডাকে ফিরে বললেন হুঁ কি হলো কিছু না পরদিন কাজ আছে এই বলে ফিরে এলাম।ওদের কাউকে কিছু বলি নি।তবে পরে বিমল কে জানিয়েছিলাম চিঠিতে।ও খুব রাগারাগি করেছিল। তবে জানিয়েছিল ওখানে জমিদারের অত্যাচারে অনেক লোক মারা যায় ।অনেক কে খুন ও করা হয়েছিল।জমিদার এর বংশের মধ্যেও কেউ কেউ খুন হয়েছিল ওই বাড়িতে।আর যাই নি তারপর ।অনেক পরে বাড়িটাও পুরোপুরি ভেঙে যায় শুনেছিলাম।