Ananya Podder

Romance Classics

4.3  

Ananya Podder

Romance Classics

সমপ্রেম

সমপ্রেম

7 mins
1.2K


শিল্পীতা, সৃঞ্জিনী আর নীলাঞ্জনা তিন বন্ধু | শিল্পীতা আর সৃঞ্জিনী সেই ক্লাস ওয়ান থেকেই অভিন্ন হৃদয় বন্ধু | নীলাঞ্জনা এসে ওদের সাথে যোগ দিলো ক্লাস নাইনে | তারপর থেকে তিনজনেই সুন্দর বন্ধুত্বে জড়িয়ে পড়েছিল |


কিন্তু উচ্চমাধ্যমিক দেওয়ার আগে থেকেই শিল্পীতার মনে হত, সৃঞ্জিনী আর নীলাঞ্জনার বন্ধুত্বটা স্বাভাবিক বন্ধুত্ব নয়, এ যেন সাধারণের চেয়েও একটু বেশি কিছু | কিন্তু হঠাৎ করে কোনো প্রশ্নও তো করা যায় না | পাছে, এতো বছরের বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে যায় !!


কিন্তু উচ্চমাধ্যমিকের পরে একবার সৃঞ্জিনীর বাড়িতে একটা গোটা দিন কাটানোর পরিকল্পনা করে ওরা তিনজনে | সেদিনটাতে সৃঞ্জিনীর বাবা মা, দাদা কেউই বাড়িতে ছিলেন না | এক আত্মীয়ের বাড়িতে বেড়াতে গেছেন ওর বাবা মা, আর দাদা তো হোস্টেলে থাকে | কিন্তু ওদের তিনজনের বাবা মায়েরই কোনো আপত্তি ছিল না, ফাঁকা বাড়িতে একসাথে সময় কাটানোতে | কারণ, তিনটে মেয়ে আর কি একে অপরের ক্ষতি করবে !!


সেদিন ওদের তিনজনের আড্ডায় শিল্পীতা কিছুক্ষনের জন্য বাকি দুজনের থেকে আলাদা হয়ে গেলে সৃঞ্জিনী আর নীলাঞ্জনা একে অপরের সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠে | আকস্মিক ভাবে ঠিক তখনই সেখানে উপস্থিত হয় শিল্পীতা | সে দুই বন্ধুর এমন অস্বস্তিকর অন্তরঙ্গতা দেখে প্রথমে ঘাবড়িয়ে যায় | তারপরে একটা প্রচন্ড ঘেন্নায় কেমন গা টা গুলিয়ে ওঠে তার, সে মুখ চাপা দিয়ে ছুটে যায় বেশিনের দিকে | পিছে পিছে ছোটে সৃঞ্জিনী আর নীলাঞ্জনাও |


শিল্পীতা ওদের দেখেই ঘেন্নায় বলে ওঠে, " একদম আমার কাছে আসবি না তোরা, নাহলে কিন্তু আমি চিৎকার করে লোক জড়ো করবো | "


নীলাঞ্জনা বলল, "শিল্পীতা একটু শান্ত হ, শান্ত হয়ে একটু শোন্ আমাদের কথা | "


শিল্পীতা চিৎকার করে ওঠে, "না, না, কোনো কথা শুনতে চাইনা আমি | তুই এতো নোংরা, আমি তো জানতামই না | আর সৃঞ্জিনী, তোকেও আমার বেস্ট ফ্রেন্ড বলতে লজ্জা লাগছে | তোরা সরে যা, আমি বাড়ি যাবো | "


নীলাঞ্জনা কিছু বলতে চাইছিলো শিল্পীতাকে, কিন্তু সৃঞ্জিনী বলল, "ওকে যেতে দে নীলাঞ্জনা, আটকাস না | ".... তারপরে শিল্পীতার উদ্দেশ্যে বলল, " তুই যেতে চাইছিস যা শিল্পীতা | কিন্তু প্লিজ, আমাদের কথা কাউকে বলিস না যেন | "


সেদিনের পরে আর সৃঞ্জিনী-নীলাঞ্জনার সাথে কোনো সম্পর্ক রাখেনি শিল্পীতা | শিল্পীতার মা জিজ্ঞেস করেছিলেন, "কি রে, মামনি, তোদের মধ্যে কি হয়েছে রে?? তুইও যাস না ওদের বাড়ি, ওরাও আসে না তোর কাছে !! "


