Imran Ali

Tragedy Fantasy Inspirational

3  

Imran Ali

Tragedy Fantasy Inspirational

স্মৃতিসঙ্গ

স্মৃতিসঙ্গ

6 mins
149



  স্টেশনের মাইকে হটাৎ একটি মহিলার কন্ঠে শোনা গেলো “ রাধিকাপুর এক্সপ্রেস সাড়ে সাতটায় তিন নম্বর প্লাটফর্ম থেকে রওনা হবে”। ঘড়িতে সাতটা পনেরো বাজে, কলকাতা চিৎপুর রেলস্টেশনে তিন নম্বর প্লাটফর্ম-এ বসে আছে ইয়াসিন গোফ্ফর-এর অপেক্ষায়। দুইজনই কলকাতায় নতুন এসেছে পড়াশোনার জন্য আর এটাই তাদের প্রথম ছুটি, ঈদের ছুটি। তাই ট্রেনেও বিশাল ভিড়, তাই তারা ঠিক করেছে সাড়ে আটটার ট্রেন জগবানী এক্সপ্রেস এ যাবে। কলেজ থেকে ফিরেই ইয়াসিন চলে এসেছে স্টেশনে।

  কিছুক্ষণ ধরেই ইয়াসিন ট্রেনের জানলার দিকে তাকিয়ে আছে একদৃষ্টিতে। জানলার ধারে একটা মেয়ে বসে আছে তারদিকে পিছু ফিরে। ইয়াসিন যদিও তার মুখ দেখতে পাচ্ছেনা, তাও সেদিকেই তাকিয়ে আছে। হটাৎ ট্রেনের দরজা থেকে “ইয়াসিন” ডাক শুনে তার চমক ভাঙে, “আরে এ তো মারিয়াম এর আব্বু”। ইয়াসিন বেঞ্চ থেকে উঠে দরজার কাছে গিয়ে ভালো-মন্দ জিজ্ঞাসার পর জানতে পারল যে তিনি মারিয়াম কে নিয়ে যেতে এসেছেন, “ও হ্যাঁ মারিয়ামও তো কলকাতায় মেডিক্যাল এর এন্ট্রান্স এর জন্য প্রশিক্ষন নিচ্ছে”। তিনি সেই জানলার দিকে আঙ্গুল দেখিয়ে বললেন যে সেখানে মারিয়াম বসে আছে। ইয়াসিনের মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল, তার হৃদস্পন্দন যেন দ্বিগুণ হয়ে উঠলো, তার মনে যেন খুশিতে ময়ূর নেচে উঠলো, অন্যদিকে ঠিক সেরকমই দুঃখের নদী বয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা হলো।

  জানলার কাছে গিয়ে ইয়াসিন “ওই” বলে উঠলো। ইয়াসিনকে হটাৎ জানলার পাশে দেখে মারিয়ামের যে কি অনুভুতি হয়েছিলো তা সে নিজে আর আল্লাহ্ তাওয়ালাই ভালো জানেন। কিছুক্ষণ দুজনই পরস্পরের দিকে তাকিয়ে চুপ থেকে একই সঙ্গে প্রশ্ন করে উঠলো কে কেমন আছে। ইয়াসিনের হাত-পা থরথর করে কাঁপছে, হৃদযন্ত্র যেন গাড়ির ইঞ্জিনের মতো দৌড়চ্ছে । মারিয়ামের সাথে যে তার এইভাবে দেখা হবে তা সে ভাবেনি। মারিয়াম যে এখনো তার প্রতি এতো ভালো ব্যবহার করবে, এতো আগ্রহের সাথে অনুভুতি নিয়ে কথা বলবে সেটাও তার কাছে অবাকের বিষয়। কিন্তু দুই বছরের জমানো আবেগের এক শতাংশ-ও প্রকাশ করার আগে ট্রেন ছাড়তে শুরু করলো। যতক্ষণ ট্রেনের বেগের সাথে তাল মেলানো যায় ততক্ষণ সে জানলার শিক ধরে হাটলো। কিন্তু তার দিকে তাকিয়ে থাকা ছাড়া ইয়াসিন আর কিছুই বলতে পারলনা। শেষে “ভালো করে যা” বলে ট্রেন ছেড়ে উল্টোদিকে হাটতে লাগল, যেখানে সে বসে ছিলো সেইদিকে। পিছু ফিরে একবারও তাকালোনা। তার চোখের কোণে কী যেন চিকচিক করছিল।

