Sucharita Das

Inspirational

3  

Sucharita Das

Inspirational

সহমর্মী

সহমর্মী

5 mins
11.1K


"ও ঠামি তুমি বাবাকে একটু বোঝাও না, আমি এত তাড়াতাড়ি বিয়ে করতে চাইনা। বিয়ে করব না তো বলছি না। কিন্তু আগে একটা ভালো চাকরি পাব, তারপর বিয়ে করবো আমি। "

 নাতনির কথায় মৃদুলা দেবী বললেন, "কিন্তু দিদিভাই তোর বাবা যা একরোখা, জেদী মানুষ, সে আমার কথা শুনবে তবে তো।"

নাতনি পৃথার আবার আবদার, " ঠামি তুমি পারবে। তুমি বোঝালে বাবা ঠিক বুঝবে। বাবা তো তোমার ছেলে।"

মৃদুলা দেবী মনে মনে ভাবলেন, "তোর বাবা আমার ছেলে একথা ঠিকই দিদিভাই। কিন্তু জানিস তো দিদিভাই, একটা বয়সের পর আর বাবা, মা তার ছেলে মেয়েদেরও শাসন করতে পারে না।" ওদের কথার মাঝেই ঘরে ঢুকলো পৃথার মা সর্বানী। ঠাকুমা , নাতনির কথায় সর্বানী বললো, "আপনার ছেলে তো আমারও কথা শুনবে না মা। যা জেদী মানুষ, বলতেও ভয় হয়। একদিন বলতে গিয়েছিলাম, কিন্তু স্পষ্ট জানিয়ে দিলো, ওর বন্ধুকে কথা দেওয়া আছে, আর এ ব্যাপারে আর কোনো কথা বলতে চায় না ও। মেয়ের বিয়ে ওখানেই হবে, আর বাকি পড়াশোনা ,চাকরি সব বিয়ের পর ই করবে মেয়ে ওখানে গিয়ে।"


মৃদুলা দেবীর মনে পড়ে যায় বহু বছর আগের নিজের জীবনের কথা। ষোলো বছর বয়সে বিয়ে হয়েছিলো ওনার। সেইসময়েও কতো ইচ্ছা ছিলো পড়াশোনা করার। কিন্তু বাড়িতে সে পরিবেশ ছিল না। তাই গল্পের বই দিয়েই সে ইচ্ছা পূরণ করতেন মৃদুলা দেবী। বই পড়া তো একটা নেশার মতো ছিল মৃদুলা দেবীর। গ্ৰামের ডাক্তার দাদুর বাড়িতে কতো রকমের যে বই থাকতো। ডাক্তারদাদুর বাড়িতে গিয়ে সেইসব বই গোগ্ৰাসে গিলতো ষোড়শী মৃদুলা। কতবার বাবাকে বলতে চেয়েছিল ষোড়শী মৃদুলা, "বাবা এখন বিয়ে করবো না। আমি পড়াশোনা করতে চাই"। কিন্তু সেই প্রত্যেকটি কথা অব্যক্তই থেকে গেছে। রাশভারী বাবার সিদ্ধান্তকে সম্মান জানাতে বিয়ে হয়ে যায় ষোড়শী মৃদুলার। বিয়ে হয়ে শ্বশুরবাড়ি আসার পর স্বামীর কাছে একটাই আবদার ছিলো তার, গল্পের বই এনে দিতে হবে তাকে। শাড়ি নয়, গয়নাগাটি নয়, শুধু মাত্র গল্পের বই চাই তার। স্বামী এনেও দিতেন চুপিচুপি। বলতেন, কাউকে দেখিও না শুধু। সত্যি কি যুগে ছিলেন, গল্পের বই পড়তে গেলেও সবার অলক্ষ্যে পড়তে হবে। নইলে যে প্রশ্ন হবে হাজারো।