শিল্পীতা ছোট্ট করে শুধু বলেছিল, "ঝগড়া হয়েছে |"


সেই দিন, আর আজ..... মাঝখানে সতেরোটা বছর কেটে গেছে | সেদিনের শিল্পীতা আজ পেশায় ডাক্তার | অনেকবছর বাদে আজ দিল্লীর যাবার ফ্লাইটে ঠিক পাশের সিটটাতেই নীলাঞ্জনাকে দেখে বেশ একটু অবাকই হয়ে গেলো শিল্পীতা | সেদিনের সেই কৈশোর পেরোনো নীলাঞ্জনাকে কেউ অতীতে না জেনে থাকলে বলতেই পারবে না, যে ও আসলে একটা মেয়ে | ওর আদল পুরো বদলে গিয়ে পুরুষ হয়ে গিয়েছে |


নীলাঞ্জনাকে চিনেও না চেনার ভান করে জানলার দিকে তাকিয়ে বসে থাকে শিল্পীতা | নীলাঞ্জনাই যেচে কথা তোলে, "তুই আমাকে চিনতে পারছিস না, এটা তো মানতে পারবো না শিল্পীতা | শুধু বলবো, এভাবে না চেনার ভানটা করিস না, বড্ড অস্বস্তি হচ্ছে | সেদিনের ওই একটা ঘটনাকেই মনে গেঁথে রাখলি তুই !! বাকি আমাদের বন্ধুত্বের সবটা ভুলে গেলি ??"


শিল্পীতা এবার মুখ ফেরালো, বলল, "আমার কাছে তো তোর পরিচয়টাই স্পষ্ট নয় | তোকে কি নামে ডাকবো বল তো?? তোর নামের সাথে তোর আচরণের তো কোনো মিল খুঁজে পাই না আমি | না সেদিন পেরেছিলাম, না আজ পারছি | "


নীলাঞ্জনা একটু হাসলো | বলল, "আজ আমি শুধুই নীলাঞ্জন | আমি যে পরিচয়ে নিজেকে চিনতে চেয়েছিলাম, তোর বেস্ট ফ্রেন্ডের নিখাদ ভালোবাসায়, আমি তাই করতে পেরেছি | সাহস করে এগিয়ে এসে আমার হাতটা বোধহয় সৃঞ্জিনী ছাড়া আর কেউই ধরার ক্ষমতা রাখতে পারতো না রে |


তুই তো সব সম্পর্ক চুকিয়ে বুকিয়ে একেবারে চলে গেলি, আমরা মরলাম, নাকি বাঁচলাম তার খোঁজটাও রাখলি না | তবে দেখ, আমরা কিন্তু হেরে যাইনি | আমাদের দিকে ধেয়ে আসা সব বাধাকে অতিক্রম করেছি আমরা |


সেদিন তোর ওভাবে চলে যাওয়া ভয় পাইয়েছিল আমাকে | কিন্তু সৃঞ্জিনী বিশ্বাসের সাথে বলেছিল, "আমি শিল্পীতাকে চিনি | আমার ক্ষতি হোক, এমন কোনো কাজ শিল্পীতা করবে না | "..... তুইও সৃঞ্জিনীর কথাকে সত্যি করে দিলি | আমরা আরও সাবধান হয়ে গেলাম, পাছে আর কেউ যেন আমার মধ্যে লুকিয়ে থাকা আমার পরিচয়টা জানতে না পারে, এই ভেবেই বাইরে চলে গেলাম, ভুবনেশ্বরের একটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে ভর্তি হলাম, সৃঞ্জিনী কেমিস্ট্রিতে অনার্স নিয়ে রয়ে গেলো কলকাতায় | এম. টেক করার পরে দিল্লীর একটা ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে লেকচারার হয়ে যাই,, ইচ্ছে করেই, কারণ আমি জানতাম, কর্পোরেট ওয়ার্ল্ডের মধ্যে ঢুকলে আমার পরিচয় নিয়ে অনেক কথা হতে পারে | আমার সিদ্ধান্তে সঙ্গ দিলো সৃঞ্জিনী | ওও চলে আসলো দিল্লীতে, একসাথে থাকতে শুরু করলাম আমরা | অনেক গুলো বছর বাদে একে অপরকে কাছে পেলাম উজাড় করে | "


নীলাঞ্জনার কথা চুপটি করে শুনে যাচ্ছিলো শিল্পীতা | এবার সে বলল, "এখনও লিভ ইন করিস বুঝি ??"


