Banabithi Patra

Drama

3  

Banabithi Patra

Drama

শখ ও স্বপ্নপূরণ

শখ ও স্বপ্নপূরণ

4 mins
1.6K


সুগার লেভেলটা বাড়ার পর থেকে রাতে দু-তিনবার বাথরুমে উঠতে হয় অনিন্দ্যকে। কয়েকদিন হলো ভীষণ গরম পড়েছে। ফ্রিজ থেকে জলের বোতলটা বের করে গলায় ঢালতে ঢালতে খেয়াল করলো, গুড্ডুর ঘরের দরজার নিচে থেকে আলোর রেখা আসছে। আলো জ্বলছে ঘরে এখনও। দেওয়াল ঘড়িটায় অন্ধকারে সময় দেখা যাচ্ছে না। সময় না দেখেও আন্দাজ করে নেয় দুটো-আড়াইটা তো বাজবেই। তারমানে আলো না নিভিয়েই ঘুমিয়ে পড়েছেন লাটসাহেব। সামনেই উচ্চমাধ্যমিক, অথচ এখনও পড়াশুনোতে এতটুকু সিরিয়াস হতে পারলো না। খেলা-খেলা আর খেলা। এই খেলাটাকে গুড্ডুর জীবন থেকে সরাতে না পারলে, জীবনে কোনদিন উন্নতি করতে পারবে না। খেলা খেলা করেই নিজের কেরিয়ারটার সর্বনাশ করেছে অনিন্দ্য। তার বন্ধুরা আজ যখন সমাজে প্রতিষ্ঠিত, সে তখন এক বেসরকারী অফিসের পাতি কেরানী। মাসের শেষে সংসারে টানাটানি আর রাশি রাশি অপূর্ণ স্বপ্ন ছাড়া খেলা আর কিচ্ছু দেয়নি অনিন্দ্যকে। তাই খেলার কালো ছায়া নিজের ছেলের জীবনে পড়ুক কোনদিন চায়নি অনিন্দ্য। যদিও ছেলেটা ফুটবলটা বেশ ভালো খেলে। কিন্তু সেই খেলাকে প্রশ্রয় দিয়ে কেরিয়ারের ক্ষতি সে কিছুতেই হতে দেবে না। একবার জয়েন্টে ডাক্তারিতে চান্স পেলে জীবনটা গড়ে যাবে ছেলেটার। যত কষ্টই হোক, যেভাবে হোক টাকা জোগাড় করে পড়াবে গুড্ডুকে। কিন্তু তার জন্য চান্সটা তো আগে পেতে হবে। অত সোজা নয়, দিনরাত এক করে পড়তে হয়। মল্লিকাটাও হয়েছে তেমনি। ছেলেকে এতটুকু শাসন করবে না কোনসময়। আলো জ্বালিয়ে ঘুমানোর জন্য আজ বেশ ভালো মতো বকুনি দেবে ভেবে গুড্ডুর ঘরের দিকে পা বাড়ায় অনিন্দ্য। দরজা ভেজানো থাকে, ভিতর থেকে খিল দেওয়ায় মল্লিকার বারণ আছে। দরজাটা আলতো করে ফাঁক করে তো অবাক অনিন্দ্য। গুড্ডু ঘুমায়নি পড়ছে। মন দিয়ে কিছু লিখছে। অনিন্দ্যকে খেয়ালুও করে না গুড্ডু। অনিন্দ্য দরজাটা আবার ভেজিয়ে দিয়ে ফিরে আসে। মনে মনে একটু খুশিই হয় ছেলের ওপর। ফিরে গিয়ে বিছানায় শুলেও আর কিছুতেই ঘুম আসে না অনিন্দ্যর। অফিসের পর একটা কোন পার্টটাইম জবের চেষ্টা করতে হবে। একটু পরিশ্রম হলেও দুটো পয়সা তো ঘরে আসবে। ছেলেটা যতদিন না নিজের পায়ে দাঁড়াচ্ছে, ততদিন পরিশ্রম চালিয়ে যেতে হবে। তখন না হয় যতখুশি বিশ্রাম নেবে। এটা সেটা চিন্তা করতে করতেই রাত ভোর হয়ে যায়।


ভোরের দিকে একটু চোখ এঁটে এসেছিল ঘুমে, মল্লিকাও আর ডেকে দেয়নি। উঠে কোনরকমে চাটুকু খেয়েই বাজারে ছোটে অনিন্দ্য। অন্যদিন গুড্ডুকে ঘুম থেকে ওঠার জন্য ডাকাডাকি করে। কাল অনেক রাত অবধি পড়েছে বলে আজ আর না ডেকেই বাজার বেরিয়ে যাচ্ছিল অনিন্দ্য। গেটের মুখেই গুড্ডুর সাথে দেখা। ফুটবল হাতে মাঠ থেকে ফিরছে। এ ছেলের জীবনে যে আর কিছু হবে না পরিষ্কার বুঝে যায় অনিন্দ্য। সেদিনের অশান্তির পর আর পড়াশুনো নিয়ে কোন কথাই বলে না গুড্ডুকে। মল্লিকার সাথেও যেটুকু প্রয়োজন সেটুকু কথাবার্তা হয়। অনিন্দ্য বুঝে গেছে, এ সংসারে কাউকে কিছু বলা বৃথা। যে যার নিজের মর্জি মতোই চলবে। স্ত্রী-সন্তানের ওপর থেকে নিজের সব প্রত্যাশাটাকে মন থেকে মুছে ফেলেছে অনিন্দ্য।