"ও ঠামি কি এতো ভাবছ বলোতো?" নাতনি পৃথার ডাকে সম্বিত ফিরল ‌মৃদুলা দেবীর। মনে মনে ভাবলেন, নিজের ফেলে আসা সেই যুগ আর তার নাতনির এই যুগের মধ্যে কোথাও যেন একটা যোগসূত্র এখনও রয়ে গেছে। সে যুগেও ষোড়শী মৃদুলা মুখ ফুটে নিজের ইচ্ছার কথা বলতে ভয় পেয়েছিল। আর এ যুগের মেয়ে পৃথাও ভয়ে তার বাবাকে নিজের ইচ্ছার কথা বলতে পারছে না। মৃদুলা দেবী মনে মনে ভাবলেন, মুখে যতই মেয়েরা আজকের যুগে অনেক এগিয়ে গেছে , এটা বলা হোক না কেন, কার্যক্ষেত্রে কি সত্যিই সেটা হয়েছে? যদি হতো তাহলে আজকের যুগে দাঁড়িয়েও তার নাতনি পৃথা তার বাবাকে বলতে পারছে না কেন, যে ,"বাবা আমি আগে পড়াশোনা করে নিজের পায়ে দাঁড়াবো, ভালো চাকরি করবো, তারপর তুমি আমার বিয়ে দিও।" মৃদুলা দেবী মনে মনে ভাবলেন,আমাদের এই সমাজ কি তাহলে এখনও পুরুষ শাসিত সমাজ ই রয়ে গেছে আগের মতই?

নারী স্বাধীনতা শুধুমাত্র কথার কথা? কে জানে এই প্রশ্নের উত্তর আসলে কি হবে।



পৃথার আজ পাকা দেখা হলো। বিয়ের আর মাত্র দুমাস বাকি। পৃথার বাবা তাঁর বন্ধুর একমাত্র ছেলের সঙ্গে পৃথার বিয়ের সমস্ত আয়োজন করে ফেলেছেন। মৃদুলা দেবী নীরবে শুধুই দেখে যাচ্ছেন সবকিছু। নিজের বিয়ের আগের অসহায়তা, আজ নাতনির মধ্যে প্রত্যক্ষ করছেন তিনি। কিন্তু ছেলের অসম্ভব জেদের কাছে তাঁর ভূমিকা এখানে নেহাতই নীরব দর্শক মাত্র। পাকা দেখার অনুষ্ঠানে পৃথাকে খুব সুন্দর লাগছিলো দেখতে। কিন্তু মৃদুলা দেবী লক্ষ্য করেছিলেন, নাতনির চেহারার উদাসীন ভাব। পৃথাকে কয়েকটি অল্পবয়সী মেয়ে তার দাদার নাম্বার দিয়ে গেল। মৃদুলা দেবী লক্ষ্য করেছেন, পৃথা সেটাও অনিচ্ছাকৃত ভাবেই নিজের ফোনে সেভ করেছে। রাত্রিবেলা নাতনি তাঁর কাছেই শোয়। মৃদুলাদেবী দেখলেন, পৃথার চোখে জল। সেদিনের ষোড়শী মৃদুলা আর আজকের পৃথা যেন মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে তাঁর চোখের সামনে। হঠাৎই বিছানা থেকে উঠে নাতনিকে বললেন, "দিদিভাই তোর বরের নাম্বারটা দে তো আমাকে।" পৃথা অভিমানে ঠোঁট ফুলিয়ে বললো,"ঠামি শেষে তুমিও ওদের দলে মিলে গেলে। ঠিক আছে এই নাও।" রাগে ঠামিকে নাম্বারটা দিয়ে মেয়ে পিছন ঘুরে শুয়ে পড়লো। পৃথার দেওয়া নাম্বারটা নিজের ফোন নাম্বারের ডায়েরিতে লিখে রেখে দিলেন মৃদুলা দেবী। 