নীলাঞ্জনা একটু হেসে বলল, "এখন আমি নীলাঞ্জনা নই রে | ওই নামের শেষের আ-কারটাকে উড়িয়ে দিয়েছি | অপারেশন করে মিস্টার বোনে গিয়েছি | "


শিল্পীতা সব শুনে অবাক হোলো | সে ভাবলো, "সত্যিই তো, হোক না সমকামী,, তবুও প্রেম তো !! সেই প্রেমের জন্য কত কাঠ খড়ই না পোড়াতে হয়েছে ওদের |


দিল্লী এয়ারপোর্ট থেকে বেরোবার সময় আজকের নীলাঞ্জন বলল, "একবার সৃঞ্জিনীর সাথে দেখা করবি না তুই ?? তোকে যে ও কি মিস করে,, কি বলবো তোকে !! একবার চল না রে শিল্পীতা, দেখা করে আসবি সৃঞ্জিনীর সাথে | আমার জন্য তোদের বন্ধুত্ব নষ্ট হয়ে গিয়েছিলো, আজ আবার আমার মাধ্যমেই মিল হোক তোদের | "


ক্যাবে বসে সৃঞ্জিনীর বাড়ির পথে যাওয়ার সময় শিল্পীতার মনে হোলো, "নীলাঞ্জনা থেকে নীলাঞ্জন হয়ে ওঠা মানুষটার মধ্যেও কত পৌরুষ !! সেই পৌরুষের নাম ভালোবাসা, সেই পৌরুষের নাম দায়িত্ব, বিশ্বাস, এমনকি নির্ভরতাও | অথচ সেই নির্ভরতাটুকু কিন্তু সৈকত দেখাতে পারেনি | বিশ্বাসের গন্ডী ভেঙে শিল্পীতার আত্মসম্মানকে নিংড়ে সে আরেকজন নার্সের সাথে নোংরা খেলায় মেতে ওঠে | পাঁচ বছরের সংসারে একটি সন্তানও দিতে পারেনি সৈকত | ভালো শিক্ষা, ভালো চাকরি, ভালো সামাজিক সম্মান, সাথে ভালো রোজগারটা দেখলেও শিল্পীতা এড়িয়ে গিয়েছিলো সৈকতের মনুষত্ব আর সততার মাপদন্ডকে, ফলে শিল্পীতার জীবনের সব হিসেব উলোটপালট হয়ে যায় | আজ সে একা | হাসপাতাল, পেশেন্ট নিয়েই তার দিন কাটে | তবে মাস ছয়েক হয়েছে, সে একটি সংস্থার বাচ্চাদের লেখাপড়ার দায়িত্ব নিয়েছে, অবসর সময়ে তাদের সাথেই সময় কাটায় সে | সৈকতের মধ্যে অনেক চেষ্টা করেও পৌরুষ খুঁজে পায়নি শিল্পীতা | সৈকতের পৌরুষ ছিল শুধু বিছানায় | বিছানা থেকে মেঝেতে পা রাখতেই তার সেই পৌরুষ হারিয়ে যেত যেন !! সৈকতের ভালোবাসায় লালসা ছিল, প্রেম ছিল না | প্রেম থাকলে শিল্পীতাকে সে এভাবে ঠকাতে পারতো না | কিন্তু সৃঞ্জিনী আর নীলাঞ্জনা সমকামী হয়েও কত গভীর প্রেমে বাঁধা পড়েছে !! নাহলে সৃঞ্জিনীর জন্য ওরকম একটা অপারেশনেও রাজী হয়ে যেতে পারে নীলাঞ্জনা ?? এতো সহজে নীলাঞ্জনা থেকে নীলাঞ্জন হতে পারে ?? "


এর মধ্যেই কখন ক্যাবটা এসে গন্তব্যস্থল স্পর্শ করলো জানা নেই, হুঁশ ফিরলো নীলাঞ্জনের ডাকে | নীলাঞ্জন বলল, "আয়, নেমে আয় শিল্পীতা | আমরা চলে এসেছি | "


