স্মরণীয় মুহূর্ত, অসাধারণ
স্মরণীয় মুহূর্ত, অসাধারণ


সতলুজ (শতদ্রু) নদীর ধারে, পাহাড় ঘেরা ছোট্ট যায়গা সুনি; সিমলা থেকে একটু নীচে। কালকা বা চণ্ডীগড় থেকে সিমলা পেরিয়েই যেতে হয়। পাহাড় ও নদী শুনেই মনটা বর্ষা কালের ময়ূরের মত নেচে উঠল। এক বন্ধুর মাধ্যমে পরিচিত হয়েছিলাম, সুনির একটি স্কুলের চেয়ারম্যানের সঙ্গে। বিদ্যালয়টির অধ্যক্ষার পদ গ্রহণ করলাম। জানুয়ারি মাসে, উত্তর ভারতের কুয়াশার ফাঁদে পড়ে ১২ ঘণ্টা দেরিতে, অভুক্ত- হাক্লান্ত অবস্থায় যখন কালকা পৌঁছলাম, সুয্যিমামা পাটে বসেছেন।
পাহাড়ে চড়া শুরু হল, সন্ধ্যের অন্ধকারে সিমলা পেরিয়ে গেলাম। সুনি পৌঁছতে বেশ রাত হয়ে গেল। প্রচণ্ড ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে, সেই রাতের মত রেস্ট হাউসে আশ্রয় নিলাম।
ভোরবেলা ঘর থেকে বেরিয়ে, একমুহূর্তেই প্রেমে পড়ে গেলাম অনতিদূরের কুয়াশা ঘেরা পাহাড়সারি ও প্রগলভা, পান্না- গলা স্রোতস্বিনী সতলুজের।
স্কুল ও থাকার যায়গা দেখার পরেই, আমরা বেরিয়ে পড়লাম অনেকদিন আগে শোনা, দর্শনীয় ‘তত্তাপানির’ উদ্দেশ্যে। নামটা বোধ হয় আসলে ‘তপ্তপানি’ কারণ সেখানে উষ্ণ প্রস্রবণ দেখা গেল- নদীর বরফ ঠাণ্ডা জলের কিনারে কিনারে। শুনলাম ওই ‘গরম পানিকা চশ্মা’ নাকি সব রোগের উপশম করে।
মকর সংক্রান্তি উপলক্ষে সেখানে বসেছে বিশাল মেলা। যে কোন মেলাই আমাকে ভীষণ টানে। ধর্মপ্রাণ হিমাচলিদের একটি বিশেষ প্রথা আমাকে আকৃষ্ট করল...‘তুলাদান’। দাতা দাঁড়ি পাল্লার একদিকে বসেন, সমপরিমাণের দানের জিনিষ বিলিয়ে দেওয়া হয় গরীব দুঃখীর মধ্যে, শনি ভগবানকে তুষ্ট করার জন্যে। ঐ ছোট্ট গ্রামীণ শহরটিতে সিগারেট, গুটকা ইত্যাদির ব্যাবহার নিষিদ্ধ। প্লাস্টিক প্যাকেটের চল নেই, আশ্চর্যজনক ভাবে সকলে নিয়মগুলো মেনেও চলে। রাস্তা ঘাটে ময়লা ফেলাও বারণ, যার ফলে হাওয়ায় কোনোরকম দূষণ নেই। খোলা আকাশ, জঙ্গল- পাহাড়- নদীর সাহচর্যে নতুন জীবন লাভ করলাম। লোকজন অতি ভদ্র, কেউ কখনো উঁচু আওয়াজে কথা বলেনা, ভারতবর্ষেই যে এইরকম কোন রাজ্য আছে তা ভাবতে ভাল লাগছিল।
প্রায় রবিবারেই ভোরের বাস ধরে চলে যেতাম সিমলা পাহাড়ে, সারা সপ্তাহের অবসাদ কেটে যেত নিমেষে। কিন্তু গরম কাল শুরু হলে টের পেলাম, হিমাচল প্রদেশের এই ছোট্ট যায়গাটি যদিও সমুদ্র তলের ২০০০ ফুট ওপরে এবং পাহাড়ে ঘেরা, খুবই গরম হয়ে যায়। উত্তর ভারতের অন্যান্য যায়গার মতই শীতে খুব ঠাণ্ডা আর গরমে গরম।
একটা আক্ষেপ কিন্তু রয়েই গেল, সিমলার এত কাছাকাছি থেকেও তুষারপাত দেখার সৌভাগ্য হলনা। সুনিতে বেশ কিছুদিন কাটিয়ে ফেললাম। প্রতি সকালে নিষ্পাপ ছোট ছোট মুখগুলোর টানে স্কুলে পৌঁছে যেতাম। স্কুল বিল্ডিং এর কাজ চলছিল। সুদূর বিহার রাজ্যের শ্রমিককূলকে সেখানে কর্মরত দেখে খুব অবাক হয়ে গেছিলাম, পেটের দায়ে মানুষকে কি না করতে হয়। মহিলা শ্রমিকগুলির অবস্থা ছিল খুবই শোচনীয়। মাথার ওপরে আট- দশটি ইঁটের ভার, একটি বাচ্চার হাত ধরে অপরটিকে পিঠে বেঁধে অবলীলাক্রমে তারা সিঁড়ি বেয়ে ওঠা নামা করত।