  আটটার দিকে গোফ্ফর স্টেশনে পৌছলো। গোফ্ফরের কাছে ইয়াসিন কিছুমাত্র উল্লেখ করলো না পূর্ববর্তী ঘটনার। সে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করলো। কলকাতায় কার কি অভিজ্ঞতা হলো এই কদিনে তা নিয়ে কথাবার্তা বলতে বলতে ট্রেন ছাড়ার সময় হয়ে এলো। আর ঠিক সময় ট্রেনও ছেড়ে দিল। জেনারেল কামরায় তারা দুজনই ট্রেনের ভেতরের দিকে ধারে সিট পেয়েছে। ট্রেন কিছুক্ষণ যাওয়ার পরেই তারা দুজনে কানে হেডফোন গুঁজে নিল। ইয়াসিন চলে গেলো তার অতিত রহস্যময় স্মৃতির দুনিয়ায়। চলে গেলো আট বছর আগে ক্লাস সিক্স-এ যেবছর সে প্রথম মারিয়াম কে দেখেছিল। মারিয়াম কে ঠিক কোনদিন, কখন, স্কুলের ঠিক কোথায় সে দেখেছিল তা তার মনে নেই, প্রথম দেখাতে তার কিরকম অনুভুতি ছিলো সেটাও তার মনে নেই। কিন্তু সেই একই বছরে যে মারিযামের হাসি, কথা বলার ধরন, চরিত্র গুণ, সবার সাথে মিশুকে প্রকৃতি আর সবার সাথে ভালো ব্যাবহার ইয়াসিনের উপর গভীর প্রভাব ফেলেছিল তা তার মনে আছে। তখনকার তার সেই অনুভুতি সে এখনো অনুভব করতে পারে। সে ক্রমে মনে করতে লাগল ক্লাসের ফাঁকে মারিযামের দিকে চুপিচুপি দেখার অভিজ্ঞতা, তাকে হাসানোর জন্য নানা রকম কান্ড ঘটিয়ে ক্লাসের মাস্টারের কাছে বোকা খাওয়ার অভিজ্ঞতা, পড়াশোনায় দারুন ভালো মারিযামের সাথে সাম্যে আসার জন্য পড়াশুনায় আগ্রহী হয়ে জেদ নিয়ে পড়ার অভিজ্ঞতা আরো স্কুলজীবন ও মারিয়াম সম্বন্ধীয় সমস্ত স্মৃতি সে মনে করতে লাগল।

  মাঝে রাস্তায় অনেক বার ট্রেন থামছে আবার চলছে। এখন বর্ধমান স্টেশন এ থেমেছে। হোকারদের চিত্কারে ইয়াসিন এর চিন্তার ভাঙন ঘটল। গোফ্ফরের দিকে তাকিয়ে দেখল সে ঘুমিয়ে গেছে। তাকে ডেকে তুলল, “কি রে কিছু খাবি নাকি? খিদে লাগলে কিছু কিনে নে”, ইয়াসিন ট্রেনে কিছু খায়না। ট্রেন আবার চলতে শুরু করলো আর ইয়াসিন তার চিন্তায় আবার মগ্ন হয়ে গেলো। তার মনে ভেসে উঠলো ক্লাস এইট-এ একদিন সে মারিয়াম এর চোখে নিজের জন্য ঠিক একই অনুভুতি লক্ষ করেছিল। কিন্তু তবুও সে কিছু বলতে পারেনি, সাহস জোটেনি। এই চোখাচোখি করেই ক্লাস এইট, নাইন ও টেন কাটছিল কিন্তু ইয়াসিন আর একটা বিষয় লক্ষ করেছিল যে মারিয়াম এর পড়াশুনা দিন দিন খারাপ হয়ে যাচ্ছিল। যদিও ইয়াসিন তার সাম্য বজায় রেখেছিলো, আর মধ্যামিক এ স্কুলের ফার্স্ট হয়েছিল। ইয়াসিনের ধারনা তার এই রহস্যময় অনুভুতির জন্যই মারিযামের রেজাল্ট খারাপ হতে শুরু করেছিল। মাধ্যামিক এর সময় তার মারিয়াম কে শেষ দেখার কথা মনে পড়ে, তার পর অনেকে অন্যান্য ভালো ভালো স্কুল-হোস্টেল এ চলে গেলো, মারিয়াম ও কলকাতার এক হোস্টেল এ চলে গেলো। ইয়াসিনেরও যাওয়ার কথা ছিলো কিন্তু স্কুলের প্রতি তার গত ছয় বছরের টান তাকে যেতে দেইনি। এইভাবে সে একই স্কুল এ থেকে গেলো আর মারিয়াম চলে গেলো কলকাতায়।

  ট্রেন থামল মালদা স্টেশনে, এখানেই ওদের নামতে হবে। গোফ্ফর-কে ডেকে তুলে ট্রেন থেকে ব্যাগ নিয়ে নামল দুইজনই। এই স্মৃতিচারণ করতে করতে কিভাবে আট ঘন্টার ট্রেনের সফর শেষ হয়ে গেলো ইয়াসিন এর অবাক লাগল, সে একটু নিজের মধ্যেই মুচকি হাসল। ভোর সাড়ে তিনটে বাজে। এখন আবার বাসে যেতে হবে দুই ঘন্টার মতো। ট্রেন স্টেশনে হাত মুখ ধুইয়ে একটা বিস্কুট এর পেকেট শেষ করে তারা বাস স্টেশন এ হেটে পৌছলো। কিছুক্ষণের মধ্যে বাস এলে উঠে জানলার পাশেই সিট পেল ইয়াসিন আর গোফ্ফর তার পরে। ইয়াসিন একটু ঘুমানোর চেষ্টা করলো কিন্তু ঘুম এলো না। সে আবার পুরনো কথা ভাবতে লাগল।