এর দু'দিন পর-----

পৃথার বাবা সন্ধ্যেবেলা অফিস থেকে ফিরেছে। ঔহঠাৎই কলিং বেলের আওয়াজ। দরজা খুলে দিল পৃথা ই। সামনে দাঁড়িয়ে আছে পৃথার হবু শ্বশুর, শাশুড়ি আর অভিমন্যু মানে পৃথার হবু বর। ওদের এই সময়ে দেখে সবাই অবাক হলেও একজন কিন্তু মোটেও অবাক হননি। পৃথার বাবা তাঁর বন্ধুকে ও তার পরিবারকে বসিয়ে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। মুখের উপর কিছু জিজ্ঞেস করতেও পারছেন না। সকলের কৌতুহলের অবসান অভিমন্যুই করলো। সে বললো," আমাদের এই বিয়ে ,যেদিন বিয়ের দিন ঠিক হয়েছে, সেই দিনেই হবে, কিন্তু শুধু মাত্র রেজিস্ট্রি করে। আনুষ্ঠানিকভাবে বিয়ে আমাদের সেদিনই হবে, যেদিন পৃথা নিজের জীবনে প্রতিষ্ঠিত হবে। কারণ আজকের দিনে একটা মেয়েরও নিজের জীবনে প্রতিষ্ঠিত হওয়া ভীষণভাবে দরকারি। আমাদের দুজনের ভবিষ্যতের স্বার্থে তোমরাও আমাদের এই সিদ্ধান্তে রাজী হয়ে যাও। অবশ্য পৃথার যদি রেজিস্ট্রি বিয়েতেও আপত্তি থাকে, তাহলে সেটাও পরেই হবে।" ঘরে উপস্থিত পৃথার বাবা, মা একে অপরের মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। কি এমন হয়ে গেল যে এই দুদিনেই এরকম সিদ্ধান্ত পাল্টে গেল। পৃথা কিন্তু একটু হলেও বুঝতে পারছিল যে, এই ঘটনার পিছনে কে আছে। সেই জন্যই ঠামি সেদিন অভিমন্যুর নাম্বার নিয়েছিল তার থেকে। পৃথার বাবা ঘটনার আকস্মিকতায় হতভম্ব। ঠিক তখনই অভিমন্যুর বাবা, পৃথার বাবাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, "আমরা এ যুগের মানুষ হয়ে যেটা বুঝতে পারিনি, মাসিমা(মৃদুলা দেবী) আমাদের সেটা বুঝিয়ে দিয়েছেন ভালো করে। বিয়ে, সংসার এ সবের থেকেও যে , আজকের যুগে একটা মেয়ের জীবনে সুপ্রতিষ্ঠিত হবার ইচ্ছেটাকে মর্যাদা দেওয়া উচিত , সেই শিক্ষা মাসিমা আমাদের দিয়েছেন। সেদিন উনি অভিমন্যুর নাম্বারে ফোন করে, পৃথার ইচ্ছার কথা জানান,একটা মেয়ে হিসাবে তার অসহায়তার কথা জানান। একটা অনিচ্ছাকৃত বিয়ের বন্ধন যে এখন সে চায় না ,এ বিষয়ে জানান। অভিমন্যু এরপর সমস্ত ঘটনা আমাদের বলে। আর তাই আমাদেরও এটাই ইচ্ছা, পৃথা তার নিজের জীবনে প্রতিষ্ঠিত হয়ে, আমার পুত্রবধূ রূপে আমার ঘরে আসুক।" পৃথার বাবা আর কোনো আপত্তি করে না এ ব্যাপারে। মৃদুলা দেবী সে রাতে সবাইকে রাতের খাবার খাইয়ে তারপর ছেড়েছিলেন।



রাত্রিবেলা ঘরে ঢুকে পৃথা আনন্দে ওর ঠামি কে জড়িয়ে ধরে বললো,"ঠামি য়ু আর গ্ৰেট"! মৃদুলা দেবী নাতনিকে আদর করে মাথায় হাত বুলিয়ে বললেন, "এবার শুয়ে পর।"তারপর নিজের মনে ভাবলেন, সেদিনের ষোড়শী মৃদুলার পাশে কেউ তার সহমর্মী হয়ে দাঁড়ায় নি। কিন্তু আজকের পৃথার পাশে তার ঠামি তার সহমর্মী হয়ে দাঁড়িয়েছে। সেদিনের ষোড়শী মৃদুলার হয়ে যে সত্যিটা তিনি সেদিন বলতে পারেননি , আজ পৃথার ঠামি হয়ে সেই সত্যিটা বলতে পেরে কিছুটা হলেও নিজেকে হালকা বোধ করছেন মৃদুলা দেবী।








 


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Inspirational