লিফটে ওঠার আগেই সৃঞ্জিনীকে ফোন লাগালো নীলাঞ্জন, "তোমার জন্য আজ একটা সারপ্রাইস গিফ্ট আছে | আমি নিশ্চিত, গিফ্টটা পেলে তুমি আমাকে দুটো চুমু এক্সট্রা দেবে | "


শিল্পীতা ওদের প্রেমের অতিরিক্ততা দেখে এবার আর বিরক্ত হোলো না, বরং মনে মনে হাসলো |


দরজা খুলতেই শিল্পীতা, সৃঞ্জিনী দুজনেই খুব অবাক হোলো | সৃঞ্জিনী হারিয়ে যাওয়া বন্ধুকে তার দরজার দোরগোড়ায় দেখে অবাক , আর শিল্পীতা অবাক সৃঞ্জিনীকে প্রেগনেন্ট দেখে |


শিল্পীতার দুচোখ ধরে শুধুই বিস্ময় !! একটা মানুষ আরেকটা মানুষকে কতখানি ভালোবাসলে এভাবে সেই ভালোবাসার মানুষটার জীবন পরিপূর্ণ করে তোলা যায় | নীলাঞ্জনের দিকে তাকিয়ে শিল্পীতা বলে, "ভগবান, তোকে সৃঞ্জিনীর জন্যই সৃষ্টি করেছিলেন রে বন্ধু | তোদের প্রেম সমকামিতা নয়, যজ্ঞের আগুনে শুদ্ধ হওয়া প্রেম তোদের | তোরা দুজনেই সমান ভাবে উজাড় করেছিস একে অপরের কাছে | তোদের এই সমপ্রেমের কাছে শ্রদ্ধার সঙ্গে মাথা নত করছি রে | "


তারপরে সৃঞ্জিনীকে বলে, "সতেরো বছর আগে যে ঘৃণা নিয়ে ভগবানের কাছে প্রার্থনা করেছিলাম, তোকে আর এই হনুমানটাকে আলাদা করে দিতে, আজ ততটাই প্রার্থনা আমার, তোরা দুটিতে খুব খুব ভালো থাক | তোদের দেখে আরও দশজন ভালোবাসার মর্মার্থ বুঝুক | "


সৃঞ্জিনী শিল্পীতার লাগেজটা কাজের মেয়েটাকে ভিতরে নিয়ে যেতে বলায় শিল্পীতা বলল, "এ কি করছিস রে?? আমার লাগেজ কেন ঘরের ভিতরে নিয়ে যাচ্ছিস?? "


সৃঞ্জিনী বন্ধুর গলা জড়িয়ে ধরে বলল, "কারণ তুই হোটেলে না উঠে আমার কাছে থাকবি বলে | দেখ বন্ধু, আমাদের সমকামী প্রেম আমাদের অতীতের আত্মীয় - পরিজন - বন্ধুবান্ধব সবার কাছ থেকে আলাদা করে দিয়েছে | তুই আমাদের সেই বন্ধু যে অতীতের সম্পর্কের সুতোটাকে ধরে রাখতে পারে | তাই, তোকে আলাদা করে হোটেলে থাকতে দেবো না আমি | এরপর থেকে যখনই দিল্লী আসবি, আমাদের এই ছোট্ট সংসারে উঠবি | বল, উঠবি তো?? "


শিল্পীতা দুই বন্ধুর হাতে হাত রেখে বলে, "ওরে, তোদের এই সংসার শুধু সংসার নয় রে, এই সংসার একটা স্বর্গ, যেখানে প্রেমের দাম বিবেক দিয়ে মেটানো হয় | আমি কথা দিলাম রে, তোদের আগামী দিনগুলোকে খুব কাছ থেকে দেখতে আবার আসবো তোদের কাছে | তোদের দেখলেই তো আর দশজনকে জানাতে পারবো, সমকামিতা নোংরা কিছু নয়, সেখানেও নিটোল প্রেম থাকে, থাকে ভালোবাসা আর বিশ্বাসের নির্ভরতা | "


----------------------------------------------------------


সমাপ্ত



Rate this content
Log in

Similar bengali story from Romance