  তার মনে এলো সেই দিনের কথা, যেদিন তাদের দুইজনের (ইয়াসিন ও মারিযামের)-ই বান্ধবী, নূর তাকে মারিয়াম-এর পক্ষ থেকে প্রস্তাব দেয়। সেটা ক্লাস ইলেভেন এ মাঝের দিকে। প্রস্তাব বলা ভুল হবে হয়তো কিন্তু সেটার মানে তাই বোঝায়, একটা প্রশ্ন, যে সে মারিয়াম কে ভালবাসে কি না। সেদিন ইয়াসিন বুঝতে পারে মানুষের মস্তিষ্ক কতো দ্রুত কাজ করতে পারে, কতো দ্রুত ভাবতে পারে। তিরিশ সেকেন্ডে তার মাথায় তিরিশ রকমের চিন্তা আসে, নানা রকমের যুক্তি-চিন্তা-ভাবনা-পরিকল্পনা ঠিক হয়। সে সোজা সাপটা উত্তরে বলে “না”। হয়তো তার অভিমান হয়েছিল। হয়তো তাকে পারিবারিক সমস্যা-ঝামেলার ভবিষ্যত চিন্তা বাধা দিয়েছিল। হয়তো সে ভেবেছিল এই অনুভুতির জন্যই মারিযামের পড়াশুনা খারাপ হচ্ছিল। হয়তো সে ভেবেছিল এখন "না" বলে, তার পড়াশুনা শেষ হলে সে নিজে থেকেই প্রস্তাব দেবে। হয়তো বা আরো ছোটো বড়ো নানা কথা ভেবেছিলো। বা হয়তো কিছু না ভেবেই “না” বলে দিয়েছিল। এইভাবেই আর কি দুই বছর তাদের মধ্যে আর কোনো যোগাযোগ নেই, কোনো সম্পর্ক নেই। কোথাও কখনো মারিযামের কথা হলে বা কেউ তার কাছে মারিযামের প্রসঙ্গ তুললে সে সব সময় উপেক্ষা করে চলত।

  হটাৎ ইয়াসিনের ফোন বেজে উঠলো। বাড়ি থেকে দাদা ফোন করেছে “ভাই কোথায় এখন, কখন পৌছবি বাড়িতে?” জানলা দিয়ে বাইরে দেখে আর ঘড়ি দেখে ইয়াসিন জবাবে বলল “আর তিরিশ মিনিট দাদা”। ফোন রেখে তার মনে এলো এই কয়েক দিন আগেই নূরের সাথে তার ফোনে কথা হয়েছে। নূরের কাছ থেকে সে জানতে পেরেছে, মারিযামের নাকি অন্য এক ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। মারিয়াম যে হোস্টেল এ গেছিল সেখানকারই একটি ছেলে। মারিয়াম কে দেখে নাকি ছেলের মা-বার খুব পছন্দ। ইয়াসিন একটা স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। মারিয়াম একটা ভালো পরিবারে বৌ হয়ে যাবে। ছেলেটাও হয়তো ইয়াসিনের থেকে ব্যবহারে অনেক ভালো, মারিয়াম এর ভালো যত্ন নেবে, ইয়াসিনের মতো careless না, মিথ্যেবাদী না, স্বার্থপর না। ডাক্তারি পাস করলেই মারিযামের বিয়ে। কে জানে সে তার বিয়েতে নিমন্ত্রণ পাবে কিনা, আর পেলেও সে যাবে কিনা।

   সে এখন ভাবল এসব ভেবে তার এখন কি লাভ। সে নিজেকে খুব ভালো বোঝাতে পারে, তার মতো হয়তো এই গুণটা অনেক কম জনেরই থাকে, নিজেকে বোঝানোর মতো। সে নিজেকে বলে “ভাই আমি বিজ্ঞান এর ছাত্র। এইসব অনুভুতি তো সব শুধুই হরমোনাল প্রভাব, অ্যাড্রিনালিন এর প্রভাব। এইসবই তো তাৎক্ষণিক। তার মতো আবার কাউকে পেলে আবার হরমোনাল প্রভাব ঘটবে আবার অনুভুতি জাগবে। তবে এই স্মৃতিগুলো শুধু সঙ্গী হয়ে থাকলে ক্ষতি নেই। অন্তত এরকম দশ ঘন্টার যাত্রায় একটা খুব ভালো সঙ্গী হয়, ফলে বিরক্তি লাগে না। শুধু আর একটা মারিয়াম এর খোজ, ঠিক সেই মারিযামের মতো"। ইয়াসিন গোফ্ফর এর গায়ে নাড়া দিয়ে তাকে জাগিয়ে দিল “কিরে বাড়ি তো, চলে এলাম তো। নাববি, নাকি বাসের সাথেই চলে যাবি?”, “হুম চল”। তারা গাড়ি থেকে নেমে যে যার বাড়ির রাস্তায় চলে গেলো।



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Tragedy