আজ গুড্ডুর উচ্চমাধ্যমিকের রেজাল্ট। কিছু না বললেও গতকাল রাত থেকেই মনে মনে যথেষ্ট উদ্বিগ্ন অনিন্দ্য। মল্লিকার চোখেমুখেও চিন্তার ছাপ। অথচ পরিক্ষার্থী নিজে কি নির্বিকার। টেনশন করার জন্য যেন বাপ-মাকে নিযুক্ত করা আছে। বাপ-মাকে পেন্নাম ঠুকে দিব্যি বন্ধুদের সাথে বেরিয়ে পড়েছে সাত সকালে। নিশ্চয় ইস্কুলেই যাচ্ছে। সাত তাড়াতাড়ি ইস্কুল গেলে কি আর চাট্টি নম্বর বেশি দেবে পর্ষদ। বুদ্ধি ছিল ছেলেটার। খেলার ভূত মাথা থেকে নামাতে পারলে, আজ পাঁচজনকে গলা উচুঁ করে বলার মতো রেজাল্ট করতে পারত। নিজের অজান্তেই একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে অনিন্দ্যর গলা থেকে।


স্কুল থেকে হেড মাস্টারমশায়ের ফোন আসে একটু বেলার দিকে। উষ্ণীষ চক্রবর্তী এবার স্কুলের মধ্যে হায়েস্ট নম্বর পেয়েছে। কিন্তু উষ্ণীষ এখনও রেজাল্ট নিতে যায়নি বলে বাড়িতে ফোন করেছেন উনি।

ছেলের রেজাল্টের আনন্দের থেকে ছেলেটার জন্য দুশ্চিন্তায় কাঁদতে থাকে মল্লিকা। কিন্তু মল্লিকাকে ধমক দিলেও দুশ্চিন্তা তো নিজেরও হচ্ছে। আজ নিজের অক্ষমতাটাই যেন বেশি করে কষ্ট দিচ্ছে অনিন্দ্যকে। ছেলেটাকে একটা মোবাইল কিনে দিতে পারলে, এতটা চিন্তা হতো না। একটা খোঁজ তো অন্তত পেত। অনিন্দ্য স্কুল থেকে রেজাল্ট নিয়ে আসে।

গুড্ডু বাড়ি আসে দুপুর গড়িয়ে প্রায় বিকাল। গুড্ডুর মাথায় ব্যাণ্ডেজ। কয়েকজন বন্ধু সাথে করে এসে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে যায়। থ্যালাসেমিয়ার শিশুদের সাহায্যার্থে একটা চ্যারিটি ফুটবল ম্যাচ ছিল। সেখানে খেলতে গিয়েই দুর্ঘটনাটা ঘটেছে।

-এইজন্যই বাবা বলে খেলাটা ছাড়তে। কিন্তু সে কথা কানে তুললে তো! রেজাল্ট বেরিয়েছে, কোথায় আনন্দ করবে তা নয় উনি খেলতে গিয়ে মাথা ফাটিয়ে বাড়ি ফিরলেন। যদি বড়ো কোন বিপদ হয়ে যেত! আর কোনদিন যদি ঐ খেলার মাঠের দিকে যেতে দেখেছি, ঠ্যাং খোঁড়া করে ঘরে ফেলে রেখে দেব।

মল্লিকা আজ প্রথমবার ছেলেকে খেলার জন্য শাসন করে। মায়ের বকুনির হাত থেকে অনিন্দ্যই বাঁচায় গুড্ডুকে।

-ছেলেটাকে আজ অন্তত বোকো না মল্লিকা। একটা ভালো উদ্দ্যেশ্যেই তো খেলতে গিয়েছিল ছেলেটা। আর এতদিন আমিই ভুল ছিলাম। খেললে পড়াশুনোর ক্ষতি হয়না। গুড্ডু তো ভালো রেজাল্ট করে সেটা প্রমাণ করে দিয়েছে। আসলে দুটোকে ব্যালেন্স করে চলতে জানতে যায়।

গুড্ডুকে বুকে জড়িয়ে ধরে অনেন্দ্য। আজ ছেলেটার জন্য জীবনে প্রথমবার ভীষণ গর্ব হচ্ছে তার।


Rate this content
Log in

Similar bengali story from Drama