সুনিতে ছিল অসম্ভব বাঁদরের উপদ্রব, মজুরগুলি বাচ্চাদের একা ছাড়তে পারত না। দরজা খোলা পেলেই বাঁদরেরা ঘরে ঢুকে করত তোলপাড়। শুকোতে দেওয়া কাপড় জামা উধাও হয়ে যেত। খাবারের প্যাকেট নিয়ে পথচলা তো প্রায় অসম্ভব ছিল, বিশেষ করে তা যদি থাকত বাচ্চাদের হাতে। বাঁদরগুলো এতটাই সাহসী ছিল, স্কুলে লাঞ্চব্রেকের পরে ক্লাসরুমে ঢুকে, সকলের উপস্থিতিতেই ওয়েস্টবিন নিয়ে যেতে একটুও ঘাবড়াতো না। প্রিন্সিপালের ঘরের সামনে দিয়েই ছিল শ্রমিকদের যাতায়াতের রাস্তা। সব সময়েই বাচ্চাগুলোর হাসি কান্নার শরিক হতাম আমি। কতদিন এমনও হয়েছে, তাদের কান্না বন্ধ করার জন্যে আমাকে ছাদে চড়তে হয়েছে, স্কুলের বাচ্চাদের জন্মদিন উপলক্ষে পাওয়া টফি- চকোলেট নিয়ে এবং এক মুহুর্তেই সেই কান্না কিভাবে হাসিতে রূপান্তরিত হয়ে যায় তা দেখে।
সত্যি কত অল্পে যে এদের খুশি করা যায়...শহর থেকে অনেক দূরে, সুনির গ্রাম্য পরিবেশে আমাদের জীবনধারাও বদলে গেছিল, খুব অল্পতেই সন্তুষ্ট হতে শিখে গেছিলাম- পেয়েছিলাম জীবনের সব থেকে বড় শিক্ষা।
সুনি পাব্লিক স্কুলের ক্লাস ৪ এর ছোট্ট অঞ্জলি ছিল প্রিন্সিপাল ম্যামের খুব ভক্ত। সে তার কিছু কিছু সহপাঠী ও শিক্ষকদের কাছে ছিল অবাঞ্ছিত, কারণ সে ছিল ‘অটিজমের’ শিকার যার ফলে শিক্ষকেরা মনে করতেন, সে অস্বাভাবিক। আমাদের দেশের অধিকাংশ শিক্ষক, যাঁদের ওপরে ভার রয়েছে শিশুমনকে গড়ে তোলার, তাঁরা নিজেরাই যে কত অপরিণতমনষ্ক তা আমি আমার এই দীর্ঘ শিক্ষতার জীবনে প্রতি পদে অনুভব করেছি। অঞ্জলি নিজের মনে খেলে বেড়াত। তার বন্ধু ছিল গাছ পাখি ফুল। মাঝে মাঝেই সে আমার রুমে ঢুকে পড়ত, আমাকে তার আঁকা ছবি, হিজিবিজি লেখা উপহার দিতে, কবিতা বা গল্প শোনাতে। একবার তার নিষ্পাপ বড় বড় চোখে চোখ রেখে আমি বললাম... ‘বলত তোমার মুখটা কেমন?একটু হেসে সে শুরু করল, ‘আমার একটা গোল মুখ আছে। মুখে দুটো ব্রাউন চোখ, দুটো ঠোঁট, দুটো কান আর একটা নাক আছে। আমি আমার মুখটাকে খুউব ভালবাসি।'
নিজেকে ভালবাসার এই পাঠটা সেদিন আমি অঞ্জলির কাছে পড়েছিলাম। নিজের প্রতি ভালবাসাই বোধহয় অপরকে ভালবাসতে পারার ভিত্তি স্থাপনা করে। একদিন টিফিনের ছুটির পরে আমার ঘরের বাইরে চেঁচামেচি শুনে আমি দৌড়ে বেরোলাম। একমাথা ঝাঁকড়া চুলে ঢাকা একটি শিশু মাটিতে পড়ে আছে, তার পিঠের ওপরে লাফাচ্ছে আর চেঁচাচ্ছে একটা বাঁদর। হতভম্ব অবস্থা কাটিয়ে উঠে, টেবিলের ওপর থেকে একটা স্কেল তুলে নিয়ে বাঁদরটার দিকে তেড়ে যেতেই, সে পালাল। স্কুলের ক্লার্ক মনোজ বাচ্চাটিকে তুলে নিলে দেখতে পাই কর্মরত শ্রমিকদের একটি শিশুকে, যাকে নিজের ছোট্ট শরীরের আড়াল দিয়ে বাঁচাবার চেষ্টা করছিল অঞ্জলি... অত্যন্ত ভীত, উত্তেজনায় কাঁপতে থাকা অঞ্জলি তখন কথা বলার অবস্থায় ছিল না।
ঘটনাটি অনুমান করে নিলাম। বাচ্চাটিকে ঘুম পাড়িয়ে তার মা কাজে গেছে, ইত্যবসরে বাঁদরটা শিশুটিকে আক্রমণ করেছে। দেখতে পেয়ে তথাকথিত অস্বাভাবিক অঞ্জলি তাকে রক্ষা করার চেষ্টা করেছে, যা হয়তো কোনও স্বাভাবিক, বড় মানুষও করার সাহস পেত না।
ব্যাথাভরা সেই বাদামী চোখজোড়ার অব্যক্ত ভাষা আমি বুঝতে পেরেছিলাম।
‘I am going to bring something new into your life, because you have never met anyone like me, nor you’ll ever meet... for in the mind of God I am unique and irreplacable’- Michel Quoist
অঞ্জলি সেদিন আমাদের মানবতার শিক্ষা দিয়ে বুঝিয়ে দিয়েছিল, ‘আমিও তোমাদের স্বাভাবিক দুনিয়ারই একজন- তোমরা মানো আর না মান।
স্মরণীয় মুহূর্ত আমার জীবনের।